প্রতীক্ষা ও প্রস্তুতি (গুচ্ছগল্প)

স্পর্শ এর ছবি
লিখেছেন স্পর্শ (তারিখ: শুক্র, ০৪/০৪/২০০৮ - ৬:৫৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১. নৃশংস শিল্পী
অনভ্যস্ত হাতে টানা রেখাগুলো কেমন যেন কেঁপে যায় বার বার। এমনিতে মোহিনী নারী অথবা অস্তাচলের দৃশ্য আঁকে সে। কখনোবা আঁকে ধোয়াশা আর ইট-কংক্রিটে ঘেরা শহুরে রাস্তা আর জনবহুল স্টিমার ঘাট। কিন্তু শহুরে কাক; কখনোই না। এক মনে আঁকার চেষ্টা চলতে থাকে তার। আঁকতে হবে অনেক কিছু- শহুরে কাক, অনাহারী মানুষ, বস্তি, ডাস্টবিন আর রাস্তার সেই সব দেশী কুকুরদের যারা হঠাৎ করেই তাদের চিরচেনা ডাস্টবীনে আবিষ্কার করেছে নতুন এক প্রতিদ্বন্দীর! হয়তো শীর্ন মৃতদেহ আর শকুনীদেরও আঁকতে হবে।

এসব ভাবতে ভাবতেই প্রথম শকুন দেখার স্মৃতি মনে পড়ে ছেলেটার। খুব ছোট বেলায় বাবার পাশে বসে যাচ্ছে নানাবাড়ী। ভ্যান চলছে একটা সদ্য তোলা বেড়ীবাঁধের উপর দিয়ে। বাঁধের দুধারে শুকনো ফসলের ক্ষেত। ধান কাটা হয়ে গেছে। ফাটা ফাটা মাটির মধ্য শুকনো ধানের গোড়াগুলো সব সার বেধে দাঁড়িয়ে আছে, যেন কুচকাওয়াজের অপেক্ষায়। বাঁধের এক পাশে মাঠ অনেকটা পেরুলে একটা শুকনো নদী। বাবা বলে, বর্ষাকালে এই নদীই নাকি ভয়াল বন্যায় ভাসিয়ে দেয় সব কিছু! এই যে উচু রাস্তাটা দেখছো এটা আসলে বাঁধ। বানের পানি গ্রামে যেতে বাধা দেবার ব্যবস্থা। তারপর ছেলেটা সেই শুকনো নদীর ধারে কি যেন দেখে অবাক হয়ে। তার কাছে মনে হয় বহু দূরে এক দল অজানা প্রানী উবু হয়ে বসে আছে। এত দূর থেকে দেখায় বড় বড় খয়েরী বিন্দুর মত। বাবা বলে ওগুলো শকুন। গ্রামের মানুষ মরা গরু ছাগল নদীতে ফেলে আসে তো। ওরা আসে সেগুলো খাবার জন্য! ঘেন্না লাগে ছেলেটার। বাবা আরো বলে ওদের চোখের দৃষ্টির কথা। তিন চার মাইল দূরেও নাকি পরিষ্কার দেখতে পায় সব! এই যে তার পায়ের লাল জুতা সেটাও দেখতে পাবে ওরা। এসব শুনে মা কেমন যেন বিচলিত হয়ে ওঠে। হাত ব্যাগ থেকে একটা কাজল দানি বের করে ছেলেটার কপালে বড় করে একটা টিপ দিয়ে দেয়। কাজলে টিপ ভাল লাগেনা ছেলেটার। টিপ তো দেয় মেয়েরা। আর সে তো এত বড় একটা ছেলে। মা যে কেন বোঝেনা!!

এসব ভেবে মৃদু হাসির রেখা দেখা দেয় তার মুখে। ফিকে হয়ে আসা স্মৃতি সব! তার পর যতবার নানাবাড়ী গেছে, সেই বাঁধের কাছে শকুন দেখে সে। প্রতিবার আগের চেয়ে অনেক কম। তার পর একসময় হারিয়ে যায় তারা। এ নিয়ে বাবার আক্ষেপ দেখে সে বলে, শকুনের মত পঁচা প্রানী তো না থাকাই ভাল। উত্তরে বাবা তাকে বোঝায় প্রানী বৈচিত্রের কথা। আর নাম নাজানা আরো অনেক দেশী প্রানীর গল্প। যারা হারিয়ে গেছে সব। ছেলেটাও বিষন্ন হয় কিছুটা।

