বুড়োর সাথে কথোপকথনঃ ২ ( শেষ পর্ব)

সবজান্তা এর ছবি
লিখেছেন সবজান্তা (তারিখ: রবি, ০৮/০৬/২০০৮ - ১১:১২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

(পূর্ব প্রকাশের পর)


--------------------------------------------------------------

উত্তরটা শুনে আমি খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। মুখে আর কোন কথা আসছিলো না। এদিকে আস্তে আস্তে আমার ভয় খানিকটা কমে শুরু করেছে, মাথাও আস্তে আস্তে পরিষ্কার হচ্ছে। যেহেতু আমার রুমের দরজা জানালা সব কিছু ঠিক ঠাক আছে, আর ভদ্রলোকও সত্যিকার অর্থে নিদারুন বুড়ো, কাজেই তাঁকে চোর ডাকাত ভাবাটা বাদ দেওয়া যেতে পারে। কাজেই এই ঘটনার একটাই গ্রহনযোগ্য ব্যাখ্যা হতে পারে - আমার হ্যালুসিনেশন হচ্ছে। সেটা অবশ্য অস্বাভাবিক না - আমি শুনেছিলাম মানুষের বদহজম থেকে দুঃস্বপ্ন কিংবা হ্যালুসিনেশন হতে পারে মানুষের। আজ সন্ধ্যায় যে পিঁয়াজু, ছোলা এগুলি খেয়েছিলাম ওগুলি থেকেই হয়ত হচ্ছে। হঠাৎ চমক ভাংগলো বুড়ো ভদ্রলোকের কন্ঠস্বরে, আমার টেবিলের কোনায় রাখা সিগারেটের প্যাকেটের দিকে আঙ্গুল তুলে বলছেন,

“তুমি সিগারেট খাও, তাই না ? ”

আমি মিনেমিনে গলায় হ্যা উত্তর দিতেই বললেন,

“এখন বুঝবে না, আজ থেকে ১৫ -২০ বছর পর যখন কাঁধের ব্যাথায় ভুগবে, তখন কপাল চাপড়াবে এই অভ্যাসের জন্য।”

উত্তরে কি বলবো ভাবছি আমি, আর এদিকে বুড়ো দেখি রীতিমত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমার ঘরের সবকিছু দেখছে। কিছুক্ষণ পরে আবার আমার দিকে মুখটাকে ঘুরিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলা শুরু করলো,

“ তোমার ঘরে বেশ বইপত্র দেখছি, এগুলো তুমি পড়ো ? ”

আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে, নিজের মনেই বলা শুরু করলেন,

“ বই পড়া ভালো, কিন্তু কি হবে বই পড়ে ? জীবনে এগুলি কোন কাজে আসে না। এইসব ফালতু গল্পের বই পড়ে সময় নষ্ট করার কোন মানে নেই, এর চেয়ে বরং এইগুলি মন দিয়ে পড়ো ”

বলে বুড়ো আঙ্গুল তাক করলেন সেলফের দ্বিতীয় তাকে, যেখানে আমার জি আর ই , সি সি এন এ র বইগুলি রাখা। খানিকটা বিস্মিত হলাম - এই ঘাটের মড়া বুড়ো, সে দেখি জি আর ই , সি সি এন এ ও চিনে, স্মার্ট বুড়ো স্বীকার করতেই হবে।
আমি বললাম, “ দাদু, সবই তো বুঝলাম ... ”,

আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই বুড়ো খ্যাঁকখ্যাঁক করে উঠলো,

“দাদু কে! দাদু বলছো কাকে ! আমি তোমার দাদু ফাদু না, আমার নাতি আছে, আমি শুধু তাদেরই দাদু। খবরদার আমাকে আর দাদু বলবে না”।

আচমকা এরকম ঝাড়ি খেয়ে আরেক দফা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম, মিনমিন করে জিজ্ঞেস করলাম,

“তাহলে আপনাকে কি বলে ডাকবো ? ” ।

একরাশ বিরক্তির সাথে উত্তর আসলো,

“কেন, বললাম না, আমাকে বুড়ো বলে ডাকতে”।

“শুধু বুড়ো?” ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করি আমি।

বুড়ো আবার খ্যাঁক করে উঠলো,

“বুড়ো নামটায় সমস্যা কি? বুড়ো বলে কি পঁচে গেছি নাকি যে এ নামে ডাকা যাবে না ? ”

আর কোন কথা বাড়াই না আমি। খানিকক্ষণের নীরবতা, তারপর আবার বুড়ো মুখ খুললো,

“প্রেম করো?”

