বন্ধু, বন্ধুত্ব অথবা একজন ক্লাসমেটের গল্প

মাহবুব ময়ূখ রিশাদ এর ছবি
লিখেছেন মাহবুব ময়ূখ রিশাদ [অতিথি] (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৫/০৮/২০১৩ - ১০:৫৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

# এনাটমি ডিসেকশন রুমের বুড়ো কংকাল আজ কেমন আছে? ক্যালসিয়ামের অভাবে ক্ষয়ে গিয়ে কী ঝরে পড়েছে মাটিতে? সুভাষ দাদু তার শত ব্যবহার্য ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করে ফেলেছেন সব? ডিসেকশন রুমে ঢোকার মুখে বড় বড় তিনটা চৌবাচ্চার মতো বাথটাবে ফরমালিন গোসল কেমন হচ্ছে নাম না জানা মানুষগুলোর? রুমের এক পাশে যেখানে শ্যাওলামাখা জানালার পাশে রাখা ডেডবডি দেখে একদা ভয় পেয়েছিল বালক, মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল সহপাঠিনীর কোলে, যেখান থেকে জানা যায় প্রেম শুরু হতে স্থানের কোনো ব্যাপার নেই সেখানে অথবা তার ঠিক আশেপাশে পরীক্ষার পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে হৃদয় অথবা ফুসফুস হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে কোন ব্যাচের ছাত্ররা?
ফিজিওলজী টার্মে কি এখনো সবাই মিলে একসঙ্গে ফেল করে? পাশ করে আগের মতো বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যায় কেউ? গোলচত্বরের মিছিলে কার ভোকাল সবচেয়ে জোরে শব্দ তোলে আজ?

এই কথাগুলো ভাবছিল অনেকেই। কাল রি-ইউনিয়ন। মেডিকেল ক্যাম্পাসে ফিরে যাবার একটা উপলক্ষ্য অথবা বলা যায় নিজের আত্মার কাছে ফিরে যাওয়ার সুযোগ। যেতে পারব না, এই কাজ সেই কাজ বলে অনেকেই তো এড়িয়েই যেতে চাইল। এমনকি সবার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া ইকবাল পর্যন্ত যাওয়ার জন্য রাজি হয়ে গেল।

অথচ আজ ক্যাম্পাস ছেড়ে যাওয়ার তিন বছর পর রি-ইউনিয়নের প্রাক্কালে এমনভাবে ইকবালের সামনে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হতে পারে, কেউ কোনোদিন চিন্তা করে নি।

ছোটন বিড়বিড় করে বলে, দোষটা কী আমার? ভুলেই তো গিয়েছিলাম, শুধু শুধু কেন ফোন দিতে গেলাম?

ছোটন অবশ্য জানে, ক্যাম্পাস ছেড়ে যাবার পর ইকবালের সঙ্গে যে খুব যোগাযোগ থাকবে এটা কেউ চিন্তা করে নি। কেউ কেউ চোখের আড়াল হলে যে সত্যি মনের আড়াল হয়ে যায় ইকবালের ব্যাপারে ওর বন্ধুদের ক্যাম্পাস পরবর্তী অনিচ্ছাকৃত অনাগ্রহের কথা অনেকটা সে কথাই প্রমাণ করে। হয়ত এর দায় অনেকটা ইকবালের-ই ছিল, হয়ত সবসময় যোগাযোগ রাখার মতো ঘনিষ্ঠতা সে কখনো গড়ে তুলতে পারে নি কিংবা ওর বন্ধুদের-ই দায় ছিল-ইকবালের নীরবতার ভেতরে ওরা কখনো ঢুকতে চেষ্টাই করে নি অথবা নীরবতার ভেতরেও যে ঢোকার রাস্তা আছে সে ব্যাপারে তারা একেবারে অজ্ঞ ছিল।

#
সৌরভ সারারাত ডিউটি করে এসে ঘুমোচ্ছিল। বেরসিক ফোন বেজে উঠে তার সদ্য শৈশবে থাকা সকালিক ঘুমের মাঝে ছেদ ঘটালে সে কিছুটা বিরক্তি নিয়ে ফোন ধরে।

সৌরভ, তুই কোথায়?