তবে এখন সে জানে শকুনও আঁকতে হবে তাকে। প্রকৃতিই ফিরিয়ে আনবে হারিয়ে যাওয়া শকুনীদের। খরা, বন্যা, ঝড় আর অকাল বৃষ্টি দিয়ে যে মর্মান্তিক চলৎচ্চিত্র সুচনা করেছে প্রকৃতি। তাতে একমাত্র সুখী চরিত্র তো ওরাই। অসহায় বোধ করে সে। গ্রাফাইট আর কাগজে ঘর্ষণ চলতেই থাকে আরো জোরে জোরে। হাতের চাপ বাড়তে থাকে ছেলেটার। নিজের অক্ষমতার কারণে আজ যে হতে চলেছে এক নৃশংস শিল্পী।

২. খয়েরী বিন্দু
ঠিক কবে ঢাকা শহরে এসেছে মনে নেই নসু মিয়ার। তবে তার জন্ম যে এখানে না, সেটা সে বুঝতে পারে স্মৃতি হাতড়ে পাতড়ে। কখনো কখনো মনে হয় ওসব হয়তো স্মৃতিই না। অলিক কোন স্বপ্ন হবে বড়জোর। চারিদিকে সবুজ তার মধ্যে একটা কিশোর বটের ঝুরি ধরে ঝুল দিয়ে ঝাপিয়ে পড়ছে পানিতে। পানিটা নদীর নাকি কোন দিঘীর মনে করতে পারেনা সে। তবে কিশোরটা যে সে নিজে, সেটা মনে করতে পারে। আজকাল সবই কেমন যেন ঘোলাটে মনে হয় তার। তার চোখের দৃষ্টির চেয়েও ঘোলাটে!

তার সবচেয়ে ছোট ছেলেটাও মারা গেছে বছর পাচেক হবে। এখন সে পড়েছে তার নাতনীর ঘাড়ে। এই যে সাথে ভুলি তাকে নানা নানা করে ডাকছে কিছুক্ষন পর পর। আসলে সে তার নাতনী না, নাতনীর মেয়ে। নানার বাপ কে কী বলে ডাকবে সেসব ওই ছোট্ট মাথায় ঢুকেনি বলেই তাকেও নানা বলেই ডাকে সে। আজকাল নিজের বয়স নিয়ে খুবই লজ্জিত নসু মিয়া। তার সাথে আর যারা এসেছিল ঢাকায়। সবাই কেমন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়তে লড়তে হেরেই গেল কবে। তাকে কখনই সেই পাঞ্জা লড়তে হয়নি। শুধু ক্ষুধার সাথেই লড়ে গেছে সারা জীবন। এই যে যেমন এখন। বসে আছে ধানমন্ডি ক্লাব মাঠে। বি ডি আর এর ‘ন্যায্য মূল্যের’ দোকানে। দোকানের সামনে বিশাল লাইন। সকালে সেও ছিল লাইনের শেষ মাথায়। তখনো দোকান খোলেনি। সাথে টাকা ছিল না। ভুলির বাপের কথা ছিল পরে টাকা নিয়ে আসার। ততক্ষনে নসুমিয়া আর ভুলি লাইনে কিছুটা এগিয়ে যাবার কথা। আগেও ৩ দিন এভাবে চাল কিনেছে তারা। তবে আজ লাইনর একেবারে সামনে কাউন্টারে পৌছানোর পর বিডিয়ার এর জওয়ান যখন তার কাছে টাকা চাইলো তখন খুবই লজ্জা পেয়ে গেল সে। জওয়ান খেকিয়ে উঠে, ভিক্কা চাইতে হয় সামনের রাস্তায় যাও, হুদাই ঝামেলা কইরোনা! সামনের জ্যামে আটকানো মিরপুর রোড দেখিয়ে দেয় সে। নসুমিয়া অভাবী মানুষ। তাই বলে ভিক্ষা করবে!!! নিজের হাতেইতো প্রথম এই রোড বানালো সে। এইতো সেদিন!!

