মেয়েজন্মের পাঁচা৯

শ্যাজা এর ছবি
লিখেছেন শ্যাজা (তারিখ: মঙ্গল, ০৩/০৭/২০০৭ - ৭:১৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মেঘলা আকাশ। গভীর রাত। সে এখনও বাড়ি ফেরেনি। শেষ দুপুরে বেরিয়েছিল কিছু একটা মিটিং আছে বলে। মিটিং প্লেসটা অবশ্য আমার জানা, দৃক ইন্ডিয়ার অফিস। কিছু একটা সংক্ষিপ্ত সিনেমা বানানোর কাজ চলছে, এইডস রোগিদের নিয়ে। বিদেশী পয়সায় বিদেশীদের দেখানোর জন্যে এরকম অনেক কাজ এঁরা করে থাকেন, এই ফাঁকে নিজেডের কাজও হয়ে যায়। বেশ কিছুদিন ধরেই চলছে এই কাজটি, ফাঁকে ফাঁকেই অন্য আরো সব কাজের প্ল্যানও ভাজা হয়। সন্ধ্যে ছ'টার পর অফিসটা মোটামুটি শুঁড়িখানা হয়ে যায় এটা ওখানকার লোকজনই বলে থাকেন। তো এহেন দৃকের অফিসে কাজ মানে মিটিং হলেই ফিরতে মাঝরাত পার। কালও তাই হবে ধরে নিয়ে বেরুনোর আগে জানতে চাই, ফিরতে মাঝরাত পার? না না! শুভ বেরিয়ে যাবে আটটায়, ওর কাজ আছে! আমি খানিকটা নিশ্চিন্ত হই। আমার একেবারেই পছন্দ নয় এই রাত করে বাড়ি ফেরা তবুও এ হরবখতই হয়ে থাকে, নতুন কিছু নয়। এই রাত করে বাড়ি ফেরা নিয়ে কিছু না ভাবলেই হয়। মাথা না ঘামালেই হয়। কিন্তু এই মাথাটাই সব গড়বড় করে দেয়। এলোমেলো ভাবনার কাঁধে চেপে ঔদাস্য এসে হাজির হয়। আমি বুঝতে পারি, আমার জ্বর বাড়ছে।

রাত দশটা বাজতে চলল দেখে ফোন করি, কোথায় আছ? প্রচন্ড শোরগোলই বলে দেয় যে সে অলিপাবে আছে, আর তিনিও তাই বলেন। কখন ফিরছ জানতে চাইলে জবাব আসে, এই উঠছি! বারোটা বাজছে দেখে আবার ফোন করি, আমার ফোন পৌঁছুতে পারে না সেখানে। তিনি নট রিচেবল। খানিক পরে আবার চেষ্টা করি। যান্ত্রিক কন্ঠস্বর একই কথা জানিয়ে দেয়।নট রিচেবল। নট রিচেবল।। ফোন যায় শুভর ফোনে, শুভ জানায়, ও বাড়ি পৌঁছুনোর পথে! বলে, সেও পৌঁছুচ্ছে হবে! আমি দু:শ্চিনতায় আকুল হই,এত রাতে গাড়ি পাবে তো?!

নীরব নীরব মধ্যরাত। দূরে টিমটিম করে জ্বলে হাওড়া সেতুর বাতি। আর কাছের বিদ্যাসাগর সেতুর সংযোগকারী সব উড়ালপুলের গোলাকার বিশাল উঁচু উঁচু ল্যাম্পপোষ্টে সাদা বাতি শুধু এক মৃত ঠান্ডা আলো ছড়িয়ে যায়। রাতজাগা কোন পাখিও রা কাড়ে না এমনকি ডাকে না একটি কুকুরও। আমার সিগারেটের প্যাকেট খালি হয় শুধু জানলার ধারে বসে বসে। ঐ আলো আঁধারির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে। মাঝে মাঝে উঠে এসে বসি কম্পিউটার স্ক্রীনের সামনে, দেখি পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষের নানা বিষয়ের আলাপ-আলোচনা, ঝগড়া-বিতন্ডা। ভালো লাগে না। কিছু লিখতে ইচ্ছে করে না। আধখানা লিখে রাখা গল্পটা আদৌ শেষ হবে কিনা সে ভাবনাও আসে মাথায় কিন্তু নিয়ে বসতে ইচ্ছে করে না! এই গভীর নীরব নীরব মধ্যরাত শুধু চেপে বসতে থাকে বুকের পরে, মাথার ভিতরে। রাগ হয় না। কষ্ট হয় না। এক অদ্ভুত নিরাসক্তি এসে ভর করে।

