দুটি ঘটনা

সালাহউদদীন তপু এর ছবি
লিখেছেন সালাহউদদীন তপু [অতিথি] (তারিখ: বুধ, ২০/০৫/২০০৯ - ৭:৫৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমাদের সবার জীবনেই অসংখ্য ঘটনা আছে, কিন্তু সবগুলো ঘটনা মনে ধরে রাখা সম্ভব নয়, আর তার প্রয়োজনও নেই। কিন্তু কিছু ঘটনা আছে যেগুলো মনে গেঁথে থাকে। সুযোগ পেলেই উঁকি মারে মনের দরজায়। কখনও উৎসাহ দেয় আবার কখনও বিরক্ত করে। এর সবগুলো সুখের নয় কিংবা দুঃখের নয়, উভয়ে মিলেমিশে একাকার। কিছু ঘটনা মনে পড়লে আনমনেই হেসে উঠি আর কিছু ঘটনায় হয়ে পড়ি বিষন্ন। এদের সংখ্যাটাও নিতান্ত কম নয়, এই সুবিশাল পরিসর থেকে দুটি ঘটনা সবার সাথে ভাগাভাগি করলাম।

ঘটনা- ১

রনি আমাদের মাঝে সবচেয়ে বড় বাহাদুর। শক্তির বড়াই তার সর্বদা। দেহটাও ওরকমই বড়সড় তবে ফিট। তাই অনেক সমসয়ই নীরবে সইতে হয় তার পালোয়ানী দেহ কর্তৃক কৃত অযাচিত অত্যাচার। সেদিন এই রনিকে নিয়েই আমরা গিয়েছিলাম আমাদের ক্যাম্পাসে। মেয়েদের প্রতি তার একটু অনুরক্তি থাকায় খুব সহজেই পরিচয় হয়ে গেল কয়েকজনের সাথে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে তার মুখও ফুটে গেলো। বেশ কিছুক্ষণ এখান সেখান করে আমরা বসলাম মল চত্বরে।

কথা প্রসঙ্গে রনি শুরু করলো বিভিন্ন স্থানে তার দেখানো পালোয়ানীর গল্প। আমরাও শুনছিলাম বেশ মজা করে, তার গল্প বলার কৌশলটা সত্যিই অসাধারণ। আর নিজের গল্প সে এমনিতেও ভাল বলে। কথা বলতে বলতে হঠাৎ করেই রনির মুখের বিকৃতি লক্ষ্য করলাম। গল্পের মাঝখানে এমন মুখ বিকৃতি অপ্রত্যাশিত। তাই আমরা মুখ চাওয়া চাওয়ি করলাম, কিন্তু কোন কারণ অনুমান করতে পারলাম না। ধীরে ধীরে তার মুখ আরও বিকৃত হচ্ছিল এবং ফর্সা মুখখানা ক্রমশ লাল হয়ে যাচ্ছিল। হাত থেকে শুরু করে সারা দেহে যেন এক ধরণের নাচ দিতে শুরু করল।

আমরা কিছুই বুঝলাম না, কিছু জিজ্ঞাসা করব সে সুযোগও পেলাম না। খুব দ্রুতই ঘটে যাচ্ছিল ঘটনাটি, তার আচরণটা এমন পর্যায়ে পৌঁছাল যে আরেকটু হলেই যেন গড়াগড়ি খাবে। ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা বোকা হয়ে গেলাম। মেয়েগুলোও গল্পে এমন আকস্মিক ছেদ পড়ায় হতভম্ব হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। আমাদের স্বাভাবিক করার জন্য সে-ই আমাদের বলল- আমি আসছি। কথাটা বলেই প্রাণপনে একটা দৌড় দিল। দৌড়টা দেখে মনে হল অলিম্পিকের সোনা জেতার জন্য দৌড়াচ্ছে। আমিও তার পিছন পিছন গেলাম।

বেশ কিছুক্ষণ পর কলাভবন থেকে তাকে উদ্ধার করলাম। ধাতস্থ হতেই জিজ্ঞাসা করলাম হয়েছে টা কি? সে তখন আমাকে কোন জবাব দেয় নি- কেবল বলল, আজ আসি আরেকদিন এসে বলবো। পরে আমরা জানতে পেরেছিলাম একটা লাল পিঁপড়া তার প্যান্টের ফাঁক গলে ভিতরে ঢুকে গিয়েছিল সেদিন আর ঐ পাজিটা এমন অজায়গায় দংশন করেছিল যে মেয়েদের সামনে বসে তাকে শাসনও করা যাচ্ছিল না, তাই দিগ্বিজয়ী এই মহাবীর তার বিক্রমকে বিসর্জন দিয়ে ক্রমশ ভূপাতিত হচ্ছিল। আমরা শুনে হেসে লুটোপুটি খাই আর বলি বেচারা রনি। আর দুঃখ করি পাজি পিঁপড়া সময়ও পেলি না দংশন করার। তবে যাই হোক পরবর্তীতে রনির বাহাদুরীর কালে একবার শুধু ঘটনাটা মনে করিয়ে দিলেই কাজ হয়ে যেত।

