কৃষ্ণবিবর খোঁড়াখুঁড়ি

শিক্ষানবিস এর ছবি
লিখেছেন শিক্ষানবিস (তারিখ: রবি, ০১/০২/২০১৫ - ৯:৪৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আজি যত তারা তব আকাশে
সবে মোর প্রাণ ভরি প্রকাশে।।

— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

একদিন সূর্য মারা যাবে। তার নিউক্লীয় সংযোজন বিক্রিয়ার জ্বালানি শেষ হয়ে যাবে। তখন পৃথিবী যদি আদৌ টিকে থাকে তবে তার আকাশে আলোর খরা নেমে আসবে আর মানুষ সব এক চিরশীতের দেশে বন্দি হবে। বেঁচে থাকতে হলে আমাদের বংশধরদেরকে অন্য কোনো উপায় দেখতে হবে। হয়ত তারা প্রথমে পৃথিবীর সম্পদ শেষ করবে, তারপর সৌরজগৎ নিঃশেষ করবে, এবং একসময় যত তারা আছে মহাবিশ্বাকাশে সব প্রাণ ভরে উজাড় করে ছাড়বে। পোড়ানোর আর কিছু না পেয়ে তাদের দৃষ্টি নিশ্চিত নিবদ্ধ হবে আপাতদৃষ্টিতে অবশিষ্ট একমাত্র অবলম্বন—কৃষ্ণবিবর—এর দিকে। তারা কি আসলেই কৃষ্ণবিবরের শক্তি আবাদ করে সভ্যতাকে পরমধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে?

প্রথমেই বলে দেই, খবর খারাপ। এই পরিকল্পনা কোনো কাজে আসবে না। কারণটা লুকিয়ে আছে কোয়ান্টাম তার (string) এর মতো অদ্ভুতুড়ে তাত্ত্বিক বস্তু আর নভোলিফ্ট এর মতো জনপ্রিয় কল্পবৈজ্ঞানিক ধারণার মধ্যে।

আশার ছলনে ভুলি

কৃষ্ণবিবর থেকে শক্তি কেন কোনকিছুই উদ্ধার করা সম্ভব এই কথা প্রথমে শুনতে পুরোপুরিই অবিশ্বাস্য মনে হয়। কারণ এ কথা কে না জানে যে, কৃষ্ণবিবর ঘিরে যে ঘটনাদিগন্ত আছে, যেখানে মহাকর্ষক্ষেত্র অসীম, তার ভিতর থেকে কিচ্ছু বেরোতে পারে না। একবার সেই দিগন্তের ভিতর পড়লেই কেল্লা ফতে, আর কোনো মুক্তি নেই। আমরা যদি কোনো বিশাল বল দিয়ে কৃষ্ণবিবরকে বাড়ি মেরে তার শক্তিহানি ঘটাতে চাই তবে উল্টো তার লাভই হবে, বলটা খেয়ে নিয়ে সে আরেকটু মোটাতাজা হবে। একটা বোম মেরে দিলেও একই ফলাফল—বোমা গিলে সে আরো ভারী হবে। কৃষ্ণবিবরে যা ঢোকে তা আর বেরোয় না তা সে গ্রহাণুই হোক, রকেটই হোক, বা এমনকি মহাপ্রভু আলোই হোক।

এতদিন এমনটাই জানতাম। কিন্তু ১৯৭৪ সালে পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসের সেরা গবেষণাপত্রগুলোর একটিতে স্টিফেন হকিং দেখালেন যে, আমাদের ধারণা ভুল ছিল। বর্তমানে হিব্রু ইউনিভার্সিটি অফ জেরুজালেম এ কর্মরত জেকব ডি বেকেনস্টাইন এর পূর্ববর্তী কাজের উপর ভিত্তি করে হকিং দেখিয়েছিলেন, কৃষ্ণবিবর থেকে অতিসামান্য পরিমাণ বিকিরণ লিক হতে পারে। কৃষ্ণবিবরে পড়লে আমরা এখনো আগের মতোই মারা যাব, আমাদের দেহ কোনোদিন সেখান থেকে মুক্তি পাবে না, কিন্তু দেহটা যে শক্তিতে রূপান্তরিত হবে তা একদিন না একদিন ফিরে আসবে। কৃষ্ণবিবর খননেচ্ছুদের জন্য এটা সুখবর: পদার্থ না পারলেও শক্তি মুক্তি পেতে পারে।

শক্তি মুক্তির কারণ বুঝতে হলে একটু কোয়ান্টাম বলবিদ্যার ধোঁয়াটে জগতে প্রবেশ করতে হবে। কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ঘটনাটি হচ্ছে টানেলিং—কিছু কণা অনেকটা সুড়ঙ্গ খননের মতো করে সাধারণভাবে একেবারে অনতিক্রমণীয় বাধাও পার হয়ে যেতে পারে। একটা উঁচু বাঁধের দিকে চলমান একটা কণাকে হঠাৎ করেই বাঁধটির ওপারে পাওয়া যায়। আমাদের জগতে এ অসম্ভব; দৌড়ে গিয়ে একটা দেয়ালের গায়ে আছড়ে পড়লে নিজেকে দেয়ালের ওপাশে আবিষ্কারের সম্ভাবনা শূন্য। কিন্তু আণুবীক্ষণিক জগতে এ যেন কোনো ব্যাপারই না।

