কুঁড়েঘরের গল্প

রংতুলি এর ছবি
লিখেছেন রংতুলি [অতিথি] (তারিখ: সোম, ১৬/০৪/২০১৮ - ৯:০৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ছেলের বয়স আসছে জুনে ১২ হবে। গিয়েছিলো একঝাঁক উচ্ছল সমবয়সীদের সাথে স্কুল ক্যাম্পিং-এ। তিনদিনে ওরা শিখেছে কিভাবে চেনা গণ্ডীর আরাম-আয়েশ ছেড়ে জীবনেকে জানতে হয়। যে বাসে করে ওদের ক্যাম্পিং-এ নিয়ে যাওয়া হয় সে পর্যন্ত গিয়েছিলাম ওকে এগিয়ে দিতে, ছেলেমেয়েরা লাইন ধরে যারযার বাক্স-পেট্রা, বিছানা-বালিশ লাগেজ স্টোরেজে দিয়ে মা-বাবাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বাসে নিজের সিটে গিয়ে বসল, ব্যস! এরপর এই তিনদিন ওদের সাথে যোগাযোগ থাকলো না কারো। আমাদের মেনে নিতে হবে সোনা-যাদুটি আর ছোট নেই। ওরা খাবে কখন, বিছানা পাতবে কোথায়, বাথরুম করবে কখন এসব চিন্তা এখন ওদের নিজেদের। তারপরেও আমার মতো বাঙালি আত্মার মায়ের প্রতিরাতে চোখের নিচে কালি গাঢ় হলে, দুশ্চিন্তায় বয়স বাড়তে থাকলে তা দিয়ে উপকার হবে না ওদের কিছু। তিনদিন তিনযুগ হয়ে একদিন ফুরালো, আমার ঘরে ফিরলো রোদে-বাতাসে পোড়া, উষ্কখুষ্ক চেহারার এক কাকতাড়ুয়া। তবে আমার কাকতাড়ুয়াটির চেহারার দিকে আমি যাব না। বরং ও সাথে করে যাদুর পুটুলি ভরে কি কি বিস্ময় আনলো তাই বলি - ওর ঘাড়ে ক্যাম্পিং-এর জিনিসপাতি ঠাসা বিশাল ঝোলাটার চেয়ে প্রায় বারো বছর জীবনে অভিজ্ঞতার ঝোলার ওজন ছিল কয়েক গুণ। পেটে দানাপানি হয়তো ছিলো না তেমন, কিন্তু পেট ভরা কথা ছিলো, যার সবটা মাকে বলার জন্য ও তড়পাচ্ছিল। তিনদিনে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে ওরা জংগলে তাঁবু টেনে থেকেছে, স্লিপিং ব্যাগে ঘুমিয়েছে, কাদা-পানিতে দাপাদাপি করেছে, পাথুরে পাহাড় ডিঙিয়েছে। তিন রকম ট্রেকিং, হাইকিং আর ক্লাইম্বিং এর কথা শুনে আমার চোখ গোল আর মুখ হাঁ হয়ে থেমে ছিলো কয়েক সেকেন্ড। ওদের বড় চ্যালেঞ্জ ছিলো দু'টো 'face your fears', এবং 'beat your fears'। প্রতিকূলতায় টিকে থাকার শিক্ষা স্কুল শিক্ষারই অংশ। আর সে শিক্ষার বাড়তি অংশ হিসেবে ক্যাম্পিং থেকে সে বাড়ি নিয়ে এল - Wattle and Daub Hut নামে এক কুঁড়েঘর প্রজেক্ট। প্রজেক্টটা ছেলেমেয়েদের নিজের হলেও এতে অভিভাবক, ভাইবোন, পরিবাদের অন্য সদস্যদের অংশগ্রহণ বৈধ এবং যুক্তিযুক্ত।

কেন কুঁড়েঘর?