আমার মাঝে মাঝেই এক অদ্ভুত রকমের জ্বর হয়। খুব বেশি ওঠে না আর সারাদিন থাকেও না। শীত শীত লাগতে থাকে, গায়ে হালকা উত্তাপ। পা দুটোতে যেন কিছুতে কামড়ায়। জ্বর এতটা ওঠে না যে আমি নিজেকে অসুস্থ ঘোষণা করে শয্যা নেব আবার সুস্থ যে নই তাও নিজেই বুঝি। এরকম আমার মাঝে মাঝেই হয়। আর একবার শুরু হলে টানা কিছুদিন চলে। সর্বোচ্চ তিন মাস চলেছিল একবার। আমি নিজেও হয়রান সাথে হয়রান আমার ডাক্তারও। এমন কোন অ্যান্টিবায়োটিক নেই যা সে আমায় খাওয়ায়নি আর হেন টেষ্ট নেই যা সে করায়নি। কোন রোগ ধরা পড়ে না, আমি শুধু ওষুধ খেয়ে যাই মাসের পর মাস। একসময় ক্লান্তি আসে, এক ডাক্তার বন্ধু বলে ওষুধ বন্ধ করে দিয়ে দেখো তো কি হয়। আমি ওষুধ বন্ধ করে দিই, দিন দশ তারপরেও জ্বর থাকে অবশেষে ছেড়ে যায়! বন্ধু বলে, কি এত ভাব যে গায়ে জ্বর চলে আসে?!

এখন আর তাই ডাক্তারের কাছে যাই না। জ্বর এলে চুপচাপ শুয়ে পড়ি আমার নকশীকাঁথা গায়ে দিয়ে, খেয়ে নেই একটা প্যারাসিটামল। এখন জ্বর এলে আর অমন তিন মাস থাকে না, মাসখানেকেই সেরে যায়। কখনও বা তারও কম। আমার আশে পাশের লোকজনও তাই এই জ্বর নিয়ে মাথা ঘামায় না, জানে, 'ভালুক জ্বর' এসেছে আবার চলেও যাবে! এবার এই ৪-৫ দিন হল শুরু হয়েছে, দেখা যাক ক'দিনে যায়! মুশকিলটা হয়, জিম যেতে পারি না। সারাদিন বাড়ির ভেতরে চারতলার এই ফ্ল্যাটে। মাঝে মাঝে দমবন্ধ লাগে, নি:শ্বাষ নিতে পারি না বলে মনে হয়। দূরে কোথাও যেতে ইচ্ছে করে, তাও পারি না। এমন সব সময়ে আমার এই মেয়েজন্ম নিয়ে আমি শোকে কাতর হই, সেই ছেলেবেলার মত। কেন মেয়ে হলাম -এই ভাবনাটা আসে অনিচ্ছা সত্বেও।

ভোররাতে ঘুম ভেঙে যায়। খোলা জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাট এসে ভিজিয়ে দিয়েছে শরীর। উঠতে চেয়েও উঠি না, পারি না। মনে হয় থাক না, কী হবে! ঝুম বৃষ্টি বাইরে। আলো ফুটেছে কিন্তু কিছু দেখা যায় না ঘন ঘোর বর্ষণে। শীত শীত লাগে। সরে যাওয়া কাঁথা গায়ে ভালো করে গায়ে টেনে নিয়ে ওর বুকের মাঝখানে গিয়ে শুই, ঘুমিয়ে পড়ি।


মন্তব্য

হাসান মোরশেদ এর ছবি

শূন্য কড়চা
-----------------------------------
'পড়ে রইলাম বিধির বামে,ভুল হলো মোর মুল সাধনে'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

তারেক এর ছবি

ভাল লাগল হাসি
_________________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে...

