গোলাপফুল, গোলাপফুল

সুরঞ্জনা এর ছবি
লিখেছেন সুরঞ্জনা (তারিখ: শুক্র, ২২/০৬/২০১২ - ৭:৩৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

'আচ্ছা দাদা, ওই লোকটা কোথায়?'

'কোন লোকটা?'

'ওই যে...', তুলি গোলাপের টব গুলোর দিকে তাকিয়ে মনে করার চেষ্টা করলো।

*

'কি খুঁজছি কিন্তু কি পাচ্ছি না।'

'মানে?'

রেণু মুখের সামনে থেকে 'ছিন্নমস্তার অভিশাপ' সরালো।

'তোর ঘটনা কি শুনি? ভর দুপুরে এসে আমার এখানে কি চাই? বললাম যে তুই কিছু বুঝবি না এই বইয়ের!'

তুলি মুখ কালো করে বললো, 'মা তো আমাকে বই পড়ে শোনালে বোঝা যায়।'

'তাহলে যা না, খালাম্মার কাছেই যা। রেণু আবার বই মেলে ধরলো মুখের সামনে।'

'কিন্তু মা তো ঘুমাচ্ছে।'

'তাহলে তুইও ঘুমা, ছোট মানুষ দুপুরবেলায় ঘুমাবি, এত ঘোরাঘুরি কিসের।'

তুলির মনটাই খারাপ হয়ে গেল।

আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরোচ্ছে, তখন আবার বই এর পেছন থেকে রেণু আপার গলা শোনা গেল, 'অ্যাই, বাড়ির বাইরে যাবি না একদম, ছেলেধরা ধরে নিয়ে যাবে।'

তিনতলার বারান্দায় গোলাপের টবের সারি। তুলি গিয়ে রেলিং ধরে দাঁড়ালো।

মেঘলা দিনের দুপুর, উল্টোদিকে মিতুদের বাড়ির সামনে একটা বেড়াল বসে বসে কান চুলকাচ্ছে।

'কি খুঁজছি কিন্তু কি পাচ্ছি না', তুলি আপনমনে বলে উঠলো।

আসলে আজকে তুলির খেলাধুলা ঠিক জমছে না।

সকালে রঙের বাক্স খুলে মনে হোল, কি যেন একটা নেই। কিন্তু গুনে গুনে দেখলো বারোটা রঙ পেন্সিলই আছে।

খাটের নিচে ঢুকে ওর সহায়-সম্পত্তি গুলোও একটু ঘেঁটে দেখতে হল (পুতুলের বাক্স এবং তিনচারটা ছবির বই), সেসব ও ঠিক আছে। ছাদে গিয়ে পানির ট্যাংকের নিচে জমানো নুড়ি পাথর গুলোও একবার দেখে এলো।

রান্নাঘরের পেছনের জানালা দিয়ে ঝোলানো দড়িটাও ঠিক আছে, তবে এখনো বেড়াল ধরা পড়েনি।

তুহিন দাদা বলেছে মাছের কাঁটাটা বেশি ছোট হয়ে গিয়েছে, বড় একটা কাঁটা ঝোলালে বেড়াল ঠিকই ধরা পড়বে, তবুও তুলি দড়িটাকে ঝুলিয়ে রেখেছে, ছোট একটা বেড়াল যদি ধরা যায়!

তাহলে কি নেই?

সেটাই তো সমস্যা, তুলির মনে পড়ছে না।

তুহিন দাদা বাসায় থাকলে সমস্যার একটা সমাধান হতে পারতো, কিন্তু তখন মাত্র দুপুর, স্কুল ছুটি হতে আরো দেরী।

ভাবলো রেণু আপা হয়তো কিছু বলতে পারবে, কিন্তু রেণু আপা তো তুলিকে পাত্তাই দিলো না।

ঝুপ করে টবের পাশে বসে পড়লো তুলি।

পিপড়ার সারি আজকেও টবের ধার ঘেঁষে চলছে, কি খুঁজে পেয়েছে ওরা?

তুলি দেখতে দেখতে উপুড় হয়ে, পাশের টবের নিচে গোঁজা কাগজটাকে টেনে বের করলো।

ভাজ খুলে দেখলো সব হিজিবিজি লেখা। তুলি ওর চেনা অক্ষর গুলো পড়তে পারলো, '...ব...ঘিজিবিজি, আ...প...ন...ক...ঘিজিবিজি...'।

'কি রে পণ্ডিত, কি পড়িস?'

