নারীর সৌন্দর্য: প্রাকৃতিক নাকি মনস্তাত্ত্বিক

সালাহউদদীন তপু এর ছবি
লিখেছেন সালাহউদদীন তপু [অতিথি] (তারিখ: শুক্র, ০২/১০/২০০৯ - ৮:৫১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

নারী হচ্ছে সুন্দরের উপমা। তাই সুন্দরের কথা এলেই চলে আসে নারীর কথা। পৃথিবীর সকল প্রাণীর পুরুষ প্রজাতি সুন্দর হলেও মানুষের ক্ষেত্রে কেন পুরুষের চেয়ে সুন্দরের বিচারে নারীরা এগিয়ে থাকে সে দ্বিধা আমার কাটে নি কখনো। প্রথমে মনে হত সৃষ্টির ক্ষেত্রে মানুষকে ব্যতিক্রম, সর্বোৎকৃষ্ট এবং একমাত্র বিবেক সম্পন্ন করে সৃষ্টি করা হয়েছে বলেই বোধ হয় তার সৌন্দর্যও অন্যান্য প্রাণী হতে ভিন্ন প্রজাতিতে দেয়া হয়েছে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় আমার চিন্তাভাবনা গুলিয়ে যেতে শুরু করে। আমি জানতে পারি, সার্বিক বিবেচনায় নারী সুন্দর নয়, আমি পুরুষ বলে আমার চোখে নারীরা সুন্দর। আর এই সমাজ পুরুষতান্ত্রিক তাই তার চোখে নারী সুন্দর। নারীদের এই সৌন্দর্য যতটা বাস্তবিক বা প্রাকৃতিক তার চেয়ে বেশি আকাঙ্ক্ষিত বা গড়ে তোলা।

আরেকটু খোলাসা করে বলি, সৌন্দর্য ভাবনা বিকশিত হয় দর্শন, সাহিত্য এবং চিত্রকলার মাধ্যমে। যুগ যুগ ধরে বিকাশমান এই প্রতিটি ধারায় পুরুষের ছিল একচ্ছত্র আধিপত্য। তাই পুরুষতান্ত্রিক চোখের প্রাকৃতিক নিয়মে নারীর আকাঙ্ক্ষিত সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে সেখানে প্রতি স্থানে স্থানে। আমি জানলাম আসলে নারী সুন্দর নয়, তাকে সুন্দর করে গড়ে তোলা হয়েছে। কারণ পুরুষ সুন্দর নারী প্রত্যাশা করে। পুরুষের নারীকে সুন্দর করে গড়ে তোলার এই বাসনাটা প্রাকৃতিক, কিন্তু যেভাবে তাকে গড়ে তোলা হয়েছে তা মনস্তাত্ত্বিক। বর্তমান সময়ে এই সত্য আরও অনেক প্রকটভাবে প্রকাশিত হয়েছে। প্রযুক্তির অভূতপূর্ব বিস্তৃতির ফলে মানুষ বিনোদনের নতুন উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে নারীর সৌন্দর্য। আর তাকে নানাবিধ উপকরণ ব্যবহার করে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে। ব্যবধানটা বাসনায় হয় নি, হয়েছে প্রকাশে।

