মেয়েটির নাম লুত্ ফা- শেষ পর্ব

শ্যাজা এর ছবি
লিখেছেন শ্যাজা (তারিখ: শুক্র, ০২/১১/২০০৭ - ৭:০৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

তাহারই মত ফুটফুটে এক কন্যা আইল ধরায়৷
অন্ধ গুহায় কাটে শৈশব,হায়! ইশ্বর হননা সহায়৷৷
তবুও মায়েতে স্বপ্নে বিভোর যন্ত্রনার হইবে শেষ৷
কন্যার রূপের ছটায় কথায় মাতিবে সারাটা দেশ৷
৷তবু মনে হয় ছোটবেলা তার,টিকিয়া আছে সঙ্গোপনে৷
কেবা তাহার যত্ন লইত, পড়েও না সকল মনে৷৷
কন্যার তরে কেহ নাহি আর একাকী কেবল মায়৷
খালি প্রার্থনা, কবে ইশ্বর হইবেন তাহার সহায়৷৷
অন্ধ পুরীতে বাড়িয়া উঠিছে আরেকটি ছোট সে দেশ৷
চারিদিকে তাহার আন্ধারে আন্ধার আলুলায়িত কৃষ্ণকেশ৷৷
জন্মে জন্মে তারা সন্তান লালনে দিবে হে জীবন কাটায়ে৷
অন্ধ পুরীতে ছাড়িবে শ্বাস,তবু স্বপ্ন রাখিবে বাঁচায়ে৷৷

কেটে যায় আরো দুটি বছর৷ লুত্ফা আবার মা হল, এবার সে মেয়ের মা৷ তাহলে কি তার স্বপ্নই বাস্তবায়িত হয়ে চলেছে৷ আল্লাহ পাক তাহলে পরীক্ষা নিচ্ছেন তার কিন্তু কিসের সে পরীক্ষা৷ সীতার চাইতেও কঠোর এই অগ্নীপরীক্ষা৷ দুই সন্তান আর শ্বশুর শাশুড়িকে নিয়ে লুত্ফা মুখ বুজে পড়ে থাকে সংসারে৷ জয় ততদিনে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে তার বাবার ব্যাবসায় ঢুকে পড়ে৷ এত বছর পর লুত্ফা যেন তার স্বামীকে পেল, কিন্তু এ কি পাওয়া? জয় বাড়ি ফেরে প্রতিদিন রাত করে৷ এসেই বসে ডিভিডি চালিয়ে৷ বিকৃত রুচির সব সিনেমা৷ আর একের পর এক ফোন৷ শার্টে লিপষ্টিকের দাগ, আলমারী ভর্তি সব নগ্ন মেয়েদের ছবি নতুন কিছু না৷ শুরু হয়েছে অন লাইনে জুয়ো খেলা৷ ননদের কাছে শুনেছে সেই সব জুয়ার প্রধান উপকরণ নারী৷ তাস নয় নারীদের নিয়েই না কি খেলা হয় জুয়ো! তার মাথার ভেতর সব দুলে ওঠে ৷ অদ্ভূত চরিত্রের সব নারীরা সরীসৃপের মত কিলবিল করে ওঠে মাথার ভেতর৷ জুয়া জুয়া জুয়া, তাকে নিয়ে ও কি চলছে না এই জুয়া খেলা? জয় প্রায়ই উধাও হয়ে যায় কাওকে কিছু না বলে৷ শ্বশুরের রাগ সে টের পায়৷ শাশুড়ির অসন্তোষের ঢেউ কখনো বা আছড়ে পড়ে লুত্ফার ওপরে৷ সে বুঝতে পারে না, কি হচ্ছে চারপাশে? প্রকৃতির নিয়মে দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়৷ জয় থাকে তার নিজের মত৷ এতটুকুও পরিবর্তন নেই৷ এখন বরং তার ও সাহস বেড়েছে, আগে সে চার-পাঁচ দিনের জন্যে উধাও হত, এখন সে মাসাধিককাল ও নিরুদ্দেশ থাকে৷ তবে কোথায় সেই লুত্ফার অদেখা ভবিষ্যত? কিম্বা যা দিনের আলোর চাইতেও বেশী পরিস্কার৷ এই তো বেশ দেখতে পাচ্ছে লুত্ফা, লুত্ফার ছেলে আজ অধিকার করল বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী৷ মেয়ে বেণী দুলিয়ে কলেজে যায়৷ সকালে জয়ের অফিসে যাওয়ার সময়টুকু লুত্ফা ভীষণ ব্যস্ত৷ পেটুক জয়ের জন্যে এক একদিন এক এক রকমের জলখাবার৷ হাঁক পাড়ে জয়, লতারে, আমার শার্টের বোতামটা যে ছেঁড়া! ছুটে আসে লুত্ফা, কোন শার্টের বোতাম ছেঁড়া? দরাজ হাসে জয়, তোকে বলেছি না, আমি বেরুনোর সময় কোথাও যাবি না? অমলিন হাসিতে অপরূপা লুত্ফা একটু কপট শাসায় জয়কে, তোমায় বলেছি না তুই করে ডাকবে না আমাকে? ছেলে মেয়ে বড় হয়েছে না? জয় আবার হাসে, ছেলে মেয়ে বড় হয়েছে বলে কি তুই ও বড় হয়ে গেলি নাকি রে ? চকিত প্রশ্ন জাগে লুত্ফার মনে, এই কি সেই জয়? ভাবনাটাকে দূরে সরিয়ে লুত্ফা এবার মন দেয় চারপাশে৷ ওমা তার এত বড় বড় ছেলে মেয়ে সব ছোট হয়ে গেল কি করে? ও খোদাবক্সের মা সব উল্টো দিকে চলছে না কি? খোদা বক্সের মা ভয়ে বুজে ফেলে চোখ,ইয়া আল্লাহ!