তুলির মাথায় চাটি মেরে স্কুলের ব্যাগ মাটিতে ফেললো তুহিন দাদা।

'মা! খাবার, জলদি! খেলতে যাব!'

বলে দুদ্দাড় চলে গেল।

আজকে কেউই তুলিকে পাত্তা দিলো না।

**

বিকেলের শেষে তুলি ছাদ থেকে সিঁড়ি বেয়ে নামছিলো। দেখলো গোলাপের টবের কাছে চুপচাপ বসে আছে রেণু আপা।

সিঁড়িতে ধুপধাপ পায়ের শব্দ হতে রেণু আপা চমকে উঠে চলে গেল।

তুলি নামতে নামতে তুহিন দাদা উঠে এলো।

'অন্ধকারে কি করিস এখানে?'

টবের পাশে বসে জুতা খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করলো তুহিন দাদা।

'কি খুঁজছি, কিন্তু কি পাচ্ছি না, এটার মানে কি দাদা?'

'কি খুঁজছি কি পাচ্ছি না...ওহ! এটাতো ছিন্নমস্তার অভিশাপে ছিলো। ইংরেজিতে চাবি কে key বলে, একটা লোক চাবি খুঁজে পাচ্ছিলো না, সেটাই বলছিল। তুই শুনলি কোথায়?'

'রেণু আপা বই পড়ছিল, আমি বললাম পড়ে শোনাও, তখন এটা বললো। কিন্তু মানে বললো না।'

'হুম।'

তুলি টবের নিচের কাগজটা আবার টেনে বের করলো।

'দাদা এই যে, আমি পড়বো দেখবে?' বলেই জোরে জোরে শুরু করলো, 'ব...ন...ক...'

'বাবারে! থাক থাক, দেখি কি পড়িস?'

তুহিন দাদা কাগজটা টেনে নিয়ে আলোতে ধরলো।

'প্রিয় বৈজ্ঞানিক,

আপনাকে জানানো হয়তো আমার অনুচিত কিন্তু...'

তুহিন দাদা জোরে জোরে পড়া থামিয়ে গম্ভীর হয়ে গেল।

তুলি জামা ধরে টানলো, 'কি দাদা?'

'এটা আর কারোকে দেখিয়েছিলি?' তুহিন দাদা শান্তস্বরে জিজ্ঞেস করলো।

তুলি মাথা নাড়লো।

'ভালো করেছিস।'

কাগজটাকে বল বানিয়ে নিচের নর্দমায় ছুড়ে ফেলে দিলো তুহিন দাদা।

কিন্তু বৈজ্ঞানিক শব্দটা শুনে তুলির কিছু একটা মনে পড়তে শুরু করেছে, আবছা আবছা।

***

'আচ্ছা দাদা, ওই লোকটা কোথায়?'

'কোন লোকটা?'

'ওই যে...', তুলি গোলাপের টব গুলোর দিকে তাকিয়ে মনে করার চেষ্টা করলো।

' গোল গোল চোখ, পাখির বাসার মত চুল যে?'

তুহিন রাস্তার দিকে মুখ ফেরালো।

'কি বলিস, কার কথা বানিয়ে বানিয়ে বলিস হাঁদারামের মতো তুইই জানিস।'

'না দাদা! ওই যে লোকটা, চশমাওয়ালা, ছাদে বসে বই পড়তো যে! আমাকে যে গোলাপফুল বলতো...?'

তুহিন ভুরু কুঁচকে তাকালো।

'সত্যি তো! রেণু আপাকেও গোলাপফুল বলতো!'

তুহিন কিছু বললো না।

'তাহলে ওকে জিজ্ঞেস করো! '

তুলি ঘরের দিকে ছুট দেয়ার আগেই তুহিন খপ করে ওকে ধরে ফেললো।

'রেণু আপাকে কিচ্ছু জিজ্ঞেস করতে হবে না।'

'কিন্তু দাদা...'

'ঝালমুড়ি খাবি? আয়, নিচে গিয়ে ঝালমুড়িওলা খুঁজি'

তুলিকে কোলে নিয়ে সিঁড়ি ঘরের দিকে পা বাড়ালো তুহিন।

'দাদা?'

'কি বল্?'

