টিপ

যূথচারী এর ছবি
লিখেছেন যূথচারী (তারিখ: বিষ্যুদ, ২২/০৪/২০১০ - ১১:৫৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রাচীন বাংলা অঞ্চলের মানুষের কপাল-সজ্জায় যেসব অলঙ্কার এবং প্রশাধন দেখা যায়, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো টিপ, তিলক এবং কুমকুম। সোনা বা রূপায় তৈরি তারকা-আকৃতির এক ধরনের টিপ ভারহুত-এ প্রাপ্ত কয়েকটি ভাস্কর্যে দেখা যায়, একে বলা হয় সিতারা।

বাংলা অঞ্চলে টিপ আর কপাল যেন অবিচ্ছেদ্য মানিকজোড়। যেখানেই কোনো মানুষের কপাল পাওয়া গেছে (মানে ভাস্কর্যে বা চিত্রে কপাল দৃশ্যমান) সেখানে অবশ্যই টিপ থাকবে। টিপ না থাকাটাই যেন ব্যতিক্রম। বাংলা থেকে প্রাপ্ত শত শত ভাস্কর্যে প্রাপ্ত টিপের মধ্য থেকে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় (কমন), এমন ৮ ধরনের টিপ হলো:

পাতা আকৃতির টিপ
এ ধরনের টিপ পাই দশম-একাদশ শতকের ষড়ক্ষরী লোকেশ্বর মূর্তির কপালে। জয়পুরহাটের পাঁচবিবি থেকে প্রাপ্ত ১১ শতকের একটি বিষ্ণুমূর্তির কপালেও অনুরূপ টিপ পাওয়া যায়। চিকন একটি লম্বা পাতা, অনেকটা পাটের পাতার মতো। এমন টিপ বাংলার ভাস্কর্যের সবচেয়ে সাধারণ বৈশিষ্ট্য।

চার-বরফি নকশি টিপ
বরফি হলো অনেকটা এই রকম জিনিস: ◊
ওপরে একটি বরফি নিচে একটি বরফি, দু'পাশে আরো দুটি বরফি এই নিয়ে চার-বরফি টিপ। এ ধরনের টিপ পাওয়া যায় পাহাড়পুর (সোমপুর) মহাবিহারের কেন্দ্রীয় মন্দিরের পাদদেশ থেকে প্রাপ্ত খ্রিস্টীয় ৫ম-৬ষ্ঠ শতকের শিব-পার্বতী ভাস্কর্যে (ভাস্কর্যটিকে অবশ্য অন্য নামে চিহ্নিত করেছে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ, কিন্তু ভাস্কর্যটির হাতে থাকা ডুগডুগি এবং অন্যান্য প্রতীক থেকে এটিকে শিব-পার্বতীর ভাস্কর্য ছাড়া অন্য কিছু মানতে আমি নারাজ) শিবের কপালে। এই ভাস্কর্যটি ছাড়াও আরো অনেক ভাস্কর্যে এই ধরনের চার বরফি টিপ দেখা যায়।

এক বরফি নকশি টিপ
এ ধরনের টিপ পাওয়া যায় জয়পুরহাটের পাথরঘাটা থেকে প্রাপ্ত কালো পাথরে তৈরি ৯ম-১০ম শতকের গড়ুর মূর্তির কপালে। রাজশাহী থেকে প্রাপ্ত একাদশ শতকে নির্মিত কালো পাথরের একটি খসপর্ণ লোকেশ্বর মূর্তির কপালেও একটি বরফির নকশি টিপ পাওয়া যায়। এটিও একটি কমন টিপ।

বৃত্তাকৃতির টিপ
এককালে যদিও বাংলায় এই ধরনের টিপের ব্যবহার প্রচুর ছিল, তবে প্রাচীন বাংলায় এই ধরনের সহজ টিপ তুলনামূলকভাবে একটু কমই দেখা যায়। বগুড়ার আদমদিঘিতে প্রাপ্ত খ্রিস্টীয় একাদশ-দ্বাদশ শতকের পার্বতীর কপালে এ ধরনের টিপ পাওয়া যায়। আরো পাওয়া যায় রাজশাহী থেকে প্রাপ্ত একাদশ শতকে নির্মিত কালো পাথরের একটি বুদ্ধ মূর্তির কপালে।

