ঝড় পরবর্তী জাদুঘর ভ্রমণে

মাহবুব ময়ূখ রিশাদ এর ছবি
লিখেছেন মাহবুব ময়ূখ রিশাদ [অতিথি] (তারিখ: শুক্র, ৩১/০৭/২০১৫ - ৮:৩৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ঝড়ে এলোমেলো হয়ে যাওয়া সময়ে রাতের বেলা কোথাও কেউ থাকে না । তখন মনে হয় দীর্ঘদিন ধরে পরিত্যক্ত হয়ে থাকা শহর হুট করে মাটির নিচ থেকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। তেমন এক ভৌতিক রাতে, যেখানে ল্যাম্পপোস্টগুলো উপড়ে গেছে সেই বিকেলবেলা, সাপের মতো এঁকেবেকে ছড়িয়ে আছে অকেজো কারেন্টের তার, থেকে থেকে স্পার্ক হচ্ছে, পানি জমে আছে রাস্তায়-ফুটপাতে, মানুষ হয়ে গেছে পাখির মতো দুর্লভ তখন আচমকায় দীর্ঘদিন পর জামিলের সঙ্গে তার শৈশবের বন্ধুর দেখা হয়ে যায়। এই অন্ধকার রাতে, জামিল বন্ধুকে অথবা বন্ধু জামিলকে ঠিক চিনে ফেলে। অথচ চেনার কথা না। কতদিন পার হয়ে গেছে, কতকিছু বদলে গেছে, তারপরেও একে অপরকে চিনতে ভুল হয় না। আয়নায় নিজের চেহারা দেখে মাঝে মাঝে চমকে যায় জামিল। তাই এমন ভূতুড়ে পরিবেশে ঠিকঠাকভাবে অতীতের চেহারা চিনে ফেলা সহজ কথা নয়। এই কঠিন কাজটি করে ফেলার পর প্রাথমিক বিস্ময়বোধ কেটে গেলে জামিল কিছুটা ভয় পেয়ে যায়।

পুরো রাস্তায় হাঁটার জায়গা নেই । খুব সাবধানে দেখেশুনে পা ফেলতে হচ্ছে। জামিলের বাসা কাছেই। হেঁটেই যাওয়া যায়। ক’দিন আগে ওয়াসার লোকজন রাস্তা খুঁড়ে যাওয়ায় এখানে-সেখানে বিপদজনক গর্ত। যখন গর্তে পা দিয়ে ফেলার ভয়ে জামিল রিকশা খুঁজছিল, তখন তার ঠিক পাশে ধোঁয়ার অস্তিত্ব দেখে সচকিত হয়ে ওঠে সে, দীর্ঘক্ষণ ধরে সিগারেট না খাওয়ায় তৃষ্ণা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ঝড় থেমে যাওয়াতে নিজের বাসায় সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে, যারা রাস্তায় আছে তারা বাসায় ফেরার উপায় খুঁজছে, এমন অবস্থায় জামিল কোনকিছু না ভেবেই পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেটে টান দিতে থাকা লোকটিকে বলে ফেলল, আপনার কাছে এক্সট্রা সিগারেট হবে?

কেমন আছ, জামিল? সিগারেট এগিয়ে দিতে গিয়ে প্রশ্ন করে লোকটি।

চমকে ওঠে জামিল। সিগারেট হাতে নেয়ার সময় ছায়াছায়া অন্ধকারেও স্পষ্ট বুঝতে পারে সে রাজীবের পাশে দাঁড়িয়ে আছে, তার ছোটবেলার বন্ধু। এই মূহুর্তে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে, ঝড়ের পর ড্রেন উপচে ওঠা পানির মাঝে, এক টুকরো দ্বীপের মতো, যেখানে কিছু ভেজা পাতা ছড়িয়ে আছে, যেখানে দু’জনের নড়াচড়ার তেমন কোন সুযোগ নেই, সেখানে সিগারেট বিনিময়ের কারণে- এভাবে পুরোনো বন্ধুকে আবিষ্কার করে জামিল বলে ওঠে, আরে তুই!