বেঁচে থাকার জন্য খাদ্যের পরে প্রয়োজন আশ্রয়। 'সুইস ফ্যামিলি রবিনসন'এর কথা মনে আছে নিশ্চয়। গল্পের যে পরিবারটি ঝড়ের রাতে জলদস্যুদের তাড়া খেয়ে আশ্রয় নেয় এক বিছিন্ন দ্বীপে। ধীরে ধীরে সেই জনমানবশূন্য, বৈরী দ্বীপটিকেই তারা চমৎকার আবাস বানিয়ে ফেলে। জীবনের প্রয়োজনীয় উপকরণ কিছু তারা নিতে পেরেছিলো জাহাজ থেকে, বাকীটা অন্বেষণ করে নিয়েছিলো প্রকৃতি থেকে। একসময় জলদস্যুদের পরাস্ত করে, সভ্য সমাজে ফিরে যাওয়ার সম্ভবনাকে নাকচ করে পরিবারটি সেখানেই স্থিতু হয় চিরতরে। ধরা যাক রবিনসন পরিবারের মতো আমরাও কখনো আটকা পড়লাম, হারিয়ে গেলাম গহীন অরণ্য বা বিছিন্ন দ্বীপে। মনুষ্য তৈরি সভ্য সমাজের সকল উপকরণ যেখানে অনুপস্থিত। সেখানে টিকে থাকার জন্য যে আশ্রয়ের প্রয়োজন হবে সেটা বানাতে হবে নিজেকেই, চারপাশে যা আছে তা দিয়েই। প্রকৃতির বুকে আশ্রয়, তৈরিও সম্পূর্ণ প্রকৃতি থেকে এবং যা প্রকৃতিরই প্রতিকূলতার বিরুদ্ধেই সুরক্ষা দিবে মাথার উপরে ছাদ হয়ে। তা কুঁড়েঘরই হোক না কেন।

কুঁড়েঘরের উপাদান

যেহেতু ধরে নিয়েছি রবিনসন পরিবারের মতো আমরাও এই মুহূর্তে মানুষ ও সভ্য সমাজ থেকে বিছিন্ন তাই সুপার মার্কেটে কিনতে পাওয়া যায় এমন কোন উপাদান আমাদের কুঁড়েঘরে ব্যবহার হবে না, এটাতো বোঝাই যায়। Wattle and Daub Hut প্রজেক্টের নিয়মাবলী সাপেক্ষে আমাদের কুড়েঘরটিতে কি কি উপকরণ ব্যবহার হবে, আর কি কি ব্যবহার হবে না নিচে তার একটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করছি সংক্ষেপে।

কৃত্রিম যা কিছু সব 'না'। যেমন -

১। কৃত্রিম আঠা, স্কচটেপ
২। সুতো, তার, দড়ি
৩। নাট-বল্টু, স্ক্রু
৪। ইট, সিমেন্ট, রড-সুরকী, ট্রাকটর, ক্রেইন, ডেভপলপার, রাজমিস্ত্রী... ইত্যাদি 'না'।

প্রাকৃতিক যা কিছু সব 'হ্যাঁ'। যেমন -

১। কাদা, মাটি, পাথর
২। গাছের আঠা, শস্য থেকে তৈরি আঠা
৩। গরু বা অন্য প্রাণীর গোবর
৪। গাছের ডাল-পালা, ছাল-বাকর, লতা-পাতা, খড়কুটো... হাত-পা-মাথা, টিকে থাকার আদিম প্রবৃত্তি ইত্যাদি 'হ্যাঁ'।

তবে কার্ডবোর্ড, পিজবোর্ড ইত্যাদি কুঁড়েঘরের বেইস হিসেবে ব্যবহার করা যাবে, কেবলমাত্র বেইস হিসেবে।

কুঁড়েঘরের ধরণ

আমাদের কুঁড়েঘরটি হতে হবে সত্যিকার কুঁড়েঘরের ক্ষুদে সংস্করণ। সরল ও আদি উপায়ে তৈরি এ কুঁড়েঘরটি কেবল মাথার উপর কাল্পনিক আশ্রয়ই দিবে না, বরং প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে টিকে থাকার তিনটি বাস্তব পরীক্ষায় সফল হতে হবে। যেমন -

