স্বপনতরীর নেয়ে

শুভপ্রসাদ এর ছবি
লিখেছেন শুভপ্রসাদ [অতিথি] (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৯/১০/২০০৯ - ৫:০৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কয়েকদিন হল একজন অতিসাধারণ মানুষকে মৃত্যু তার অমোঘ ছোবল মেরে নিয়ে গেল তথাকথিত পরপারে। কোনও অপঘাতে হয় নি সেই মৃত্যু। কারণ অপঘাত ছাড়া কোনও অতি সাধারণ মানুষের মৃত্যু কখনও সংবাদে পরিণত হয় না। ধরা যাক, সুনামীর ঢেউ এ আটদিন সমুদ্রের বুকে ভেসে বেড়ানো ইন্দোনেশীয় কিশোরটির কথা। যদি সুনামী না আসত, যদি না সে ভরা বিস্ময়, অদম্য সাহস আর অপার বিশ্বাস নিয়ে সমুদ্রের বুকে আট দিন ভেসে না বেড়াতো, কেউ ই জানতো না তার কথা। ইন্দোনেশিয়ার সেই প্রত্যন্ত মসজিদে ঝাঁট দিয়ে কাটিয়ে দিত জীবন। হঠাৎ একদিন সবার অলক্ষ্যে হয়ত টুপ করে ঝরে পড়ত বাগানের নগণ্য আগাছার মতই। আমাদের আজকের মৃত্যু সংবাদও ‘প্রায় কিছুই না একটি মানুষ’ নিয়ে। ‘কিছুই না’ আর ‘প্রায় কিছুই না’ এই দুই শব্দের মাঝখানে রয়ে যাওয়া সামান্য ফারাক ঘিরেই আমার এবং আরো কিছু মানুষের আগ্রহ ঘিরে রয়েছে ওই মানুষটিকে নিয়ে। খবরটি খুবই সাদামাটা। শিলচর পলিটেকনিকের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারি রবীন্দ্র কুমার দাস শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। রাত্তিরে ঘুমিয়ে আর সকালে ওঠেন নি। খুবই গুরুত্বহীন একটি মানুষের খুবই অকিঞ্চিৎকর একটি মৃত্যু। এতে ‘খবর’ কোথায়? পলিটেকনিকে নিশ্চয়ই প্রথাসিদ্ধ শোকজ্ঞাপন হয়েছে যথাযথ শ্রদ্ধায়ই, তবে আর বাগাড়ম্বর কেন? নিজের সাইজের চেয়ে একটু ঢলঢলে পোশাকে অভ্যস্ত রবীন্দ্র কুমার দাস বা রবি দা তাঁর সাদামাটা জীবনে কতগুলো অসম্ভব, অবাস্তব, বর্ণময় স্বপ্ন দেখত। সেই স্বপ্নের কোনটা মহাকাশ নিয়ে, আবার কোনটা একেবারেই মাটির পৃথিবী নিয়ে। পলিটেকনিকের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারির দায়িত্ব আর কি? এই টেবিল থেকে ওই টেবিলে ফাইল পত্তর বগলে, এটা ওটা জরুরী চিঠি নিয়ে এখানে ওখানে ঘুরে সারা দিন হেঁটে বেড়ানো। কখনও বা চায়ের দোকান থেকে চা, পান, সিগারেট নিয়ে আসা। মাটির পৃথিবীর এই রসকষহীন কাজ করতে করতে আপাত রসকষহীন রবি দা মাঝে মাঝেই তাকিয়ে থাকত আকাশের দিকে। আমাদের মত লোকেরা ভাবত হয়ত রবিদা দেখছে আকাশে উড়ে যাওয়া কোনও এরোপ্লেন বা পাখি। খুব বেশি হলে আসন্ন বৃষ্টির পূর্বাভাস। আসলে রবিদার দৃষ্টি এতটা কাছের আকাশে আটকাত না। সে তাকিয়ে থাকত আরো দূরে, আরো সুনীল গভীরে। মহাকাশের গ্রহ গ্রহান্তরে। যদি এই বিশাল মহাকাশের অনাদি অনন্ত বিস্ময়ের কোনও সন্দেশ পাওয়া যায়। উড়ে যাওয়া এরোপ্লেন বা ভেসে বেড়ানো পাখি ছাড়িয়ে রবিদার