কোয়ান্টাম টানেলিং এর মাধ্যমেই তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াসের নিবিড়ালিঙ্গন থেকে একটি হিলিয়াম নিউক্লিয়াস নিজেকে মুক্ত করতে পারে, এবং কৃষ্ণবিবরের অন্ধকূপ থেকে উত্থিত হয়ে "হকিং বিকিরণ" মহাবিশ্বের আলোকমেলায় সামিল হতে পারে। কণাগুলো কৃষ্ণবিবরের ঘটনাদিগন্তের অসীম মহাকর্ষক্ষেত্রের বাঁধন সবেগে ছিন্ন করতে পারে না, বরং তাদের মুক্তি ঘটে চোরাই সুড়ঙ্গ পথে। (এযাবৎ কেউ অবশ্যই কোনো কৃষ্ণবিবর লিক হতে দেখেনি। কিন্তু বক্র স্থানকালে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা প্রয়োগ করলে এই গাণিতিক ফলাফলটা এত অবশ্যম্ভাবীরূপে বেরিয়ে আসে যে কারো পক্ষেই এটা সন্দেহ করা সম্ভব নয়।)

কৃষ্ণবিবর যেহেতু লিক করে সেহেতু তাদের শক্তি দিয়ে উদরপূর্তির সাধ আমাদের জাগতেই পারে। কিন্তু আরেকটু তলিয়ে দেখলেই সব সমস্যা বেরিয়ে আসে। যেভাবেই এই শক্তি সংগ্রহের চেষ্টা করি না কেন লাভ হবে না, সব দিকই প্রতিবন্ধকতাপূর্ণ।

একটা অতিসরল উপায় হতে পারে কেবল অপেক্ষা করা। পর্যাপ্ত সময় অপেক্ষা করলে আমরা কৃষ্ণবিবরকে একটি একটি করে ফোটন উগলাতে উগলাতে তার মধ্যকার সবটুকু শক্তি মহাবিশ্বের কাছে বিসর্জন দিতে দেখব। সে যত শক্তি হারাবে ততই ছোটো হতে থাকবে এবং সব শক্তি ফুরোলে একেবারে নাই হয়ে যাবে। সেদিক থেকে দেখলে, কৃষ্ণবিবর এক কাপ অতিগরম সুস্বাদু কফির মতো যার পৃষ্ঠ মহাভিকর্ষের জাঁতাকলে পিষ্ট হওয়ার ভয়ে স্পর্শ করা যাচ্ছে না। তারপরও এই মহাবিধ্বংসী কফি আস্বাদনের একটা উপায় আছে: বাষ্পীভূত হওয়ার অপেক্ষা করা আর বাষ্পগুলো নিঃশ্বাসের সাথে গ্রহণ করা।

এখানেও ঘাপলা আছে। অপেক্ষা করা খুব সোজা হলেও ভয়াবহ ধীর। কৃষ্ণবিবরেরা খুব নিস্তেজ—সূর্যের সমান ভরের একটা মাত্র ৬০ ন্যানোকেলভিন তাপমাত্রায় কিরণ দেয়, সূর্যপৃষ্ঠের তাপমাত্রা যেখানে প্রায় ছয় হাজার কেলভিন; ১৯৮০'র দশকের আগে আমরা এত নিম্ন তাপমাত্রা গবেষণাগারে তৈরি করতেও জানতাম না। সৌর-ভরের একটা কৃষ্ণবিবর পুরোপুরি বাষ্পীভূত হতে সময় নেবে মহাবিশ্বের বর্তমান বয়সের ১০৫৭ গুণ; এটা কত দীর্ঘ ভাবতে গেলেও মগজ ভোঁতা হয়ে যায়। সাধারণত, একটা কৃষ্ণবিবরের আয়ু তার ভরের তৃতীয় ঘাত অর্থাৎ m3 এর সমানুপাতিক। আমাদের টলটলায়মান বংশধরদের তাই সবকিছু দ্রুত করার একটা উপায় খুঁজতে হবে।

তাদের জন্য প্রাথমিক একটা আশার কথা হচ্ছে যত হকিং কণা ঘটনাদিগন্ত থেকে পালায় তার খুব কমই শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণবিবরের মায়া চিরতরে ছিন্ন করে অসীমশূন্যে হারাতে পারে। আসলে প্রায় কেউই পারে না। কোয়ান্টাম সুড়ঙ্গপথে যত কণা ঘটনাদিগন্তের বাইরে আসে তার প্রায় প্রতিটিকেই কৃষ্ণবিবর আবার তার মহাকর্ষের জালে বন্দি করে ফিরিয়ে আনে। আমরা যদি কোনোভাবে এই ফোটনগুলো—যারা ঘটনাদিগন্ত পার হয়েছে এবং এখনো বিবরের মহাকর্ষক্ষেত্রে পুনরায় আবদ্ধ হয়নি—ধরতে পারতাম তবে হয়ত কৃষ্ণবিবরের শক্তিক্ষরণ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে পারতাম।