১। ঝড় হাওয়া
২। বৃষ্টি
৩। এবং তাপমাত্রা

আমাদের কুঁড়েঘর

কুঁড়েঘর প্রজেক্টের সময়সীমা ছিলো ৪ সপ্তাহ। ছেলে কাগজে কলমে পরিকল্পনা এঁকে বসে আছে কবে থেকে। নানান গড়িমসির কারণে কাঁচামাল সংগ্রহের কাজটি বেঁধে ছিলো। দিন গড়াতে গড়াতে ডেড লাইনের আগের সপ্তাহন্তে 'আর নয়' করে আদাজল খেয়ে লেগে পড়লাম, সবাই মিলে। পাশের পার্ক থেকে জোগাড় হলো - গাছের ছাল, ছোট ডাল, নুড়ি পাথর ইত্যাদি। মাপমতো কার্ডবোর্ড কেটে সেটার উপর কাজ শুরু করলো ছেলে তার পরিকল্পনামাফিক। ঠিক হলো নুড়ি পাথর দিয়ে ভিতটা করা হবে, তার উপর চিকন ডাল বসিয়ে হবে দেয়াল। কিন্তু বিপত্তি বাধলো আঠালো কোনকিছুর অভাব, অনেক চেষ্টা করেও একটু এঁটেল মাটি কোথাও পাওয়া গেলো না। পার্কের মাটি ছিলো বালিমাটি যা দিয়ে ঠিক গাঁথুনি বা ভিতের কাজটি হচ্ছিল না। ছেলে নানা উপায়ে চেষ্টা করে যেতে থাকলো, একটু আঠালো ভাব আনতে ভাতে বালি মিশিয়ে দেখা হলো। নাহ! কিছুতেই কিছু হচ্ছিলো না। উপায় না দেখে গমের আটার সাথে পানি মিশিয়ে চুলায় জ্বাল দিলাম, আঠালো একটা ডো তৈরি হলো এরসাথে মেশানো হলো কাঠের গুড়ি, যা ভালই কাজ করল। এর উপর নুড়িপাথর বসিয়ে ভিত তৈরি হলো। এখন দেয়াল তৈরির পালা। ছেলে একটার পর একটা চিকন ডাল মাপমতো কেটে চারপাশ দিয়ে গেঁথে যেতে থাকলো, দরজার জায়গাটুকু বাদে। আমি এই ফাঁকে চারটি শক্ত ডাল নিয়ে ফ্রেম বানাতে বসলাম, ইচ্ছে ছিলো ফ্রেমটা বাইরে থেকে দেয়ালগুলোকে সাপোর্ট দিবে। কিন্তু দেয়াল গাঁথা শেষ হতে না হতেই দেখা গেল চিকন কাঠিগুলো ভেতরের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে। বোঝা গেল শুধু বাইরে নয়, ভেতরেও একটা ফ্রেম দরকার। আবার মাপজোঁক, চারটি শক্ত ডাল খুঁজে ভেতরের ফ্রেম করা হলো, ফ্রেমটি কোনোমতে গাঁথা দেয়ালের ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়া হলো। পামগাছের শুকনো লম্বা পাতা দড়ির কাজ করলো, প্রয়োজনে আমার ঘরে তৈরি আটার আঠা ব্যবহার হলো কাদার পরিবর্তে। যাক, চারপাশটা দাঁড়ালো। বাকী থাকলো ছাদ।