জামিল খেয়াল করে না, এতদিন পর দেখা হলেও সে অবলীলায় রাজীবকে তুই বলে ফেলে যদিও রাজীব তাকে তুমি বলেছিল- তাৎক্ষণিকভাবে জামিল সেটি ধরতে পারে না।

রাজীবের চেহারার পরিবর্তনগুলো দেখতে চেষ্টা করে জামিল। তীক্ষ্ণ চোখে আপাদমস্তক দেখেও জামিল ঠিক বুঝে উঠতে পারে না, কোথায় কোথায় বদলে গেছে সে। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করে কৈশোরের রাজীবের কিছুই মনে নেই তার। অথচ সে ঠিকঠিকভাবেই বুঝতে পারছে এ রাজীব। অপর পাশে দাঁড়িয়ে জামিলকে ঘিরে রাজীবের একই অনুভূতি হচ্ছে কি’না জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করল না। এতদিন পর বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে এসব প্রশ্ন জানতে চাওয়া যায় না। বরং আবেগের আতিশয্যে কী করবে বুঝে উঠতে না পেরে একে অপরকে জড়িয়ে ধরতে হয়। এই দুজন এসবের কিছু না করে প্রাথমিক আলাপচারিতায় আটকে থাকে।

থাকিস কোথায়? জামিল জানতে চাইল।
এই তো এখানে। হাত দিয়ে কিছু একটা বোঝাতে চাইল রাজীব। যার অর্থ হতে পারে, এই এলাকায় কোথাও থাকি কিংবা এখান থেকে অনেক দূরের কোথাও, এমনকি আরেকতু বৃহৎভাবে দেখলে এই দেশেই কোথাও থাকি। জামিল, এমনভাবে মাথা নাড়ায় যেন সে বুঝে ফেলেছে। যদিও জানার এমন কোন আগ্রহ নেই তার, প্রশ্ন খুঁজে পাচ্ছে না দেখে বলার জন্য বলা।

তুমি তো এখানেই থাকো। সামনের গলিতে। রাজীব এখনো তুমি বলেই কথা চালিয়ে যেতে থাকে।

জামিল কোথায় থাকে তার জানার কথা না থাকলেও সে জানে এবং ব্যাপারটি জামিলকে ভীত করে তোলে। হয়ত রাজীব এই এলাকায় থাকে কিংবা সে অন্যকারো কাছে শুনেছে, তাদের কোন কমন ফ্রেন্ড জানিয়েছে-তাই ব্যাপারটি অস্বাভাবিক কিছু নয়- তবু জামিল টের পায়, সে ঘামছে, যদিও বেশ ঠান্ডা বাতাস বইছে।

তার গলার স্বর ক্ষীণ হয়ে আছে এবং টের পায় রাজীব তাকে তুমি করে বলছে। নিজে তুই বলায় বেশ লজ্জা পেয়ে গেল সে ভেতরে ভেতরে। চেষ্টা করেও মনে আসে না ছোট থাকতে কী বলে ডাকত। তুই বলে ডাকার কথা, ঐ বয়সে ঐভাবেই বন্ধুত্ব হয়। বুড়ো বয়সের ক্যালকুলেটিভ ফ্রেন্ডশিপগুলো জানা হয়ে ওঠে না। রাজীব ডাকছে না- হয়ত সে জামিলের প্রমিজ ভেঙ্গে ফেলা অথবা খুব প্রিয় কিছু কৌশলে ছিনিয়ে নেবার কারণে তাকে আর বন্ধু বলে ভাবছে না কিংবা কৈশোরের চেহারা বাদ দিলে এখন তার আর কিছুই মনে নেই। তবু এতদিন পর বন্ধুর আগের তিক্তস্মৃতিগুলো মনে আছে কি’না এই ভেবে সে অস্বস্তিবোধ করতে থাকে।

কী করছ এখন? জামিল জানতে চায়।

জাদুঘর বানাচ্ছি।সিগারেট শেষ হয়ে গেলে এবার রাজীব আরেকটা সিগারেট বের করে দেয়।

জাদুঘর বানাচ্ছে শুনেও জামিলের তেমন ভাবান্তর হয় না। জাদুঘর বানাতেই পারে, হয়ত সে আর্কিটেক্ট। জাদুঘরের ডিজাইন করছে।

রাজীব বলে, তোমার তো ব্যবসায়ী হিসেবে ভালো নাম-ডাক হচ্ছে।

জামিল খেয়াল করে, কথাটি বলার সময় রাজীবের মুখে মুচকি হাসি ফুটে ওঠে। কিছুটা তাচ্ছিল্যের বলে মনে হয়। আরো অনেক কিছুর মতো এর কারণটিও ধরতে পারে না।

এত কিছু কিভাবে জানো?