ঘুমাচ্ছি। কাল নাইট ছিল।

আচ্ছা শোন, আমরা ইকবালের বাসায় যাচ্ছি। তুই চলে যায়।

ইকবাল? কোন ইকবাল? আজ রাতে না আমাদের চিটাগাং এ রি-ইউনিয়নের যাবার কথা?

আমাদের ইকবাল, ইনোসেন্ট ইকবাল। ও কাল রাতে মারা গেছে।আমি মেসেজে ওর বাসার ঠিকানা পাঠিয়ে দিচ্ছি।

খুব প্রিয় কিংবা কাছের কোনো মানুষের একেবারে চলে যাওয়ার সংবাদ যদি কেউ ফোনে শুনে তবে নিঃসন্দেহে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে হাত থেকে ফোন পড়ে যেতে পারে, সারারাত জেগে থাকার ক্লান্তি সত্ত্বেও ঘুম একেবার দূর হয়ে যেতে পারে, সমস্ত পৃথিবী বিশাল শূণ্যের ভেতরে হারিয়ে যেতে পারে, কান্নায় চোখ ভেঙ্গে যেতে পারে। সৌরভ কেবল চমকে ওঠে আর তার ঘুম সঙ্গে সঙ্গে চলে যায়। অবশ্য এখানে তর্কের অবকাশ থাকে যে, সৌরভ আসলে কেন এত চমকে ওঠে? মৃত্যুসংবাদ শুনে নাকি তার দীর্ঘদিনের রুমমেটকে সে মাত্র তিন বছর পর কোন ইকবাল বলে প্রশ্ন রেখেছিল বলে? তার জবাব কিছুক্ষণ পর সৌরভের ভাবনার ভেতরে বের হয়ে আসে। সৌরভ নিজেকে বলে, ইকবালকে আমি চিনতে পারলাম না?

কী, ব্যাপার এত তাড়াতাড়ি তোমার ঘুম ভেঙ্গে গেল?

ইকবাল মারা গেছে, কাল রাতে।

ইকবাল, মারা গেছে! মানে কী? আমাদের ব্যাচের ইকবাল? তোমার রুমমেট? যাকে তোমরা ইনোসেন্ট ইকবাল বলে ডাকতে? হু, বলে বিছানা থেকে নেমে বাথরুমের দিকে যায় সৌরভ। আর ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে সাজিয়া, সৌরভের বউ যে একসময় ইকবালের সঙ্গে এক-ই ক্লাসে পাঁচ বছর কাটিয়েছে কিন্তু কোনোদিন কথা বলে নি কিংবা কথা বলার সুযোগ হয় নি। সাজিয়া কাদতে শুরু করে। ব্যাপারাটা এতটা আকষ্মিক যে সে হয়ত নিজেকে ধরে রাখতে পারে নি আর। বাথরুম থেকে কান্নার শব্দ শুনে পুনরায় নিজেকে প্রশ্ন করে সৌরভ। সাজিয়ে যেখানে একবার বলা মাত্র ইকবালকে চিনে ফেলল, আর সে পারল না? ওকে কাঁদতে দেখেও বিস্মিত বোধ করে সৌরভ। খুব শক্ত মেয়ে। কখনো কাঁদতে দেখে নি। ছাত্র জীবনের শেষ দিকে যখন হাত কেটে, প্রায় দু ডজন ঘুমের ঔষধ খেয়ে অর্ধ-মৃতের মতো স্টুডেন্ট কেবিনে পড়েছিল তখন সে এসে বলেছিল, এসব নাটক বন্ধ করে পুরোপুরি মরে দেখাও। আর আজ সে প্রায় বিস্মৃতির অতলে চলে যাওয়া ইকবালের চির প্রস্থানের খবর শুনে এভাবে অঝোর ধারায় কাঁদছে?

আমি যাচ্ছি ওখানে। তুমি কী যাবে? সাজিয়া নিঃশব্দে সম্মতি জানায়।

খুব খারাপ লাগছে? বের হতে হতে জিজ্ঞেস করে সৌরভ। লাগাটা কী অস্বাভাবিক? তোমার লাগছে না? চুপ হয়ে যায় সৌরভ।

এতক্ষণ ধরে ভেবেছে সে কেন ইকবালকে চিনতে পারে নি, ইকবাল ও কি তার কথা এভাবে ভুলে গিয়েছিল? সাজিয়ার প্রশ্ন শুনে তার খেয়াল হলো ইকবাল কী তার কথা সত্যি ভুলে গিয়েছিল কি’না তা আর কোনোদিন জানা হবে না। সিএনজিতে ওঠার আগ পর্যন্ত ওরা চুপ করে থাকে।

