আগামীকাল রাজকুমারের তামসিক খিচুড়ির মজমা

যূথচারী এর ছবি
লিখেছেন যূথচারী (তারিখ: বিষ্যুদ, ২২/১০/২০০৯ - ৯:২৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ভারতীয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের বদান্যতায় সে বার কোনো একজন রাগশিল্পী এসেছিলেন জাহাঙ্গীরনগরে। রাগসঙ্গীতের সেই আসরে রাজকুমার ছিলেন এবং পুরো অনুষ্ঠান-ই তিনি মনোযোগ সহকারে উপভোগ করতেন, যদি না রায়হান ভাই এসে তাকে তুলে নিয়ে যেতেন। ঘটনা হলো, রাজকুমারের স্নাতকোত্তরের ভাইবা ছিল ওইদিন। ভাইবা-তে অনুপস্থিত থাকলে বা ফেইল করলে, লিখিত পরীক্ষায় যতো ভালই করুক না কেন- ফেইল। ব্যাপক অনুসন্ধানের পর রায়হান ভাই, পরীক্ষার সময় শেষ হয়ে যাওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পর রাজকুমারকে খুঁজে পান এবং বলা বাহুল্য সে বারের মতো রাজকুমারকে ফেইল করার হাত থেকে বাঁচান। তবে কতোটুকু বাঁচাতে পারলেন জানি না, কারণ রাজকুমার তৃতীয় শ্রেণী পেয়েছিলেন, এবং এজন্য তাকে যথেষ্ঠ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণী পাওয়া খুব কঠিন।

আমরা যারা রাজকুমারের ভক্তকুল, এই তৃতীয় শ্রেণীপ্রাপ্ত একটি মানুষকে তার পরেও পছন্দ করি। কারণ আমরা জানি, এই পুরো সমাজ এবং এই ব্যক্তিকে আলাদা করে ফেলা যায় অনায়াসেই। তৃতীয় শ্রেণী চতুর্থ শ্রেণী এইসব নিয়ে কখনো মাথা নিয়ে ঘামাননি তিনি, রাজকুমার পড়ুয়া ছিলেন এবং তার স্বাতন্ত্র্য ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় পাস করে কোনো চাকরি বাকরি করার থেকে কোনো সাধুসঙ্গে মাসের পর মাস কাটিয়ে দেওয়াটা তার কাছে অনেক লোভনীয় ছিল। অথবা চা বাগানে। কিংবা কোনো আদিবাসী পাড়ায়। সাধারণ পাতার বিড়ি আর দুয়েক কাপ চা- এই হলেই দিন চলে যেতো রাজকুমারের। একটানা কতোদিন শুধু চা আর বিড়ি খেয়ে কাটিয়েছেন রাজকুমার, এই নিয়ে নানা মিথ প্রচলিত আছে, সর্বনিম্ন ৩০ দিন থেকে সর্বোচ্চ ৪৫ দিন পর্যন্ত ঘোরাঘুরি করে সেটা, তবে সত্যিটা বোধহয় আরো অনেক কম। ছবি তুলতে ভালোবাসতেন মানুষটি, তবে বিষয় হওয়া চাই অসূর্যস্পর্শা ধরনের। যে ছবি আগে কেউ তোলেনি এমন বিষয় পছন্দ করতেন তিনি, যদিও তুলেছেন অনেক ঘরোয়া ছবিও।

গাঁজা খাওয়ার ব্যাপারটাকে ব্যাপারটাকে রাজকুমার এক শিল্প-সাধনার পর্যায়ে উন্নীত করেছিলেন। সাধারণ নেশাখোরদের মতো না, রাজকুমার এটাকে তার ধর্মের মতো পবিত্র মনে করতেন। তিনি এটাকে বলতেন সিদ্ধি এবং এটা তিনি সাধনার অংশ হিসেবে সেবন করতেন, নেশা করার জন্য নয়। টেবিল বাজিয়ে গান করা ছিল তার প্রিয় স্বভাবগুলোর একটি। কফিল ভাই, শামীম ভাই বা অন্য কোনো শিল্পী থাকলে তিনি শুধু টেবিল-ই বাজাতেন, মাতাল রাজ্জাকের বিচ্ছেদী গানগুলো সেই আসরের প্রধান উপজীব্য ছিল।

রাজকুমার ছিলেন একজন সত্যিকারের ভালো সঙ্গী। যেকোনো জায়গায় যেকোনো মুহূর্তে যেতে প্রস্তুত ছিলেন রাজকুমার, আহ্বান মাত্র সম্মতি এবং যাত্রা শুরু। বিভিন্ন বিষয়ে তার বিস্তর অভিজ্ঞতা ছিল; ভ্রমণে খুব কাজে দিতো। ভ্রমণ হোক আর অন্য যেকোনো জায়গায়, রাজকুমারের মতো একজন সঙ্গী পাওয়া সত্যিই খুব কঠিন। প্রচুর মতবিরোধ সত্ত্বেও পরমতসহিষ্ণুতা ও তানের ঐক্য তাকে আমাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছিল।