এবার বেশ শব্দ করে হেসে ফেলে রাজীব। জাদুঘর বানাচ্ছি তো। আমাকে সব জানতে হয়।

জাদুঘর কোথায় বানাচ্ছ?

এই তো এখানেই। হাত দিয়ে আবার আগের মতো ইশারা করে রাজীব। হেঁয়ালি ধরতে পারে না জামিল। সিগারেট শেষ হয়ে গেলে, জামিল বলে, আমার বাসায় যাবে?

প্রশ্নটি ছুড়ে দিয়ে নিজেই চমকে ওঠে। বাসায় যেতে বলার মতো তেমন কোন আলাপ হয় নি। তাছাড়া বাসায় পিয়া আছে, জামিলের স্ত্রী। পিয়াকে দেখে রাজীব অথবা রাজীবকে দেখে পিয়া কিভাবে রিয়েক্ট করবে জানে না সে। তাই এমন হটকারীর মতো ছুড়ে দেয়া প্রস্তাবে নিজেই কুঁকড়ে যায় জামিল। প্রার্থনা করতে থাকে, যেন রাজীব এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়।

তুমি বরং আমার জাদুঘর দেখবে চলো।

তোমার জাদুঘর মানে? তুমি না বললে, জাদুঘর বানাচ্ছ? মানে বানানো কি শেষ?

আবার হেঁয়ালিপূর্ণ হাসি দিয়ে রাজীব বলে, বানাচ্ছি তো। প্রতিদিন কাজ থাকে। একটু একটু করে কাজ এগোচ্ছে। আজ তুমি গেলে হয়ত কাজটা শেষ করা যাবে। জামিলের মনে হয়, রাজীব টাকা ধার চাইবে। কোন একটা কাজ করতে গিয়ে টাকা শর্ট পড়েছে। ঘটনাক্রমে অথবা পরিকল্পিতভাবে তাকে পেয়ে গিয়ে এখন টাকা চাইবে। সে ভালো করে জানে, জামিলের ব্যবসা ভালো চলছে। এতক্ষণে, জামিল একটু হলে হেঁয়ালির মানে ধরতে পারে, যদিও তা কতটুকু সঠিক ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। কৈশোরের রাজীব হয়ে থাকলে, তার মানসিক চেতনার পরিবর্তন না ঘটে থাকলে কখনো সে টাকা ধার চাইবে না। স্কুলে যেখানে একজন আরেকজনের টিফিন নিয়ে খেয়ে ফেলত, দু টাকা এক টাকা ধার নিয়ে, আশেপাশে কোন দোকানে খেতে চলে যেত, সেখানে রাজীব এসবের কিছুই করত না।

তুই এমন কেন?- এই প্রশ্নের জবাবে সে উত্তর দিত, কারো কাছ থেকে কিছু চাইতে ইচ্ছে করে না। নিজের যা আছে তাতেই আমি খুশি।

সময় বদলে যায়। তাই এই বদলে যাওয়া সময়ের কারণেই রাজীব দীর্ঘদিন পর বন্ধুকে কাছে পেয়ে টাকা ধার চাইতেই পারে, এই সম্ভাবনায় জল ঢেলে দিয়ে রাজীব বলল- টাকা ধার চাব, এটা ভেব না।

ঘড়িতে সময় দেখে জামিল। মাত্র সাড়ে নয়টা বাজে। অথচ দেখে মনে হচ্ছে এখন মধ্যরাত। তার বাসায় তাড়া আছে কি নেই মনে করতে পারে না জামিল। এতদিন পর বন্ধুর সঙ্গে দেখা, হয়ত মাঝের ইতিহাস তিক্ততায় ভরা, তারপরেও বন্ধু- যাওয়া তো যায় তার জাদুঘর দেখতে। আবার মনের একটি অংশ বলে ওঠে, কী লাভ হবে এই জাদুঘর দেখে! কথা নেই, বার্তা নেই- একজন এসে বললেও যেতে হবে?- যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেলেই যেখানে বন্ধুত্ব হালকা হয়ে যায়, সেখানে এভাবে ওর সঙ্গে কোথাও যাওয়ার মানে নেই।

তুমি ভয় পাচ্ছ কেন?

