একদিন পালাব

সৈয়দ আফসার এর ছবি
লিখেছেন সৈয়দ আফসার (তারিখ: সোম, ২৪/০৯/২০১২ - ৪:২৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এই শীতের দেশ থেকে সত্যি সত্যি একদিন পালাব আমি
আহা! শীত, অন্ধকার রাত্রি, তোকে একটু পাশেটাশে নিয়ে
বসি নিরিবিলি, তুই স্রোতানদীর পাড় ঘেঁশাএক পোড়াবাঁশি
তোর দেহানুভবের চক্রপথটি ধরে পালক ছড়াতে ছড়াতে
পাশ-বিরহের ঠোকাঠুকি দেখতে কেন যে দাঁড়াস ব্রত-মুখে?
তারচে’ ভালো নিভন্ত একটি দীর্ঘশ্বাস পাঠে জোনাক জ্বলুক
রাত্রিজাগা-রোগে...
হাওয়ায় ওড়ে ধোঁয়াসহ মশলা-ঘ্রাণ, মুহূর্ত পালাতে পালাতে
রাত্রিও ভেস্তে যাবে মন-গানে, পরিচিত দালানের মানুষগুলো
ঘুমিয়ে পড়বে; আমি চিরটাকাল শীতানুভব করব অর্ধেক ঋণে
তুই কি জানিস—হাড়ের শব্দগুলো সময়কে ভাঙছে শূন্যে
সোডিয়াম বাল্বও আমার মতো নিঃস্ব জীবন কাটাচ্ছে গোপনে


এই শীতের দেশ থেকে সত্যি সত্যি একদিন পালাব আমি
যেখানে দৌড়ায়নি আমার শৈশবস্মৃতিসহ ধুলো-মাটির ঘ্রাণ
উড়ন্ত ফড়িঙের পাখা ধরতে-ধরতে কাটেনি বিকেলবেলা
ঘরের ইয়ার্ডে মার্বেল খেলিনি, মেঘলাকাশে উড়াইনি ঘুড়ি
দলবেঁধে সাঁতরাইনি জলে, উড়াল জালে ধরিনি মাছ খালে
বিলে, মাঘ-ফাগুনে নদী আর খালের মাটি খুঁড়ে ধরিনি কৈ,
শিং, মাগুর, বাইম কিংবা টাকি...
জিয়ল মাছের খোঁজে কাদা-মাটি ভাঙছি স্বপ্ন-আঁকা জলে...
সত্যি সত্যি মনে হয় কোথায় এলাম আমি! এমন শীতে
বিকালে খেলি না গোল্লাছুট-দারাগুটি কিংবা এক্কাদোক্কা খেলা
মেয়েরা গলায় পরে না শিমুল-হিজল, জারুল ফুলের মালা


এই শীতের দেশ থেকে সত্যি সত্যি একদিন পালাব আমি
যেখানে মৌমাছির গুনগুন নেই, ঝিঁঝি-ডাকা সন্ধ্যার ঘরে
হারিকেন জ্বলেনি, পাখির কিচিরমিচির শব্দ আসে না কানে
উঠানে, মাচাঙ ভরে ফোটে না ঝিঙে-কুমড়া কিংবা লাউফুল
আকাশে ওড়ে না শালিক, চড়াই, বক, ডালে বসে না ঘুঘু-
কোকিল-বুলবুলি কিংবা টিয়া
ভরানদী-খাল-বিলে মাছের খলবল শব্দও নেই, পচা-বড়শি
বাওয়ার পুকুরটাও নেই; বাঁশঝাড়ের হাওয়া লাগে না গায়ে
নদীর কিনারে পাল তোলা নৌকায় কাড়াল ধরে না মাঝি
কাকডাকা ভোরে রাখাল বাজায় না বাঁশি, মনের শোকে
মাগুরা নদীর ঘোলাজলে হাঁসগুলো ওড়ে না ঝাঁকে ঝাঁকে


এই শীতের দেশ থেকে সত্যি সত্যি একদিন পালাব আমি
যেখানে কাজের নিশ্চয়তা নেই, আবহাওয়ার নিজস্বতা নেই
শাদা রমণীরা শাড়ি পরে না, হাতে চুড়ি-নাকফুলও দেখি না
পায়ে নূপুরের শব্দ বাজে না, ফুল ও ফলে নেই কোনো ঘ্রাণ!
বাগানভরা আনাজপাতির তরতাজা ঘ্রাণটাও পাই না নাকে
রুটিন বাঁধা ঘুম-খাওয়া; কাজ ছাড়া সবই ভাবনাহীন যন্ত্রণা
নিত্য আমায় দেখে-শুনে রাখে চপার-চাকুসহ ‘জলের করাত’
এ-পরিবেশে যে-কথাটি বহুবার বলছি ‘বন্ধুরা করো না করুণা’
রাতে-বিরাতে তোদের কথা ভাবতে-ভাবতে অবিরল চোখে
জড়ো যত কথা; হিমশৃঙ্খল ছিঁড়ে দীঘদিন বাঁচার আশা করে না