সৌরভ টের পেতে থাকে, তার এবার খারাপ লাগছে। কতদিন যে ওর বিছানায় গিয়ে এবড়ো-থেবড়ো হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে তার হিসেব নেই। আজ সেই ইকবাল কি’না নিজস্ব ঠিকানার একেবারে স্বৈরাচারী দাবিদার হয়ে দখল করে বসল, যেন কেউ আর তার জায়গা নিতে না পারে?
জানো, আমি প্রথমে ইকবালকে চিনতে পারি নি। মনে হচ্ছিল, কোথাকার কে মারা গেছে আমাকে যেতে হবে কেন?

যার সঙ্গে ছয় বছর রুম শেয়ার করে থেকেছ, তাকে চিনতে পারো নি? সাজিয়ার কন্ঠেও বিস্ময় ঝরে পড়ে।

আমার তো এটাই অবাক লাগছে। এমন নয় যে কেবল, রুম শেয়ার; ওর বেডে যখন ইচ্ছে তখন গিয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম, ওর শার্ট পড়ে বের হয়ে যেতাম, ওর এপ্রন কলেজে নিয়ে গিয়ে হারিয়ে ফেলতাম। সময় তো খুব বেশি পার হয় নি, মাত্র তিন বছর!

তুমি তো ওকে আমাদের বিয়েতেও দাওয়াত দাও নি। সাজিয়া আরেকটি ভুলের কথা মনে করিয়ে দেয় দীর্ঘশ্বাসের সাথে।

সৌরভ আবার চুপ হয়ে যায়। আসলেই ওকে দাওয়াত দেয়া হয় নি। দাওয়াত দেয়ার কথা মনে ছিল না। যাদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে, তাদেরকে ফোন দিয়ে বলা হয়েছিল আর বাকিদের ফেসবুকে ইভেন্ট খুলে বিয়ের কথা জানিয়েছিল। ইকবালের ফেসবুক আইডির কথা ভ্রু কুঁচকে মনে করার চেষ্টা করে সৌরভ। ইকবালের হয়ত ফেসবুক আইডি ছিল না; না হয় কত মানুষের সঙ্গেই তো কথা হয়-চেনা, অচেনা, ইকবালের সঙ্গে তবে হবে না কেন?

আচমকা ব্রেকে চাপ দিতে হয় সিএনজি ড্রাইভারকে। একটা ছোট বাচ্চা, খুব বেশি হলে ছয় থেকে সাত বছর বয়স সিএন জির সামনে হুট করে দৌড় দিয়েছিল।

অসতর্ক অবস্থায় সামনের স্টিলে গিয়ে হালকা বাড়ি খায় সাজিয়া। সেদিকে তার ভ্রুক্ষেপ হয় না খুব একটা। হালকা ধাক্কা খাওয়ায় চুল সামনের দিকে চলে এসেছে। মাথা কিছুটা নিচের দিকে ঝুঁকিয়ে রেখে সাজিয়া জিজ্ঞেস করে, আমি মরে গেলেও বোধহয় এভাবে ভুলে যাবে, না? অন্য কারো সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে আলাপ করতে করতে এভাবেই হয়ত কোথাও যাবে। তাই না?

অদ্ভুত কথা বলবে না। এই ঘটনার সঙ্গে তোমার কী সম্পর্ক? নিজেকে জড়াচ্ছ কেন?

সাজিয়া বলে, তোমার সঙ্গে যে জড়িয়ে আছি।মানছি, দুটো এক না। কিন্তু একেবারেই কী আলাদা?

