সীমান্তরেখা-১

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি
লিখেছেন আব্দুল গাফফার রনি [অতিথি] (তারিখ: মঙ্গল, ৩১/০৭/২০১২ - ২:১৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পূর্ব প্রজন্ম

প্রথম অধ্যায়
এইখানে এই বাঁশবাগানের নিচে বড় একটা বাঁক নিয়ে দক্ষিণের দিকে বয়ে গেছে ইছামতী। এই বাঁকটা শুধু বাঁক নয়, ঘাটও বটে। এপার ওপার- দু’পারের লোকেরাই একে বলে ঘোলোর ঘাট, তবে গোসলের জন্য ব্যবহার করে শুধু ওপারের লোকেরা। এপারেদের জন্য ঘোলার ঘাটের কাছাকাছি আরো দুটো ঘাট আছে। একটা মেয়েঘাট- মহিলা আর শিশুরা ব্যবহার করে। অন্যটা মর্দাঘাট- এটা শুধু পুরুষদের ব্যবহারের জন্য।
ঘোলার ঘাট যতটা না পরিচিত ঘাট হিসাবে, তারচেয়েও বেশি পরিচিত চোরাচালানের প্রবেশ দ্বার হিসাবে। ‘ঘোলার ঘাট’ নামকরণটাও অযথার্থ নয়; বেশ সার্থক। আসলে ‘ঘোলা’ শব্দটা এখানে পানির অবিশুদ্ধতা অর্থে ব্যবহার হয়নি; বরং বর্ষা মৌশুম ব্যতিত বছরের বাকিটা সময় দীঘির কাজল কালো জলের মতোই স্বচ্ছ। বাংলাদেশের খান, বিশ্বাস, শেখ, রায়, চৌধুরী ইত্যাদি পদবিগুলোর মতো ঘোলাও একটা পদবি। এদের কোন পূর্বপুরুষ কবে কোন সূত্রে এই পদবি লাভ করেছিল তা কেবল ঘোলারাই বলতে পারে। ঘোলার ঘাটের এপার-ওপারের ঘাটসহ আশেপাশের সব জমির মালিকানা ঘোলাদের নামে।
ঘোলাদের বাঁশবাগানে ভেজা মাটিতে আনমনা হয়ে বসে আছে সবেদ আলি। সেই সকাল থেকে। গলায় একটা তেল চিঁটচিঁটে নেংটি গামছা পেঁচানো। পরনের লুঙ্গিটা হাঁটুর ওপর তুলে বাঁধা। আজ নাকি ওপার থেকে চাল আসবে- আসবে মানে আসবে- কখন আসবে, কতটুকু আসবে তার হদিস জানে না কেউ। পাঁচ দিন ধরে শুধু আসবে আসবে রবই শোনা যাচ্ছে। কিন্তু আসছে না। পাঁচ দিন আগেই আসার কথা ছিল। একটানা বৃষ্টির কারণে সেটা সম্ভব হয়নি।
এদিকে গ্রামে ভাতের বড্ড আকাল। ৭১-এর দুর্ভিক্ষ যেন আবার ডালপালা মেলতে শুরু করেছে। ঘরে চাল নেই সবেদ আলির। নতুন বউ, বৃদ্ধ বাবা-মা আর ছোট তিন ভাই-বোন নিয়ে তার সংসার। ভাই দুটো এখনো আয় করতে শেখেনি। একমাত্র বোনটার বছর দুই আগে বিয়ে দিয়েছিল। ভগ্নিপতির যৌতুকের চাহিদা মেটাতে পারেনি বলে সে ছ’মাস যাবত সবেদ আলির ঘাড়ে সওয়ার হয়ে আছে সে। চালের অভাবে রান্নাঘরে একেবারে হাড়ি জ্বলছে না, তা নয়। দোকানে-বাজারে চাল পাওয়া না গেলেও সস্তায় গমের পোকা ধরা আটা পাওয়া যাচ্ছে চার টাকা কেজি দরে। কিন্তু কী আর করা? এই অতি বৃষ্টির মৌশুমে চোরাচালান বন্ধ- আয় রোজগার নেই বললেই চলে। তাই বাধ্য হয়েই সেই পোকাধরা আটা কিনে পোকা বেছে কখনো রুটি তৈরি করে, কখনো বা আটার সাথে একটু চিনি, একটু লবণ মিশিয়ে আটাঘোঁটা করে পেট বাঁচাতে হচ্ছে। নতুন লোক-কুটুমের কাছে মান-ইজ্জত বলে আর কিছু থাকল না। পরক্ষণেই সবেদ আলি ভাবে, শ্বশুর বাড়ির অবস্থাও এমন আহামরি কিছু নয়। তারাও কি বিরানি-পোলাও দিয়ে উদরপূর্তি করছে? তবে সেই-বা অত মান-ইজ্জতের চিন্তায় অস্থির কেন!