বর্শার ফলা আকৃতির টিপ
এ ধরনের টিপ পাওয়া যায় জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল থেকে প্রাপ্ত ১১-১২ শতকের কালো পাথরে তৈরি একটি বামন বিষ্ণুর কপালে। ত্রিভুজ আর বর্শার ফলার মধ্যে অনেক পার্থক্য যেটা সহজেই চোখে পড়ে, তার পরেও পাতা, ত্রিভুজ আর বর্শার ফলা- এই তিন টিপ আলাদা করতে আমাদের যথেষ্ট ঝামেলা পোহাতে হয়েছে।

ত্রিভুজাকৃতির টিপ
এ ধরনের টিপ পাওয়া যায় জয়পুরহাটের পাঁচবিবি থেকে প্রাপ্ত একাদশ শতকের চক্রপুরুষের কপালে।

মাছ আকৃতির টিপ
এ ধরনের টিপ পাওয়া যায় রাজশাহী থেকে প্রাপ্ত কাঠে নির্মিত ঊনিশ শতকের রাধা একটি ভাস্কর্যে।

ক্রীস্টমাস ট্রি ধরনের টিপ
এটার যে কী নাম দেবো বুঝতে পারছি না, প্রথমে দিলাম লম্বু টিপ, পরে দিলাম, ত্রিভুজগাড়ি টিপ। দেখতে অনেকটা এই রকম- প্রথমে একটা লম্বা সমদ্বিবাহু ত্রিভুজ, যার ভূমিটি অপেক্ষাকৃত ছোট, তার নিচে একটু ছোট একই ধরনের আরেকটি ত্রিভুজ, তার নিচে দুটি চাকা। এই ধরনের টিপের দেখা পাই রাজশাহীর গোদাবাড়ি থেকে প্রাপ্ত খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতকে পাথরে নির্মিত গঙ্গার কপালে। মূর্তিটি অপরূপা। টিপটিও অনন্য। জানেন বোধহয়, গঙ্গার রূপে ব্রহ্মা-বিষ্ণু সকলেই পাগলপারা হয়ে গিয়েছিলেন।

পুনশ্চ: এক. এখানে শুধু সেই মূর্তিগুলোর কথাই বলা হয়েছে, যে মূর্তিগুলোতে এই টিপগুলো প্রকটভাবে দৃশ্যমান। মানে আতশী কাচ ছাড়াই দেখতে পাবেন।
দুই. এটিও আরেকটি অহেতুক রচনা।


মন্তব্য

মাহবুব লীলেন এর ছবি

এই লেখাটা কিন্তু দুর্দান্ত হয়েছে
সুযোগ পেলে টিপগুলোর ছবি যোগ করে দিলে একটা কাজের কাজ হবে

০২

আমার একটা সাধারণ অবজারভেশন হলো প্রাচীন মূর্তিগুলোতে প্রায় সব পুরুষের কপালে টিপ থাকলেও টিপের বর্তমান ব্যবহার প্রায় পুরোটাই মেয়েদের দখলে

টিপছাড়া পুরুষমূর্তি ঠিক কবে থেকে পাওয়া গেছে সে বিষযে কি কোনো তথ্য আছে আপনার কাছে?

নাশতারান এর ছবি

দুর্দান্ত রচনা! ছবি থাকলে আরো মজা পেতাম। নিদেনপক্ষে আকৃতিগুলো হাতে এঁকে দিতে পারতেন।

এমন অহেতুক পোস্ট আরো চাই।

অফটপিকঃ বানান বিষয়ে দুটো কথা এখানে

_____________________

আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।

এনকিদু এর ছবি

দারুন লেখা, নতুন জিনিস শিখলাম । ফটোর অভাবে লেখাটা দারুন থেকে অসাধারণে উঠতে পারলনা । ফটো যদি নাও থাকে, কম্পিউটারে ছবি এঁকে কিন্তু দেয়া যেতে পারে, ভেবে দেখবেন ।

একটা চিন্তা মাথায় ঘুরছে । প্রথম যেই টিপের কথা বললেন, পাতা আকৃতি, সেটা কি কপালে আঁকা রাজতীলক হতে পারে ?