ধানমন্ডি থানার সামনে এসে সিএনজি থামে।

এসে গেছি? সাজিয়া জানতে চায়।

জানি না। ছোটন বলেছিল, থানার পাশের বাড়িতে। দেখি, ওকে ফোন দিয়ে।

সৌরভ চারপাশে তাকাচ্ছে। তার খুব শখ ধানমন্ডিতে ফ্ল্যাট কিনবে সে। তার বাবার শখ ছিল বাড়ি বানাবে। দোতালা বাসা। সামনে একটি সুইমিং পুল। দানবাকৃতির গেটে ঝোলানো থাকবে নোটিশ, ‘ কুকুর হইতে সাবধান ‘। আর সৌরভের চাওয়া এখন দমবন্ধ করা ফ্ল্যাট কেনার স্বপ্নে পরিণত হয়েছে।

সাজিয়াও সিএনজি থেকে নামে। একটু আগে চুল এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। কোন ফাকে ঠিক করে নিয়েছে।

তোরা এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ছোটনের কন্ঠ শুনে হুশ ফিরে সৌরভের এবং আবার লজ্জিত হয়। মৃত বন্ধুকে দেখতে এসে বাড়ির কথা ভাবছিল, সাজিয়াও অভ্যাসবশত নিজের চুল ঠিক করে নিয়েছিল, অথচ কিছুক্ষণ আগেও সে কাঁদছিল; সবকিছু এগিয়ে চলে স্বাভাবিক নিয়মে। সাজিয়ার প্রশ্নটা উঁকি দেয় মনে। আসলেই তো সাজিয়া কিংবা অন্য কাছের কেউ মারা গেলেও কী এভাবেই স্বাভাবিক থাকবে জীবন?

বাসা কোনটা?

এই তো এখানেই। সামনের বিল্ডিং এর দোতলায়।

ছোটনকে উদ্দেশ্য করে সৌরভ বলে, চল যাই।

যেতে ইচ্ছে করছে না। এতক্ষন ছিলাম। আমিই তো ওকে মেরে ফেললাম।

কী বলিস, এইসব?

ছোটন বলে, কী দরকার ছিল এতদিন পর ফোন দেবার? কী দরকার ছিল ওকে আসতে বলার?

আমতা আমতা করে সৌরভ বলার চেষ্টা করে, এটা কী তুই জানতি যে দূর্ঘটনা ঘটবে?

ছোটন সিগারেট ধরায়। বলতে থাকে, আমাদের সাথে ও সব জায়গায় যেত। সেন্ট-মার্টিন, বান্দরবন; কোথায় যায় নি সে? অথচ দেখ, কোন গ্রুপ ছবিতে ছেলেটা নাই। ঐ তো আমাদের সব ছবি তুলত।থাকবে কী করে?

সাজিয়া বলে, এসেছি যখন ভেতরে তো যাব। এসব কথা এখন বলে কী লাভ?

বাড়িতে ঢোকার সময় সৌরভের মনে হলো, এরা তো দেখি ভালো বড়লোক ছিল।সৌরভ অবশ্য জানে না, ছোটন, সাজিয়া কিংবা আরো অনেকের ঠিক এই কথাটি মনে হচ্ছিল।

মৃত বাড়ির চেহারা ঠিক যেমন হওয়ার কথা তেমন দৃশ্য দেখা যায় না। কান্নার রোল নেই, হৈ চৈ নেই, মিনিটে মিনিটে কেউ ফিট হয়ে যাচ্ছে না।বাড়ির মানুষদের চোখে পড়ে না। বেশ বড় বাসা। হয়ত ভেতরে কোথায়। এমন নীরব মৃত বাড়ির চেহারা অস্বাভাবিক লাগে সৌরভের। বুঝতে পারে ছোটন কেন বাইরে দাড়িয়ে আছে।

তবে ইকবালের বন্ধু-বান্ধব অনেকেই এসেছে। লাশের পাশে রিনা দাঁড়িয়ে সবাইকে চাদর সরিয়ে চেহারা দেখাচ্ছে। সৌরভ তার রুমমেটের চেহারায় মৃদু হাসি লক্ষ্য করে অবাক হয়। একটু দূরে আরো কয়েকজন বন্ধু টুকটুক করে আড্ডা দিচ্ছে। তেমন কোনো শোকের চিহ্ন নেই কারো মুখে। ছোটোখাটো একটা রি-ইউনিয়ন এখানেই হয়ে গেল যেন।