জিজ্ঞাসা উত্তর খুঁজে বেড়াতো আরও বিশালত্বে, আরও অনিশ্চয়তায়, বিপুল সুদূরে। মহাকাশের গ্রহ নক্ষত্র, তাদের গতিবিধি, সেই বিশাল অজানার কতটা জানা গেল বিজ্ঞানের দৌলতে সে নিয়ে রবিদার জিজ্ঞাসার শেষ নেই। পরীক্ষা হলে কোনও প্রয়োজনীয় নোটিস পৌঁছে দিয়ে, কাগজে সই করিয়ে হঠাৎ দেখা গেল রবি দা যাচ্ছে না। বরং মিটমিট করে হাসছে। অনেকেই জানতেন, এই হাসির পরই প্যান্টের পকেটের জঠর থেকে বেরিয়ে আসতে পারে কোনও খবরের কাগজের ছেঁড়া পাতা বা ‘আনন্দমেলা’-র প্রচ্ছদের ছেঁড়া এক ফালি। মহাকাশের কোনও গ্রহ বা নক্ষত্রপুঞ্জের ছবি বা মহাকাশ বিষয়ে কোনও খবরের অংশ ছিঁড়ে নিয়ে এসেছে রবি দা। ‘এখন তো নেকচুনের পরও আরেকটা গ্রহ আবিষ্কার হয়েছে। জানেন তো সেটা? ওই নক্ষত্রগুলো সবগুলি একেকটা সূর্য। ওখানেও পৃথিবী থাকতে পারে, মানুষও।’ এভাবেই নিজের জ্ঞান ও বিস্ময়কে ভাগ করে নিতে চাইত রবি দা। বলা বাহুল্য, সকলেই হাসতেন। আমরা কয়েকজন রবি দার স্বপ্নকে মাঝেমাঝেই তাতিয়ে দিতাম নানা প্রশ্নে। রবি দা খবর দিত, আমেরিকা খুব শি¹িরই চন্দ্রে পর্যটক পাঠাবে। রবি দার ভীষণ আগ্রহ যাত্রীদের একজন হওয়ার। ভাড়া বেশি হলে সরকারি লোন টোন নিয়ে ব্যবস্থা হয়ে যাবে। ভাড়া নিয়ে রবি দা কখনওই ভাবত না, তাঁর চিন্তা ছিল ‘সিট’ পাওয়া যাবে কি না। আগ্রহী শ্রোতা আমাদেরকেই মহাকাশ বিষয়ে নতুন খবর পেলেই ছুটে এসে জানিয়ে যেত রবি দা। মহাকাশের বিস্ময় তাঁর কাজের মাঝে মাঝে যে ‘কান্নাধারা’ বইয়ে দিত, তার জেরে নানা অঘটনও ঘটে যেত। একদিন বিকেলের দিকে আমরা চা বিস্কুট আনতে পাঠালাম রবি দাকে। চা আনতে যাবার সময় বলল, অনেক নতুন খবর আছে, চা নিয়ে এসে জানাচ্ছি সে সব কথা। কিন্তু চা আনতে গিয়ে রবি দা তো আর ফেরে না। অনেক সময় কেটে যাবার পর আমরা যখন সত্যিই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ছি প্রায়, এমন সময়ই শার্ট এবং প্যান্টের নানা জায়গায় গোবরের ছোপ, ধূলো মেখে রবি দা এসে হাজির। চা নিয়ে রাস্তা পেরোবার সময় আছাড় খেয়ে পড়ে গেছে রাস্তায়। অগত্যা আবার পয়সা দিতে হল। খবরের কাগজে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মহাকাশযান নিক্ষেপের ছবি দেখে রবি দা নিজেই মহাকাশ পাড়ি দেবার এক অভিনব পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিল। সমস্ত মহাকাশযান আকাশে পাড়ি দেবার সময় নীচে আগুন জ্বলে। এটা দেখেই অভিনব পদ্ধতি উদ্ভাবন হল রবি দা’র। রবি দা একদিন বলল সেই পরিকল্পনার কথা। একের পর এক গ্যাস সিলিন্ডার বেঁধে তার ওপর চেপে বসবে রবি দা। বিকেলে, রবি দা’র মতে সূর্য যখন পৃথিবীর সবচেয়ে কাছাকাছি আসে, তখন সবচেয়ে ওপরের সিলিন্ডারে চেপে তলায় আগুন ধরিয়ে মহাকাশে পাড়ি দেবে। বেশি কিছু