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

মূলত পাঠক এর ছবি

যদি ছবি ছাপাতে সমস্যা থাকে তো লিঙ্ক দেন। এই সব চমৎকার বর্ণনা শুনে অবধি ছবি দেখার ইচ্ছাটা প্রবল হয়ে উঠেছে।

যূথচারী এর ছবি

ছবি গুলো ডেস্কটপে আছে। সেটা এই মুহূর্তে আমার সাথে নেই। আচ্ছা, কালকে ছবিগুলো দেয়ার চেষ্টা করবো।

মাহবুব লীলেন,
আপনি তো ব্যাপারটা জানেনই যে, বাংলার ধ্রুপদী মূর্তি বলতে আমরা বুঝি দুটি সময়কে- গুপ্ত এবং পাল। এর মধ্যে প্রথম ধরনটিই বেশি আকর্ষণীয় বলে বিবেচিত হয়। মূর্তি তো এখনো তৈরি হয়। এবং এখনো মূর্তি তৈরি করা হলে, প্রায়শই টিপ দেয়া হয়। আপনি যে প্রশ্নটি করেছেন, সেটার জবাব দেয়া কঠিন। কারণ সব মূর্তিতেই টিপ আছে। সমস্যা হলো, মূর্তির সংগ্রহ কম। ৬ষ্ঠ-৭ম শতক, তারপর ১১শ-১২শ শতকের মূর্তিতে তো টিপ আছেই। এর পরের সংগ্রহ ১৮শ শতকের। সেখানেও টিপ আছে। এখনকার মূর্তিতেও আছে। আরো জেনে আপনাকে পরে আবার জানাবো।

এনকিদু,
না, রাজতিলক না। তিলক নিয়ে পরে একদিন আলোচনা করবোনে। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলার পোশাক, অলংকার ও সাজ নিয়ে একটা পাণ্ডুলিপি তৈরি করা আছে। নানা কারণে শেষ পর্যন্ত বের হয়নি। (প্রকাশক থাকলে জায়গায় থেকে আওয়াজ দিয়েন, জায়গায় গিয়ে পৌঁছে দেবো)।


চোখের সামনে পুড়ছে যখন মনসুন্দর গ্রাম...
আমি যাই নাইরে, আমি যেতে পারি না, আমি যাই না...


চোখের সামনে পুড়ছে যখন মনসুন্দর গ্রাম...
আমি যাই নাইরে, আমি যেতে পারি না, আমি যাই না...

হরফ এর ছবি

খুবই তথ্যবহুল মনোজ্ঞ রচনা। ছবি দেখার ইচ্ছা রইলো।
-----------------------------------------
"ছুটলে কথা থামায় কে/আজকে ঠেকায় আমায় কে"

ছুটলে কথা থামায় কে/আজকে ঠেকায় আমায় কে

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- প্রতিটা ধরণের টিপের সাথে সংশ্লিষ্ট ছবি দেখার সাধের কথা আমিও জানিয়ে গেলাম।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

মামুন হক এর ছবি

দারুণ তথ্যবহুল লেখা। ভালো লাগলো খুব। ছবির দাবী জানিয়ে গেলাম আমিও।

অতিথি লেখক এর ছবি

পুরানকালে পুরুষরা টিপ দিত, জানতাম নাতো, ছবি কবে দিবেন অপেক্ষায় রইলাম?

স্বপ্নদ্রোহ

রানা মেহের এর ছবি

দারুন।
ছবির অপেক্ষায় রইলাম আমিও
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

জগাই এর ছবি

কয়েকটি প্রশ্ন : ভারহুতে প্রাপ্ত ভাস্কর্য পাথরের, কি করে বোঝা গেল টিপ সোনা বা রূপায় তৈরি ?
ভারহুতের আমলেও কি ‘সিতারা’ বলত ?
সব টিপ বোধহয় টিপ নয়, বিষ্ণুর কপালে খাড়া পত্রাকৃতি ত্রিনয়নের চিহ্ণ । বুদ্ধের কপালে গোলাকৃতি চিহ্ণের নাম ঊর্ণা, ৩২টি মহাপুরুষলক্ষণের একটি, তাঁর ত্রিনয়নের প্রতীক।

নৈষাদ এর ছবি

চমৎকার লেখা। ছবির ব্যাপারে অন্যদের সাথে সহমত।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।