এসব ফোটন আসলেই সংগ্রহ করা সম্ভব কি-না তা বুঝতে হলে প্রথমে কৃষ্ণবিবরের আশপাশটাতে যেসব চরম বল কাজ করে সে সম্পর্কে আরেকটু জানতে হবে। অধিকাংশ কণার পুনঃধৃত হওয়ার কারণ ঘটনাদিগন্ত থেকে ঠিক উল্লম্ব দিকে সরলরেখা বরাবর পালাতে না পারা। ঘটনাদিগন্তের ঠিক বাইরে দাঁড়িয়ে একটা লেজার রশ্মি ছাড়ার কথা কল্পনা করুন। আলো কেবল তখনই পালাতে পারবে যখন লেজারটি তাক করা হবে মাথার ঠিক উপর দিক বরাবর; দিগন্তের যত কাছে থাকবেন রশ্মিটিকে ততই নিখুঁতভাবে সুবিন্দু বরাবর তাক করতে হবে। ঘটনাদিগন্তের কাছে মহাকর্ষক্ষেত্র এতই শক্তিশালী যে উল্লম্ব দিক থেকে অতিসামান্য বিচ্যুতি ঘটলেও আলোর পথ একসময় বাঁকা হয়ে যাবে এবং সে ঘোরা পথে আবার দিগন্তে ফিরে আসবে।

ঘূর্ণন বেগ কণার মুক্তির অন্তরায় হতে পারে এটা ভাবতে প্রথমে বেশ অদ্ভুত লাগে। হাজার হোক ঠিক এই কক্ষীয় ঘূর্ণন বেগের কারণেই তো আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন শূন্যে ভেসে থাকতে পারে—পৃথিবীর কেন্দ্রমুখী মহাকর্ষ বলের সাথে ভারসাম্য রক্ষার জন্য যে কেন্দ্রাতিগ বল দরকার ঘূর্ণন বেগই তা সরবরাহ করে। কিন্তু একটা কৃষ্ণবিবরের খুব কাছে চলে গেলে পরিস্থিতি একেবারে উল্টে যায়—ঘূর্ণন বেগ মহাকর্ষের প্রতিকূলে নয় বরং অনুকূলে কাজ করে। এটা সাধারণ আপেক্ষিকতার একটা ফলাফল। সাধারণাপেক্ষবাদের মূলকথা হচ্ছে, ভর এবং শক্তি দুটোই মহাকর্ষ বল অনুভব করে—বস্তুর কেবল জাড্যভরই নয়, তার কক্ষীয় গতিশক্তিও মহাকর্ষের অধীন। কৃষ্ণবিবরের কাছাকাছি (আরো নিখুঁত করে বললে, কেন্দ্র থেকে ঘটনাদিগন্তের দেড়গুণ ব্যাসার্ধ্য পর্যন্ত) কক্ষীয় গতিশক্তির কারণে সৃষ্ট কেন্দ্রাতিগ বলের চেয়ে তার উপর ক্রিয়ারত মহাকর্ষণ বেশি শক্তিশালী। এই ব্যাসার্ধ্যের ভিতরে কৌণিক বেগ যত বেশি হয় কণা ততই দ্রুত দিগন্তের দিকে পড়তে থাকে।

এই ক্রিয়ার আরেকটা ফলাফল হচ্ছে, কেউ যদি রশি বেয়ে উপর থেকে ঘটনাদিগন্তের দিকে নামতে থাকে তাহলে দিগন্তের যত কাছে পৌঁছাবে ততই বেশি গরম হতে থাকবে। কারণ, দিগন্তের কাছ থেকে পালানো কঠিন হওয়ায় যত কাছে যাওয়া যাবে পলায়নরত হকিং বিকিরণের পাশাপাশি পালাতে অক্ষম ফোটনগুলো ততই বেশি পাওয়া যাবে এবং এই ফোটনসমুদ্রে অবগাহনের কারণেই গা গরম হবে। যত কাছে তত গরম—এমন বাতাবরণকে "তাপীয় বাতাবরণ" বলা হয়, কৃষ্ণবিবরের বাতাবরণ যার আদর্শ উদাহরণ। এই তাপ শক্তি বহন করে।

এই শক্তি ঘটনাদিগন্তের বাইরে মজুদ থাকে দেখেই কারো কারো মাথায় কৃষ্ণবিবর খুঁড়ে শক্তি আহরণের বুদ্ধিটা এসেছিল—রশি বেয়ে বিবরের ঘটনাদিগন্তের বাইরের তাপীয় বাতাবরণে নেমে সেখান থেকে তাপ সংগ্রহ করে নিয়ে আসার মহাপরিকল্পনা। মানুষকে তো নামতে হচ্ছে না, একটা বাক্স নামিয়ে দিলেই হবে। কল্পবৈজ্ঞানিক ঢঙে ভাবা হয়েছিল দিগন্তের খুব কাছে কিন্তু বাইরে থেকে সেই বাক্সে গরম বাতাস ভরে নিয়ে তারপর তা উঠিয়ে আনলেই হবে। হকিং বিকিরণ তো নিজ থেকেই পালাতে পারে, কিন্তু সেটা ছাড়া ঐ বাক্সে আর যাকিছু থাকবে তার কিছুই আমরা নাক না গলালে বিবর থেকে পালাতে পারত না। (একবার গ্যাসভর্তি বাক্সটা ঘটনাদিগন্ত থেকে যথেষ্ট দূরে আনতে পারলে তারপর বাকি পথ বয়ে পৃথিবীতে আনাটা তুলনামূলক সোজা: একটা রকেটে ভরে পৃথিবীর দিকে ছুঁড়ে মারো, বা সেগুলো লেজার রশ্মিতে রূপান্তরিত করে বিম করে দাও।)