মাঠে ক্রিকেট খেলা চলছে। সাদা সাদা জামা পরে লাল বল দিয়ে খেলছে ছেলেরা। মাঠের এক পাশে ভুখা মানুষের ভিড়। এই ভিড় বাড়ছেই দিনে দিনে। কদিনেই ছেলেদের খেলার মাঠ চলে যাবে ভুখা মানুষের দখলে। তার দীর্ঘ্য জীবনে এইরকম ভিড় আগেও দেখেছে সে। এর চেয়ে বেশি ভিড়ও দেখেছে। সেটা ছিল লঙ্গরখানা! হঠাৎ করেই বিভৎস এক আশঙ্কায় কেপে ওঠে তার বুক। চকিতে সে তাকায় আকাশের দিকে। নিজের ঘোলা চোখ বুলিয়ে নেয় ঈষাণ, বায়ু, অগ্নি, আর নৈরিতে। খুঁজে না পাবার প্রবল ইচ্ছা নিয়ে খয়েরী কিছু বিন্দু খোঁজে সে!!

ভুলির হাতটা একটু জোরে চেপে ধরে নসু মিয়া। বলে, আয় ভুলি আবার লাইনে দাড়াই। তর বাপে যদি আসে।

৩. বাঁশফুল ও ওলাবিবি
তার আসল নাম নওশের মোল্লা। তবে গ্রামের লোকের মুখে সেই নাম পরিবর্তিত হয়ে এখন দাড়িয়েছে নৈশ মোল্লা! এ নিয়ে নৈশ মোল্লার কোন দুঃখ নেই। সে এই হরে-কৃষ্ণপুর গ্রামের সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তি। সবচেয়ে মানী ব্যক্তিও। গ্রামের কোন ব্যপারে তার কথাই শেষ কথা। এই যেমন গ্রামের নামটাই সে পালটিয়ে দিলো বছর খানেক আগে। নৈশ মোল্লার বিচক্ষনতার কথা বলতে গেলে সেই গল্পও বলতেই হয়।

গ্রামে মসজিদ বানানো হয়েছে। জামে মসজিদ। ব্যপক আয়োজন করে সেই মসজিদ উদ্বোধন করতে গিয়ে এই নৈশ মোল্লা খেয়াল করল মসজিদের নাম ফলকে পাথর খোদাই করে লেখাঃ ‘হরে-কৃষ্ণপুর জামে মসজিদ’। মসজিদের গায়ে ‘হরে-কৃষ্ণ’ ভাবা যায়!! ধর্ম-কর্ম সব গেল। কত বড় গর্ধব এরা। গ্রামের মধ্যেও গেল গেল রব উঠলো। এর পর নৈশ মোল্লাই সমাধান দিলেন। গ্রামের নাম পরিবর্তন করে রেখেদিলেন ‘ইসলামপুর’। সরকারী নথিতে এখনো হরে-কৃষ্ণপুর থাকলেও মসজিদের ফলক তো বেচে গেল। বেচে গেল গ্রামের ধর্ম কর্মও।

গ্রামে আবার নতুন এক কান্ড ঘটেছে। গ্রামের সব বাঁশঝাড়ে ফুল ফুটেছে এক সাথে!! যাদের বয়স ষাটের মত। তারাও জীবনে দেখেনাই এমন কান্ড। বাঁশের ফুল!! প্রথম ফুল ফুটল হারু শেখের বাঁশ ঝাড়ে। সবাই তো এই কান্ড দেখে খুশি। আশে পাশের গ্রামেও রটে গেল এই কথা। অনেকেই সাইকেল চেপে অথবা হেটে দেখতে আসল এই আজব ব্যপার। সবাই দারুন খুশি। শুধু নৈশ মোল্লার কি যেন হয়ে গেল! তার পুরো পাগলের দশা। বাঁশের ফুলের কথা শুনলেই সে তেড়ে যায়। বলে হাসিস না হাসিস না দাত গুলান সাইরা রাখ। মরবি সব দলে দলে।

ততদিনে গ্রামের অন্য সব ঝাড়েও ফুল ফুটে গেছে। নৈশ মোল্লার মনে পড়ে গেছে তার একেবারে ছোট বেলার কথা। যখন তার মাও তাকে ডাকতো গেদু। উহ্‌, একদিন তার নামও গেদু ছিল! ভাবতেই কেমন লাগে। তার পর গ্রামের বাশঝারে সব ফুল এসে গেল। মুরুব্বিরা সব করুন মুখে এদিক সেদিক চায়। বাঁশের ফুল আসা মানে ওলাবিবি আসবে। দলে দলে লোক মরে ওলা ওঠা রোগে। প্রথমে ফুল শুকিয়ে গেল। তার পর মরে গেল সব বাশের ঝাড়। তার পর মানুষ। হুঠ করেই গেদু দেখল তাকে গেদু বলার জন্য আর কেও নেই। ওলাবিবি নিয়ে গেছে সবাইকে। শুধু গ্রামের ঈষাণ কোনের মান্দার গাছে রেখে গেছে এক ঝাক শকুন, আর শকুনী। পরে মান্দার গাছটাও মারা গেছিল। এখন অবশ্য সেখানে আরো বড় একটা মান্দার গাছ হয়ে গেছে। বাশ ঝাড় ও হয়ে গেছে নতুন করে।