রাজীব কথাটি বলার সঙ্গে সঙ্গে রিকশা এসে টুং টাং শব্দে বেল বাজায়।

যেখানে রাস্তাঘাটে মানুষ নেই, আবার ঝড় আসবে বলে মনে হচ্ছে, সেখানে আচমকা এই রিকশা-ওয়ালা কিভাবে এলো, কোনদিক দিয়ে এলো ঠিক বুঝে উঠতে পারে না জামিল।

নাহ, ভয় পাব কেন?

তোমার জাদুঘর কোথায়?

এই তো এখানেই না বলে রিকশায় উঠে বসে রাজীব, সেই সঙ্গে জামিল।

কিছুক্ষণ আগেই কখন বাসায় ফিরতে পারবে বলে অস্থির হয়ে ছিল জামিল। এখন সে অস্থির হয়ে পড়ে জাদুঘর দেখার জন্য। কী এমন জাদুঘর বানালো রাজীব, যা দেখানোর জন্য এমন একটি ভৌতিক রাতের প্রয়োজন হয়ে পড়ল?

২)

চেনা শহর এমনিতেই অচেনা হয়ে আছে। রাজীব বিভিন্ন গলি ঘুরে একটি সাদা পুরোনো দোতলা বিল্ডিং এর সামনে রিকশা দাঁড় করায়। জামিল ধাঁধায় পড়ে যায়। বাসাটি চিনতে পারছে না সে। বুঝতেও পারছে না ঠিক কোথায় আছে। রিকশায় এসেছে, খুব বেশি সময় পার হয় নি- এর মাঝে কতদূরেই বা যাওয়া যাবে? কিন্তু জামিল দেখে সে অনেক দূরে কোথাও চলে এসেছে। এত এত গাছ চারপাশে, ঢাকায় কী আর দেখা যায়!

এটা তোমার বাসা?

রাজীব মাথা ঝাঁকায়। আমি আসলে ভাবিনি, তোমার সঙ্গে এভাবে দেখা হয়ে যাবে। আমি কারো সঙ্গেই যোগাযোগ রাখিনি। তাই আলাদা করে তোমার বাসার কাছাকাছি থাকলেও যোগাযোগের ইচ্ছে হয় নি। অবশ্য আমার কাজ শেষ হলে তোমাদের সবাইকে এনে দেখানোর ইচ্ছে আছে।

জামিল টের পায়, রাজীবের কন্ঠস্বর পাল্টে যাচ্ছে। হেঁয়ালি কেটে গাম্ভীর্য্য এসে ভর করছে।

বাসার কাছাকাছি? আমি কিন্তু একেবারেই চিনতে পারছি না।

তুমি বোধহয় চশমা পড়ে আছ। এজন্য দেখতে পারছ না।

গেট দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে রাজীবের কথা শুনে হেসে ফেলে জামিল। কি যে বলো না- চশমা কেন পড়ব? আমার চোখে কস্মিনকালেও সমস্যা ছিল না। আর চশমা থাকলে তো সবকিছু ভালোভাবে দেখতে পাবার কথা।

রাজীব চাবি বের করে দরজা খুলতে থাকে। জামিল একটু পিছিয়ে গিয়ে কোথায় কী আছে দেখতে চেষ্টা করে। এখনো কারেন্ট আসে নি। অন্ধকার সয়ে এসেছে- এর মাঝে কেবল এটুকুই বুঝতে পারে এই বাড়িতে কেউ থাকে না, বোধহয় দীর্ঘদিন কেউ আসে নি। দরজা খোলার সময় ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ হয়। মনের বাধা সত্ত্বেও জামিল ভেতরে ঢোকে আর সমস্ত ঘর আলোকিত হয়ে ওঠে। কারেন্ট চলে এসেছে ভেবে ভালো করে তাকিয়েই বুঝতে পারল, কারেন্টের আলো এত উজ্জ্বল হয় না। আলো এসে চোখে আঘাত করে। জামিল চোখের সামনে দু হাত নিয়ে আসে।

রাজীব, কী হচ্ছে এসব?