এই কৌশলকে তুলনা করা যায় আমাদের সেই সুস্বাদু কিন্তু ভয়ংকর কাপের কফিতে আলতো করে ফুঁ দেয়ার সাথে। কিছু না করলে বাষ্পীভূত অধিকাংশ তরল আবার কাপে ফিরে যায়, কিন্তু কফির ঠিক উপরের পৃষ্ঠে ফুঁ দিলে সদ্য উঠতে চাওয়া বাষ্পগুলোকে কাপে ফিরে যাওয়ার আগেই পগারপার করে দেয়া যায়। অনুমান করা হয়েছিল, কৃষ্ণবিবরের তাপীয় বাতাবরণ ফুঁ দিয়ে দিয়ে খালি করতে থাকলে আরো অনেক কম সময়ে গোটা বিবরকে নাই করা সম্ভব; হয়ত তখন m3 নয় বরং শুধু m এর সমানুপাতিক হারে তার বাষ্পীভবন ঘটবে। মানে আগে যদি কোনো বিবর ২৭ বছরে পুরোপুরি বাষ্পীভূত হতো এখন তবে হবে ৩ বছরে।

তাত্ত্বিকেরা কী ভীষণ অসম্ভব সব বিষয় নিয়ে চিন্তা করে দিনাতিপাত করেন তার আদর্শ উদাহরণ হতে পারেন এ প্রবন্ধের লেখক অ্যাডাম ব্রাউন যিনি সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, অত্যল্প সময়ে কৃষ্ণবিবর নাই করতে পারার এই ধারণা ভুল। কারণটা অবশ্য কোয়ান্টাম বলবিদ্যা বা কোয়ান্টাম্মহাকর্ষ প্রসূত কোনো মৌলিক সীমাবদ্ধতা নয়, বরং পুরোই প্রকৌশলগত। সমস্যাটা খুব সরল: কৃষ্ণবিবরের তাপীয় বাতাবরণে নামার জন্য প্রয়োজনীয় যথেষ্ট শক্ত একটা দড়িই বানানো সম্ভব না। এই বাতাবরণ খননের জন্য অনেক উপর থেকে ঘটনাদিগন্তের কাছ পর্যন্ত যায় এমন একটা দড়ি লাগবে—বানাতে হবে একটা নভোলিফ্ট। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ব্রাউন সাহেব কোনো এক অজানা তাড়নায় এ নিয়ে হঠাৎ চিন্তিত হলেন এবং হিসাব নিকাশ শেষে বললেন, এ অসম্ভব।

নভোলিফ্ট

নভোলিফ্ট (স্পেস এলিভেটর বা স্কাই হুক) একটা ভবিষ্যম্ভাবী (futuristic) বস্তু যার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় কল্পবিজ্ঞান মহারথী আর্থার সি ক্লার্ক এর ১৯৭৯ এর উপন্যাস দ্য ফাউন্টেনস অফ প্যারাডাইস এ। তিনি মহাশূন্য থেকে ভূপৃষ্ঠের খুব কাছ পর্যন্ত নেমে আসা একটা ঝুলন্ত দড়ির কল্পনা করেছিলেন। গগনচুম্বী দালানে যেখানে এক তলা তার উপরের তলাকে ধাক্কা দিয়ে ধরে রাখে, এই ঝুলন্ত দড়িতে সেখানে উপরের অংশ নিচের অংশকে টেনে ধরে রাখবে। দড়ির একেবারে উপরের প্রান্ত পৃথিবীর অনেক উপর (ভূস্থিরকক্ষের বাইরে) দিয়ে ধীরগতিতে আবর্তনরত একটা ভারী কিছুর সাথে বাঁধা থাকবে যা কেন্দ্রাতিগ বল দিয়ে দড়িটাকে উপরের দিকে টানবে, এবং নিচপ্রান্তটা ভূপৃষ্ঠের একটু উপর পর্যন্ত আসবে—বিভিন্ন শক্তির মধ্যে এমন একটা ভারসাম্য তৈরি করা হবে যাতে দড়িটা সর্বক্ষণ একটা নির্দিষ্ট স্থানে শূন্যে ভাসমান থাকে। যেন জাদুর মতো; ক্লার্কই অবশ্য বলেছিলেন, যথেষ্ট উন্নত প্রযুক্তির সাথে জাদুর পার্থক্য করা যায় না।

এটা বানানোর উদ্দেশ্য হচ্ছে মহাকাশে মালামাল পরিবহন। নভোলিফ্ট এলে রকেটের ঝুঁকি, অদক্ষতা আর অপচয় থেকে মুক্তি মিলবে; যাত্রার প্রথমাংশে একটা রকেটের সবচেয়ে ভারী কার্গো থাকে তার নিজের জ্বালানি। দড়ির সাথে একটা বিদ্যুচ্চালিত লিফ্ট জুড়ে দিলেই কাজ সারা যায়। এভাবে পৃথিবীর নিম্নকক্ষে মালামাল স্থানান্তরের খরচ যখন কেবল প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের খরচে নেমে আসবে তখন এক কিলোগ্রাম ভর মহাশূন্যে নিতে মাত্র কয়েক শত টাকা লাগবে যেখানে বর্তমানে নভোখেয়াযান দিয়ে নিতে লাগে প্রায় এক কোটি টাকা।

কল্পনার চেয়ে বাস্তবতা অনেক কঠিন; নভোলিফ্ট বানানোর পথে অনেক কারিগরি সমস্যা আছে যার মধ্যে প্রধান হচ্ছে দড়িটা বানানোর জন্য উপযুক্ত একটা পদার্থ খুঁজে বের করা। এক্ষেত্রে আদর্শ পদার্থকে একইসাথে শক্ত ও হালকা হতে হবে—শক্ত যাতে ভারবহনে সক্ষম হয় আর হালকা যাতে নিচের দড়ি উপরের দড়িকে অতিভারে জর্জরিত না করে।