ছাদের জন্য সমান লম্বা দুটো ডাল নেয়া হলো, যার দৈঘ্য আমাদের কুঁড়েঘরে দেয়ালের চেয়ে কিছুটা বেশি, ওদের মাথায় আরেকটা লম্বা ডাল বেঁধে ঘরের মাঝ বরবার লম্বালম্বি দুপাশ থেকে বসিয়ে দেয়া হলো। সমান লম্বা ডাল ছাদের পিলারের কাজ করবে, যার একটা সামনের দিকে দরজার পাশে, অন্যটা ঘরের পেছন দিকে বসলো। ওদের গোড়ায় খুব করে আঠা আর কাঠের গুঁড়ি গুঁজে দেয়া হলো, যাতে ছাদের ভার বয়ে দাড়িয়ে থাকতে পারে। এখন ওদের মাথায় ঘরের মাঝ বরাবর উপর দিয়ে যে লম্বা ডালটা থাকলো তার উপর দুপাশ দিয়ে গাছের শুকনো ছাল দিয়ে ছাউনি মতো করা হলো। ফুটাফাটা আঠা আর পাতলা গাছের ছাল দিয়ে ঢেকে দেয়া হলো। দরজায় একটা ফ্রেম বসানো হলো। ছাদের নিচ দিয়ে ঘরের বাইরে থেকেও একটা ফ্রেম বসানো হলো। কিছু একটা দাঁড়ালো। দেখতে না কুঁড়ে ঘর না কাঠের ঘর। আমরা মা-ছেলে পরম তৃপ্তি নিয়ে ওটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আমাদের কাজের সময় হুটহাট খুচরা ফরমায়েশ খেঁটে কাঁচামাল সরবরাহকারি ছেলের বাবাও এসে 'good job' বলে গেল। এবার স্কুলের জন্য ফাইনাল প্রজেক্টের একটা ভিডিও করলাম, যেখানে ছেলে আমাদের কার্যাবলীর বিস্তারিত বর্ণনা করলো। রাত হয়েছিলো, শনিবার রাত। হাতে একদিন রেখে আমরা কাজটা শেষ করতে পেরেছি ভেবে গর্ববোধ করলাম। সে রাতের মতো ঘুমোতে গেলাম।

রোববারের জন্য রইল কুঁড়েঘরের ঝড় হাওয়া, বৃষ্টি এবং তাপমাত্রার পরীক্ষার কাজ। এরপর তা সোমাবার স্কুলে নিয়ে যাওয়ার উপযোগী হবে। রোববার সকালে নাস্তার মাঝেই ছেলে আবিষ্কার করলো আমাদের কুঁড়েঘর বাম পাশে হেলে পড়েছে। খাওয়া গেল, মনটাও দমে গেলে। আবার ছুট লাগালাম পার্কে, খুঁজে পেতে এমনকিছু ডাল যোগাড় করা হলো যার মাথার দিকটা দ্বিখণ্ডিত বা 'V' আকৃতির। ছাদ যে লম্বা ডাল ও দুপাশের পিলারের উপর দাড়িয়ে আছে, তার সামনে দু'দিক ও পেছনে দু'দিক দিয়ে ঠেস দেয়া হলো এই ভি আকৃতির ডালগুলো দিয়ে। আঠা আর কাঠের গুড়ি দিয়ে ওদের গোড়াগুলো ভাল করে গেঁথে দেয়া হলো। মাথা বেঁধে দেয়া হলো পামের শুকনো ঝিরি পাতা দিয়ে। ঘরটা আবার সোজা হলো। এবার নজর গেল ছাদটার দিকে। শনিবার রাতে যখন ছাদটা বানানো হয়েছিলো তখন বাল্পের আলোয় ঠিকমতো যা চোখে পড়েনি তাহলো, গাছের শুকনো ছালগুলো আসলে কিছুটা স্পঞ্জের মতো, বৃষ্টির পানি শুষে নিয়ে ভিজে থাকবে এবং এটা ভেদ করে খুব সহজেই পানি ঘরের ভেতরে চলে আসবে, এছাড়াও ছালগুলোতে অসংখ্য সূক্ষ্ম ফুটো যার সব বন্ধ করা সম্ভব না। মোটকথা ছাদটা পানি টেস্ট এ টিকতে পারবে না। অনেক ভেবে শেষ পর্যন্ত ছেলে ও ছেলের বাবা গেল পামপাতার যে অংশটা গাছের সাথে এঁটে থাকে তা আনতে। মনমতো একটা বড় পামপাতা নিয়ে বাপ-বেটা হাজির হলো। পাতার গোড়ার অংশটা চ্যাপ্টা, পুরু আর মসৃণ। ছাদের জন্য এর থেকে ভালো আর কিছু হতেই পারে না! ওটাকে মাপমতো কেটে মাঝখান থেকে হালকা ভাঁজ করে তৈরি হলো সত্যিকারে পানি প্রতিরোধক চমৎকার ছাদ।