নৈশ মোল্লার কথার কেউ অমান্য করেনা কখনো। তবে এইবার কলেজে পড়া পোলাপাইনরা এই ওলাবিবির গল্প শুনে হাসে। আর বলে ওলাবিবি না মুন্ডু। ওইটাতো কলেরা। আর এই যুগে কলেরা হইলেও বেইল নাই। স্যালাইন খাইলেই সব ঠিক। গ্রামের মানুষও এই প্রথম নৈশ মোল্লার কথার একটু কম গুরুত্ব দেয়। নৈশ মোল্লা রুষ্ঠ হয়।

তার পর একদিন ঝুপ করে মারা যায় হারুশেখের ঝাড়। সব বাঁশ কেমন যেন হলদে সাদা হয়ে যায়। তার পর একে একে অন্য ঝাড় গুলোও সাদা হতে থাকে। পোলাপাইনরা ভয় পেয়ে যায়। গ্রামের লোকের বুক অজানা আশঙ্কায় কেঁপে কেঁপে ওঠে। অবচেতন ভাবেই তারা প্রস্তুতি নিতে থাকে অজানা সঙ্কটের। নৈশ মোল্লা মনে মনে হাসে, অথবা কাঁদে। তার দীর্ঘ্য অভিজ্ঞতাপূর্ণ চোখে সে তাকায় আকাশের দিকে। চার চোখ ঘুরে আসে ঈষাণ, বায়ু, অগ্নি আর নৈরিতে। কখনোবা চকিতে দেখে নেয় তারই মত পুরোনো সেই মান্দার গাছটাকে। খয়েরী কিছু বিন্দু খোঁজে সে।

৪. প্রকৃতি ও মা
বহু দূরে কোন অজানা বুনো স্থানে একটা অচেনা গাছের উপর মৃদু চিক চিক শব্দগুলো ধীরে ধীরে কর্কশ হয়ে যেতে থাকে। খুশি, মমতা আর কৃতজ্ঞতার মিশ্র অনুভুতি অনুভব করে এক মা। কৃতজ্ঞতা সেই প্রকৃতির প্রতি- আলো ছায়া আর খাদ্য দিয়ে এবং কোল জুড়ে এমন শিশু দিয়ে তাকে অতি গোপনে এবং নিরিড় মমতায় প্রস্তুত করে তুলেছে যে। এইতো আর অল্প কিছু দিন। ডানা গুলো আরেকটু শক্ত হলেই উড়তে পারবে এরা। কোন দিক হয়তো ‘পুর্ব বা পশ্চিম’ এমন কোন নাম নিয়ে ধরা পড়েনা তার কাছে। তার পরও সে জানে তাদের যেতে হবে পুর্বে। অনন্ত কাল ধরে যে অনুভুতির সাহায্যে প্রকৃতির সাথে কথা বলেছে সে। সেই অনুভুতিই তাকে যেতে বলে সেদিকে। এক প্রবল টান যেন তাকে টেনে নিতে চায়। কেমন যেন মিষ্টি গুঞ্জন আসতে থাকে সেদিক থেকে। কারো কারো কাছে এই গুঞ্জন অবশ্য হাহাকারের। এইতো আর মাত্র কদিন!

৫. প্রতীক্ষা ও প্রস্তুতি
এভাবেই একটা গুমোট অনিশ্চয়তার মধ্যে নীরবে এক বিভৎস প্রস্তুতি চলতে থাকে এই জনপদের প্রতিটি কোনে কোনে।

প্রস্তুতি চলতে থাকে অবশ্যম্ভবীকে আমন্ত্রনের...

*******
-স্পর্শ

dbabble@yahoo.com


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

ধুর নৃশংস বানান ভুল করছি!!
তাউ দেখি ছাপছে!!
অতিথি লেখক হলে এই সমস্যা। এডিট করা যায়না লেখা ! মন খারাপ

স্পর্শ

অতিথি লেখক এর ছবি

নতুন ভাবে চিন্তা, নতুন ভাবে উপস্থাপন, আকৃষ্ট করল খুব। শুভ কামনা

আদি কোষ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।