ইস্পাত যথেষ্ট শক্ত নয়, আসলে ধারেকাছেও নয়। নিচের সবকিছুর ভার বহনের পাশাপাশি ইস্পাতের একটা নির্দিষ্ট অংশকে তার নিজের ভারও বইতে হবে, যে কারণে নিচ থেকে উপরের দিকে ইস্পাতরশিটির পুরুত্ব ক্রমেই বাড়িয়ে যেতে হবে। ইস্পাত যেহেতু তার শক্তির তুলনায় বড্ড বেশি ভারী সেহেতু পৃথিবীর কাছাকাছি তার পুরুত্ব প্রতি কয়েক কিলোমিটারে প্রায় দ্বিগুণ করে বাড়াতে থাকতে হবে। ভূস্থিরকক্ষে পৌঁছানের অনেক আগেই তার পুরুত্ব অসম্ভব রকমের বেশি হয়ে যাবে। সুতরাং ঊনবিংশ শতকের পদার্থ দিয়ে নভোলিফ্ট বানানোর কল্পনাও করা যায় না। কিন্তু একবিংশ শতকের কিছু পদার্থ বেশ সম্ভাবনাময়। কার্বন ন্যানোটিউব—ষড়ভুজাকৃতির কেলাসে সজ্জিত কার্বন ফিতে—ইস্পাতের চেয়ে হাজার গুণ শক্ত। সুতরাং এটা দিয়ে বহির্জাগতিক নভোলিফ্ট বানানো যেতেও পারে।

এযাবৎ মনুষ্যনির্মীত বৃহত্তম এই প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে বাধা হবে অনেক—খরচ হবে খর্ব খর্ব টাকা, ন্যানোটিউব পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে কিভাবে হাজার হাজার কিলোমিটার লম্বা দড়ি বানানো সম্ভব তা জানতে হবে, এবং পথিমধ্যে আরো অনেক সমস্যা দেখা দেবে। কিন্তু ব্রাউন সাহেবদের মতো তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীদের ওসব নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলে, কোনো কাঠামো তৈরির প্রক্রিয়া যদি পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক সূত্রগুলো ভঙ্গ না করে তাহলেই হলো, বাকিটা উনারা প্রকৌশলীদের হাতে ছেড়ে দেবেন। (এই সূত্র অনুসারে নিউক্লীয় সংযোজন বিক্রিয়াচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণ সমস্যারও সমাধান হয়ে গেছে বলতে হবে, যদিও একমাত্র সূর্য ছাড়া আর কোনো সংযোজনাগার এখন পর্যন্ত আমাদের সভ্যতাকে শক্তি যোগানোর সম্মান লাভ করতে পারেনি।)

কৃষ্ণবিবর লিফ্ট

এ তো গেল সাধারণ একটা গ্রহের উপর নভোলিফ্ট বানানোর কথা, কৃষ্ণবিবরের উপর বানানো পুরোই আলাদা ব্যাপার। মহাকর্ষক্ষেত্র অনেক বেশি তীব্র, এবং পৃথিবীর চারদিকে যা ভালভাবে কাজ করতে পারে কৃষ্ণবিবরের চারদিকে তা অতিনেক্কারজনক রকমের অপর্যাপ্ত।

এটা দেখানো সম্ভব যে, অতিশক্তিমান কার্বন ন্যানোটিউব দিয়েও কৃষ্ণবিবরের উপর নভোলিফ্ট বানাতে গেলে ঘটনাদিগন্তের কাছাকাছি দড়িকে এতই সরু হতে হবে যে মাত্র একটা হকিং ফোটনই তা ভেঙে চুরমার করে দিতে পারবে, আর দিগন্ত থেকে অনেক উপরে দড়িটাকে এতই পুরু হতে হবে যে সে নিজের ভারে ধ্বসে পড়ে নিজেই একটা কৃষ্ণবিবরে পরিণত হবে।

এসব সীমাবদ্ধতার কারণে কার্বন ন্যানোটিউব প্রথমেই বাদ দিয়ে দিতে হয়। কিন্তু যেমন লৌহযুগের পর ব্রোঞ্জযুগ এসেছে এবং যেভাবে ইস্পাতযুগের পর একসময় কার্বন্যানোনলযুগ আসবে তেমনি আমরা আশা করতেই পারি যে ভবিষ্যতে আরো অনেক শক্তিশালী ও হালকা পদার্থ উদ্ভাবিত হবে। এবং হতেই পারে। কিন্তু এই প্রগতিরও একটা সীমা আছে। প্রকৌশলের একটা সীমা আছে, যেকোনো পদার্থের প্রসারণসাধ্যতা-ভার (tensile-strength-to-weight) অনুপাতের একটা সীমা আছে—যে সীমা প্রকৃতির মৌলিক নীতি দিয়েই নির্ধারিত হয়। আর মজার ব্যাপার হচ্ছে বহুকিছুর মতো এই সীমাও নির্ধারিত হয় আইনস্টাইনের বিখ্যাত সমীকরণ E=mc2 দিয়ে।