ঘটনা- ২

আমাদের এক শিক্ষক ছিলেন যিনি ছাত্রদের মারার জন্য কোন বেত ব্যবহার করতেন না। ছাত্রদের চুল ধরে টেনে তার পিঠে গুটিকয় ঘুষি মারতেন ধপাধপ করে। তার মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের ঘুষির চেয়েও চুল টেনে ধরাটা অধিক ভয়ানক ছিল, কারণ এত জোরে চুল ধরে টানতেন যে মনে হচ্ছে মাথার ঘিলু ধরে টানছেন। তবে এমন ছাত্র আমাদের স্কুলে খুঁজে পাওয়া ভার যে কিনা একবারও তার হাতের চুল টানার অভিজ্ঞতা অর্জন করে নি। তাই ফার্স্টবয় থেকে শুরু করে লাস্ট বয় সবাই তটস্থ থাকতো কখন স্যার উত্তেজিত হয়ে তেড়ে আসেন চুলের মুঠি ধরার জন্য এই ভয়ে।

আমরা যখন নাইনে পড়ি তখন আমাদের ক্লাশে অন্য স্কুলে থেকে একটি নতুন ছেলে ভর্তি হল। ছাত্র হিসেবে খুব বেশি ভাল না হওয়ায় টানা দুদিন স্যারের হাতে চুল টানা ট্রিটমেন্ট পেয়ে সে নতুন একটা বুদ্ধি বের করে ফেললো। পরদিন যখন সে ক্লাশে আসলো, তখন দেখা গেল তার মাথা ন্যাড়া, ফলে স্যার তার চুল ধরে টানার সুযোগ পাবে না। আমরাও আশ্চর্য হলাম, সত্যিই তো বেশ কার্যকরী বুদ্ধি। আর আফসোস করলাম এই বুদ্ধি তো আমাদের মাথায় আগে কখনো আসে নি।

যাই হোক, সেদিন স্যার যথারীতি ক্লাশে আসলেন, সেই নবাগত ছেলেটিকে প্রশ্ন করলেন এবং যথারীতি সে সঠিক উত্তর দিতে ব্যর্থ হলো। স্যার তার অভ্যাসবশত মাথায় খপ করে হাত বসিয়ে দিলেন। তার মাথাটা ধরতে পারলেও চুল ধরতে পারলেন না। শূণ্য মুঠি নিয়ে তার হাতখানা ফিরে এল তার দিকেই। সাথে সাথে সমস্ত ক্লাশজুড়ে একটা হাসির রোল পড়ে গেল। ঘটনার আকস্মিকতায় স্যার থতমত খেয়ে গেলেন। কিন্তু চিরাচরিত শাস্তিটুকু দিতে না পারার ক্ষোভটা তার রাগে পরিণত হলো। তিনি পিছন ফিরে টেবিল থেকে কাঠের শক্ত ডাস্টারটি হাতে নিয়ে তার মাথায় প্রবল বেগে আঘাত করেন।

নিমেষেই ক্লাশরুম শ্মশানের মত নীরব হয়ে যায়। অত্যাশ্চর্যের স্তব্ধতা নিয়ে সবাই তাকিয়ে থাকে স্যার এবং ছেলেটির দিকে। কারো মুখে কোন কথা জুটে না। কয়েক মুহূর্ত নীরব চোখে তাকিয়ে থেকে স্যার কোন কথা না বলেই ক্লাশ থেকে চলে যান। ছেলেটিও তাঁর পিছু পিছু বেরিয়ে যায় চোখ মুছতে মুছতে। পরদিন থেকে স্যার আর কারো চুলে ধরে মারেন নি, আর ছেলেটিকেও কোনদিন স্কুলে আসতে দেখি নি।


মন্তব্য

নিবিড় এর ছবি

প্রথমটায় মজা পেলাম হাসি
কিন্তু শেষের কাহিনি টা পড়ে খারাপ লাগল। আসলে এইভাবে কত ছেলে মেয়েদের যে স্কুল ভীতি জন্মে যায় কে জানে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় আসলেই এইটা খুব খারাপ একটা প্র্যাক্টিস।


মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

০১
অতএব "হাতি ঘোড়া গেলো তল, পিঁপড়া বলে কতো জল" প্রবাদখানি মিথ্যা প্রতীয়মান হইলো। দেঁতো হাসি

০২
এই ব্যাপারগুলো অস্বাভাবিক এবং অবিশ্বাস্য লাগে আমার। মন খারাপ

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

সালাহউদদীন তপু এর ছবি

১.
পিঁপড়া তো সব সময়ই হাতির চেয়ে অধিক শক্তিশালী, মনে নেই ছোটবেলায় পড়া হাতি আর পিঁপড়ার গল্পটি?

২.
অস্বাভাবিক কিংবা অবিশ্বাস্য যাই মনে হোক সত্যকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না কখনও।

মন্তব্য প্রদানের জন্য ধন্যবাদ ।

অতিথি লেখক এর ছবি

আমি ভেবেছিলাম........টয়লেট চেপেছে ...
এখন দেখি পিঁপড়া কাহিনী...

সব স্কুলেই এমন একজন শিক্ষক (!)থাকেন...

( জয়িতা )

ধুসর গোধূলি এর ছবি
সালাহউদদীন তপু এর ছবি

আসলে ঐ ছেলেটি আমাদের স্কুল ছেড়ে তখন অন্য স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। স্যার ছেলেটির কথা সরাসরি আমাদের জিজ্ঞাসা না করলেও ছেলেটির প্রতি কৃত আচরণের জন্য স্যারের অনুশোচনা আমরা তার আচরণে দেখতে পেয়েছি।

ফারহানা [অতিথি] এর ছবি

আমরা কি জীবন যাপন করি নাকি প্রথা যাপন করি????????

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

প্রথমটা মজা লাগল।
দ্বিতীয়টা পড়ে বেশ খারাপ লাগল। এই ধরনের ঘটনা একদমই অনাকাঙ্খিত।

ভাল লাগল পোস্টটা। লিখুন আরো।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।