এ ও সে ও: ১৪ ঈগলের ডানা

কর্ণজয় এর ছবি
লিখেছেন কর্ণজয় (তারিখ: শুক্র, ১৩/০৪/২০১২ - ১২:২১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমিতো জানিই আমার পরিণতি
তোমার লাস্য চোখের লবণ জলে
ইচ্ছের নৌকো ভাসানোর শেষ ইচ্ছে
পূরনেও ব্যর্থ ; এক করূণ নিয়তি।*১
পৃথিবীর কাছে একটা চিঠি লিখতে বসেছি। ক্লাইস্টের মত একটা চিঠি। ইসমাইলের মত একটা চিঠি। কিন্তু কোন শব্দই কলমে আসছে না। এলোমেলো শব্দগুলো বসিয়ে যাই। আবার কাটি। কিছুতেই একটা চিঠি দাঁড়ায় না। শেষপর্যন্ত পুরো পৃষ্ঠা জুড়ে কাটাকুটির কালো দাগের মধ্যে কয়েকটা শব্দ জুলজুল করে চেয়ে থাকে। যেন শরীরের চারপাশে ঝুল সাজিয়ে একটা মাকড়সা আমার দিকে চেয়ে আছে। আমিও ওর দিকে চেয়ে থাকি। মনে হয়, কী যেন বলতে চাচ্ছে ও। তাকিয়ে থাকতে ওর কথা যেন একটু একটু বুঝতে পারি। শেষপর্যন্ত একটা কবিতার মত দাঁড়ায় সেটা। আজফারভাইকে মনে পড়ে। আজফারভাই পাগল হয়ে যাওয়ার ঠিক আগে আগে মানুষের সাথে কথা বলা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিলেন। মাঝেমধ্যে যাও বা বলতেন, মনে হতো নিজের সাথে নিজেই কথা বলছেন। কথাগুলো আমার কাছে কবিতার মত মনে হতো।
বধির, মূক এবং অন্ধ ’’-
সবচেয়ে এগিয়ে ছিল আমাদের মধ্যে যে
সেই ছেলেটির বুক পকেটের ডায়েরীটিতে লেখা ছিল এমনতর তিনটি শব্দ
আমরা বধির মূক এবং অন্ধ সেজে পেলাম
প্রত্যেকে বিজয়ীর আনন্দ।
আজফার ভাইয়ের মুখ ভেসে ওঠে। ‘আল্লা তুমি আমারে মাফ করো - এই অসহ্য সুস্থদের হাত থেকে আমারে রক্ষা করো- আমারে বাঁচাও...’ তিনি আর্তনাদ করে উঠেছিলেন।
বিজয়ীর উল্লাসে মত্ত এই পৃথিবী থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে এখন আজফারভাই পাগলা গারদের বন্দী ঘরে পায়চারী করছেন। এটাও তো এক ধরনের মৃত্যু। আমি তার পায়ের শব্দটা শুনতে পাই। হৃদপিণ্ডের শব্দের মত। কান পেতে শুনি। শব্দটা মনে হয় মর্টারের শব্দের মত । একটু পর পর ধুড়–ম ধুড়–ম ধুড়–ম। যেন কোথাও বিদ্রোহ হচ্ছে । বিদ্রোহী যোদ্বারা গোপন আস্তানা ছেড়ে উঠে এসে আমার মধ্যে একে একে জড়ো হচ্ছে। জীবনের জন্য জীবনের বিদ্রোহ প্রকাশ্য যুদ্ধে রূপ দিতে ঝাপিয়ে পড়বে আর একটু পরেই। মৃত্যুর মত।
একটা দীর্ঘশ্বাস পাকিয়ে ওঠে। আকাশে তাকাই।
চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে সবকিছূ। তারাগুলো জ্বলছে নিভছে।
এক খণ্ড মেঘ ভেসে যাচ্ছে, আকাশের অনেক নিচ দিয়ে- প্রায় মাথার উপর দিয়ে।