একটা দড়ির প্রসারণসাধ্যতা দিয়ে বুঝা যায় তাকে লম্বা করার জন্য কী পরিমাণ শক্তি খরচ করতে হবে: সাধ্যতা যত বেশি লম্বা করতে তত বেশি শক্তি লাগে। ইলাস্টিক ফিতার প্রসারণসাধ্যতা বেশি কারণ তার মধ্যকার অণুগুলোকে পুনর্বিন্যস্ত করার মাধ্যমে তাকে লম্বা করতে হলে শক্তির দরকার পরে: পুনর্বিন্যস্ত করা সহজ হলে প্রসারণসাধ্যতা কম, আর কঠিন হলে বেশি। কিন্তু দড়ির অণু পুনর্বিন্যস্ত করার বদলে আমরা সবসময়ই আরেকটা নতুন দড়ি তৈরি করে আগেরটার সাথে তা জুড়ে দিতে পারি। এভাবে একটা দড়ির দৈর্ঘ্য বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির পরিমাণ হচ্ছে নতুন তৈরি করা দড়িটুকুর ভরের সমতুল্য শক্তির সমান যা আইনস্টাইনের E=mc2 সমীকরণ থেকে পাওয়া যায়—এখানে m হচ্ছে নবযুক্ত দড়িটুকুর ভর আর c2 হচ্ছে আলোর বেগের বর্গ।

বুঝাই যাচ্ছে এভাবে দৈর্ঘ্য বাড়ানো খুবই ব্যয়বহুল, কিন্তু এতে ঝুঁকি সবচেয়ে কম। এটা কোনো দড়ির দৈর্ঘ্য বৃদ্ধির ক্ষমতার একটা ঊর্ধ্বসীমা নির্ধারণ করে দেয় এবং সে কারণে যেকোনো পদার্থের প্রসারণসাধ্যতার সীমাও এটা দিয়েও নির্ধারিত হয়। কোনো পদার্থের প্রসারণসাধ্যতা কখনোই তার প্রতি একক দৈর্ঘ্যের ভর এবং আলোর বেগের বর্গের গুণফলের চেয়ে বেশি হতে পারে না। (ভাবতে পারেন দুটো দড়ি জোড়া লাগালে শক্তি দ্বিগুণ হয়ে যাবে। কিন্তু সেক্ষেত্রে ভরও দ্বিগুণ বাড়বে যার ফলে শক্তি-ভর অনুপাত একই থাকবে।)

পদার্থের শক্তির এই মৌলিক সীমাটা অবশ্য অনেক বড়ো এবং এদিক থেকে প্রকৃতি আমাদেরকে বেশ দয়াই দেখিয়েছে বলতে হবে; সীমার মধ্যে থেকেও প্রাযুক্তিক উন্নতির প্রচুর সুযোগ আছে। সীমাটা ইস্পাতের শক্তির চেয়ে লক্ষ লক্ষ কোটি গুণ বেশি, এবং এমনকি কার্বন ন্যানোটিউবের শক্তির চেয়েও কোটিগুণ বেশি। তারপরও মনে রাখতে হবে, এটা অসীম নয়, পদার্থের উন্নতি একদিন থামাতেই হবে। গতি অর্জন যেমন আলোর বেগে গিয়ে থেমে যেত বাধ্য তেমনি শক্ত পদার্থ নির্মাণও একসময় থেমে যেতে বাধ্য এবং দুটোই নির্ধারিত হয় E=mc2 দিয়ে।

একটা পদার্থের কথা কল্পনা করা যাক যার শক্তি ঊর্ধ্বসীমার সবচেয়ে কাছাকাছি—এর চেয়ে শক্ত আর কিছু হতে পারে না। কোনো গবেষণাগারে এর ছিটেফোটাও দেখা সম্ভব হয়নি এবং অনেক পদার্থবিজ্ঞানী এর অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেন, কিন্তু অনেকে আবার এর গবেষণায় জীবন উৎসর্গ করে চলেছেন। প্রকৃতির সবচেয়ে শক্তিশালী পদার্থকে হয়ত কখনো দেখা যায়নি, কিন্তু ইতিমধ্যেই এর একটা নাম আছে: তার বা স্ট্রিং। তার নিয়ে গবেষণাকারীরা—তারতাত্ত্বিকেরা—মনে করেন তার-ই প্রকৃতির মৌলিকতম গাঠনিক উপাদান। আমাদের আলোচনার জন্য অবশ্য তাদের মৌলিকত্বের ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ না, গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তাদের শক্তি।

তারেরা ভয়ংকর শক্তিশালী। জুতার ফিতার সমান দৈর্ঘ্য ও ভরের একটা তার দিয়ে সমগ্র এভারেস্ট পর্বতকে ঝুলিয়ে রাখা সম্ভব। প্রকৌশলের কাজ যত কঠিন হয় ততই শক্ত পদার্থের দরকার পড়ে, আর তাই একটা কৃষ্ণবিবরের চারদিকে নভোলিফ্ট স্থাপন করতে হলে তারই একমাত্র অবলম্বন; ন্যানোটিউব যেখানে ব্যর্থ, মৌলিক তার হয়ত সেখানে কৃতকার্য হবে। যদি কেউ একাজ করতে পারে তবে তার পারবে, সে না পারলে আর কেউ পারবে না; কোয়ান্টাম তারই আমাদের শেষ ভরসা।