জোরে জোরে উপরে নীচে মাথা ঝাঁকাই আমি। বুড়োর মেজাজ যেন খানিকটা ভালো হল, নিজের মনেই বলতে লাগলো,

“ভালো, প্রেম করা ভালো, সময় ভালো কাটে। কিন্তু কি লাভ বলো? মানুষ সবসময়ই একা। যতই দলবল বেঁধে থাকার চেষ্টা করো না কেন, একাকীত্ব তোমাকে ছাড়বে না। ”

খানিকটা সময় চুপ থেকেয়াবার শুরু করলো বুড়ো,

“ কি হতে চাও বড় হয়ে ? ”

বীরদর্পে উত্তর জানালাম, আমি এরই মধ্যে যথেষ্ট বড় হয়ে গিয়েছি, আর আমি জীবনে কি হবো, তাও আগেই ঠিক হয়ে গিয়েছে - ইঞ্জিনিয়ার হওয়া ছাড়া আমার আর কোন রাস্তা নেই। চেঁচিয়ে উঠলো বুড়ো,

“তুমি নিজেকে কি ভাবো? বিরাট পন্ডিত কিছু ? তোমার কি ধারণা তোমার সম্পর্কে না জেনে আমি এখানে এসেছি ? আমি জানতে চাইছি, পাশ করে কি করবে, চাকরি নাকি অন্য কিছু ? ”

একটু ঢোক গিলে, গরগর করে বলতে শুরু করলাম আমি আমার জীবনের প্ল্যান, কিভাবে পাশ করার পর বিদেশে এম এস সি, পি এইচ ডি করবো, কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাকি জীবনটা রিসার্চ করে পার করে দিবো ইত্যাদি ইত্যাদি।

সবটা শুনে বুড়ো মুচকি হেসে বললো,

“ ভালো, স্বপ্ন দেখা ভালো”

এরপর কিছুটা উদাস হয়ে গিয়ে আরো যোগ করলেন,

" কিন্তু যদি এরকম কিছু না করতে পারো, মন খারাপ করো না, এক জীবনে সবার সব কিছু হয়না। এটুকু জানবে, এই সামর্থ্য তোমার ছিলো, শুধু মাত্র পরিস্থিতির কারণেই হয়তো পারলে না” ।

হঠাৎ করেই আমার মনে হলো, এই বুড়োর কন্ঠস্বরটা বেশ পরিচিত ঠেকছে আমার কাছে। অনেক চেষ্টা করলাম মনে করার, কোথায় শুনেছি এই গলা - কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারলাম না। এদিকে বুড়ো দেখি বেশ উসখুস করা শুরু করে দিয়েছে জানালার দিকে তাকিয়ে। বার বার বলতে লাগলেন, আমার যাওয়ার সময় হয়ে এলো।

তারপর আচমকা আমার দিকে ফিরে বলা শুরু করলেন,

“ তোমাকে একটা কথা বলি, ভয় পেয়ো না। আমি কিছুক্ষণ আগেই মারা গিয়েছি। যতদিন বেঁচে ছিলাম তুমি ছিলে আমার সবচেয়ে পছন্দের মানুষ। তাই একেবারে চলে যাওয়ার আগে তোমার সাথে একটু দেখা করতে আসলাম। তোমাকে যেই কথাগুলি বললাম সেগুলো একটু মনে রেখো। তোমার ভালোর জন্যই বলা ... ... আচ্ছা আমি এখন যাই, ভালো থেকো।”


-------------------------------------------------------------------------
বুড়ো চেয়ার থেকে উঠে বারান্দার দিকে হেঁটে যাচ্ছে। এ কি ! বুড়ো দেখি অবিকল আমার মত খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটছে, সাথে সাথে বুঝে গেলাম, এ গলার স্বর আমি কোথায় শুনেছি। আর কিছু ভেবে উঠবার আগেই, আমি জ্ঞান হারালাম।


মন্তব্য

রেনেট এর ছবি

গল্পের থিম ভাল লাগল। তবে সিরিজ গল্প দেখে গল্প আরো লম্বা হবে আশা করেছিলাম।
চলুক
-----------------------------------------------------
We cannot change the cards we are dealt, just how we play the hand.