‘সবেদ ভাই, একলা একলা গাঙ্গের ধারে বসে আচো, উপার থেকে চাইল আসবে নাকি শুনলাম?’
কে যেন পেছন থেকে জিজ্ঞেস করল কথাটা। সবেদ আলি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে হাবু ডাগা পেছনে দাঁড়িয়ে। হাবু ডাগাকে চোরাচালানী দলের মহাজন থেকে শুরু করে মুটে পর্যন্ত কেউই পছন্দ করে না। শুধু চোরাচালানী দল কেন গ্রামের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা- কেউই তাকে ভাল চোখে দেখে না। তার অবশ্য যৌক্তিক কারণও আছে। সতেরো বছর বয়সী এই ছেলেটা অতিমাত্রায় ডানপিঠে। মাঠে রস চুরি, রাতারাতি সাঙ্গপাঙ্গসহ লোকের পেঁয়াজ ক্ষেতে হামলা চালিয়ে তেল-বেসন দিয়ে পিঁয়াজি তৈরি করে সেখানেই গলধকরণ, গ্রামের উঠতি বয়সী মেয়েদের নানা ভাবে উত্যাক্ত করা, অন্যের গাছের ডাবগুলো সাবাড় করাসহ এমন কোন বখাটেপনা নেই, যা সে করে না। তবে চোরা চালানীরা তাকে পছন্দ করে না ভিন্ন কারণে। এর আগেও সে মাথামুটের কাজ করেছে। কিন্তু মহাজনের বিশ্বতস্তা ভঙ্গ করেছে বার বার। তার মাথায় মাল চাপালে মহাজনের বাড়ি পৌঁছানের আগেই মুখ সেলাই বস্তা থেকে দু-পাঁচ কেজি মাল রহস্যময় ভাবে গায়েব হয়ে যায়। ডাগা খেলাতেই মূলত হাবু ডাগা অনন্য- তার সাথে পেরে ওঠে এমন খেলোয়াড় এ তল্লাটে নেই। খেলাটাও সে খেলে মনের হাউসে- জিতলেই দু-পাঁচ টাকা প্রাইজমানি পাওয়া যায়।
‘কীরে হাবু- তুই? এই অবেলায় ঘাটে কী মতলবে?’ হাবুর অভিসন্ধি আঁচ করার চেষ্টা করে সবেদ আলি।
‘সবেদ ভাই, তুমার দলে আমার ন্যাও না ভাই-’ মুখে করুণ ভাব এনে বলল হাবু ডাগা।
‘তুই জানিস, আমাদের দলের কেউ তোকে পছন্দ করে না? তাছাড়া তুই যেরাম বখাটে তোর দিয়ে মোটেও বিশ্বাস নেই; কখন কোন মাল নিয়ে হাওয়া হয়ে যাস তার ঠিক আছে?’ সোজাসাপ্টা জবাব সবেদ আলির।
‘আল্লার কিরে সবেদ ভাই, আমি একদম ভাল হয়ে গিইচি। বিশ্বাস করো, এখন থেকে তুমাদের কথায় ওঠব আর বসব।’
‘তোর আল্লার কিরেয় ঢক নেই।’
‘তুমার পা’য় পড়ি সবেদ ভাই, আমার ন্যাও। কাজ না করলি বাপ আর আমাকে বাড়ি থাকতি দেবে না...’
সবেদ আলি কিছুতেই রাজি হতে চায় না। সে মাথামুটে দলের হেড। চোরাচালানের মাল ঘাট থেকে মহাজনদের বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার জন্য দুটো দল আছে। একটা মাথামুটে, অন্যটা সাইকেল পার্টি। মাথামুটেরা চোরাচালানের মাল মাথায় করে ঘাট থেকে বাড়ি পৌঁছে দেয় আর সাইকেল পার্টিরা পৌঁছায় সাইকেলে করে। উভয় ক্ষেত্রেই পারিশ্রমিক সমান- বস্তা প্রতি দশটাকা। যাদের সাইকেল কেনার সামর্থ নেই তারাই সাথারণত মাথা মুটে। মাথা মুটেদের একটা আলাদা