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

অমি রহমান পিয়াল এর ছবি

অনুভূতিতে ছেলে জন্মের সঙ্গে বিশেষ প্রভেদ নাই

..................................

তোর জন্য আকাশ থেকে পেজা
এক টুকরো মেঘ এনেছি ভেজা
বৃষ্টি করে এক্ষুনি দে তুই
বৃষ্টি দিয়ে ছাদ বানিয়ে শুই


তোর জন্য আকাশ থেকে পেজা
এক টুকরো মেঘ এনেছি ভেজা
বৃষ্টি করে এক্ষুনি দে তুই
বৃষ্টি দিয়ে ছাদ বানিয়ে শুই

শ্যাজা এর ছবি

মোরশেদ,
হুঁ ...

পিয়াল,
কে জানে ...


---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)

নজমুল আলবাব এর ছবি

ভালো লাগলো। পড়লাম আর বৌকে ভাবলাম। ও ওতো এভাবে প্রতিরাতে বসে থাকে।

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

ছেলে জন্মটা আমার বৃথাই গেল।
চার-পাঁচ দিন পর কোথাও আড্ডায় যাওয়া হয়।
পাব-ক্লাব হয় না কতো দিন?
বিয়ের পর একা একা সন্ধ্যার পর বাইরে যাইনা।

এখন তো যৌথ জীবন।
একাকী জীবনের আনন্দটা একা হয়ে আর নিতে পারি না।
তবে কোনো আক্ষেপ নেই।
হাতের কাছে ব্রডব্যান্ড। আমার পাব-ক্লাব লাগে না।
-----------------------------------------------
গাধারে সাবান দিয়া গোসল দেয়ানোটা গাধাপ্রীতির উজ্জ্বল নমুনা হতে পারে; তবে ফলাফল পূর্বেই অনুমান করা সম্ভব, গাধার চামড়ার ক্ষতি আর সাবানের অপচয়।

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

শ্যাজা এর ছবি

শোহেইল,
আপনার গিন্নি ভাগ্যবান।
ভাল থাকুন আপনারা।

নজমুল,
লেখা পড়ে ভেবেছেন জেনে ভাল লাগলো।
ভাল থাকুন সব।


---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)

শামীম এর ছবি

লেখাটা ভালো লাগল। হাসি

লী=৯ এর ব্যবহার অনেকদিন পরে দেখলাম। এটা সম্ভবত বাংলাদেশে বর্ণমালা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে।

====
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

"টিপিক্যাল পুরুষালি মন্তব্য" জাতীয় ভুল বোঝাবুঝির ঝুঁকি নিয়েই বলি, মেয়েদের অথেনটিক লেখা পড়তে ভালো লাগে। খুব বেশি পাই না। যা পাওয়া যায় তার বেশিরভাগ হয় এক ধরনের আরোপিত আঁতলামো, অথবা রদ্দি ও অপাঠ্য।

আপনার লেখা ভালো লাগলো।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

অমিত আহমেদ এর ছবি

একমত জুবায়ের ভাই।


আমার বেলা যে যায় সাঁঝ-বেলাতে
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে

ঝরাপাতা এর ছবি

ধুরো, মন খারাপ করে দিলা।

সমরেশের একটা গল্পের লাইন মনে পড়ছে-
তুমি ভুল বুঝলে নিঃশ্বাস ভারী হয়।
_______________________________________
রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

কারুবাসনা এর ছবি

পড়ে ভাল লাগল। ৫ দিলাম। জ্বর অবশ্য ভাল না,তবে উত্কন্ঠা সহ অনুভূতি এরকম আরো চাই, আরো লেখা পড়তে চাই। জিও।


----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।


----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।

কারুবাসনা এর ছবি

আর কাল কি হল?


