বিদিত লাল দাসের গান শোনা

শ্যাজা এর ছবি
লিখেছেন শ্যাজা (তারিখ: শনি, ১১/০৮/২০০৭ - ৪:১২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বিদিত লাল দাস

একত্রিশে জুলাই সকালবেলায় খবরের কাগজের 'কোথায় কী' কলাম দেখতে গিয়ে চোখে পড়ল 'মধুসুদন মঞ্চ'এ 'নির্মলেন্দু চৌধুরী'র স্মরণ সভায় গান গাইবেন 'বিদিত লাল দাস'। খবরটা পড়ে সঙ্গে সঙ্গে যে প্রশ্নটি মাথায় এলো এই 'বিদিত লাল দাস' কী আমাদের সিলেটের গায়ক? কোথাও আর কিছু লেখা না থাকায় নিজে নিজেই ভেবে নিলাম, এখানে কোন বিদিত লাল দাস আছেন বলে তো জানি না, কাজেই ইনি আমাদের সিলেটের গায়কই হবেন।

ঢাকা থেকে সদ্য সদ্য কিনে আনা বিদিত লাল দাসের সিডি চালিয়ে সুমেরুকে গানও শুনিয়ে দিলাম আর ঠিক করলাম যাব গান শুনতে! সুমেরুর সেদিন শ্যুট ছিল, বললো, তাড়াতাড়ি শেষ করে পৌঁছে যাবে হল'এ। আমি আগে থাকতে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানলাম, টিকিট দিয়ে নয়, অনুষ্ঠানটি সকলের জন্যে অবারিত দ্বার। অপেক্ষার সময়টুকু হলের বাইরের সিঁড়িতে বসে ঝাল ঝাল 'ঘটিগরম' (গরম গরম মশলা চানাচুর) খেয়ে কাটিয়ে দিলাম। অপেক্ষা অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার, অপেক্ষা সুমেরুর শ্যুট সেরে হলে আসার।

ঢাকায় গীতালীতে যখন পুরনো লোকসংগীতের সংগ্রহ দেখছিলাম তখন হঠাৎই চোখ পড়ে 'বিদিত লাল দাস' নামটির উপর। এক বিস্মৃত নাম। নামটি দেখামাত্রই একসাথে ভিড় করে এলো অনেক স্মৃতি। এক পিচ্চি টেলিভিশনের সামনে বসে আছে বিশেষ করে লোকসংগীতের অনুষ্ঠানের সময় ধরে। টিবি রুমে আর কেউ নেই। প্রতিদিন একই সময়ে একই চিত্র। তখন ভাল মন্দ বুঝতাম না, গানের কথাও খুব একটা বুঝতাম না শুধু গান শুনতাম। ভাল লাগত সুর। লোকসংগীতের সুর। সিডিতে ঐ নামটি দেখামাত্র কিনে ফেললাম, গান কেমন হবে, ভাল কী মন্দ কোন চিন্তা না করেই। এমনকি ওখানে সিডি চালিয়ে গান শুনিওনি যেমন অন্য সব সিডি শুনে তারপরে কিনেছি।
মধুসুদন মঞ্চে বিদিত লাল দাস ও তাঁর সঙ্গীরা
২৯শে জুলাই সিলেটের আরেক কৃতী সন্তান, প্রয়াত লোকসংগীত শিল্পী নির্মলেন্দু চৌধুরীর জন্মতিথি। সেই উপলক্ষ্যে ৩১শে জুলাই মধুসুদন মঞ্চে লোকভারতী ও পশচিমবঙ্গ সরকারের যৌথ উদ্যোগে এই অনুষ্ঠান। 'লোকভারতী' নির্মলেন্দু চৌধুরী'র নিজের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান যা এখন চালাচ্ছেন উৎপলেন্দু চৌধুরী। উৎপলেন্দু চৌধুরী নির্মলেন্দু চৌধুরীর সুপুত্র। বিদিত লাল দাস আর নির্মলেন্দু চৌধুরী প্রায় সমসাময়িক ছিলেন, উৎপলেন্দু বিদিত লাল দাসকে নিজের গুরু বলে অভিহিত করলেন। তো নির্মলেন্দু চৌধুরীর এই স্মরণ সভায় লোকভারতী নিয়ে আসে বিদিত লাল দাস'কে। তাঁকে সম্বর্ধনা দেয় লোকভারতী ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার। পশ্চিমবঙ্গের ক্রীড়া ও সংস্কৃতি মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী হাজির ছিলেন বিদিত লাল দাস'কে সন্মান জানাবেন বলে। ফুলের তোড়া, মানপত্র আর একটি স্মারক দেন সুভাষবাবু। বিদিত লাল বাবুর গায়ে শাল জড়িয়ে দেন উৎপলেন্দু চৌধুরী।

অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার বেশ আগে পৌঁছে গেছিলাম বলে জায়গা পেয়ে যাই একেবারে সামনে, দ্বিতীয় সারিতে। প্রথম সারিতে বসে বেশ কয়েকজন নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতায় মগ্ন সিলেটি ভাষায়। এঁরা সব সিলেট থেকে এসেছেন বিদিত লালবাবুর সঙ্গে। সে এক অদ্ভুত অনুভব। সেই কোনকালে ছেড়ে চলে আসা সিলেটের মানুষ আর সিলেটি ভাষা তাও এই খোদ কলকাতায় বসে! সেই অনুভূতির কথা বলে বোঝানো যায় না।

গাঢ় নীল পাঞ্জাবী আর সাদা পাজামা পরা বিদিত লাল দাস এলেন অনুষ্ঠান শুরুর ঠিক আগে, সামনের সারিতে এসে বসলেন। যথেষ্ট বয়েস হয়েছে, কথা বলতে গেলে গলা কাঁপে, হাত দিয়ে কিছু ধরতে গেলে কাঁপে হাত। শুধু যখন গান গাইতে শুরু করেন তখন উদাত্ত গলার আওয়াজে গমগম করে হলঘর। আর নাগাড়ে গেয়ে যান আটখানি গান। তাঁর গানের সাথে তবলা বাজাবেন বলে সিলেট থেকে সঙ্গে এসেছেন তাঁরই গানের স্কুলের তবলা শিক্ষক টিংকু। হৃদরোগী বিদিত লাল দাস একা গান গাইতে পারেন না বলে মঞ্চে তাঁর সাথে থাকেন গানের সঙ্গী ( নামটি ভুলে গেছি), যদিও বিদিত লাল দাসের গলা ছাপিয়ে তার গলা একবারও শোনা যায় না, আলাদা করে বোঝা যায় না।
গানের সাথী সহ বিদিত লাল দাস
বন্দনা গান দিয়ে শুরু করেন তিনি,
পরথমে মে বন্দনা করি আল্লা রসুল
হজরত ওয়ালীরে দিলাম .....
মাই ফাতেমা হযরত আলী হাসান আর হুসেন
মাতার উপর তুইলা রইলাম...
তার বাদে বন্দনা করি বাবা শাজলাআআআআআআআআআললললললললললল
তিনশ ষাইট আউলিয়া বন্দি...

(কথাগুলো মনে পড়ছে না বলে ডট ডট দিয়ে দিলাম, ক্ষমা করবেন)
এই 'বাবা শাজলাল' বলে তিনি গলা যে উচ্চতায় নিয়ে যান এখনো, সেটা না বলে বোঝানো যাবে না। একে একে গেয়ে যান আটখানি গান। প্রটিটি গানের পরে করতালিতে ফেটে পড়ে হল। মঙ্গলবারের সন্ধ্যায়ও সেই হল পুরো ভর্তি ছিল। চরম মুগ্ধতায় শুনে যাচ্ছিলাম েকের পর এক গান। মনে হচ্ছিল, এই গান যদি এভাবেই চলতে থাকত! পরক্ষণেই নিজেই লজ্জা পাচ্ছিলাম নিজের এই স্বার্থপর চিন্তায়। অসুস্থ শিল্পী এতদূর থেকে এসেছেন আটখানি গান শুনিয়েছেন, এই কী যথেষ্ট নয়!সেই কোন ছেলেবেলায় যাঁর গান টেলিভিশনে দেখেছি-শুনেছি আজ সামনে বসে তাঁর গান শুনছি-দেখছি তাও কলকাতায় বসে এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী কিছু হতে পারে!

(আরও কয়েকজন সেই অনুষ্ঠানে গান গেয়েছেন, মুগ্ধ করেছেন আগরতলার এক কিশোরী শিল্পী। তার কথা পরে অন্য কোনদিন, অন্য কোন সময়ে।)


মন্তব্য

আরিফ জেবতিক এর ছবি

বিদিত লাল দাসের শরীর ভালো নয় কিন্তু গলা কিন্তু আগের মতোই।

বিদিত দা'র পাশে বসা গায়কটা বোধহয় পলাশ।আমি শিওর না,ছবি ক্লিয়ার না।তবে নজমুল বলতে পারবে হয়তো।

-----------------------------------
কিস্তিমাতের যুদ্ধ শেষে,সাদাকালো ঘুটিগুলো এক বাক্সেই ফেরত যাবে...