কদর আছে বর্ষা মৌশুমে। বছরের অন্য সময় মহাজনরা মূলত সাইকেল পার্টিদেরই দ্বারস্থ হয়। কারণ একজন সাইকেলওয়ালা দু-তিন বস্তা মাল বইতে পারে; মাথামুটেরা একটার বেশি পারে না। মহজনরা চায় মাল যত দ্রুত সম্ভব ঘাট থেকে তার তাদের বাড়িতে পৌঁছে যাক- কখন কোন ইনফরমেশনে ওপর থেকে বিডিআর-এর বড়কর্তা এসে দাবড় দেয় তার ঠিক আছে! কিন্তু বর্ষাকালে পরিস্থিতি ভিন্ন। রাস্তায় এমন কাদা হয় তিন বস্তা কেন এক বস্তা মাল সমেত কোনো সাইকেলওয়ালার সাধ্য নেই কাদা ভেঙ্গে মাল মহাজনের বাড়িতে পৌঁছে দেয়। ফলে মাথামুটেরাই বর্ষকালে চোরাচালানীদের অন্ধের যষ্ঠি।
নানাভাবে বুঝিয়ে সুঝিয়ে অবশেষে সবেদ আলিকে রাজি করিয়ে ফেলে হাবু ডাগা।
আবার টিপ টিপ বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। বাঁশঝাড়গুলো ঘিরে গজিয়ে ওঠা ভাটঝোপের ভেতর মাথা গুঁজে থাকা বুনোকচুর পাতায় পড়া বৃষ্টির ফোঁটাগুলো টলমল করতে করতে মুক্তোদানার আকার ধারণ করে মাটিতে ঝরে ঝরে পড়ছে। রঙ্গিন একটা ঢ্যাঢ়া পোকা হেলাঞ্চা লতার ডগায় বসে মনের হরষে গোসল করছে সেই টিপটিপ বৃষ্টির ধারায়। ভাটপাতার আড়ালে ঘাপটি মেরে বসে থাকা একটা গিরগিটি ক্ষিপ্র গতিতে তার লম্বা জিব দিয়ে পোকটাকে টেনে নিয়ে পাকস্থলিতে চালান করে দিল। শ্যেন দৃষ্টিতে দেখছিল সবেদ আলি। পোকাটাকে গিলে আবার জিবটা বের করে আয়েশি ভঙ্গিতে নিজের ঠোঁট চাটতে লাগল গিরগিটিটা। ভঙ্গিটা ভাল লাগল না সবেদ আলির। শরীরের ভেতরটা রি রি করে জ্বলে উঠল- পাজি গিরগিটি শুধু ওকে নয় গোটা মানব জাতিকেই যেন তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছে। মানুষের পেটে ভাত নেই, গিরগিটির অত আয়েশ কেন? মাটি থেকে একটা শুকনো কঞ্চি কুড়িয়ে নিয়ে সপাটে চালিয়ে দিল সেটা গিরগিটির উদ্ধত মথাটা লক্ষ্য করে। মুহুর্তের মধ্যে মস্তকছিন্ন গিরগিটির নিথর দেহটা লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। কিছুটা দিগ্বীজয়ী বীরের মতো, কিছুটা লুটেরা বোম্বেটেদের মতো একটা হাসির রেখা ফুটল সবেদ আলির অবয়বে।
ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় হাবু ডাগা চেহারায় করুণ অভিব্যক্তি প্রকাশ করে বলল, ‘ইডা তুমি কী করলে সবেদ ভাই? বিনিকাজে এট্টা জাহান খুন করলে!’
‘বিনিকাজে!’ ক্রর হাসিটা মুখে লাগিয়ে রেখেই বলল সবেদ আলি, ‘জানিস নে, এক বাড়িতি এট্টা ফুলোফেউটি মারতি পারলি সাতটা নেকি পাওয়া যায়? হাদিসি আচে!’
আর কথা বাড়াল না হাবু ডাগা। যত বখাটেই সে হোক, সবেদ আলির এই কথাটা সে মেনে নিতে পারল না। কোনো প্রাণী হত্যা করে নেকি লাভের কথা কোনো হাদিসে থাকতে পারে বলে সে অন্তত বিশ্বাস করে না। তাছাড়া নেকি হাসিল করার পর ডাকাতের মতো ক্রুর হাসিটাও মানানসই নয়। তবে মুখে একথাটা প্রকাশ করে সদ্য লাভ করা কর্মসংস্থানের সুযোগটা হাতছাড়া করার বোকামীটা করল না হাবু ডাগা।