হ্যাঁ, কোয়ান্টাম তার আসলেই অনেক শক্ত, কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, কৃষ্ণবিবর লিফ্ট বানানোর পক্ষে যথেষ্ট শক্ত নয়। এবং আরো নৈরাশ্যজনক হচ্ছে, তাদের শক্তি একাজে প্রয়োজনীয় শক্তির খুব কাছাকাছি। আরেকটু শক্ত হলেই কৃষ্ণবিবরের চারপাশে একটা নভোলিফ্টের ধারণা দাঁড় করিয়ে ফেলা যেত; এবং আরেকটু কম শক্ত হলে একদম কোনো আশাই থাকত না—কারণ তখন সে নিজের ভারেই ধ্বসে পড়ত। তারেরা দাঁড়িয়ে আছে অক্ষত আর বিক্ষত কৃষ্ণবিবরের ঠিক সীমানাটিতে, অনেক উপর থেকে কৃষ্ণবিবরের ঘটনাদিগন্তের কাছাকাছি পর্যন্ত তার দিয়ে নির্মীত একটা দড়ি নিজের ভার ঠিকই বইতে পারবে কিন্তু তারপর লিফ্ট দিয়ে মালামাল পরিবহনের কোনো শক্তিই আর তার অবশিষ্ট থাকবে না। দড়িটা নিজেকে বহন করতে পারে, কিন্তু নিচ থেকে কোনো বাক্স ফিরিয়ে আনার আশা আমাদের ছেড়ে দিতে হয়।

এই হলো তবে কৃষ্ণবিবরের নিজেকে অক্ষত রাখার গোপন রহস্য। প্রকৃতি এমন নিয়ম বানিয়ে রেখেছে যে দড়ি দিয়ে বিবরের তাপীয় বাতাবরণে পৌঁছানো যাবে কিন্তু সেখান থেকে কিছু আনা যাবে না; কৃষ্ণবিবরের ধন লুণ্ঠনের আশাতরী তীরে এসেই ডুবতে বাধ্য। তারের শক্তি যেহেতু সম্ভবসীমার খুব কাছাকাছি সেহেতু অপেক্ষাকৃত ছোটো দড়ি ব্যবহার করে বিবরের বাতাবরণের উপরের অংশ থেকে কিছু শক্তি আহরণ করা যাবে।

কিন্তু এখান থেকে কিছু আনার সাথে হকিং বিকিরণের আশায় অপেক্ষা করে বসে থাকার খুব একটা পার্থক্য নেই: কারণ এক্ষেত্রেও কৃষ্ণবিবরের বাষ্পীভবন কাল তার ভরের তৃতীয় ঘাতের সমানুপাতিকই থেকে যায়। এখানে সেখানে খোঁচাখুঁচি করে একটা দুইটা ফোটন হাতিয়ে নিয়ে কৃষ্ণবিবরের বয়স হয়ত কিছুটা কমানো যাবে কিন্তু সেটা কখনোই একটা ক্ষুধার্ত সভ্যতার অন্ন যোগানোর পক্ষে যথেষ্ট হবে না।

এসব ক্ষেত্রেও মানুষের সবচেয়ে বড় সেই শত্রুই—আলোর বেগ—বীরদর্পে আবার হাজির হয়। যেহেতু আমরা আলোর চেয়ে বেশি বেগে ভ্রমণ করতে পারি না সেহেতু কখনো কৃষ্ণবিবরের ঘটনাদিগন্ত থেকে পালাতে পারব না। যেহেতু আমাদের জ্বালানি থেকে কক্ষণো mc2 এর চেয়ে বেশি শক্তি আহরণ করতে পারি না সেহেতু যুগে যুগে অক্ষত কৃষ্ণবিবরগুলো দেখে দেখেই আমাদের দিন কাটাতে হবে। এবং যেহেতু কোনো দড়ির শক্তি প্রতি একক দৈর্ঘ্যে তার ভর ও আলোর বেগের বর্গের গুণফলের চেয়ে বেশি হতে পারে না সেহেতু বিবরের রত্নরাজি দিয়ে উদরপূর্তিও কখনো করতে পারব না।

সূর্য মারা গেলে পরে আমাদেরকে চিরশীতের দেশেই বাস করতে হবে। কৃষ্ণবিবরের তাপীয় বাতাবরণের শক্তির প্রাচুর্যের কথা ভাবলে আমাদের রাতের ঘুমটাই হারাম হবে, আর কিছু হবে না। অতি উৎসাহে কখনো ডাকাতির আশায় বাক্সপেটরা নিয়ে কৃষ্ণবিবরের খুব কাছ চলে গেলে বিবরের কিছু হবে না, উল্টো আমরাই সব হারাব। আলোকস্বল্পতা, তাপস্বল্পতা, নিদ্রাস্বল্পতা, মহাবিশ্বের তাপীয় মৃত্যু—মুক্তির কোনো আশা নেই। আশার কথা একটাই—সেদিন আসতে বহুত দেরি।


পাঠসহায়ক রেখাচিত্র। উপরে বাম থেকে ডানে: ১) কৃষ্ণবিবরের ঘটনাদিগন্ত, ২) কৃষ্ণবিবরের ক্ষেত্রে ঘূর্ণনবেগও মহাকর্ষের অধীন, ৩) পৃথিবীর ক্ষেত্রে ঘূর্ণনবেগ মহাকর্ষের বিপরীতে কাজ করে। নিচে বাম থেকে ডানে: ১) কৃষ্ণবিবর থেকে সোজা উল্লম্ব দিকে নিঃসৃত বিকিরণ পালিয়ে যেতে পারে যার নাম হকিং বিকিরণ, ২) হকিং ছাড়া অন্য বিকিরণ বাক্সে ভরে পগারপারের অপচেষ্টা, ৩) যা অনেকটা কফির কাপে ফুঁ দেয়ার মতো, ৪) ভূপৃষ্ঠ থেকে যত উপরে যাবেন নভোলিফ্টের দড়িকে ততই পুরু হতে হবে, এবং ৫) দালানে নিচতলা উপর তলাকে ধরা রাখে, আর নভোলিফ্টে উপরের দড়ি নিচের দড়িকে ধরে রাখবে।