'লোকটাকে কি ছেলেধরা ধরে নিয়ে গেল?'

দোতলায় রেণু আপাদের বারান্দা, ফুলের টবে আলো পড়ছে। আধ-খোলা দরজার পাল্লার ভেতর থেকে সারেগামার সুর ভেসে আসছে...

সেদিকে তাকিয়ে তুহিন দাদা বললো, 'কিছু লোককে ধরে নিয়ে গেলে খারাপ হয় না।'

'কিন্তু ভয় নেই, লোকটাকে কেউ ধরে নিয়ে যায় নি, লোকটা পালিয়ে গেল।

কারো কারো জন্যে সেটাই সহজ।'

তুহিন দাদা হাসলো, কিন্তু তুলির মনে হোল, তুহিন দাদার মোটেই হাসি পায় নি।

****


মন্তব্য

মাহমুদ এর ছবি

সুন্দর।
'কি' আর 'কী' শব্দ দুটি বেশ কিছু জায়গায় একাকার হয়ে গিয়েছে!

সুরঞ্জনা এর ছবি

'কি' আর 'কী' এর পার্থক্য সম্বন্ধে আমি নিজেই ঠিক করে জানি না।
ভুলটা অনভিপ্রেত, তবে কাকতাল নয় খাইছে

ধন্যবাদ হাসি

............................................................................................
এক পথে যারা চলিবে তাহারা
সকলেরে নিক্‌ চিনে।

আইলসা এর ছবি

"কি" বোধহয় প্রশ্নবাচক আর "কী" বিস্ময়সূচক। আমার সঠিক মনে নাই তবে বাংলা স্যারের মাইর খাইছিলাম একবার পরীক্ষার খাতায় সব "ক"-এ দীর্ঘ-ই ব্যবহার কইরা। আমার তখন ধারনা ছিলো জ্ঞানী গুনীরা (আধুনিক ভাষায় যারে সুশীল সমাজ বলে) "কী" লেখে। কিন্তু সুশীল হ্ওয়া সহজ নহে। প্রচুর পিটানি খাইছিলাম। সেইকালে তো ছাত্রবন্ধু কোর্ট ছিলনা আর বাপ-মা ও ছিল পাষন্ড টাইপের। স্কুলে স্যাররা মারলে আরেক দফা পিটানি দিতো ফাই হিসেবে।

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

'কী' ব্যবহৃত হয় যেসব প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ বা না দিয়ে সারা যায় সেসব ক্ষেত্রে। "তুমি ভাত খাবে কী?"
'কি' ব্যবহৃদত হয় অন্য সব প্রশ্নের ক্ষেত্রে। "তুমি কি দিয়ে ভাত খাবে?"

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

উলটা হলো।

- তুমি কি খেয়েছ?
> হ্যাঁ।

- তুমি কী খেয়েছ?
> ভাত।

সুরঞ্জনা এর ছবি

আরি বাহ! ধন্যবাদ অপ্র! হাসি

............................................................................................
এক পথে যারা চলিবে তাহারা
সকলেরে নিক্‌ চিনে।

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

কী - হল সর্বনাম (মানে কোন একটা জিনিসের বদলে বসে, উচ্চারণেও টের পাওয়া যায়, যেমন, তুমি কী (শাক দিয়ে/মাংস দিয়ে) দিয়ে ভাত খাবে?-এখানে একটু টেনে বলতে হচ্ছে -কী)
কি - হল অব্যয় (প্রশ্ন করতে ব্যবহার হয়, উচ্চারণেও টের পাওয়া যায়, যেমন, তুমি কি (খাবে নাকি প্রশ্ন কয়রা হচ্ছে) ভাত খাবে?-এখানে একটু কম টেনে বলতে হচ্ছে -কি)
আপনার উত্তরটা উলটা হয়েছে মুর্শেদ ভাই

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

বাহ্...