‘কী, সবেদ আলি, কী খবর?’
সবেদ আলি চোখ ফিরিয়ে দেখে পাঁচু মাঝি ঘাটে নৌকা ভিড়িয়েছে। চাপা খুশিতে ময়ুরের মতো পেখম মেলে নেচে উঠল সবেদ আলির মন। ভাবল, ‘আজ তাহলে সত্যি সত্যি চা’ল আসছে!'
‘আরে, পাঁচুদা যে! তুমার কী খবর?’ পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল সে পাঁচু মাঝিকে। ‘আইজ কী সত্যিই চা’ল আসছে?’
‘সেরাম পাকা কথা শুনেই তো আলাম, না হলি এই বাদলা মাতায় দুপুরে ঘুম বাদ দিয়ে হাবড় কাদা ভেঙ্গে ঘাটে আসতাম?’ ঘাটের ধারের মোঁথাবাঁশে নৌকার গলুইটা বাঁধতে বাঁধতে বলল পাঁচু মাঝি।
‘তুমাদের আর কী, ওদেশে তো চালির অভাব নেই- ইচ্ছা করলিই দুপুরি ঘুম দিতি পারো আবার রাতি যাত্রাপালায় সঙ সেজে লোক হাসাতিও পারো; ক্যান্ যে দেশডা ভেঙ্গে দু’ভাগ করেলো নেতারা!’ আক্ষেপ ঝরে পড়ল সবেদ আলির কণ্ঠ থেকে।
পাঁচু মাঝি লুঙ্গিটা গুটিয়ে বেটম বেঁধে নিয়ে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এসে সবেদ আলি আর হাবু ডাগার সামনে কয়েকটা ভাটপাতা বিছিয়ে বসে পড়ল। লুঙ্গির গাঁট থেকে পাতার বিড়ির প্যাকেটটা বের করে নিজের মুখে একটা গুঁজে নিয়ে একটা সবেদের আরেকটা হাবু ডাগার দিকে বাড়িয়ে দিল। পরক্ষণেই বিড়িটা ঠোঁট থেকে সরিয়ে বলল, ‘এই যাহ! ম্যাচটা শিথেনে রেখে এইচি, তুমাদের কাছে ম্যাচ আছে?’
সবেদ আলি পলিথিনের প্যাকেটে যত্ন করে রাখা দেশলায়টা বের করে পাঁচু মাঝির দিকে বাড়িয়ে দিল।
পাঁচু মাঝি টিপ টিপ বৃষ্টির হাত থেকে থেকে বাঁচিয়ে নিপুন হাতে ধরাল বিড়িটা।পরে সেই আগুন সঙ্ক্রমিত হলো সবেদ আর হাবুর বিড়িতেও বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে আবার ফিরে গেল পুরোনো প্রসঙ্গে।
‘শুনলাম তুমাদের দেশডা নাকি আবার ভেঙ্গে যাচ্ছে?
‘মানে!’ অবাক হলো সবেদ আলি।
‘মানে তুমাদের জিলা আর যশোর থাকছে না, ঝিনেদা হচ্ছে।’
‘কন থেকে শুনলে?’
‘বিবিসিতি।’ বিড়িটা ঠো্ঁটে চেপে রেখেই বলল পাঁচু মাঝি।
‘আমিও শুনিচি খবরডা,’ পাঁচুর সাথে সহমত পোষণ করল হাবুডাগা।
‘দ্যাখোদিনি কাণ্ড!' বিরক্ত কণ্ঠে বলল সবেদ আলি। ‘ভাঙ্গে ভাঙ্গুক তাতে অসুবিধে নেই, তা আমাদের ঝিনেদার মদহয়ই না ফেলে যশোরের মধ্যিয় রাখলি পারতো। কনে যশোর আর কনে ঝিনেদা! এমনিই আমাদের উপজিলাডা মহেশপুর না হয়ে জীবননগর হলি ভালো হতো। এখন আবার সেই ঝিনেদায় দোড়োদড়ি, চাড্ডিখানি কখা!’
‘ভালো কথা জীবননগরও আর কুষ্টিয়ার মধ্যি থাকছে না, চুয়োড্যাঙ্গা আলাদা জিলা হচ্চে-’ বলল হাবু ডাগা।
‘তাই! ইরশাদ দেশে কোনো কিচুই ঠিক মতো চলতি দেবে না দেখছি; কবে যে ও শালা গদি ছাড়বে?’