রাজকুমার ধান্দাবাজ ছিলেন না। অর্থ, খ্যাতি, ক্ষমতা অথবা অন্য কোনো মোহ তাকে টানেনি একদম। কোনো রকমে একটু মাথা গোঁজার ব্যবস্থা (মানে ঘর হতে হবে এমন না, রাস্তা হলেও চলে) আর পাতার বিড়ি এবং চায়ের সংস্থান- এই ক’টি জিনিসই তার চাহিদা ছিল। এই সারল্য এই যুগে বিরল। এবং সেই সাথে গুরুত্বহীন। কেননা, ক্ষমতাহীন মানুষকে কেউ সঙ্গী করে না। রাজকুমার-ও তাই চিরকাল ছিলেন নিঃসঙ্গ। বিভিন্ন সময় আমাদের বিভিন্ন জনের সাথে তার খুব সখ্য ছিল। হয়তো আমাদের যূথ-এর সাথেও তিনি যূথচারী হয়েছেন অনেক সময়। কিন্তু কেউই আমরা তাকে দেইনি (অথবা আমরা নেইনি) স্থায়ী সান্নিধ্য। কেননা আমাদের চলার পথ অনেক উর্ধগামী, অনেক ক্ষমতা, খ্যাতি ও অর্থমুখী। রাজকুমার আমাদের মোহের অনেক নিচ দিয়ে স্বচ্ছ ঝরনার মতো প্রবহমান থেকেছেন সবসময়, এখনও আছেন।

কিন্তু আমরা সবাই এটা জানি, এই স্বচ্ছতা, এই সারল্য এই নিমোর্হ জীবনের প্রতি আমাদের এক অর্ন্তলীন আকর্ষণ আছে। তাই রাজকুমার যখন পাশে নেই, তখন আমরা স্মৃতিকাতর হই। আমাদের নানা রঙে মাখামাখি জীবনে জলীয় স্বচ্ছতার জন্য আকুল হই।

সবুজ বাঘের আহ্বানে আগামীকাল (শুক্রবার ২৩ অক্টোবর) সারাদিন এবং সারারাত আমরা থাকবো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাজকুমার স্মরণ না, আসলে নিজের বিস্মৃতিকেই জাগিয়ে তোলার একটা চেষ্টা; অনেক গাছ কাটা হয়েছে জানবিবি-তে। তবুও এখনো সেখানে গেলে কেন জানি মনে হয়, সারল্য এখনো অপাঙতেয় নয়।


মন্তব্য

সুমন চৌধুরী এর ছবি

মেলানকলিক ধরনের লেখা। রাজকুমারের আনন্দদায়ক স্মৃতিগুলি এখন একেকটা আলাদা আলাদা বিষাদের... কখনো অভিমানের উৎস। আমাদের অনেকেই একসময় প্রাণপণে চেয়েছি রাজকুমার হতে। কিন্তু প্রাণের সেই পণে যথেষ্ট অস্বচ্ছতা অসততা থাকায় আর হয়ে ওঠেনি। রাজকুমার আমাদের চেয়ে ভালো কী না সেই বালের আলাপ এখানে অপ্রাসঙ্গিক। এখানে কথা একটাই। রাজকুমার এমন একটা কিছু পেরেছে যা আমরা পারি নাই ........



অজ্ঞাতবাস

রণদীপম বসু এর ছবি

লেখাটা খুব ভালো লাগলো রাজকুমার নামের একটা রহস্যময় অন্তর্জালিক চরিত্রকে চমৎকার স্কেচে অনুকৃতি দিতে পেরেছেন বলেও নয়, বরং আপনার অন্যান্য তথ্যবহুল লেখার দায় থেকে মুক্ত হয়ে এই লেখাটাতে প্রকৃতই সাহিত্য মাখিয়ে দিতে পেরেছেন খুব সফলভাবে, এজন্যই।
আপনার কলমের স্বতঃস্ফূর্তকাকে সম্মান জানাচ্ছি। আর রাজকুমারও আমাদের কাছে রহস্যময়ই থাকুক। কেননা এই রহস্যময়তা তাকেই মানায়, কিংবা আপনারা যারা তাঁর সহচর তাঁরা তাঁকে রহস্যময় করে তুলতে পেরেছেন বলে।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

সোহাগ [অতিথি] এর ছবি

রাজকুমারকে চিনি না জাবি তে সে যে মিথ সচলে জানলাম যাই হোক সুন্দর লেখা। শাপলুকে বলছি ডেইরি ফার্ম গেটে একটা বিড়ি খাস আমার নামে।

Shahriar এর ছবি

গাজা কী মাগনা পাওয়া যায়? তাই রাজকুমার-রা বা্স্তব নয়|আমরা কয়েকদিনের জন্য রাজকুমার ছিলাম বটে!Like your writing! shalar mouse keyboard-e likhte parlam na ar!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।