হা, হা। হাত সরিয়ে নাও জামিল। আমরা জাদুঘরে প্রবেশ করেছি। এখনো কাজ পুরোপুরি শেষ হয় নি। আলোর তীব্রতা একটু বেশি হয়ে গেছে, কমিয়ে দিতে হবে।

জামিল হাত সরিয়ে নেয়। তার স্কুলের বিল্ডিং দেখতে পেয়ে চমকে ওঠে। ছোট ছোট লাল ইটের বৃটিশ আমলের বিল্ডিং। ছেলেরা স্কুলে ঢুকছে। স্কুলের পাশেই মাঠ দেখতে পেল। দেখতে পেল নিজেকে, ক্রিকেট ব্যাট হাতে। নন স্ট্রাইকিং এন্ডে রাজীব। কেবল ক্লাসের না, স্কুলের বিখ্যাত ওপেনিং জুটি ছিল তারা।

ঐ দেখ, আমরা- জামিল সবকিছু ভুলে গিয়ে হেসে ওঠে। ভালো লাগছে তোর? অনেক কষ্ট করে ঘুরে ঘুরে স্মৃতিগুলো জোগাড় করেছি। আমার আর কতটুকু বা মনে ছিল। স্কুলে গিয়েছি। এর ওর সঙ্গে কথা বলেছি। আজ তোকেও পেয়ে গেলাম।

জাদুঘরে ঢোকার পর থেকেই, তুই করে বলছে দুজনেই। অতীতের কাছে ফিরে গেলে বোধহয় অদৃশ্য কোন দেয়াল ভেঙ্গে যায়। না হয়, একটু আগের ফর্মাল কথাবার্তাগুলো নিমিষে আন্তরিক হয়ে গেল কী করে?
পুকুরটা কোথায়, জামিল জানতে চায়?
জামিলদের স্কুলে একটি পুকুর ছিল। বিশাল সেই পুকুর, দুর্বল চোখশক্তি সম্পন্ন ছেলেরা এক পাড়ে দাঁড়ালে অন্যপাশে দেখতে পেত না। পুকুরের জল পরিষ্কার ছিল। গুজব ছিল, সেই পরিষ্কার জলে প্রতিদিন সকালে ঘুম ঘুম চোখে ছাত্ররা যখন পিটির জন্য দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে স্কুলে ঢুকত, তার ঠিক আগে জনৈক সুন্দরী ম্যাডাম, প্রায় পুকুরের জলকে আয়নাভেবে নিজের চুল ঠিক করে নিত।

জামিল সাঁতার জানত না। তাই স্কুল ছুটির পর অনেকেই যখন পুকুরে ধুপধাপ লাফ দিয়ে পড়ত, সে কেবল পা ডুবিয়ে রাখত। এমনই এক পা ডুবিয়ে রাখা মধ্যদুপুরে, স্কুলের শেষদিন জামিল প্রমিজ করেছিল রাজীবকে, স্কুল শেষ হয়ে গেলেও আমরা প্রতিমাসে এখানে একবার এসে দেখা করব। রাজীব মুচকি হেসেছিল।

সেদিনের পর আরো একবার দেখা হয়েছিল ঐ পুকুর পাড়েই। কেমন আছিস? কলেজ কেমন যাচ্ছে?- এতটুকু বলেই চুপ হয়ে গিয়েছিল জামিল। মাঝে এক বছরে অনেককিছু বদলে গিয়েছিল। প্রতিমাসে দেখা করার আবেগটা হয়ত আরো কয়েকবছর থাকত কিন্তু এরমাঝে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা তাদের সম্পর্কের ভবিষ্যতকে সন্দিহান করে তুলেছিল। সেদিন জামিল লক্ষ্য করেছিল, পুকুরের জলটাও আর আগের মতো নেই, অনেক ঘোলা হয়ে আছে।

এখন জাদুঘরের ভেতর পুকুর খুঁজে বের করে সেখানে নিজেকে আর পিয়াকে দেখতে পেল। দুজন কথা বলছে।

পিয়া, রাজীব অন্য একজনকে ভালোবাসে। তোমাকে সে মিথ্যে বলেছে।

পিয়ার চোখ ছলছল করে ওঠে। পুকুরের জল আরো ঘোলা হয়ে যায়।

সরি, রাজীব। আমি সেদিন পিয়ার কাছে মিথ্যে বলে তোর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিলাম।

রাজীব বলে, আমি কষ্ট পেয়েছিলাম। তুই আমার বন্ধু ছিলি। আমাকে বলে দেখতে পারতি।

জামিলের বলার কিছু থাকে না, তাই চুপ করে থাকে।

রাজীব বলে, আমি এই জাদুঘর কেন বানাচ্ছি জানিস?