আমি এই ব্যাখ্যায় পরিপূর্ণ তৃপ্তি লাভ করতে পারি নি, তাই জানার আগ্রহটা একেবারে মরে যায় নি। পড়াশোনার অভ্যাস আমার নিতান্তই কম থাকায় আমি এ ব্যাপারে তাত্ত্বিক কোন জ্ঞান লাভে সক্ষম হই নি। কিন্তু আমার বন্ধুমহলে বিভিন্নজনের কাছে প্রশ্ন করে আমি এর ব্যাখ্যা যোগাড় করতে চেয়েছিলাম। মনঃপূত ব্যাখ্যা দিতে পারে নি কেউ। তবে একটি নতুন ধারণা পেলাম যা আমাকে মোটামুটি একটি কারণের ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম হয়েছে কেন নারীরাই সুন্দর, পুরুষেরা নয়। ধারণাটি এরকম, নারীরা সুন্দর নয়-তারা আকর্ষণীয় অথবা আবেদনময়ী। সাদা চোখে সুন্দর আর আবেদনময়ীর পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমাদের চোখ সাদা, তাই যে মেয়ে যত আবেদনময়ী আমরা তাকে তত সুন্দর বলি। আসলে সৌন্দর্য আর আবেদনের পার্থক্যটা আমরা তখন গুলিয়ে ফেলি। আমার সেই বন্ধুর মত অনুসারে সৌন্দর্যের জন্য নারীর মুখাপেক্ষী হবার কোন প্রয়োজন নেই। কেননা, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য তার নৈসর্গে। তার প্রকৃতি, আকাশ, পাহাড়, নদী, সমুদ্র, ঝরণা সব মিলিয়ে অফুরন্ত তার সৌন্দর্য ভাণ্ডার। তাই যে প্রকৃতার্থে সৌন্দর্যের অনুসন্ধানী সে নারীকে সুন্দররূপে দেখবে না। নারীকে দেখবে সৌন্দর্যের ক্ষুদ্র একটা উপকরণ হিসেবে, যেখানে নারীর চেয়ে পুরুষ তার সুঠাম দেহ নিয়ে অনেক ধাপ এগিয়ে আছে।

আমার এই বন্ধুটির মতে সৌন্দর্যে তৃপ্তি থাকবে কিন্তু আকর্ষণ থাকবে না। উল্টোদিকে যার আকর্ষণ দুর্নিবার, কিন্তু তৃপ্তি সেই তুলনায় অপ্রতুল তাকে আমরা বলব আকর্ষণীয়। নারীতে আকর্ষণ আছে কিন্তু তৃপ্তি নেই। তাই নারীকে সুন্দর না বলে আকর্ষণীয়, সহজ ভাষায় আবেদনময়ী বলাই যুক্তিযুক্ত। আমি তার এই কথা মেনে নেই বটে কিন্তু এই বলে বিরোধীতা করলাম যে মানুষ আর প্রকৃতিকে এক চোখে দেখলে উপমা সঠিক হয় না। তখন সে আমায় বললো-সুন্দর হলো শিশুরা যাদেরকে দেখে আমাদের মনে তৃপ্তি আসে কিন্তু আমরা তাদের ব্যবহারের জন্য আকর্ষিত হই না। নারীরা সুন্দর নয়, কারণ আমরা তাদের ব্যবহার করার জন্য শুধু আকর্ষিত নয়, উন্মাদ হয়ে যাই।

আরও সহজ করে বোঝানোর জন্য সে আমায় যা বললো তার সারমর্ম এই, সৌন্দর্য হলো একটি সার্বজনীন ব্যাপার। যদিও তার কোন সার্বজনীন সজ্ঞা নেই, তবু তার গ্রহণযোগ্যতা সর্বক্ষেত্রে প্রায় সমান। এখানে শিশুর উদাহরণটিকে আরো একবার টেনে আনা যায়। নারীর ক্ষেত্রে সার্বজনীনতার এই সূত্র খাটে না। কারণ, যুবক অবস্থায় নারীকে যতটা সুন্দর বলে মনে হয়, জীবনের অন্য কোন অংশে তাকে এতটা সুন্দর বলে মনে হয় না। এর একমাত্র কারণ ঐ সময়টাতে নারীকে মানুষের মন সবচেয়ে সুন্দরভাবে আকাঙ্ক্ষা করে এবং তাকে পাবার বাসনা তার মনে উগ্রভাবে বাস করে। তাই সেই চোখে প্রলেপ হিসেবে নারী উপস্থাপিত হয় সর্বাপেক্ষা সুন্দর হিসেবে। কারণ ঐ চোখে নারীর আবেদনটি সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয়। তার এই যুক্তিটিকে আমি অবজ্ঞা করতে পারি নি। ফলে আমিও স্বীকার করে নিয়েছি আসলে নারী সুন্দর নয়, আকর্ষণীয় অথবা আবেদনময়ী। এবং এই আবেদন প্রাকৃতিকভাবেই মানসিক।