---------------------------------------------------------------

ইহা সায়েন্টিফিক অ্যামেরিকান সাময়িকীতে (ফেব্রুয়ারি ২০১৫) লেখা স্ট্যানফোর্ডের তাত্ত্বিক পদার্থবিদ অ্যাডাম ব্রাউন সাহেবের Can We Mine a Black Hole? প্রবন্ধটির স্বেচ্ছাচারী বঙ্গানুবাদ।

কৃষ্ণবিবর সম্পর্কে অতিসংক্ষেপে আরো জানতে চাইলে জামাল নজরুল ইসলাম এর "কৃষ্ণ বিবর" বইটা পড়তে পারেন।


মন্তব্য

মেঘলা মানুষ এর ছবি

স্ট্রিং থিয়রির বাংলা যে তারত্ত্ত্ব -এটা জানা ছিল না।
প্রথমে মনে হচ্ছিল পড়ে মনে হয় শেষ করতে পারব না, একটু পড়ার পরে মজাটা পেয়ে পুরোটা পড়ে ফেললাম।

মহাকাশ বড়ই জটিল, আর অ্যাস্ট্রোফিজিক্স আরও জটিল। আপনার লেখাটা বেশ স‌হজ ভাবে উঠে এসেছে জটিল বিষয়গুলো।
বাংলায় বিজ্ঞান বিষয়ক লেখার আকাল কাটুক আপনার মত মানুষদের হাত ধরেই।

শুভেচ্ছা :

শিক্ষানবিস এর ছবি

হুম তারতত্ত্ব নামটা বোধহয় এই প্রবন্ধেই প্রথমবারের মতো ব্যবহৃত হয়েছে, অন্তত আমার জানামতে। কিন্তু, এভাবে লিখতে লিখতেই একদিন বাংলা নামগুলো প্রচলিত হবে আশাকরি। আসলে গ্র্যাভিটেশনের বাংলা হিসেবে মহাকর্ষ বা মহাকর্ষণ ও কাউকে না কাউকে নিশ্চয়ই শুরু করতে হয়েছিল। হয়ত অন্য কেউ অন্য কোনো নামও প্রস্তাব করেছিলেন। যারটা শুনতে সবচেয়ে ভাল তারটাই টিকে গেছে। আশাকরি তারতত্ত্বও টিকে যাবে।

সহজ লেগেছে শুনে ভাল লাগল। অবশ্য কৃতিত্ব প্রায় পুরোটাই অ্যাডাম ব্রাউন এর, বাংলায় নিয়ে আসাটা কেবল আমার।

স্পর্শ এর ছবি

সায়েন্স অফ ইন্টারস্টেলার বইটা হাতে নিয়ে বসে আছি। পড়ার সময় হচ্ছে না। স্পিনিং ব্লাক-হোলের কাছে যাওয়ার সময় কেন 'স্পেগেটিফিকেশন' হলো না সেটা বুঝতে চাই। ঐ সিনেমার মত করে ব্লাকহোলের কাছে গিয়ে শক্তি আহরণ করা সম্ভব না?


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

শিক্ষানবিস এর ছবি

ইন্টারস্টেলার এখনো দেখিনি, তবে এই সপ্তাহের মধ্যেই সম্ভবত দেখে ফেলব, খ্রোনিঙেন এর সিনেমা হলে এখনো চলছে। আসলে এই প্রবন্ধটা অনুবাদের সময় মাথায়ই ছিল না যে, অ্যাডাম ব্রাউন এর এমন একটা লেখা লেখার কারণ সম্ভবত ঐ সিনেমাটাই। এখন তাই মনে হচ্ছে। সিনেমাটার কথা অবশ্যই ফেলে দেয়া যাবে না, যেহেতু কিপ থর্ন এর মতো বিজ্ঞানী তার সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। হয়ত, কিপ থর্ন এর ভিন্ন কোনো ব্যাখ্যা আছে। সিনেমাটা না দেখে এবং বইটা না পড়ে আসলে কিছু বলতে পারছি না।

সিনেমায় কি দেখিয়েছে যে, ঘুরন্ত কৃষ্ণবিবরের কাছে গেলেও কোনো দুমড়ায়ন ঘটছে না? দেখিয়ে থাকলে আমি ঠিক জানি না কারণ কী। কৃষ্ণবিবর নিয়ে আমার পড়াশোনা সামান্য, আর ঘুরন্ত কৃষ্ণবিবর--যাকে Kerr বিবর বলা হয়--নিয়ে খুবই কম জানি। হকিং তার বিকিরণ আবিষ্কারের কয়েক বছর পর সায়েন্টিফিক অ্যামেরিকান এ The Quantum Mechanics of Black Holes নামে একটা লেখা লিখেছিলেন যা অনুবাদ করছি এখন। আশাকরি শীঘ্রই এ নিয়ে আরো বলতে পারব।

এক লহমা এর ছবি

কঠিন বিষয়। যেটুকু বোঝা গেল সেটা আপনার চমৎকার লেখার কারণে।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

হাততালি

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

জটিল একটা বিষয় সহজ ভাষায় উপহার দেয়ার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে ।

মহাবিশ্বের পরিব্রাজক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।