হার্ট

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি
লিখেছেন সুলতানা সাদিয়া [অতিথি] (তারিখ: সোম, ১৯/০৯/২০১৬ - ২:২২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমাদের মায়ের মাঝে কোনো রহস্য ছিল না। মা ছিলেন সাদামাটা চেহারার বৈচিত্র্যহীন একজন মানুষ। মায়ের পরনে বরাবরই আটপৌড়ে পোশাক। ঘরে বা বাইরে বেরোলেও মায়ের পরনে মাড়হীন জংলি ফুলের নরম শাড়ি থাকতো। সাথে থাকতো কালো রঙের কুঁচি দেয়া বোরকা। সুতি শাড়ির বদলে কখনো জর্জেট বা সিল্ক নতুবা শাড়ির বদলে কামিজ বা ম্যাক্সি পরাও দেখিনি মাকে। মায়ের তোলা শাড়িগুলো আলমারি থেকে বের হতো কদাচিত। কোথায়ই বা যাবে মা?

অসুখ-বিসুখের বালাই নেই তাই ডাক্তারের কাছেও যাওয়া নেই। ছোটবেলায় আমাদের স্কুলে আনা-নেওয়া করতো দারোয়ান ফারুক কাকা নতুবা দাদাজান আসলে দাদাজান। সপ্তাহান্তে বাবা বাড়িতে আসলে বাবাকে অনেক কষ্টে রাজি করিয়ে আমরা তিন ভাইবোন চিড়িয়াখানা বা পার্কে যেতাম। মা আমাদের সঙ্গী হয়নি কখনো। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম, মা আমাদের সাথে যাবে না।

মায়ের নামটাও মায়ের মতো সাদামাটা, আকর্ষণহীন। সখিনা খাতুন। আমার নানা আলহাজ কুদরত-ই-এলাহী ছিলেন মৌলভি। মৌলভি বাড়ির মেয়ের নামে বাড়াবাড়ি রকমের ঐশ্বর্য থাকবে না সেটাই স্বাভাবিক। তবে আমার নানাবাড়ির পারিবারিক ঐশ্বর্য ছিল বেশ। অবশ্য শ্বশুরবাড়ির শানশওকত নিয়ে বাবার তেমন মাথাব্যথা ছিল বলে মনে হয় না। বাবা নিজে নানাবাড়ি খুব একটা যেতেন না, আমাদের যাওয়াও পছন্দ করতেন না। তবু আমরা যেতাম। বছরে দুএকবার। কারো বিয়ে বা মৃত্যুর সংবাদে। তখনও মা ধীর, স্থির। কোনো ঘটনাতেই বাড়তি আবেগ ফুটে উঠতো না মায়ের চেহারাতে।

শুধু যদি আমি, আনোয়ার, মনোয়ার পাশের ঘরে কোনো কারণে চিৎকার করতাম, মা ছুটে আসতো,
-ব্যথা পেলি?
মায়ের উৎকন্ঠাকে পাত্তা না দিয়ে আমরা একে অন্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তাম। খামচি, চিমটি, ঘুষি বিনিময়ে তিন ভাইবোন নিজেদের অস্তিত্ব টিকানোর লড়াইয়ে নামতাম। মা মুচকি হেসে রান্নাঘরে চলে যেতো। মায়ের হাসিরও কোনো বিশেষত্ব ছিল না। আসলে মায়ের গোলাকার ছোট মুখটিতে বিশেষায়িত করার মতো কোনো ছোট তিল, জরুল, জোড় ভ্রু ছিল না বা মা হাসলে গালে টোলও পড়তো না। মায়ের কপাল, থুতনির ঘামগুলোও ছিল মায়ের মতো বর্ণহীন।