শক্ত কাঠামো, ফুট-ফাটা বিহীন মসৃণ ছাউনি এবং দেখতে আদতে একটা কুঁড়েঘর অবশেষে দাড়িয়ে গেল। এবার শুরু হলো ছেলের এটেনশন টু ডিটেলসের কাজ। সে দেয়ালের উপর আটা আর কাঠের গুঁড়ির মিশ্রণ লেপে তার উপর গাছের ছাল এঁটে দিলো। দেয়ালগুলো আরেক আস্তর পুরু হলো। বাকী ফাঁক-ফোকর বুঁজে দিলো গাছের ছাল আর শুকনো পাতা দিয়ে। আমার মনটা খুঁতখুঁত করছিলো কার্ডবোর্ডের বেইসটার জন্য, কারণ সব মিলিয়ে ঘরটার ওজন কম হয়নি। সেই তুলয়ায় বেইসটা খুবই নাজুক মনে হচ্ছিলো। চোখ গেলো পাশে রাখা আমার মোটা শক্ত কাঠের চপিং বোর্ডটার দিকে। ডালপালা কাটাকুটির জন্য এতক্ষণ ওটা ব্যবহৃত হচ্ছিলো। কিছু না ভেবের আটার আঠা লাগিয়ে কার্ডবোর্ডসহ আস্ত কুঁড়েঘরটিকেই সেঁটে দিলাম ওটার উপর। যদিও চপিং বোর্ডটা খুবই কাজের ছিলো, তবে সেটা এখন ছেলের কুঁড়েঘর প্রজেক্টের বলি। এরচেয়ে সম্মানজনক পরিণতি একটা মামুলী চপিং বোর্ডের আর কি হতে পারে!

সারাদিন ঘরটাকে কড়া রোদে ফেলে রাখা হলো। কয়েক লেয়ারের পুরু দেয়ালের কারণে ভেতরটা তুলনামূলক ঠাণ্ডাই ছিলো, ছেলে ভেতরের আর বাইরের তাপমাত্রা কয়েকবার মেপে টুকে রাখলো। কড়া রোদের কারণে আটা আর কাঠের গুঁড়ির মিশ্রণ শুকিয়ে কংক্রিট হয়ে উঠলো। সন্ধ্যার পর স্ট্যান্ডফ্যান ফুল স্পীডে ছেড়ে তার সামনে ঘরটাকে ধরা হলো, ঘরের মাথায় বসানো দেখতে পলকা ফ্ল্যাগটাও নড়লো না এক ফোঁটা। ঘরটাকে টাবে রেখে উপর থেকে পানি ঢালা হলো, পামপাতার মসৃণ আবরণ বেয়ে পানি মুহূর্তেই ছলকে গেলো। ঘরের ভেতর তো দূর, ছাউনিটাও যেন পানি ঝেড়ে ফেলে নিজে শুকনো ও চকচকে থেকে যেতে চাইছে বারাবার। সুতরাং Wattle and Daub Hut পুরোপুরি পরীক্ষিত এবং প্রস্তুত।

