মরা গাধার কান অথবা পুতিনের ‘সুবচন’

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি
লিখেছেন সংসারে এক সন্ন্যাসী (তারিখ: শনি, ২২/১২/২০০৭ - ৪:৫৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

autoটাইম ম্যাগাজিনের 'ম্যান অফ দ্য ইয়ার' আখ্যা পাবার পর পুতিনকে নিয়ে আলোচনা চলছে ব্যাপক। আমিই বা পিছিয়ে থাকি কেন! বছর দেড়েক আগে 'সাপ্তাহিক ২০০০'-এ প্রকাশিত আমার একটা লেখা সচলায়তনে ছেড়ে দেয়ার মওকা পেয়ে গেলাম।

টাটকা এক রুশ কৌতুক দিয়েই শুরু করি। তুমুল হাসির তা নয়, তবে অর্থবহ।

- খুশির খবরটা শুনেছেন? পুতিনকে টাইম ম্যাগাজিন 'ম্যান অফ দ্য ইয়ার' নির্বাচিত করেছে।
- খুশি হবার কিছুই নেই। কয়েক বছর আগে বিন লাদেনও হয়েছিল 'ম্যান অফ দ্য ইয়ার'!

_____________

মরা গাধার কান অথবা পুতিনের ‘সুবচন’

আমার জিভ - আমার শত্রু।
- রুশ প্রবাদ

ম্যান অফ দ্য ইয়ার

ইয়েলৎসিনের পর তাঁর ক্ষমতায় আরোহণকে তখন অনেকেই ইতিবাচক বলে মনে করেছিলেন। খামখেয়ালি, অনির্দিষ্ট, অ্যালকোহলাসক্ত এবং প্রায়শই অসুস্থ ইয়েলৎসিনের পাশে তাঁকে মনে হয়েছিল অনেক বেশি স্মার্ট, কর্মঠ, তৎপর। কথা বলেন শ্রোতার চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে। কথাবার্তায় ইয়েলৎসিনের মতো আড়ষ্টতা নেই, নেই জড়তা। ভাবা হয়েছিল, রাশিয়ার শিশু-গণতন্ত্র দ্রুত পরিণত হতে শুরু করবে তাঁর শাসনামলে। কিন্তু কেজিবি-র প্রাক্তন অফিসার পুতিন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের মূল্য কতোটা দেবেন, তা নিয়ে তখন সংশয় প্রকাশ করেছিলেন অনেকেই। তাঁদের আশঙ্কাই সত্য প্রমাণিত হয়েছে শেষমেষ।

হালে দেখা যাচ্ছে, রুশ জনগণ গণতন্ত্র যেটুকু উপভোগ করতে পেরেছে, তা ওই ইয়েলৎসিনের শাসনামলেই। পুতিন রাশিয়াকে নিয়ে চলেছেন একনায়কতন্ত্রের পথে। রাশিয়ায় নামমাত্র বিরোধী দলগুলোর অধিকাংশই এখন পুতিনের তল্পিবাহক, গণতান্ত্রিক দলগুলোর মাথা তুলে দাঁড়ানোর অবস্থা নেই, ভিন্ন মতাবলম্বী সমস্ত টিভি চ্যানেল হয় বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, নয় নিয়ে আসা হয়েছে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের আওতায়, সব প্রভাবশালী পত্রিকাকে একে একে বানিয়ে ফেলা হয়েছে সরকারের মুখপত্র। লোক দেখানোর জন্য রেখে দেয়া হয়েছে ভিন্নমত প্রকাশের শেষ অবলম্বন ‘কমেরসান্ত’ নামের স্বল্প-প্রচারিত দৈনিক আর রেডিও স্টেশন ‘এখো মস্ক্ভি’।

গত ২৩ জুন পার্লামেন্টারি অ্যাসেম্বলি অফ দ্য কাউন্সিল অফ ইয়োরোপ (PACE) রাশিয়াকে ‘অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র’ ঘোষণা করেছে। তাৎক্ষণিকভাবে রাশিয়া এর প্রতিবাদ জানালেও বিশ্বে রাশিয়ার বর্তমান ইমেজের জন্য দায়ী যে পুতিন ও তাঁর একনায়কতান্ত্রিক রাজনীতি, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।

পুতিনের রাজনীতির পর্যালোচনা করা বর্তমান লেখাটির লক্ষ্য নয়। এতে কেবল উল্লেখ করা হয়েছে তাঁর কিছু ‘বাণী’। বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁকে সঙ্গত কারণেই কথা বলতে হয় ডিপ্লোম্যাসির সুশ্রাব্য মোড়কে মুড়িয়ে। কিন্তু প্রায়ই তিনি নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন, এবং ডিপ্লোম্যাসির ধার না ধেরে হয়ে ওঠেন সত্যিকারের পুতিন। খসে পড়ে ভদ্রতার মুখোশ। নগ্ন হয়ে পড়ে তাঁর অন্তর্জগৎ: উদ্ধত, যুদ্ধংদেহী, অ্যাগ্রেসিভ, অসহিষ্ণু। ফলে তাঁর নৈতিকতা আর সংস্কৃতির মান নিয়ে প্রশ্ন জাগে স্বভাবতই।

পুতিনের ‘বাণীসমগ্র’ থেকে নির্বাচিত টপ টেন:

২০০২ সালে বেলজিয়ামে এক সাংবাদিক সম্মেলনে ফরাসী সাংবাদিকের চেচনিয়া বিষয়ক এক প্রশ্নের জবাবে:

 আপনি যদি সত্যিই ইসলামী মৌলবাদী হতে চান এবং এর জন্যে যদি খতনা দেয়ার প্রয়োজন পড়ে, তো আমি আপনাকে মস্কোয় আসার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। রাশিয়া বহুধর্মের দেশ এবং এই ‘সমস্যা’ সমাধানের জন্য অনেক বিশেষজ্ঞ আমাদের আছে। আমি তাদের এই ‘অপারেশনটি’ এমনভাবে করার পরামর্শ দেবো, যাতে আপনার ওই জায়গায় আর অন্যকিছু না গজায়।

রুশ ফেডারেশনের পীতালোভ্স্কি অঞ্চল বিষয়ে লাতভিয়ার দাবি (কুরিল দ্বীপপুঞ্জ বিষয়ে জাপানের যেমন) প্রসঙ্গে:

পীতালোভ্স্কি অঞ্চল নয়, তারা পাবে মরা গাধার কান।

সাবমেরিন ‘র্কুস্ক’ ট্র্যাজেডির রহস্য জানতে চেয়ে সিএনএন-এর ল্যারি কিং-এর করা প্রশ্নে (‘হোয়াট হ্যাপেন্ড টু র্কুস্ক?’) পুতিনের স্মিতহাস্য উত্তর:

 ডুবে গেছে।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট শিরাক সম্পর্কে:

 তিনি আমাকে একটা বই উপহার দিয়েছেন। আমিও তাঁকে দিয়েছি একটা। ক্রেমলিন বিষয়ে। ক্রেমলিন কোথায়, তা ফ্রান্সকে ভুললে চলবে না। জেনে রাখুক, এই নামে একটা জায়গা আছে পৃথিবীতে।

সিআইএস-এর রাষ্ট্রপ্রধানদের সভায়:

 আমাদের সবকিছু ওদের (ইউরোপিয়ান কাউন্সিল। - অনুবাদক) মতো হয় না কেন? কারণ আমরা, কথাটা বলার জন্য দুঃখিত, বসে বসে শিকনির জাবর কাটি।

চেচনিয়ার গেরিলা যোদ্ধাদের প্রসঙ্গে:

 ওরা তো খরগোশের মতো পালিয়ে বেড়ায়।

নরওয়েতে সাংবাদিক সম্মেলনে:

 আমি বলতে চাই না যে, আপনাদের মতামতের কোনও মূল্য আমরা দেই না এবং কোনও অঙ্গেও ঠেকাই না। না, উপদেশে আমরা কান দেবো। সৎ উপদেশে।

রাষ্ট্র আর ধনকুবেরদের পারস্পরিক সম্পর্ক প্রসঙ্গে:

 আমি বলতে চাই না যে, রাষ্ট্র আর ধনকুবেররা চিরন্তন শত্রু। আমার ব্যক্তিগত মতামত, রাষ্ট্রের হাতে আছে ডাণ্ডা, যা দিয়ে আঘাত করা হয় একবার। এবং তা মাথায়। আমরা ডাণ্ডাটি কেবল হাতে নিয়েছি, দেখা গেল, মনযোগ আকর্ষণের জন্যে এটাই ছিলো যথেষ্ট। আর আমরা যদি সত্যি সত্যি ক্ষেপে উঠি, তাহলে ডাণ্ডার যথাযথ ব্যবহার করা হবে।

চেচনিয়ার বিদ্রোহীদের প্রসঙ্গে:

 আমরা তাদের খুঁজে বেড়াবো সব জায়গায়। যদি টয়লেটে তাদের ধরতে পারি, তো ওই পায়খানাতেই তাদের বারোটা বাজানো হবে।

ইতালীয় এক পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে:

 আইন মেনে চলা দরকার সব সময়। বিশেষ অঙ্গ চেপে ধরার পরেই নয় শুধু।

২২.০৭.২০০৫
কিয়েভ, ইউক্রেন।

________

পুনশ্চ: আজ একটা কৌতূহলোদ্দীপক লেখা পেলাম পুতিন প্রসঙ্গে।


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

পড়লাম। আসলেই জিহ্বা মানুষকে অনেকভাবেই উপস্থাপন করতে পারে।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

"জিভের আমি, জিভের তুমি, জিভ দিয়ে যায় চেনা..." হাসি

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

পড়লাম। আমার কেন যেন মনে হয়, এই ঘাউরা পুতিনকে দরকারও ছিল। দুর্বল রাশিয়া আজো থাকলে আমেরিকার ধামকি অগ্রাহ্য করার মত কেউ থাকতো না।

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

আমেরিকার দারোগাগিরি আমারও পছন্দ নয়। আবার একইভাবে পুতিনের কীর্তিকলাপ (বিশেষ করে রাশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতি আচরণের ক্ষেত্রে) আমার রীতিমতো অসভ্য মনে হয়। আর তাছাড়া বর্তমান পৃথিবীতে কোনও সভ্য রাষ্ট্রনায়ক, যতো শক্তিশালী দেশের রাষ্ট্রনায়কই তিনি হোন না কেন, এমন ভাষায় কথা বলার অধিকার রাখেন না।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

পুতিনকে দেখে স্টালিনের কথা মনে হয়। একই ডিলেমা। এক দিকে দুর্ধর্ষ একনায়ক, অন্যদিকে আধিপত্যবাদ।

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

আরও কয়েকটা ছিলো, তবে সেসব অনুবাদ-অযোগ্য অর্থাৎকিছু রুশ শব্দের দ্ব্যর্থবোধ অনুবাদে হারিয়ে যাবে।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

শেখ জলিল এর ছবি

পুতিন সম্পর্কে বেশ জানা হলো। ধন্যবাদ।

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

ভাবছি, পুতিনের রাশিয়া বিষয়ক আমার আরেকটি ছোট্ট পুরনো লেখা ছাড়বো সচলায়তনে।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।