এই শীতের দেশ থেকে সত্যি সত্যি একদিন পালাব আমি
যান্ত্রিক বাস্ববতার মিথকল ঘেঁষা কবিতা-পলায়ন-কথাগুলো
দৃষ্টি-কোপের তীব্র যন্ত্রণা ডাইনে-বাঁয়ে সজোরে কামড়ে ধরে
বিচূর্ণ বিলাপগুলো কিভাবে দেহ থেকে পুরোটা বিচ্ছিন্ন করে
ফেলছে আমায়? এ-ভিনদেশিপনায় এ-দেহমনে কোনো পুষ্টি নেই
আমার দেশ, আমার জল-মাটি-সোঁদাগন্ধ, রৌদ্রের গুণাগুণ নেই
কেন যে অলক্ষুণে দিন-দিন শরীর থেকে উড়ে যাচ্ছে অরণ্যে!...
পচনধরা বাঁচার শক্তি নিয়ে পুনরায় ফিরছি স্পাইন অপারেশনে
অপারেশনের পর, দীর্ঘদিন যন্ত্রণার নীরব ফাঁকে-ফোকরে কুঁকড়ে
থেকেছি, লুকিয়ে থেকেছি, দেহের নীরব চিৎকার কেউ শুনেনি


এই শীতের দেশ থেকে সত্যি সত্যি একদিন পালাব আমি
পালাব কবিতায়, কবিতা কি গুঁড়িয়ে মুড়িয়ে বসছ আত্মায়?
নাকি লুকিয়েছ এ-নগর, ভিনদেশিপনায়? কিছুই জানি না
প্রকৃতি এমন আশ্চর্য যে চেয়ারে বসলেও পিঠে ব্যথা করে
বালিশ চেপে লিখি না কাঁধের শিরাগুলো ফুলে-ফেঁপে ওঠে
শুয়েও পারি না, কাটা মাংসের মন্থর টানে ঘুম টলে চোখে
অথচ চাঁদনী রাতে অবাক বিস্ময়ে কেন বুকে অহরহ হাঁটো
তুমি কি রণজিৎ দাশের ‘আমাদের লাজুক কবিতা’র মতো?
তোমায় কোথায় শোয়াব? এ-শীতের দেশে ফুটপাত খালি নেই
ফেরিওলা নেই যে, দলামোচায় বানাবে ছোলাভাজা, বাদামভাজা
কিংবা চানাচুর ঘুটার ঠোঙা


এই শীতের দেশ থেকে সত্যি সত্যি একদিন পালাব আমি
যেখানে হিমরাতে ফুটপাতে দূরের হাওয়ায় হিমক্ষুধা জমায়
হিমক্ষুধা সোডিয়াম বাল্বে দুলতে দুলতে আলোপাহাড়ে ওঠে
চেয়ে দেখি কীভাবে গ্রহণ না-করে আলোও আড়ালে লুকায়
বলি-আমাকে জুড়িয়ে দাও, ভুলিয়ে দাও, রক্ত-মাংস-হাড়ে
দেয়ালবন্দী জীবনযাপন ভালাগে না, পোড়া-বুকটি ছিঁড়ে-খুঁড়ে
খাও...কারণ, জীবনের ভুলত্রুটিগুলো যতই ভাবছি, ভাবনার
যোগসাজশে লোটানো কৌশলগুলো আমাকে বহুমুখী কথার
ব্যথা-চিতায় অবাধে পোড়ায়, আমি এক ছদ্মবেশী ঘুমখুনিকে
দিনদিন অস্তিত্বে ধারণ করছি, যে কিনা পূর্বাপর মন-ছোবলের
রক্তঘ্রাণে খোঁজে ঘাস, নদী, জল, বাতাসসহ মানুষের কোলাহল


এই শীতের দেশ থেকে সত্যি সত্যি একদিন পালাব আমি
যেখানে খালি গায়ে জড়ায় না জল-মাটি কিংবা পুবালি হাওয়া
ঠোঁটের লিপ্ত জলগুলো গোধূলি-আলোর ‘অগ্নিক্ষরা চোখে’
কামরূপী, স্বরহারা
কেবল দিক-দিগন্ত ছুঁয়ে যাওয়া; জানালার দিকে তাকালেই
দৃষ্টিকাঁটাগুলো নিজের মর্জিমতো বেয়ে ওঠে হাসে-কাঁদে
ব্যথাভরা শরীর সাঁতরাতে-সাঁতরাতে দাঁড়িয়েছি তার পাশে
পালাব পালাব করে কখন যে দু-চোখ ভরে ঘুম চলে আসে
যতদিন পালাতে পারব না আমি, আমার জীবনটা ভরে রাখছি
একটি কালো স্যুটকেসে।


মন্তব্য

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি
অতিথি লেখক এর ছবি

হাসি

দেবা ভাই
-----------------------------------------
'দেবা ভাই' এর ব্লগ

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

বাহ, অসাধারণ!

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

অতিথি লেখক এর ছবি

বাহ্ মনে হলো বেশ হোম সিকনেস কাজ করছিলো কবিতা লেখার সময়।
বেশ সুন্দর।

☺অবিণীতা [Aubineeta]

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।