বরাবরই মায়ের খোঁপাচুল ঢাকা থাকতো ঘোমটায়। মায়ের কানের দুপাশে বা মাথার চুলের মাঝ সিথিঁর দুপাশে কখনো রঙিন ক্লিপ চোখে পড়েনি। অথচ আমার বান্ধবী তমার মাকে দেখতাম চুড়ো করে চুল বেঁধে ডান কানের পাশে রঙিন ফুল গুঁজে আমাদের বাড়ি বেড়াতে আসতো। তখন তমার মাই কথা বলতো বেশি। মা শুধু হঠাৎ হ্যাঁ বা না সূচক শব্দ বলে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতো। তমার মাও মাকে খুব বেশি গুরুত্ব দিতো বলে মনে হতো না। ভদ্রমহিলা নিজের স্বামী সন্তানের বীরত্বের কাহিনী শুনিয়ে টুনিয়ে মায়ের হাতের লেবু চা আর গরম গরম সবজি পাকোড়া খেয়ে বিদায় নিতেন।

শুধু প্রতিবেশী কেনো নিতান্তই রহস্যহীন মাকে আমরা ভাইবোনেরাও বিশেষ কোনো গুরুত্বই দিতাম না। বাবাকে যতো প্রয়োজন মাকে খুব বেশি প্রয়োজন ছিল না আমাদের। বাবার প্রবল ব্যক্তিত্বের কাছে বরাবর পরাজিত মাকে নিত্যদিন কেনো দরকার তা আমাদের ছোট মাথাতে আসতো না। নিজেদের ঘরে ঢুকতেই পরিপাটি বিছানা-পত্তর, টেবিল, আয়রন করা স্কুল-ড্রেস, জামা-কাপড়, র্যা কে ঝকঝকে জুতোজোড়া রেডি থাকতো বলেই হয়তো মাকে আমাদের খোঁজাখুঁজি করা লাগতো না।

কেবলমাত্র ঘড়ির কাঁটা খাবারের সময় হয়েছে বলে জানান দিতেই আনোয়ার আর মনোয়ারের মাকে খোঁজাখুঁজি করা শুরু হতো। কোনো কোনো দিন মায়ের দেরি দেখে আনোয়ার বাবার মতো হুংকার করতো,
-এত্ত দেরি ক্যান মা? ভাত রাঁধো না পোলাও!
কোনো কেনোদিন মা সত্যি সত্যি টেবিলে পোলাও নিয়ে হাজির করতো। সাথে মুরগির কোরমা, গরুর মাংস ভুনা আর ঘন মুগ ডাল। কৃত্রিম আফসোস দেখাতে দেখাতে আনোয়ার বাটি থেকে প্রায় অর্ধেকটা মাংস পাতে তুলে নিয়ে বলতো,
-সেদিন রাহাতদের বাসায় বিফ ভুনা খেলাম, আন্টি সস দিয়ে রাঁধছে, কী যে মজা হইছে! নারে লিপি?

আমার ইচ্ছে করতো আনোয়ারকে ধমকে দেই, মায়েরটা ভাল হয়নি, তবে অত খাচ্ছিস কেনরে? কিন্তু মায়ের মুখে আঁচল চাপা হাসি দেখে বুঝতাম মা আনোয়ারের জ্যাঠামিতে মজাই পাচ্ছে।

মা হাসতো। ছন্দহীন, বৈচিত্র্যহীন। আসলে হাসি কান্নার মতো রহস্যময় আবেগগুলোও মায়ের কাছে নিতান্ত রহস্যহীন হয়ে যেতো। সেই যে মনোয়ারের যেই বার চিকেন পক্স হলো, মায়ের চোখ মুখ দেখে আমি ঠিক বুঝতাম নির্ঘুম রাত মায়ের চোখের জলেই কেটেছে। কিন্তু আমাদের অসুখের সময় গোপনে মায়ের চোখের জল ফেলাটাও আমাদের কাছে নিতান্ত স্বাভাবিক একটা বিষয় মনে হতো। আবার বাবা যখন শুক্র শনিবারের ছুটি শেষে নিজের কর্মস্থল সরিষাবাড়ি চলে যেতো, প্রতি রবিবারেও মায়ের লাল চোখ আমাদের কাছে রহস্যহীন স্বাভাবিক মনে হতো। আমরা তাই কখনোই মায়ের কাছে জানতে চাইনি, মা, তুমি কাঁদছো কেন? মা, তুমি খেয়েছো? মা, তোমার কি কিছু লাগবে?