সহ্য যখন সীমার অতীত ভরসা কেবল তিনি৷
শূণ্যদৃষ্টিতে কাটিছে প্রহর তসবীহ গণি গণি৷৷
ইচ্ছা তবু তাহার সব ছাড়ি-ছুড়ি দেশে সে পলায়৷
স্বামী সন্তানে সম্পর্কের টানে আজ সে নিরূপায়৷৷
সবই জানেন, তবুও করেন, বিধি কেবলই বাম৷
একটি জীবন বৃথাই কাটিবে কে চুকাইবে দাম৷৷
শিশির আঘাতে ক্ষেতের ফসল নষ্ট হইলে তবু৷
যে মকুব করে ঋণ, সে গরমেন, তিনিও অন্য প্রভু৷৷
তবু ইশ্বর কভু দেন নাই সাড়া, বৃথা হয়েছে ডাক৷
অগ্নিপরীক্ষাপরে সীতারে লহিতে ধরণী হয়েছে ফাঁক৷৷
মিছে কথা যত এসব তোমরা, বিশ্বাস করিও না মোটে৷
পাগলই সে, যেন যাহা রটে তাহার কিছু অন্তত বটে৷৷

লুত্ফা এখন শুধু ইশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে৷ দিনে পাঁচবারেরও বেশী নামাজ পড়ে, ফজরের পর এক বসাতেই পড়ে ওঠে এশরাক আর চাশত, সন্ধ্যের নামাজ পড়তে বসে পড়ে ওঠে আওয়াবীন৷ মধ্যরাś পেড়ে তাহাজ্জুদ৷ শুকনো মুখে বসে থাকে তসবীহ হাতে৷ লুত্ফা রাতদিন জপ করে সেই দোয়া, যা এক লক্ষ পঁচিশ হাজার বার পড়ে মাছের পেটের ভিতর থেকে নিরাপদে জীবন্ত বেরিয়ে এসেছিলেন ইউনুউস নবী, লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজ যালেমীন! এক লক্ষ পঁচিশ হাজার বার পড়তে গিয়ে কত লক্ষ বার সেই দোয়া পড়ে লুত্ফা এখন আর সেই হিসেব নিজেও রাখে না৷ শুধু পড়েই চলে৷ নি:শব্দে৷ ঠোঁটদুটোকে শুধু নড়তে দেখা যায়৷ পারতপক্ষে কারো সাথে কথা বলে না৷ শ্বশুরের প্রতি এক দুর্দমনীয় রাগ পোষন করে নিজেরই মনে৷ নিজেকে সে বিচ্ছিন্ন করে নেয় সকলের থেকে, তার জগত্ বলতে শুধুই ছেলে, মেয়ে৷ শাশুড়ি নিজের ছেলেকে গালাগাল দেন, লুত্ফার তাও সহ্য হয় না৷ তার কানে আসে, জয় নাকি মদ খায়, বিভত্স সব জুয়ো খেলে৷ জয় অন্য মেয়ের কাছে যায়, এই সম্ভাবনার কথাও তার কানে আসে৷ সে আঙুল চাপা দেয় কানে৷ আল্লাহ! শুনতে চায় না সে এসব কথা৷ ভাবতেও চায় না৷ বিশ্বাস করা তো বহুদূর৷ সব কিছুর পরেও জয়কে সে অসম্ভব ভালবাসে, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় সেই দিন অচিরেই আসবে, লুত্ফার ছেলে অধিকার করবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী৷ মেয়ে তার ঠিক তার মতনই সুন্দরী৷ লোকে বলবে এতো সেই সকলে চোখ থেকে হারিয়ে যাওয়া শ্রীহট্টের লুত্ফা সুন্দরী৷ সে যা পায়নি সব পাবে তার সেই মেয়ে৷ খেলতে খেলতে বড় হবে, মেয়ে বেণী দুলিয়ে কলেজে যাবে৷ সকালে জয়ের অফিসে যাওয়ার সময়টুকু লুত্ফা ভীষন ব্যস্ত থাকবে৷ পেটুক জয়ের জন্যে তৈরী করে দেবে এক একদিন এক এক রকমের জলখাবার৷ হাঁক পাড়বে জয়, লতারে, আমার শার্টের বোতামটা যে ছেঁড়া! ছুটে আসবে লুত্ফা, কোন শার্টের বোতাম ছেঁড়া? দরাজ হাসে জয়, তোকে বলেছি না, আমি বেরুনোর সময় কোথাও যাবি না? অমলিন হাসিতে