---------------------------------------------------------------------------
একা একা লাগে

ধুসর গোধূলি এর ছবি
সবজান্তা এর ছবি

ধূগো ভাই, দুঃখ কইরেন না। বুড়াই তো, কোন সুন্দরি মেয়ে কিংবা কারো শালী তো না চোখ টিপি


অলমিতি বিস্তারেণ

সবজান্তা এর ছবি

ধন্যবাদ রেনেট ভাই। গল্পটা নিয়ে আমার মত যতবার চেঞ্জ হয়েছে সেটা নিয়েই একটা বই লিখে ফেলা যাবে চোখ টিপি

আমি গল্পটা ইচ্ছা করেই কিছুটা ছোট করেছি, এবং তাড়াহুড়া করে শেষ করেছি। পরীক্ষার পর লিখলে হয়ত অন্যরকম করে লিখতে পারতাম - কিন্তু নিজেকে যতদূর চিনি , কোন কাজ ২ সপ্তাহের বেশি ফেলে রাখলে সে কাজ আর আমার করা হয়ে ওঠে না। দেখি , হয়ত সামনে কোন একসময় গল্পের অন্যান্য সমাপ্তিগুলি নিয়েও গল্পটা অন্যভাবে লেখা যাবে।


অলমিতি বিস্তারেণ

আসিফ মোহাম্মদ আদনান এর ছবি

ভাইরে শুধু জিআরই, সিসিএনএ পড়লেই কি জীবনে সব কাজে লাগানো যায়রে? বাংলাদেশ প্রযুক্তি এবং প্রকৌশল (কারিগরী, কৃষি কিংবা জীববিজ্ঞান)গত দিক দিয়ে পিছিয়ে আছে। বুড়াকে দিয়ে ঐসব কিছুর উন্নতির একটা দিক নির্দেশনা দিয়ে দিতে পারলেন না?
যাই হোক শুভ কামনা।

সবজান্তা এর ছবি

অ্যাঁ


অলমিতি বিস্তারেণ

স্পর্শ এর ছবি

ভাল লাগলো!
[][][][][][][][][][][][][][][][][][]
ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ, কোরো না পাখা।


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

এনকিদু এর ছবি

২ সিরিজে গল্প শেষ করার ছোঁয়াচে রোগে ধরেছে । প্রথমে রায়হান আবীর, তারপর সবজান্তা । ভাল হয়ে যাও , ভাল হইতে পয়সা লাগে না । ভাল হয়ে লম্বা লম্বা সিরিজ লিখ, হাম্বা হাম্বা করে মন্তব্য দিব ।


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

সবজান্তা এর ছবি

রাইয়ান, গল্পটা অল্পের জন্য মরার হাত থেকে বেঁচেছে। গল্পটা আর কখনোই লেখা হতো না, যদি না আজ সকালে বৃষ্টি না হত। প্ল্যান ছিলো হলে যাবো আড্ডা মারতে, বৃষ্টির জন্য ভাবলাম গল্পটা শেষ করেই ফেলি।

আমার থেকে লম্বা সিরিজ আশা করাটা উচ্চমাত্রার দুরাশা।


অলমিতি বিস্তারেণ

খেকশিয়াল এর ছবি

আমার পড়া সবজান্তার সেরা একটা গল্প, বিপ্লবী পাঁচ তারা ।

-----------------------------------------
রাজামশাই বলে উঠলেন, 'পক্ষীরাজ যদি হবে, তা হলে ন্যাজ নেই কেন?'

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

সবজান্তা এর ছবি

অ্যাঁ ! কঙ্কি !!


অলমিতি বিস্তারেণ

অচেনা কেউ এর ছবি

ভালই তো লাগল তোমার গপ্পো পইড়া, বুড়া ভুল কইছে পেরেম করা সবসময় ভাল না।যাই হোক তোমার জ্ঞান ফিরছিল কেমতে হেইডা মনে প্রশ্ন রইয়া গেল।আমি তো মনে করছিলাম বুড়ায় বুঝি তোমারে লইয়া যাইতে আইছে কুনুহানে।

ভাল থেকো।সব ভাল কিছুর জন্য শুভকামনা রইল।

আর মনে মনে পাঁচ দিলাম তোমাকে।

সবজান্তা এর ছবি

আপনি কি আমি যাকে ভাবছি সেই ?


অলমিতি বিস্তারেণ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।