তেতাল্লিশ বছর বয়সে আমাদের রহস্যহীন মা একদিন মারা গেলো। বৃষ্টিহীন আষাঢ়ের খর রৌদ্রের তাপে অতিষ্ঠ আমি সেদিন বারান্দায় ঝোলানো দোলনাতে একবাটি ফজলি আম নিয়ে বসেছি। কাটা চামচে এক টুকরো আম গেঁথে যেই মুখে পুরেছি সেই সময়েই আনোয়ারের চিৎকারে ছুটে যেয়ে দেখি মা রান্নাঘরের মেঝেতে কাত হয়ে পড়ে আছে। ডাক্তার এসে বললেন, হার্ট এ্যাটাক।

আমরা বাড়ির সকলে অবাক হয়ে সেদিনই প্রথম শুনলাম, আমাদের পরিবারের এই সদস্যটির একটি হার্ট ছিল!


মন্তব্য

সোহেল ইমাম এর ছবি

অসাধারন লাগলো। হতে পারে আত্মজৈবনিক কিংবা শুধুই গল্প কিন্তু কি আশ্চর্য সংযম নিয়ে লেখাটা এগিয়েছে। বাগবাহুল্য সরিয়ে ছিমছাম সাদামাটা শব্দে এগিয়ে একটা সমাপ্তিকে বুকের ভেতর বিস্ফোরিত করে দেওয়া। যা চোখের উপর প্রাত্যহিক দেখার আড়ালে, অনুভবের আড়ালেই থেকে যায় সেই ছবিটা সেই অনুভবটা। ঈর্ষনীয় লেখনী আপনার সাদিয়া আপা।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

ধন্যবাদ ভাই। খুব সুন্দর করে বলেন আপনি।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

দেবদ্যুতি এর ছবি

অদ্ভুত বিষাদময় সুন্দর গল্প সাদিয়া'পু

...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

ভালো থেকো প্রিয় দেবদ্যুতি

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

অতিথি লেখক এর ছবি

অনবদ্য গল্প। না, গল্প নয়। সত্যি। আপনার লেখনিতে যেন আমার মায়ের তথা সারা বিশ্বের মা'দের কথা ফুটে উঠেছে। আমার ভাবনায় ম'দের নিঃস্বার্থ ও নিঃশব্দ জীবনের এক ঝলক "মা"- শীর্ষক কবিতায় লিখেছিলাম প্রায় এক বছর আগে। ফেস্ বুকে পোস্টও করেছিলাম। ভাবনার এত মিল দেখে আমি নিজেকে সংবরণ করতে পারলাম না। মন্তব্য করে ফেল্লাম। ভুল হোলে মাফ করবেন। - মোহন মিত্র (অতিথি), ২০/০৯/২০১৬

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

অশেষ কৃতজ্ঞতা। এত সুন্দর করে অনুভূতি জানানোর জন্য। কবিতাটা পড়ার ইচ্ছে জানালাম।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

Munirul Islam এর ছবি

মায়েরা এমন হয়। আল্লাহ আপনার মাকে জান্নাতবাসী করুক। আমিন

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

আমার মায়ের জন্য দোয়া করবেন।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

রাজিব মাহমুদ এর ছবি

ভালো লাগল। তবে মায়ের চরিত্রে আরেকটু ডিটেইলিং থাকলে শেষের শ্লেষটা আরো পাকা হত মনে হয়। লিখতে থাকুন। ধন্যবাদ।

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

অশেষ ধন্যবাদ। পরামর্শটুকু মনে রাখলাম।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

অতিথি লেখক এর ছবি

অসম্ভব সুন্দর লাগলো।
#শাহরিয়ার সৈকত

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

ধন্যবাদ অনেক।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

অতিথি লেখক এর ছবি

আমরা বাড়ির সকলে অবাক হয়ে সেদিনই প্রথম শুনলাম, আমাদের পরিবারের এই সদস্যটির একটি হার্ট ছিল

সাদিয়া আপু অনেক ভালো লাগলো।

এ্যানি মাসুদ

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

অজস্র ধন্যবাদ

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।