কেন?

আমি আসলে অনেকগুলো পুতুল বানাবো। কিছু বানানো হয়ে গিয়েছে। আরো কাজ চলছে। আয় পাশের রুমে। পাশের রুমে চেনা-অচেনা মানুষদের পুতুল থরে থরে সাজানো দেখতে পায় জামিল। বিস্মিত হয়ে বলে, এগুলো দিয়ে কী করবি?

প্রত্যেকটা পুতুলের নিচে একেকটা গল্প থাকবে- কৈশোরের গল্প, বন্ধুত্বের গল্প, বিশ্বাসের গল্প, অবিশ্বাসের গল্প। যার পুতুল সে চাইলে এসে কিনে নিয়ে যেতে পারে। আর প্রথমে যা দেখে এলি, সেই রুমে গল্পগুলোর স্থিরচিত্র থাকবে। সবার জন্য আলাদা আলাদা স্থিরচিত্র তৈরি করা একটু কঠিন। তোকে ভালো করে চিনি দেখে, তোর জন্য বানাতে পেরেছি।

আমি চলে যাব। জামিলের সমস্ত শরীর শিরশির করতে থাকে।

রাজীব গম্ভীর কন্ঠে বলে, তোকে বলা হয় নি, এই জাদুঘরে সবাই নিজের ইচ্ছেয় আসতে পারে কিন্তু আমার ইচ্ছে ছাড়া বের হতে পারবে না। আরো অনেকগুলো ঘর আছে। ওগুলো তোকে দেখে যেতে হবে।

জামিল মন্ত্রমুগ্ধের মতো পা বাড়ায়। আরেকটি ছোট ঘরে ঢুকে নিজের রক্তাক্ত দেহ পড়ে থাকতে দেখে চিৎকার দিয়ে ওঠে। দরজা খুলে বের হতে নেয়। কিন্তু দরজা খুলতে পারে না।

রাজীব ভাবলেশহীন স্বরে বলে, আমি স্বপ্নে প্রায় তোকে হত্যা করি। কখনো ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে, কখনো ছুরি দিয়ে ফালি ফালি করে, কখনো আগুনে পুড়িয়ে। এছাড়া আমার কোন উপায় থাকে না আসলে। তোর কারণে, আমি কাউকে বিশ্বাস করতে পারি না। আমার বিশ্বাসের হত্যাকারি হিসেবে তোকে বারবার হত্যা করি। প্রতিশোধ বলতে পারিস। আমাদের শেষবার দেখা হওয়ার কথা ভুলে গেছিস? চাইলে কিন্তু তুই আমার হাত ধরতে পারতি।

জামিলের চোখ কোটর থেকে বের হয়ে আসতে নেয়। নিজের লাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে না পেরে চোখ বন্ধ করে নেয়। রক্তে ফ্লোর ভেসে যাচ্ছে যেন কেউ পানির কল খুলে দিয়েছে, আর গলগল করে রক্ত পড়ছে সেখান থেকে।

আমাকে মাফ করে দে, রাজীব।

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রাজীব বলে, ভয় পাচ্ছিস কেন? ভয় পেয়ে মাফ চাইতে নেই। তোকে অনুভব করতে হবে। অনুভব না করলে ঐ মাফ দিয়ে আমি কী করব, বল?