#

প্রায় তিন বছর ছোটনের ফোন পেয়ে নস্টালজিক হয়ে গেল ইকবাল।

ক্যাম্পাসে রি-ইউনিয়ন হচ্ছে। চলে আয়, বন্ধু। অনেক আড্ডা হবে।

চলে আসব। ডেট জেনে নিয়ে ফোন রেখে দিলো সে।

এটা ছোটনের ট্রেডমার্ক ডায়লগ, চলে আয় বন্ধু। এখনো বদলায় নি। ভোর চারটার দিকে কিংবা পাঁচটার দিকে রুমের দরজা খটখট করে ধাক্কা দিয়ে ওর আর সৌরভের ঘুম ভাঙ্গিয়ে বলত চলে আয় বন্ধু, কবুতরের মাংস খেয়ে আসি। স্পেশাল পার্টিগুলোর দিনেও ইকবালের কাছে ডাক এসে যেত, চলে আয় বন্ধু। মজা হবে।আসলেই মজা হতো। বন্ধুরা গলা ভেজাতে ভেজাতে পাগলামি করত আর ইকবাল চুপচাপ দেখত।

ইকবাল কখনো গলা ভেজায় নি। এই নিয়ে অনেক হাসাহাসি করত, ব্যাকডেটেড বলত। ইকবালের কোনো ভ্রুক্ষেপ হতো না ।বড় হয়ে যাওয়া মানুষের বাচ্চাদের মতো পাগলামি দেখতে ভালো লাগত ইকবালের । ওদের দেখে অবাক হতো। মনে হতো, জীবনের গ্লানিগুলো উগড়ে দিচ্ছে। কেউ পড়াশোনা বাদ দিয়ে রাজনীতিতে ঢুকে পড়েছে, কারো ফ্যামিলির অবস্থা ভালো না, টিউশনির টাকা আসছে না, পাশ করতে পারছে না, প্রেমিকার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, কত শত সমস্যা সবার। ইকবাল নিজের কোনো সমস্যা খুঁজে না পেয়ে চুপচাপ বসে থাকত। এ জন্য হয়ত তার কোনোদিন কিছু খেতে ইচ্ছে হয় নি। কোনো দুঃখ তো নেই, তবে কী উগড়ে দিবে সে? মাঝে মাঝে ইকবালের মনে হয় অহেতুক এই আড্ডায় ডাক কেন পড়ে তার? হয়ত বন্ধুরা তাদের সামনে একজন সমস্যাহীন মানুষকে দেখে মদ্যপানে অধিক উৎসাহী হয়ে ওঠে। কোনোদিন জিজ্ঞেস করা হয় নি তার। এবার ভাবে গিয়ে জিজ্ঞেস করবে।

বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে রিনার সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়াটা অলৌকিক কিছু মনে হয় না।রিনা তাকে প্রাথমিকভাবে চিনতে ব্যর্থ হয় তাতেও অবাক হয় না সে। সে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বলে, আমি ইকবাল। আমি তোমার ব্যাচমেট। চিনেতে পারছ না? এই বলে মিষ্টি করে হেসে ফেলে ইকবাল।

ব্যাচের সুন্দরীদের একজন ছিল রিনা। ক্যাম্পাস স্টার। নাচ, গান, ব্যাচ প্রোগ্রামের উজ্জ্বল নক্ষত্র; এভাবে হয়ত একটা প্রাথমিক ধারনা দিয়ে ফেলা যায় রিনার ব্যাপারে। কিন্তু ইকবালের ব্যাপারে? চেহারায় কি খুব একটা বিশেষত্ব ছিল? চুলগুলো কি অন্যদের থেকে আলাদা ছিল? দেয়াল পত্রিকাগুলোয় লিখত? রাজনীতি করত? নাহ, এর কোনো কিছুই সে করত না। তাই ইকবালের পরিচয় দিতে গেলে বোধহয় এভাবে বলাই শ্রেয় ব্যাচের অসাধারণ কিছু ছেলের একটা সাধারণ বন্ধু ছিল। তাকে সবাই ইকবাল বলে ডাকত।

রিনা যদি এমন কাউকে না চিনে তবে সেটা দোষের না। ইকবাল বিষয়টা জানে, তাই তার মন খারাপ হয় না। ইকবালের অবশ্য আদৌ কখনো মন খারাপ হয় কি’না তা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক হতে পারে তার বন্ধুদের ভেতরে।

এক পর্যায়ে এই বিশেষত্বহীন চেহারা রিনার মনে পড়ে এবং সে লজ্জিত বোধ করে।

কথা শুরু হয় আর আট দশটা কথোপকথের মতো করে।

কোথায় আছ, কেমন আছ? কী করছ? এফসিপিএস দিয়েছ? বিয়ে? এরপর দুজনের কথা আচমকা কিন্তু প্রত্যাশিতভাবে শেষ হয়ে যায়। বাসে দুজনের সিট পাশাপাশি পড়ে। যাত্রা শুরু হবার কিছুক্ষণ পর তাই যখন ইকবাল বলে ওঠে, আত্মহত্যা বিষয়ে তোমার কী মতামত?