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

সুরঞ্জনা এর ছবি

ম্যাঁও

............................................................................................
এক পথে যারা চলিবে তাহারা
সকলেরে নিক্‌ চিনে।

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

চলুক

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

সুরঞ্জনা এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

............................................................................................
এক পথে যারা চলিবে তাহারা
সকলেরে নিক্‌ চিনে।

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

চলুক

সুরঞ্জনা এর ছবি

ম্যাঁও

............................................................................................
এক পথে যারা চলিবে তাহারা
সকলেরে নিক্‌ চিনে।

তদানিন্তন পাঁঠা এর ছবি

বৈজ্ঞানিকের কী হলো জনগণ জানতে চায়। মন খারাপ গল্পের ধরন ভাল। কিন্তু শুরু না হতেই শেষ। মন খারাপ

সুরঞ্জনা এর ছবি

আ!! এত্ত বড় গল্প তাও শুরুতেই শেষ বলেন!
মন খারাপ

............................................................................................
এক পথে যারা চলিবে তাহারা
সকলেরে নিক্‌ চিনে।

তারেক অণু এর ছবি
সুরঞ্জনা এর ছবি

ম্যাঁও

............................................................................................
এক পথে যারা চলিবে তাহারা
সকলেরে নিক্‌ চিনে।

মুস্তাফিজ এর ছবি

ভালো লেগেছে।

...........................
Every Picture Tells a Story

সুরঞ্জনা এর ছবি

ধন্যবাদ মুস্তাফিজ ভাই হাসি

............................................................................................
এক পথে যারা চলিবে তাহারা
সকলেরে নিক্‌ চিনে।

অনিন্দ্য অন্তর অপু এর ছবি

চমৎকার একটা গল্প। এত সুন্দর কথপ কথনের মাধ্যমে পাঠককে ধরে রাখতে পেরেছেন। একটানা পড়া শেষে মুগ্ধতা নিয়েই পড়া শেষ করেছি। শুভ কামনা রইল আপনার জন্য

সুরঞ্জনা এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ
হাসি

............................................................................................
এক পথে যারা চলিবে তাহারা
সকলেরে নিক্‌ চিনে।

মর্ম এর ছবি

তুলিটার জন্য খারাপ লাগল, আহারে! বেচারির সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে কারো কোন খবর নাই! ওর জন্য এই মিঁয়াওটা রেখে গেলাম। ওকে অবশ্যি অবশ্যি বলবেন, তুহিন দাদা মোটেই ঠিক করেনি। কাঁটা বরশিতে ঝুলিয়ে বেড়ালের জন্য ফাঁদ পাতা মোটেই ঠিক নয়, গলায় আটকে ওরা ব্যথা পাবে না বুঝি?!

~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

সুরঞ্জনা এর ছবি

আসলেই, ওর সব গোলমাল হয়ে গেল, কারো খবর নাই।
ধন্যবাদ!
হাসি

............................................................................................
এক পথে যারা চলিবে তাহারা
সকলেরে নিক্‌ চিনে।

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

আহারে... মন খারাপ

গল্প ভালো হয়েছে খুকি হাসি

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

সুরঞ্জনা এর ছবি

ধন্যবাদ
হাসি

............................................................................................
এক পথে যারা চলিবে তাহারা
সকলেরে নিক্‌ চিনে।

দ্রোহী এর ছবি

কে সেই বৈজ্ঞানিক? জাতি জানতে চায়।

ব্লগে তো তার পৃষ্ঠা গুনে গল্প লেখার হ্যাপা নাই। সব গল্প অ্যাতো সংক্ষেপে সারলে চলে?

সুরঞ্জনা এর ছবি

জানার কোন শেষ নাই
জানার চেষ্টা বৃথা তাই! দেঁতো হাসি

বড় লিখলে তো নিজেই তেড়ে আসবেন লাঠি নিয়ে, সময় নষ্ট করার জন্য। হাসি

............................................................................................
এক পথে যারা চলিবে তাহারা
সকলেরে নিক্‌ চিনে।

অতিথি লেখক এর ছবি

কথোপকথন সাজিয়ে একেবারে গল্পের শেষে টেনে এনে ফেলার ভঙ্গীটা ভীষণ ভালো লাগলো। চলুক

পথিক পরাণ

সুরঞ্জনা এর ছবি

ধন্যবাদ
হাসি

............................................................................................
এক পথে যারা চলিবে তাহারা
সকলেরে নিক্‌ চিনে।

অতিথি লেখক এর ছবি

সুন্দর একটা গল্প। লিখে যান।

রাজীব মাহমুদ

সুরঞ্জনা এর ছবি

হাসি
ধন্যবাদ।

............................................................................................
এক পথে যারা চলিবে তাহারা
সকলেরে নিক্‌ চিনে।

sanjib এর ছবি

হুমমমম।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।