গৃহস্থ নিজামুদ্দিন বিশ্বাসের মেজোছেলে ভোটকা মধু বাঁশবাগানের পাশ দিয়ে টিপ টিপ বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে যাচ্ছিল একপাল গরু তাড়িয়ে। সবেদ আলির শেষ বাক্যটা তার কানে গেছে। কথাটা তার গায়ে লাগল। মুখটা বিকৃত করে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, ‘ইরশাদ না থাকলি ন’শ ট্যাকা পাটের মণ ইয়ের মধ্যি দিয়ে বেরু’তো...’
সবেদ আলিও কথাটা লুফে নিয়ে পাল্টা উত্তর দিতে দেরি করল না- ‘তুমাদের পাট আছে তাই পাটের মণের হিসাব করোগে’। আমাদের পাট নেই প্যাট আচে, আমাদের পাট নেই, প্যাট আছে আছে- পাটের পাটের মণের হিসাব রেখে কী করব? আটাঘুঁটা খেয়ে খেয়ে প্যাটের নাড়িভুড়ি ঘোল হয়ে গেল- ও শালা ক্ষ্যামতা থেকে না সরলি শান্তি নেই।’
ভোটকা মধুর মুখে যেন চুনকালি পড়ল; সবেদ আলির কথার জবাব খুঁজে না পেয়ে ‘হই, হুররু, হাট হাট,’ করে গরুগুলোকে খেদিয়ে সেখান থেকে কেটে পড়ল।
‘বাদ দ্যাও, ওসব ক্ষ্যামোতার কতা,’ বলল পাঁচু মাঝি। ‘হাবু কি তুমার দলে ঢুইকলো?’
‘নিতি তো চাইনি- যে হারামজাদার, হারামজাদা- এরাম করে ধরলে না-ও করতি পারছি নে-’
‘আরে ন্যাও ন্যাও,’ হাবু ডাগার পক্ষে ওকালতি শুরু করল পাঁচু মাঝি। ‘দেখো ও একদিন এলাকার সবচেয়ে ব্লাক-মার্কেট হবে।’
পাঁচু মাঝি প্রসংশাসূচক সর্টিফিকেট লাভ করে ভেতরে ভেতরে আহ্লাদে গদগদ হয়ে উঠল হাবু ডাগা। কিছুটা লজ্জাও প্রকাশ পেল তার চেহারায়।
‘ব্লাক-মার্কেট’ শব্দটা এই এলাকার চোরাচালানিদের জন্য আত্মগৌবের অভিধাই বটে। কিন্তু কেউ যদি ইংরেজি শব্দটা বাংলা অর্থ করে ‘কালোবাজারী’ শব্দটা কারো নামের পেছনে জুড়ে দেয় তাহলে নির্ঘাত সে ষাড়ের মতো শিং উচিয়ে তেড়ে আসবে! হাতোর কাছে লাঠি-সোটা পেলে মন্তব্যকারীর মাথা ফাটিয়ে দিতেও হয়তো দ্বীধা করবে না। ‘ব্লাক-মার্কেট’ আর ‘কালোবাজারী’ শব্দ দুটো আভিধানিকভাবে যতই সমার্থক হোক, এদের নিজেদের বিচার-বুদ্ধির অভিধানে এই দুইয়ের তাৎপার্যিক ব্যাবধান আকাশ আর পাতাল।
হঠাৎ আকাশ ভেঙ্গেচুরে মুষলধারে বৃষ্টি নামল। মেঘের গুড়ুম গুড়ুম গজর্নের সাথে ঝঁলসে ওঠা বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল ঘোলাদের পুরো বাঁশবাগান। চাল আসবে বলে কিছুক্ষণ আগে সবেদ আলির চেহারায় যে ওজ্জ্বল্যতা দেখা দিয়েছিল বৃষ্টির ঝরণা ধারা তা যেন মুহূর্তের মধ্যে ধুয়ে মুছে দিয়ে গেলো।
‘শালার বৃষ্টি!’ প্রকৃতিকে উচ্চস্বরে গাল দিয়ে উঠল সে। পাঁচু মাঝির কোনো ভাবান্তর নেই। মাত্র লাভ করা কর্মসংস্থানের সুযোগটা বৃষ্টির কারণে বিলম্বিবত হয়ে যাওয়ায় খানিকটা বিষন্নতা ভর করল হাবু ডাগার মনেও। কিন্তু বৃষ্টিপতনের ছন্দের তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথে কোথায় কোথায় ভেসে গেল সেই বিষন্নতা! ওর নিমগ্ন দৃষ্টি এখন ইছামতীর ছোট্ট বুকে।