চাওয়ার নেই। একটুখানি মহাকাশের লীলা খেলা দেখে এসে উল্টো লাফ দিয়ে চলে আসবে আবার মাটির পৃথিবীতে। এ টুকুই চাওয়া রবি দা’র। অবশ্য আরেকটা চাহিদাও ছিল রবি দা’র। সেটা নিয়েও সকলে মুখ টিপে হাসত। রবি দা’র বাবা পলিটেকনিকেই গাড়ি চালাতেন। ছোটবেলা থেকেই রবি দা দেখেছে বাবাকে গাড়ি চালাতে, আর মনে মনে স্বপ্ন দেখত বড় হয়ে এখানেই গাড়ি চালানোর চাকরি করবে। চালাবে বাবার গাড়িটাই। কিন্তু রবিদা চাকরিতে আসতে আসতে সে গাড়ি হয়ে গেল অচল। সরকারি ভাষায় ‘এবানডন্ড্’। ধীরে ধীরে ক্যাম্পাসের একধারে পড়ে থাকা অচল গাড়িটার গায়ে জঙলা ঘাস জন্ম নিল। কিন্তু রবি দা নাছোড়বান্দা। বাবা বলেছিলেন, গাড়িটার ইঞ্জিন খুব ভাল। সুতরাং একটু সারিয়ে নিলে ওই অনড় গাড়িটা আবার গড়গড় করে চলবে। এটা প্রায় অন্ধ বিশ্বাসে পরিণত হল রবি দা’র। সব অধ্যক্ষের কাছেই এক আর্জি নিয়ে হাজির হয় রবি দা। বাবার স্মৃতিবিজড়িত, ছোট বেলা থেকে স্বপ্ন দেখে আসা গাড়িটা তার কাছে বিক্রি করে দেওয়া হোক। সব অধ্যক্ষই এক উত্তর দেন। অচল এই গাড়িটা আবার সচল করা অসম্ভব। রবি দা মানতে রাজি নয়। সকলের কাছেই যায়, বলে, একটু অধ্যক্ষকে বলে যদি গাড়িটা পাবার ব্যবস্থা করে দেয় কেউ। ‘একবার গাড়িটা পেলে, আপনাদের সক্কলকে বিকেলে আমি গাড়ি চালিয়ে বাড়ি পৌঁছে দেব প্রতিদিন বিকেলে। দু’টাকা করে দেবেন আপনারা। আচ্ছা, না হয় একটাকাই দেবেন। একটাকা দেবেন তো নিশ্চয়ই।’ এই কথাগুলির ‘আমি গাড়ি চালিয়ে’ বলার সময় রবি দা’র মুখে শিশুর হাসি। তক্ষুনি যেন স্টিয়ারিং এ হাত দিয়ে সে গাড়ি চালাতে শুরু করে দিয়েছে । জীবনভর এই এক দুঃখ থেকে গেল রবি দা’র, গাড়িটা চোখের সামনেই থাকল সারা জীবন, পড়েও রইল, কিন্তু কেউ তার কাছে বিক্রি করল না। প্রায়ই দেখতাম শিক্ষক কর্মচারি অনেকেই রবি দাকে জিজ্ঞেস করছেন, রবি, মাইনে কবে হবে, বা অ্যারিয়ার কিছু পাওয়া যাবে কি? রবি দা’র ঠোটের ডগায় উত্তর প্রস্তুত। দশ তারিখ ট্রেজারি ব্যান উঠবে বা মার্চে তিন পার্সেন্ট ডি,এ অ্যারিয়ার পাওয়া যাবে। আশ্চর্য, উত্তরগুলি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অভ্রান্ত। অলৌকিক কিছু নয়। অফিসে থাকার সুবাদে, অনেক সময়ই অনেক সরকারি খবর আগেভাগে জেনে যেত সে। এই সমস্ত বিষয়ে তার অভ্রান্ত তথ্যের জন্য বেশ কৌতুককর ঘটনাও হত। একবার, আশুতোষ চক্রবর্তী অস্থায়ীভাবে অধ্যক্ষের দায়িত্বে থাকার সময় হঠাৎই দেখি রবি দাকে বলছেন, টাকা পয়সার বড় সমস্যা, বুঝলে রবি। অ্যারিয়ার- টেরিয়ার কিছু পাওয়া যাবে কি? বিস্মিত আমি প্রশ্ন করি, আপনিও রবি দাকেই জিজ্ঞেস করছেন স্যার? ‘না, রবির কাছে এই খবর আগেই আসে। সেজন্যই জিজ্ঞেস করলাম।’ বলেই হাসলেন। সকলেই হাসত তার এটা ওটা নিয়ে। ওকে নিয়ে হাসি ছাড়া আর কোনও চর্চার কোনও অবকাশ ছিল না। কারণ, এতটাই সাধারণ ছিল রবি দা। তার মহাকাশ বিষয়ক আগ্রহ, বাবার চালানো গাড়িটার জন্যে কাঙালপনা, মাইনে অ্যারিয়ার সম্পর্কে পাক্কা খবর-সব মিলিয়েই সে হাসিরই সৃষ্টি করত সকলের। কেউ কেউ হয়ত পাগলই বলত তাকে। শুনেছিলাম, মহাকাশ নিয়ে এধরণের উদাস হয়ে থাকাকে নাকি মনোবিজ্ঞানে কসমিক এলিয়েনেশন বলে। আমার কখনওই রবি দাকে পাগল মনে হয় নি। মনে হত খুব সাধারণ একটা মানুষ, যে অসাধারণ কিছু স্বপ্নকে লালন করে চলেছে সারাজীবন। তার শিশুর মত হাসি, তার ঢলঢলে জামাকাপড়, তার অদ্ভুত চালচলন, হঠাৎ হঠাৎ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা- সব মিলিয়ে রবি দা ছিল একজন স্বপ্নচারী মানুষ। কিন্তু এতটাই সাধারণ যে কখনই খবর হয়ে উঠল না। খবর হয়ে ওঠার মত যোগ্যতা থাকলেও হয়ে ওঠার মত পরিসর রবি দা’রা হয়ত কখনওই পায় না। তার অতিসাধারণ জীবনের একান্ত কয়েকটি খাঁজে একান্তে লালন করা স্বপ্ন নিয়ে হঠাৎ করে ঘুমের মধ্যেই চলে গেল রবি দা, চলে গেল এই কর্মব্যস্ত পৃথিবীর কিছুমাত্র ক্ষতি সাধন না করেই। শেষ নিঃশ্বাস পড়ার আগে ঘুমের মধ্যে কি ওই মহাকাশেরই বা তার বাবার চালানো গাড়িটাকে স্বপ্ন দেখছিল সে। প্রাত্যহিক অর্থে বলার মত হয়ত তার কোনও অবদানও ছিল না এই পৃথিবীতে। এখন আর মানুষটা নেই। ভবিষ্যতে পলিটেকনিকের ওই ভাঙা গাড়িটা দেখে অথবা হঠাৎ খবরের কাগজে মহাকাশ বিষয়ে কোনও ছবি দেখে কারো কারো হয়ত মনে পড়বে রবি দা’র কথা। মনে পড়ে চোখের জল না এলেও, হাসবে সকলেই, রবি দার কথা ভেবে। মাত্র এটুকুই অবদান এই মাটির পৃথিবীতে রবি দা’র। সেজন্যই তার নিভৃত মৃত্যু শেষ পর্যন্ত একটি অনুল্লেখ্য ঘটনাই এই কাজের পৃথিবীর জন্যে।


মন্তব্য

মূলত পাঠক এর ছবি

বাঃ!

রেজওয়ান এর ছবি
জুয়েইরিযাহ মউ এর ছবি

উদাস করা বিষয় নিয়ে দারুণ একটি লেখা।

--------------------------------------------------------
জানতে হলে পথেই এসো, গৃহী হয়ে কে কবে কি পেয়েছে বলো....


-----------------------------------------------------------------------------------------------------

" ছেলেবেলা থেকেই আমি নিজেকে শুধু নষ্ট হতে দিয়েছি, ভেসে যেতে দিয়েছি, উড়িয়ে-পুড়িয়ে দিতে চেয়েছি নিজেকে। দ্বিধা আর শঙ্কা, এই নিয়েই আমি এক বিতিকিচ্ছিরি

দুষ্ট বালিকা এর ছবি

অদ্ভুত সুন্দর লিখেছেন! বাহ!

**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।

মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।

রানা মেহের এর ছবি

একটু কষ্ট করে লেখা প্যারা করে দেবেন কি?
একদমই পড়তে পারলামনা এভাবে
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।