আমার এই লেখার মানে নারীর সৌন্দর্যকে খাটো করে দেখা কিংবা এককভাবে অস্বীকার করা নয়, তবে অধিকাংশ উপস্থাপনায় নারীর সৌন্দর্যের কারণ অনুধাবন করা। প্রত্যেক মা-ই নারী কিন্তু কোন মা-ই অসুন্দর নয়, তার মানে এই নয় মায়েরা সন্তানের কাছে আবেদনময়ী। কিন্তু সে তখন মাকে নারী হিসেবে দেখে না, দেখে মা হিসেবে, তাই তার রূপ বদলে যায়। যেমন বলেছি শিশুর কথা- শিশুর মধ্যেও নারী আছে কিন্তু সেখানে সেই ভাগ না করাটাই শ্রেয়।

আমি আবারও বলছি আমার এই লেখাটি কোন তত্ত্ব নয়, নিছক আমার ব্যাক্তিগত অভিমত। কুপমণ্ডুকের এই বিশ্বভ্রমণের ইতিহাস লেখার ধৃষ্টতা অবশ্যই মার্জনীয়।


মন্তব্য

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

প্রকৃতিতে কিন্তু উল্টোটা সত্যি। যেমন ধরুন পাখিদের মধ্যে পুরুষরাই সুন্দর। তাদের দৈহিক সৌন্দর্য তুলনামুলক ভাবে বেশী। তারা ডাকতে পারে মিষ্টি সুরে, যে ডাক শুনেই স্ত্রী পাখীরা কাছে আসে। একই ঘটনা স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যেও। মাছদের মধ্যে কেমন তা জানিনা অবশ্য।


নারী সুন্দর নয়, আকর্ষণীয় অথবা আবেদনময়ী। এবং এই আবেদন প্রাকৃতিকভাবেই মানসিক।
জেনারেলাইজড ধারনা যা সবার বেলাতেই প্রয়োগ করা যায়।

ভালো লেখা। চলুক

সালাহউদদীন তপু এর ছবি

ধন্যবাদ।

রেনেসাঁ [অতিথি] এর ছবি

চলুক

মাহবুব লীলেন এর ছবি

যারা চোখে দেখে না তাদের মধ্যে এই বিষয়টা কীভাবে কাজ করে বলেন তো?

তারাও নাকি সুন্দর অসুন্দর বোঝে?

সবজান্তা এর ছবি

কী তামশা! আগেই আন্দাজ করসিলাম এই লেখায় লীলেন ভাই কমেন্ট করবে দেঁতো হাসি


অলমিতি বিস্তারেণ

সালাহউদদীন তপু এর ছবি

আমি চিরন্তন সুন্দর কিংবা অসুন্দরের কথা বলি নি, আমি বলেছি নারীকে কেন সৌন্দর্যের উপমা হিসেবে ধরা হয় সে কথা। যারা চোখে দেখে না তাদের অনুভূতি কি দ্বারা পরিচালিত হয়, তা আমি জানি না। তবে তারাও পুরুষশাসিত সমাজেরই অংশ, ফলে তাদের মানসিকতার একটা বড় অংশে তার প্রভাব থাকবে এটা খুব স্বাভাবিক।

আপনাকে ধন্যবাদ।

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালোই বলেছেন। ভালো লাগলো লেখাটা পড়ে।

ধন্যবাদ।
দলছুট।

সালাহউদদীন তপু এর ছবি

আপনাদের ভাল লাগাই আমার প্রাপ্তি, অনুপ্রেরণা তো বটেই।

ধন্যবাদ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।