রিমঝিম বৃষ্টির আঘাতে ইছামতীর বুকে ছোট্ট ছোট্ট তরঙ্গ বইতে শুরু করেছে। কোথা থেকে একটা পানকৌড়ি এসে যোগ দিয়েছে সেই তরঙ্গের সাথে তাল মিলিয়ে। ঢেউয়ের উন্মত্ততায় ভাঙ্গতে শুরু করেছে সারা বছর ধরে জমে থাকা দাম আর কচুরিপানার জটলা। আসলে বর্ষাকালেই কেবল ইছামতী জীবন্ত। ভারত-বাংলাদেশের শতশত পল্লীর লাখো লাখো হতদরিদ্র মানুষের দুঃখ-কষ্টের লোনাজল মেশানো বর্ষার ঢলে ইছামতী ফুলেফেঁপে ওঠে।
১৯৪৭ সালেও ইছামতী ছিলো অবিভক্ত বাংলার দুটি এতিহ্যবাহী জেলা যশোর-নদীয়াকে বিভক্তকারী ছোট্ট নদী। এরপর পেরিয়ে গেছে অনেক বছর। এতোদিনে ইছামতীর কত জল নিঃশব্দে গড়িয়ে গেছে সুন্দরবন হয়ে বঙ্গপোসাগরে- এখন ইছামতী শুধু দুটি জেলাকে বিভক্তকারী নদী নয়; দুটি দেশকে বিভক্তকারী রেখাও বটে। ইছামতীতে সেকালের মতো ব্যবসায়ীদের পাটবোঝাই বড় বড় নৌকা হয়তো চলে না; তবে আজও অনেক পিতা তার পুত্রকে নিয়ে অস্তগামী সূর্যের রক্তিম সূধা পান করতে আসে ইছামতীর বাঁকে। আজও ভাঁটফুল, কালসুন্দা, শিয়াকুল, আশ্বড়, হেলেঞ্চা আর হাজারো রকম নাম না জানা লতাপাতার ঝোপ নদীর বাঁকের অনেক স্থানকে দুর্ভেদ্য করে রেখেছে। গ্রীস্মের কাটফাটা দুপুরে ফেটে চৌচির নদীর পাড়ে শিয়ালকাটার হলুদ হলুদ ফুলের দ্যূতি সূর্যের আলোকেও যেন ম্লান করে দেয়।
এখনো শরৎ এলে ইছামতী দু’পাড়ে বিছিয়ে দেয় কাশফুলের শুভ্র চাদর, এখনো শীত এলে ইছামতী স্রোতহীন হয়ে পড়ে; তখন এর বুকে দাম কচুরিপানা জমাট বেঁধে সৃষ্টি করে চিংড়ি, কৈ, টাকি, ট্যাংরা, পুটি, শিং, মাগুরদের অভয়ারণ্য। আজও এর বুকে মাছরাঙ্গা পানকৌড়িরা খুঁজে ফেরে সাধনার শিকার। খরগোশ বনমোরগদের দেখা হয়তো মিলবে না, তবে শালিক, শ্যামা, ঘুঘু, গুড়গুড়িদের আজও দেখা যায় মাটিতে পড়ে থাকা খাবার খুঁজতে।