জামিল কাঁদতে থাকে। সেই শৈশবে কবে কেঁদেছিল, এরপর আর কাঁদে নি। কাঁদতে কাঁদতে তার হেঁচকি উঠে যায়। মনে পড়তে থাকে একে একে জীবনের সব মিথ্যেগুলো। কতজনের সাথে, কতভাবে অন্যায় করে আজ সে এখানে এসেছে। তার কান্না শেষ হয় না।

দরজা বন্ধের আওয়াজ হয়। চোখ খুলে জামিল দেখে পুরো ঘরে সে আর তার লাশ। এত রক্তের ভেতরে সে পা ফেলার জায়গা পায় না।

ভয়ার্ত কন্ঠে জামিল উচ্চারণ করে, দরজাটা খুলে দে রাজীব, আমি বাড়ি যাব। তারপর জামিলের মনে পড়ে যায়, নদীতে রাজীব ভেসে গিয়েছিল, কেউ কেউ বলত রাজীবকে খুন করা হয়েছিল; যা বহু আগেই মনে পড় উচিৎ ছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য সঠিক সময়ে সবকিছু মাথায় আসে না, এটা মেনে নিয়েই মানুষকে জীবন কাটাতে হয়।

জামিল আবার উচ্চারণ করে, রাজীব! কেউ দরজা খুলে না। ওপাশে সাড়াশব্দ নেই। তার মনে হতে থাকে, অনন্তকাল ধরে সে আটকা পড়ে আছে, যার কোন শেষ নেই। শূন্যে হাত বাড়ায় জামিল, ঠিক যেভাবে রাজীব ডুবে যাওয়ার আগে হাত বাড়িয়েছিল।


মন্তব্য

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

বহুদিন পর লিখলেন। কি ভয়ংকর গল্প! তবু ভাল লাগল।

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

মাহবুব ময়ূখ রিশাদ এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

মন মাঝি এর ছবি

মচৎকার! চলুক
এই ছবিটা দেখেন। এই গল্পের সাথে কোথায় যেন একটা মিল আছে।

****************************************

মাহবুব ময়ূখ রিশাদ এর ছবি

দেখেছি আগেই। দারুণ সাসপেন্স।

ধন্যবাদ।

------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

নজমুল আলবাব এর ছবি

আপনে দেখি খালি মরা মরির গল্প লেখেন!!! অ্যাঁ

ভালো লেগেছে। চলুক

মাহবুব ময়ূখ রিশাদ এর ছবি

আরে তাই তো, সামনের আরো কয়েকটা ঐসব নিয়েই মন খারাপ

ধন্যবাদ হাসি

------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

খুব সাধারণ একটা থিম লেখকের আঙুলের নৈপুন্যে এইভাবেই অসাধারণ হয়ে ওঠে।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

মাহবুব ময়ূখ রিশাদ এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

নীড় সন্ধানী এর ছবি

অনেকদিন পর আপনার গল্প পড়লাম এবং পড়তে পড়তে এত বুঁদ হয়ে গিয়েছিলাম যে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো রীতিমত। তবে গল্পের লোকেশান চট্টগ্রাম ওয়াসার মোড় থেকে ধরে এগোচ্ছিলাম আমি দামপাড়ার দিকে বৃষ্টি স্নাত রাতে শিল্পকলার নির্জন রাস্তাটা দিয়ে। হাসি

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

মাহবুব ময়ূখ রিশাদ এর ছবি

ধন্যবাদ হাসি

------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

অতিথি লেখক এর ছবি

গতকালই পড়েছিলাম, কিন্তু মন্তব্য করা হয়নি। বরাবরের মতোই স্বচ্ছন্দগতির লেখা। শুরুর দিকে বেশ খানিকটা কম্প্যাক্ট থাকলেও একসময় কাহিনীটা মোটামুটি ধরনের প্রেডিক্টেবল হয়ে গেছে, এ ধরনের ডার্ক ফ্যান্টাসিতে আরও একটু অনির্দেশ্যতা থাকলে গল্পটা বেশী জমজমাট হতো মনে হয়।
শুভকামনা রিশাদ....

@জিল্লুর রহমান (সোহাগ)

মাহবুব ময়ূখ রিশাদ এর ছবি

থ্যাঙ্কস সোহাগ ভাই।

এই প্রথম এই ধরনের চেষ্টা। মাথায় থাকবে। হাসি

------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

রানা মেহের এর ছবি

চমৎকার গল্প, যতটা না কাহিনীতে তার থেকে আপনার বর্ণনায়।
পরবর্তী 'মরার গল্পের' অপেক্ষায় থাকলাম হাসি

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।