কুঁড়েঘরে ভালোবাসা

রোববার রাতে বিছানায় যাওয়ার সাথে সাথেই ঘুমে তলিয়ে গেলাম। শরীর ক্লান্ত তবে কুঁড়েঘরের পরিণতি নিয়ে মস্তিষ্ক শতভাগ নিশ্চিত। মস্তিষ্ক যখন প্রয়োজনের চেয়ে বেশি খোশমেজাজে থাকে তখন নানাবিধ সিগন্যাল দিয়ে আমাদের উত্যক্ত করে। ঘুমের মাঝে আমি স্বপ্ন দেখলাম, কুঁড়েঘরে বাস করেছি। কি আজব! আমার মতো এতো বড় মানুষ ওই ছোট পুতুলের থাকার উপযোগী কুঁড়েঘরে এঁটে যাচ্ছি কীভাবে! এতো কষ্ট আর যত্নে বানানো ঘরটার যাতে কোনো ক্ষতি না হয় এই ভেবে আমি পাশে শুয়ে থাকা মানুষটার গায়ে মিশে যেতে লাগলাম, আরো ঘেঁষে নিজের অস্তিত্ব শূন্যে না পৌঁছা পর্যন্ত। পাশের মানুষটাও ছিলো কান্ত, অফিসের কিছু সফটওয়্যার প্রোগাম সে বেশ কিছুদিন ধরে তৈরি করছে, কুঁড়েঘরটার মতই একটু একটু করে, পরিশ্রম আর যত্ন নিয়ে। যা হবার তাই হলো, একসময় আমরা দু'জনেই মিশে গেলাম, একজন আরেজনের মাঝে। ঘুমের মাঝে ভালোবাসার বিশেষ আকর্ষণ হলো স্বপ্ন। স্বপ্নে অনুভূতিগুলো কেমন তীব্র হয়। সে অনুভূতি ধরে রাখতে আমারা অনেকক্ষণ ভালোবাসার স্বপ্নগুলো নিয়ে কথা বলি। আমার সাথে সাথে সেও স্বপ্ন দেখছিলো দু'টো প্রোগাম রেডি কোনটা দিয়ে ভালবাসবে। আমি হাসছিলাম এটা কি হলো, ছেলের কুঁড়েঘরেও আমাদের পরিণয় হলো!

ছবি: 
27/04/2012 - 2:25পূর্বাহ্ন

মন্তব্য

হিমু এর ছবি

যুগে যুগে এভাবেই ছোটোদের সবকিছু বড়রা লিয়ে লিলো।

রংতুলি এর ছবি

পুরোপুরি না, ধারে। ছোটরা ঘুমায় তো! হাসি

হিমু এর ছবি

Wattle and daub hut এর বাংলা হতে পারে পঙ্ককুটির।

রংতুলি এর ছবি

এতসব নতুন শব্দ আপনার আসে কীভাবে! আমি তো চেনা শব্দ খেয়ে ফেলে, হাঁ করে বসে থাকি। আবার কখনো এমনসব খটমট আক্ষরিক বাংলা করে ফেলি, যে নিজেই হেসে দেই।

এক লহমা এর ছবি

বাঃ! এইরকম আরও অনেক মজার অভিজ্ঞতা আসতে থাকুক, আর আমরাও তার আনন্দ উপভোগ করতে থাকি!

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

রংতুলি এর ছবি

মনও বলে আসতে থাকুক, গল্পের তো আর শেষ নাই। শুধু সময় একটা কালপ্রিট, এর সাথে দৌড়ে পেরে উঠি না যে। হাসি

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

এই দেশে যখন বাচ্চাদের খেলার জন্য অবারিত মাঠ-পুকুর-নদী-ঝোপ-জঙ্গল-বাগান ছিল তখন তারা নিজেরা নিজেরাই এমন কুঁড়েঘর বানাতো। সেই কুঁড়েঘরে ঢুকে খেলাও যেতো। আজ সে সব কুঁড়েঘরের কথা বানোয়াট গল্প বলে মনে হবে।