ঠিক এই অবস্থায়, বাসের স্পিড ষাটের ঘরে, কাঁচপুর ব্রিজ পার হয়ে এখন দু পাশে অন্ধকারাচ্ছন্ন ধানক্ষেত, চোখেও হালকা ঘুম লেগে আসছে; এই ধরনের প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিল না রিনা।

মানে? এটুকু বলে আর কিছু বলার থাকে না তার।

আমি তখন ছোট। ক্লাস সেভেনে পড়ি। আমার ভাই, রাগ করে আত্মহত্যা করে বসল। আমরা ঠিক টের পাইনি কেন ছোট্ট মুখের ভেতর কিসের এত বেদনা নিয়ে সে আমাদের ছেড়ে গেল। কখনো কখনো মনে হতো, ও বোধহয় আমার উপর রাগ করে চলে গেছে। টিভির চ্যানেল চেইঞ্জ করা নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল। আবার মাও ভাবত, বোধয় মা’র উপর রাগ করে চলে গেছে। বাবাকে দেখে কিছু বোঝা যেত না। কী যে একটা অসহায়ত্ব! আমরা কেবল ঘরের চারপাশে মৃত্যুর কারণ খুঁজে বেড়াতাম। চিটাগাং গিয়ে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম সব। সবাইকে দেখতাম। ভালো লাগত। আমি দুঃখী ছিলাম না কখনো। মাঝে মাঝে একটা কারণ খুঁজে বেড়াতাম, এই যা।

এসব কথা শুনলে যা হয়, চুপ করে থাকতে হয়, রিনাও তাই চুপ করে থাকে।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, কেন রিনার সঙ্গে ইকবালের দেখা হয়ে যাবে? কেন তারা পাশাপাশি বসবে? কেন, ইকবাল না বলা কথাগুলো হুট করে রিনাকেই বলে ফেলবে?

কিছুক্ষণ পর মুখোমুখি সংঘর্ষে ইকবাল ঘটনাস্থলে মারা গেলে, মাত্র এক হাত দূরত্বে সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় রিনা ঘোলাটে দৃষ্টি মেলে ইকবালকে ডাকার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত এই ধরনের একটা সমীকরণ দাঁড়ায়, এভাবে মরে যাবে দেখেই হয়ত গত কয়েকদিনের কাকতালীয় ঘটনাগুলোর অবতারণা হয়েছিল।

রিনার ঐ অবস্থায় মনে হতে থাকে, তার জীবন বেঁচে গেছে। তার ছোট্ট বাবুটার যে পেটের ভেতরে চুপচাপ বড় হচ্ছে, তার জীবন বেঁচে গেছে। উদ্ধারকর্মীরা এলে সে ছোটনকে ফোন দেয়। তার আগে বলে, আমি একজন ডাক্তার। ইকবালকে দেখিয়ে বলে, ও আমার ক্লাসমেট। খুব সম্ভবত মারা গেছে।

এই সময় তার কন্ঠস্বরের ওঠানামা লক্ষ্য করা যায়। এই তারতম্য কি ক্লাসমেটের মৃত্যুর কারণে নাকি এই ধরনের একটা বিপর্যয় থেকে বেঁচে যাওয়ার জন্য তা ঠিক বোঝা যায় না, আলাদাও করা যায় না।
ইকবালের লাশ নিয়ে যাওয়ার সময় ওর মুখ হাসি হাসি মনে হয়। মৃত মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থার দুরবস্থা অথবা কোনো অবস্থা না থাকার কারণে এই হাসির রহস্য উদ্ধার করা সম্ভব হয় না। অবশ্য এমন একটা সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দেয়া যায় না যে, নিজের গোপন অনুভূতির কথা বলে ফেলেও সবসময় ক্লাসমেট হয়ে থাকা ইকবাল, মৃত্যুর পরেও ক্লাসমেট পরিচয় প্রাপ্ত হয় দেখে অথবা তার মৃত্যুর খবর জানতে পারে যে সৌরভ বলবে--কোন ইকবাল? সেই খবর আগাম জানতে পারে সে ওভাবে হাসছিল কিংবা এভাবেও ভাবা যায় খুব সাধারণ কেউ আসলে এভাবেই হাসতে হাসতে পৃথিবীকে বিদায় জানায়।


মন্তব্য

সাত্যকি এর ছবি

চমৎকার। বরাবরের মতই তোমার মুগ্ধ পাঠক আমি।

রিনার নির্লিপ্ত ভঙ্গি একটু বেশিই চোখে লাগলো না ?