শ্যাজা এর ছবি

'সালাম' বলেছিলেন সম্ভবত। ভুলে গেছি মন খারাপ


---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

জুতসই ছবি জুড়েছেন দেখা যায়। চলুক

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

শ্যাজা এর ছবি

থেংকু মুর্শেদ হাসি


---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)

হাসান মোরশেদ এর ছবি

'আমরা হক্কল সিলটি' হাসি

শ্যাজারে ধন্যবাদ ।বিদিত বাবু বেঁচেবর্তে আছেন এখনো,দেখে ভালো লাগলো ।

-----------------------------------
'আমি ও অনন্তকাল এইখানে পরস্পর বিস্ময়ে বিঁধে আছি'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

শ্যাজা এর ছবি

বেঁচে তো আছেনই এখনও গান গেয়ে ফাটিয়ে দিচ্ছেন।

আরো অনেক অনেক দিন বেঁচে থাকুন, ভাল থাকুন।


---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)

হাসান মোরশেদ এর ছবি

আমরা ছোটবেলায় বিদিত খোলা গলার গান শুনতাম ।ওস্তাদ ফুল মোহাম্মদ ও ছিলেন । তারপর হিমাংশু দা ।

সংস্কৃতি নেই গো দিদি । ধর্মের ষাঁড় হয়েছি সকলে । সুরমার পানি ও এখন আরো বেশী ঘোলাটে ।
-----------------------------------
'আমি ও অনন্তকাল এইখানে পরস্পর বিস্ময়ে বিঁধে আছি'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

শ্যাজা এর ছবি

সেদিন আর নেই বলেই এত ভাল লেগেছে বিদিতবাবুকে এই কলকাতায় দেখে। কেউ কেউ তবু ধরে রেখেছেন সেদিনকে এই দুর্দিনেও।

তবলাবাদক টিংকু দুর্দান্ত তবলা বাজান আর বিন্দাস বাজান। আলাদা করে কোন তবলাবাদককে সেদিন ভালো লাগলো হাসি


---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)

কারুবাসনা এর ছবি

মহম্মদ আজিজ।


----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।


----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

ভালো লাগলো পড়তে।
-----------------------------------------------
সচল থাকুন ---- সচল রাখুন

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

শ্যাজা এর ছবি

ধইন্যবাদ শোমোচৌ হাসি


---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

বিদিত লাল দাশের লেখাটা ভালো লাগলো... আপনেরে ঈর্ষা হইতেছে...

পশ্চিমবঙ্গের কোন জায়গায় জানি ভবা উৎসব হয়... সেখানে ভবা পাগলার অনুসারীরা জমায়েত হয়... গান গায়... তারিখটা আমার জানা নাই... জানলে পরে যাইতে আগ্রহ আছিলো... আপনে কি জানেন ?

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

আহমেদুর রশীদ এর ছবি

বিদিত লালের গান নিয়ে কেউ প্রবন্ধ লিখলে আমার কাছে পাঠাতে পারেন।

editor@shuddhashar.com

+88 01716 525939

---------------------------------------------------------

ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে
________________________________________
http://ahmedurrashid.

শ্যাজা এর ছবি

নজরুল ইসলাম,
আপনার মন্তব্য আগে চোখে পড়েনি।
না ভাই, ভবা উত্সব কোথায় হয় জানা নেই। তবে শুনে যাওয়ার আগ্রহ হচ্ছে। খোঁজ নেব এব্যপারে।


---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

ধন্যবাদ শ্যাজা।
ভবা ছিলেন আমাদের মানিকগঞ্জের লোক... কালী সাধক... তিনি পরে পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। সেখানে তার শিষ্যকূল গড়ে ওঠে... পবন দাস বাউলও শুনছি তার শিষ্যত্ব নিছিলেন। আসল চিনি এ্যালবামে ভবার লেখা ও সুর করা গান আছে। তাঁর শিষ্যদের গাওয়া বেশ কিছু গান নিয়া একটা ক্যাসেট ছিলো আমার কাছে (বাজারজাত হয়নাই কখনো) সিডির ভারে সেই ক্যাসেট নষ্ট হইয়া গেছে। এখন আফসোস হয় খুব। গাইতে ইচ্ছা হয় খুব 'খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধো মন'।
ভালো থাকবেন। খোঁজ পাইলে জানাইলে কৃতার্থ হবো।

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।