অপরুপা লুত্ফা একটু কপট শাসায় জয়কে, তোমায় বলেছি না তুই করে ডাকবে না আমাকে? ছেলে মেয়ে বড় হয়েছে না? জয় আবার হাসে, ছেলে মেয়ে বড় হয়েছে বলে কি তুই ও বড় হয়ে গেলি নাকি রে ? চকিত প্রশ্ন জাগে লুত্ফার মনে, এই কি সেই জয়? ভাবনাটাকে দূরে সরিয়ে রাখে লুত্ফা৷ লুত্ফা বাস করে এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপে৷ নিজের চারপাশে গড়েছে এক অদৃশ্য সমুদ্র৷ সেই সমুদ্রের জলরাশি পেরিয়ে কেউ পৌছুতে পারে না তার কাছে৷ সমস্ত কিছু পেরিয়ে তাকে যেতে হবে তার সেই স্বপ্নের কাছে! কবে ? কবে? কবে? বাড়ির সকলে ভয় পায়৷ লুত্ফা কখনও হাসে কখনও কাঁদে৷ তিনতলায় কেউই যায় না খোদাবক্সের মা ছাড়া৷ সেই ঝেড়ে-ফুঁকে দেয়, বিভিন্ন রকম ওষুধ এনে খাওয়ায়৷ প্রবচন শোনায়, জয় নাকি বলেছে তাকে নিয়ে যাবে শ্রীহট্টে তাদের বাড়িতে খুব শিগগিরই৷ তবে? তবে? তবে? কত দেরী তার, আরো মন দিয়ে সে ডাকতে থাকে আল্লাহকে৷ শ্রীহট্টের সেই সুন্দরী যে এক দিন অচমকাই চলে গেল সবার অলক্ষে৷ আবার বেঁচে উঠবে সে৷ এতদিন যেন লুত্ফা নামে কোন মেয়েই এই পৃথিবীতে ছিল না৷ আসবে, আল্লাহ পাকের অসীম কৃপায় সেই মেয়েটি আবার ফিরে আসবে৷ লুত্ফা নিজেকে পুরোপুরি সমর্পণ করে ইশ্বরের পায়ে৷ রাতদিন নিরন্তর প্রার্থনা... শুধুই প্রার্থনা... আর মনে বিশ্বাস, জয় ফিরবে, একদিন জয় পুরোপুরি ফিরে আসবে তার কাছে৷ খোদাবক্সের মা, শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে এসে ফিসফিসিয়ে জানায়, জীনে ধরেছে লুত্ফাকে৷ অনিচ্ছা সত্ত্বেও ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করেন শ্বশুরমশাই, মানসিক রোগ বেশী বেড়ে গেলে এক বাড়িতে বাস করাই যাবে না, যতই হোক সে ঘরের বৌ৷

যুগে যুগে নারী হইয়াছে পাগল অযথা অত্যাচারে৷
আত্মহুতী দিয়াছে জীবন, পচে মরিয়াছে অন্ধকারে৷৷
সোনার ফসল হয়েছে ধ্বংস,আইজ যন্ত্রের জয়গানে৷
মঙ্গলকামনায় ব্রতের হদিস, কোথায় কেবা মানে৷৷
বিরূপ হাওয়ায় শুকায়েছে মাটি দেশে আসিয়াছে খরা৷
কন্যা ভ্রুণ যদি ধরিয়াছ পেটে নিয়তি তাহার মরা৷৷
বন্ধ হইবে আসিয়াছে কানুন এমত জেনেছে লোকে৷
স্বামীহারা হয়ে আজও মরে তারা বৈধব্য আর শোকে৷৷
এমত প্রতিমা বাহারি উপমা গানে কবিতায় গল্পে৷
বর্ননা তাহার থামিবেনা কভূ ছোট ভূমিকায় বা স্বল্পে৷৷
তবু ভুলিবে লোকে মজিবে না শোকে দূর হইবে না ব্যথা৷
যদি দেখা পাও এমত নারীর তুমিও লিখিও দু'এক কথা৷৷

-শেষ-


মন্তব্য

হাসান মোরশেদ এর ছবি

সেই তো চিরন্তন গল্প ।

শ্রীহট্টের লুত্ফা সুন্দরী
যেনো খুব চেনা সেই মেয়েটি ।
-----------------------------------
মানুষ এখনো বালক,এখনো কেবলি সম্ভাবনা
ফুরোয়নি তার আয়ু

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।