----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।


----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।

দৃশা এর ছবি

দৃক আমার বড় প্রিয় জায়গা... তবে এ বোধহয় ভিন্ন জায়গা।

দৃশা

কারুবাসনা এর ছবি

ভিন্ন জায়গা কেন হবে? ওটা বাংলাদেশে এটা ইন্ডিয়াতে @ দৃশা


----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।


----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।

শ্যাজা এর ছবি

জুবায়ের,
কিছু একটা তো কাজ করে মেয়েদের মধ্যে যার জন্যে আমরা ইচ্ছে করলেও 'মেয়ে' থেকে 'মানুষ' হয়ে উঠতে পারি না। সেই কিছু একটা- হীনমন্যতা হতে পারে, নিজের সামাজিক অবস্থান হতে পারে, যে পরিবেশে বড় হয়ে উঠি সেই পরিবেশ হতে পারে, আশে পাশের মানুষজন হতে পারে-যারা সারাক্ষণই মনে করিয়ে দেন, তোমরা মেয়েমানুষ। আর হতে পারে
নিজেদের মর্ষকামিতাও।

আমরা যে মেয়েমানুষ সেটা সেই বুঝতে শিখতে শুরু করার বয়স থেকে আমাদেরকে এত বেশি করে বুঝিয়ে দেওয়া হয় যে আমরা নিজেরাও একসময় ভুলে যাই যে আমরাও মানুষ, শুধুমাত্র মেয়েমানুষ নই। এই বোধটা সর্বত্রই কাজ করে, নিজের ব্যাক্তিজীবনে, কর্মস্থলে, রাস্তায়, আর এই লেখালেখিতেও। সর্বত্রই আমরা জানিয়ে দিতে চাই, বুঝিয়ে দিতে চাই অ-দরকারেও যে আমরা মেয়ে-মানুষ। আমি নাম নিতে চাই না কিন্তু ওপাড়ার এক বিশিষ্ট ব্লগারের কিছু লেখা আমার নিজের খুব পছন্দ। তিনি লেখেন প্রচুর প্রচুর কিন্তু তাঁর সব লেখা আমার পছন্দ নয় আর এই অপছন্দের কারণ সর্বদাই 'আমি মেয়েমানুষ' বিষয়টি। মনযোগ আকর্ষণের এই মাধ্যমটি আমার পছন্দ নয়।

'আমি মেয়েমানুষ' এই বোধটা যে আমার মধ্যে কাজ কলরে না তা নয়, অবশ্যই করে। কিন্তু সব সময় সব জায়গায় এই নাকি কান্নায় আসলে কী কিছু হয়? হয় না। মেনে নেওয়া, মানিয়ে নেওয়া আমরা শিখে যাই সেই তখন থেকেই, যখন থেকে বুঝতে শিখি, 'আমি মেয়েমানুষ।'

কথাগুলো একটু অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেল। আমার লেখা আপনার ভালো লেগেছে, ধন্যবাদ।

শামীম,
ঠিক বলেছেন। সমস্যা থেকে পালালে যদি মুক্তি মিলত তাহলে নাহয় পালিয়েই যাওয়া যেত কিন্তু তা যখন হওয়ার নয় তখন সব নিয়েই থাকতে হয়, হবে।

সুমেরু,
কাল কী হল? তাইলে তো একটা রোজনামচা লিখতে হয়! সেটা কি তোমার ভালো লাগবে? আর ব্লগারেরাও আমাকে ব্যান করে দেবন এই বলে, আরে, এ দেখি খালি প্যানপ্যানায় ! মন খারাপ

সবাইকে ধন্যবাদ।


---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।