হাবু ডাগার বাবা-চাচারা উত্তর দেশের লোক, তাই ইছামতীর সাথে তাদের বন্ধন নাড়িছেঁড়া নয়। কিন্তু হাবু ডাগার জস্ম, বেড়ে ওঠা এই ইছামতীর বাঁকেই। নদীর সাথে ট্যাংরা-কৈদের যে সম্পর্ক; শেওড়া-ডুমুর গাছেদের যে সম্পর্ক; মাছরাঙ্গা-পানকৌড়িদের যে সম্পর্ক- হাবু ডাগারও তাই- এই বন্ধন শুধু বেঁচে থাকার নয়; আত্মারও। মাছ, পশুপাখি, লতাগুল্ম যেমন জীবনধারণের জন্য ইছমতীর ওপর নির্ভরশীল, তেমনি তাদের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড ইছমতীরও প্রাণ সঞ্চার করেছে। তবে হাবু ডাগার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা এমন নয়। এতদিন সে বাপের হোটেলেই খেয়েছে। বাপ দেড়ে-বাড়িতে কাজ করে, মাও কাজ করে- তাই কোনোভাবেই ইছামতীর ওপর সে নির্ভরশীল নয়। বরং গ্রীষ্মের দুপুরে স্রোতহীন ইছামতী মৃত্যুদুয়ারী বৃদ্ধার মতো খাবি খেতে থাকে, ট্যাংরা-পুটিরা উর্ধাকাশের দিকে উলম্ফনে আগ্রহ হারিয়ে স্বার্থপরের মতো ধাপ-কচুরিপানার অভয়ারণ্যে মাথা গোঁজে, মাছরাঙ্গা-পানকৌড়িরা নদী ছেড়ে পুকুর-ডোবার দিকে উড়ে যায়- স্বর্ণলতা আর সোনালি ফুলের গা ধোয়া সোনাঝরা রোদের ঝিকিমিকি যেমন ইছামতীর সৌন্দর্য বিলীন হতে বাধা দেয় না; তখনি দলে দলে কিশোর হাবুডাগারা এসে ইছামতীর জলে হোলিখেলায় মেতে উঠে এর হৎস্পন্দন ঠেকিয়ে রাখে।
সবেদ আলি আর পাঁচু মাঝির ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন। চোরাচালানের মুখরতায় ইছামতীর প্রাণ সঞ্চার হয়তো হয়, তাতে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যাপরটাই বড়। সবেদ আলিকে ঘুম থেকে উঠেই কোনোমতে পান্তা কিংবা আটঘুঁটা খেয়ে বেরিয়ে পড়তে হয় ইছামতীর দিকে। তারপর অপেক্ষার পর অপেক্ষা- কখন বর্ডার খুলবে, কখন মালজাল আসবে, আসলেও সাইকেল পার্টিদের দাপটে এক বোঝাও মাথাই উঠবে কিনা- ইত্যাদি।
বংশপরম্পরায় পাঁচু মাঝিদের শিরায় শিরায় ইছামতীর ঢেউয়ের স্পন্দন। বিশলায়তনের শ্যামকুড় গ্রামের গায়ে গায়ে লেগে আছে পশ্চিমবঙ্গের পাঁচ পাঁচটা গ্রাম। এতবড় সীমান্তে চোরাচালানের প্রবেশদ্বার যত্রতত্র। সবগুলো দ্বারের জন্য নৌকা মাত্র তিনখানা। আকারে আয়তনে পাঁচুর নৌকাটাই দর্শনধারী। স্বভাবতাই সীমান্তরেখায় তার পদচারণাই সবচেয়ে বেশি।