**********************

কয়েক বছর আগে আপনার একটা গল্পের একটা প্রসঙ্গের বর্ণনা পড়ে "একই সাথে কষ্টে ও আনন্দে কেঁপে উঠেছি" বলেছিলাম। এই পোস্টের শেষ অনুচ্ছেদ পড়ে অতি পরিচিত এক অনুভূতিতে কেঁপে উঠেছি। মানুষ কী চিন্তায়, কী অনুভবে, কী আশায় শয্যাসঙ্গীর গায়ের সাথে মিশে যেতে যেতে নিজেকে অস্তিত্বশূন্য করে তুলতে চায় তা কি সে ঠিক ঠিক বলতে পারে! কেউ কেউ ঠিকই এমন করে বলে ফেলতে পারে।

স্বপ্নের ভালোবাসার তীব্রতার রেশ ঘুম ভাঙলেও লেগে থাকে, কিন্তু তার কথা কয়জনে মনে রেখে ঠিক এমন করে বর্ণনা করতে পারে!


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

রংতুলি এর ছবি

দেশের বাচ্চাগুলোর জন্য মায়া লাগে, খেলার মাঠ ছাড়া একটা শৈশব কতটা বন্দি, সেটা তারাই জানে।

ভালবাসা জীবনের বাইরে না, কতশত অভাব-অনুযোগ-হতাশার কথা আমরা নিত্য বলে ফেলি, ভালোবাসার কথা বলতে কেন যত দ্বিধা!

টাকার বিনিময় কতো কাজ করে দি, কত ব্যাকলগ সাফ হয়। প্রশংসাও পাই হয়তো কখনো, কিন্তু ভেতরে কোথাও অপূর্ণতা থেকে যায়। যে আত্নতৃপ্তি দু'টো লাইন লিখে আসে, সেটা আর কিছুতে আসে না। তার উপর আপনার এই মন্তব্য! মাঝে মাঝে মনে হয়, এতটা পাওয়ার মতো আসলেই কি কিছু লিখতে পেরেছি কখনো!

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

@রংতুলি
বেশি দূরে যেতে হয় না। আমাদের নিজেদের সন্তানের দিনগুলো চিন্তা করলে নিজেকে মস্ত অপরাধী মনে হয়।

সাহিত্যের কথা বাদ দিন, দৈনন্দিন জীবনে বা ব্যক্তিগত কথনে, অথবা সামাজিক আলোচনায় আমরা ভালোবাসার কথা উচ্চারণে বড়ই কুণ্ঠিত। অথচ ভালোবাসার ছোট্ট একটা কথা একটা সম্মিলনের পরিবেশ প্রাণবন্ত করে তুলতে পারে, একটা মানুষের সময়টাকে রঙিন করে দিতে পারে। দেখনদারি (show-off) নয়, নিখাদ ভালোবাসার কথা প্রকাশে যে লজ্জা বা অসম্মান নেই সেটা লোকে মানতেই চায় না।

কখন, কোথায়, কোন্‌ জিনিসটা কোন্‌ কথাটা কোন্‌ কাজটা কার মনে যে অলখে একটা ঘন্টা বাজিয়ে দেবে তা কি কেউ বলতে পারে! অনেক অনেক বছর আগে এক রাতে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা উপন্যাস পড়ার সময় একটা লাইন হঠাৎ বুকে গিয়ে বাঁধলো। অদ্ভূত এক কষ্টে সে রাতটা কেটেছিল। এখনো সেই প্রসঙ্গটা মনে হলে মন খারাপ হয়ে যায়। অথচ শ্যামল কি জীবদ্দশায় কখনো ভাবতে পেরেছেন তাঁর লেখা সেই ছোট্ট প্রসঙ্গটি আড়াইশ' কিলোমিটার দূরের এক আবেগী নির্বোধকে সারা জীবন এক অপার্থিব হাহাকারে বার বার ডোবাবে?