মাহবুব ময়ূখ রিশাদ এর ছবি

জানতাম, তোমার কমেন্ট থাকবে। বেশি চোখে লাগল বুঝি? জানি না আসলে। ওই ঘটনায় পড়ি নি তো কখনো। তবে লেখার সময় যা মনে হয়েছিল, জীবনের যুদ্ধে একটা সময় নিজের বেঁচে থাকাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় যে আর সবকিছুকেই নির্লিপ্ত মনে হয়। হাসি
এটা, সাতমাস পর লেখা হাসি

------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

আয়ন এর ছবি

গল্পটা যখন এনাটমি ডিসেকশন রুম থেকে শুরু হয়েছিল তখনই একটূ নড়েচড়ে বসেছিলাম। নিজের অতিপ্রিয় কিছু যায়গার কথা পড়ে একটু তো নস্টালজিক হয়ে গেলামই। সেই সাথে মনে হচ্ছে আমার প্রিয় মেডিকেল ছেড়ে আসার পর হয়তো এরকমই হবে দিনগুলি মন খারাপ
গল্প ভাল্লাগসে হাসি

মাহবুব ময়ূখ রিশাদ এর ছবি

ধন্যবাদ হাসি

------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

বন্দনা এর ছবি

গল্প ভাল লাগছে রিশাদ, তবে মাথা ঘুরে আসলেই কি কেউ সহপাঠিনির কোলে পরে গিয়েছিল নাকি জানতে ইচ্ছে করছে?

মাহবুব ময়ূখ রিশাদ এর ছবি

হ্যা, পড়ে গিয়েছিল। তবে আমরা জানতে পেরেছিলাম তা ছিল ইচ্ছাকৃত খাইছে

------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

এস এম নিয়াজ মাওলা এর ছবি

সেদিন আমারো এই ধরনের এক অভিজ্ঞতা হয়েছিলো! মেডিকেল কলেজে আমরা অবশ্য খুব ভালো বন্ধুও ছিলাম না! যা হোক, সে ঘটনা। তোমাকে দেখে এবং মেডিকেলের ছায়াময় তোমার গল্প পড়ে খুব ভাল লাগলো আরিশ। ভালো থেকো খুব।

-নিয়াজ

মাহবুব ময়ূখ রিশাদ এর ছবি

ধন্যবাদ নিয়াজ ভাই

------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

নীড় সন্ধানী এর ছবি

পড়তে পড়তে ভুলেই গিয়েছিলাম এটা গল্প। মন খারাপ

সেদিন পাড়ার পরিচিত এক অল্পবয়েসী ডাক্তার সুলতান মারা গেল ক্যান্সারে। ঈদের একদিন পর। মনে হচ্ছিল মাত্র সেদিন ইন্টার পাশ করে ডাক্তারীতে ভর্তি হলো। ডাক্তার হলো, সংসার হলো, বাবা হলো সে। তারপর দুম করে চলে গেল। কোন মানে হয়? মাথার ভেতর ঘুরছিল ওটা।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

মাহবুব ময়ূখ রিশাদ এর ছবি

কি হয়েছিল? অল্প বয়সে মানুষ মারা গেলে খারাপ লাগে

------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

মর্ম এর ছবি

শিরোনামটাই টেনে হিঁচড়ে গল্প পড়তে নিয়ে এল।

আর গল্প যতই হোক, এ সত্যিও বটে! সবাই-ই তো কারো না কারো চোখে কেবল ক্লাশমেটই একজন

~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

মাহবুব ময়ূখ রিশাদ এর ছবি

ধন্যবাদ হাসি

------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

অতিথি লেখক এর ছবি

মন খারাপ করা গল্প
ইসরাত

মাহবুব ময়ূখ রিশাদ এর ছবি

থ্যাঙ্কস

------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।