--------
চলবে


মন্তব্য

সুমন চৌধুরী এর ছবি

পড়তে শুরু করলাম।

টাইপোগুলি আরেকটু খেয়াল করলে আরো ভালো হবে।

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

ধন্যবাদ সুমনদা, টাইপগুলো সম্পাদনা করে যতদুর সম্ভব ঠিক করে দিলাম।

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

পথিক পরাণ এর ছবি

শুরুটা সুন্দর।
চোরাচালানের ভিতরের ছবিগুলা দেখার অপেক্ষায় রইলাম--

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-
সেই ছবি তুলে ধরাই এই উপন্যাসের অন্যতম লক্ষ্য। সচলদের সমর্থন পেলে সে লক্ষ্য পূরণ হবে আশ রাখি।

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

ক্রেসিডা এর ছবি

সুন্দর শুরু.. আশা করি শেষটায় আরো বেশী সুন্দর হয়ে উঠবে।

__________________________
বুক পকেটে খুচরো পয়সার মতো কিছু গোলাপের পাঁপড়ি;

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-
শুরু-শেষের ধারাহিকতা বজায় রাখাই এখন আসল চ্যালেঞ্জ।

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

হিমু এর ছবি

আপনার প্রত্যেকটা কমেন্টে বানান ভুল। আপনি কি এটা ইচ্ছা করে করছেন?

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

খাইছে
ইচ্ছে করে নয়, ইউনিকোডে আমার টাইপিং সমস্যা আছে। তবে নিজের দুর্বলটাও আড়াল করছি না- সবকিছুতে ভুল করা আমার অভ্যেস- মানে ভোলারাম আর কী-

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

নিলয় নন্দী এর ছবি

রনি, লেখালেখির ব্যাপারে আমরা একটু স্থিরতা আশা করি।
আপনার তাড়াহুড়ো করার চেষ্টাটা চোখে লাগছে।
কমেন্ট করার পরে একবার পড়ে দেখলেই তো হয়, তাই না?

বাংলা ব্যকরণে আমার জ্ঞান সীমিত।
খোঁজ নিয়ে দেখুন তো, সীমান্তরেখা সমাসবদ্ধ হয়ে এক শব্দ হবে কি না।

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-
হ‌্যাঁ নিলয়দা, সীমান্তরেখা এক শব্দেই হবে।

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

কল্যাণ এর ছবি

চলুক

_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

শুরু করলাম। বর্ণনার ঢঙটা সুন্দর, বোঝাই যায় প্রকৃতির কাছের মানুষ আপনি। তবে পুরনো পর্বগুলো মাঝে মাঝে দেখে নিলে অনেক টাইপো কমে যাবে। ভোলারাম হবেন না তবে।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।