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

রংতুলি এর ছবি

ছেলেমেয়েদের মাঝেমধ্যে প্রকৃতির কাছে নিয়ে গেলে কেমন হয়? রোজ না হোক, অন্তত দুসপ্তায় বা মাসে একবার। খুব দূরে না হোক, কাছেপিঠেই কোথাও। নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিলেন খোলা মাঠে, নদী কিংবা পুকুরপাড়ে। চোখ রাখলেন পাশে থেকে।

আমাদের সমাজে ভালবাসাকে যেমন অনুচ্চারিত গোপন বিষয় হিসেবে দেখা হয় সে প্রসঙ্গে ভারতীয় 'পিকে' সিনেমার একটা ডায়লগ আমরা প্রায়ই মজা করে বলে থাকি, বাংলা করতে গেলে যা কিছুটা এমন শোনাবে - '...এ দেশে ভালোবাসা লজ্জার বিষয়, তা হবে বন্ধ দরজার ভেতরে, আর বাকি সব মারামারি, কাটা-কাটি হবে দরজার বাইরে...' এই অযাচিত সামাজিক অবদমন থেকে মানুষের এই মাত্রায় (রোজ খবরে যেসব দেখি) বিকৃত যৌনলালশার জন্ম হচ্ছে কিনা, তা মনোবিজ্ঞানীরাই ভাল বলতে পারবেন।

আগেও বলেছি, আবার বলছি আপনার মন্তব্যগুলো আমার খুব ছোট লেখনি জগতের অনেক বড় প্রাপ্তি। এতটা পাওয়ার যোগ্য আমি কখনই না। ইয়ে মানে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাসটির নাম জানতে পারি কি?

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

'জলপাত্র'


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

মন মাঝি এর ছবি

এই দেশে যখন বাচ্চাদের খেলার জন্য অবারিত মাঠ-পুকুর-নদী-ঝোপ-জঙ্গল-বাগান ছিল তখন তারা নিজেরা নিজেরাই এমন কুঁড়েঘর বানাতো। সেই কুঁড়েঘরে ঢুকে খেলাও যেতো। আজ সে সব কুঁড়েঘরের কথা বানোয়াট গল্প বলে মনে হবে।

"দেশে"-র বদলে "ঢাকা" বলাই হয়তো সঠিক হবে। আমিতো ঢাকার বাইরে এই "অবারিত মাঠ-পুকুর-নদী-ঝোপ-জঙ্গল-বাগান" সবই দেখে এলাম। বাচ্চাদেরও খেলতে দেখলাম! এইতো, এখানেই দেখুন না: https://flic.kr/s/aHskahc233

****************************************

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

@মনমাঝি

আমরা যারা তথাকথিত বড় শহরে বেড়ে উঠেছি তাদের কাছে "অবারিত মাঠ-পুকুর-নদী-ঝোপ-জঙ্গল-বাগান"-এর সংজ্ঞা এক রকম আর ছোট শহর, শহরতলী, গ্রাম, অজ পাড়াগাঁ'র মানুষদের কাছে তার সংজ্ঞা ভিন্ন ভিন্ন রকম। প্রত্যেকজন বয়স্ক স্থানীয়কে তার স্থানের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে ঐ ভিন্ন ভিন্ন সংজ্ঞার আলোকে তিনি বলে দিতে পারবেন কী কী 'নাই' হয়ে গেছে। ৩০/৩৫ বছর আগের জেলা শহরগুলোর খোলা সৌন্দর্য এখন এঁদো ঘিঞ্জিতে দমবন্ধকরা হয়ে গেছে। গ্রামগুলো এখন প্রাণপণে শহর হবার চেষ্টায় আছে। ফলে সেখানে গ্রাম আর শহরের সব কালিমাগুলো যোগ হচ্ছে, এবং গ্রাম আর শহরের সব সৌন্দর্যগুলো নাই হয়ে যাচ্ছে। আমরা শুধু গ্লানিতে আছি, মহিমায় নেই।

আপনি যা দেখালেন সেটা সত্য। তবে সেখানে কী কী নাই হয়ে গেছে সেটা জানতে হলে আপনাকে সেখানকার স্থানীয়কে জিজ্ঞেস করে জানতে হবে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সোহেল ইমাম এর ছবি

চমৎকার লাগলো পড়ে

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

রংতুলি এর ছবি

পড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ @সোহেল ইমাম।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।