আগে এমন করে চাঁদ উঠলে, এমন করে মেঘ উড়ে গেলে ফ্রিদার কথা মনে হতো। কিন্তু এখন ওকে মনে পড়ে না। ঝুমিও কষ্ট দিতে পারে না। একটা নৈর্ব্যক্তিক বিচ্ছিন্নতা আমাকে নিয়তির মত কোথায় জানি ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে।
ঠাণ্ডা একটা বাতাস বয়ে যায়। চোখ বন্ধ করে থাকি। ধীরে ধীরে বাতাসের গতিবেগটা বাড়তে থাকে। সেই বাতাসে মিশে থাকে জলের কণারা। ওরা আমার মুখ ভিজিয়ে দিয়ে যায়। আমার ভাল লাগে। একটা শো শো আওয়াজ হয়। একটা ঝড় নামছে। আমার ভাল লাগে। ঝড়ের শব্দ বাড়তে থাকে। ঝড়ের সাথে এবার বড় বড় ফোটায় বৃষ্টি নামে। আমার দেহ ভিজে যায়। আমার ভাল লাগে। চোখের তারায় বৃষ্টি মাখতে ইচ্ছে করে। আমি চোখ খুলে তাকাই। অদ্বুত একটা দৃশ্য। মুশলধারে বৃষ্টি নেমেছে। কিন্তু আকাশে ফুটে আছে হাজারে হাজারে তারা। সেই তারার আলোয় লাস্টবেঞ্চি ফিসফিস করে।
: শুধু মানুষই নিজেকে ফিরিয়ে নিতে পারে। ঈশ্বরও পারে না।
লাস্টবেঞ্চি এসেছে। ওকে দেখে আর ভয় লাগে না। সরাসরি তাকাই ওর দিকে। আমার মতই লাগে ওকে।
: তাই। আসলেই মানুষ যা পারে- ঈশ্বরও তা পারেন না।
মনে মনে ভাবি, নিজেকে ফিরিয়ে নেয়ার কথা। নিজেকে ফিরিয়ে নেয়াই যায়।
শেষপর্যন্ত মনের ভেতর থেকে সিদ্ধান্তটা আসে। ‘আমার মৃত্যুটা আমিই ঘটাবো’। সিদ্ধান্তটা নিতে পেরে শান্ত লাগে। অনেকদিন পরে মনের ভেতর একটা হালকা চনমনে ভাব তৈরী হয়। নিজেকে অনেক বড় মনে হয়। লাস্টবেঞ্চি এসে দাড়ায়। তার মুখে হাসি।
: তোমার কথাই রইলো। আমি প্রস্তুত।
আমি ওকে বলি।
: আমি জানতাম তুমি পারবে।
: হ্যা আমি পারবো।
: অভিবাদন তোমাকে।
লাস্ট বেঞ্চি আমাকে কুর্ণিশ করে বলে - এসো অহংকার পান করি। আমরা দুজনে বুক ভরে বাতাস টেনে নি। নিজেকে ওর মত বড় মনে হয় । ও চলে যায়। আমি মৃত্যুটা কীভাবে ঘটানো যায় -সেটা নিয়ে ভাবি। দিনের বেলায় মরতে ইচ্ছে করে না। রাতেই ঘটনাটা ঘটাবো। তখন চাঁদ থাকবে আকাশে। সুন্দর হবে মৃত্যুটা।
বিভিন্নজন কীভাবে আত্মহত্যা করেছে ঘটনাগুলো মনের মধ্যে আনাগোনা করে। জীবনানন্দ দাশ এসে বেরিয়ে যান। ওনার কাছ থেকে শুনি শেষ মুহূর্তে ট্রাম লাইনের উপর দিয়ে ইলেকট্রিক তার আছে সেখানে ট্রাম আসলে স্ফুলিঙ্গ বের হতে থাকে। তিনি সেই স্ফুলিঙ্গের দিকে তাকিয়ে নক্ষত্রের বিষ্ফোরন দেখছিলেন। ট্রামটা তাকে আঘাত করার সাথে সাথে নক্ষত্রটা অজস্র তারা ছুটিয়ে ফেটে পড়ে। তিনিও এর সাথে সাথে নক্ষত্রমণ্ডলে বিলীন হয়ে যান।
বিকেলের আলো তখনও মরে নি। সন্ধ্যের বাতাস বইতে শুরু করেছে কেবল। এসময়ে আসলেন আর্নেষ্ট হেমিংওয়ে। তার তাছ থেকে আফ্রিকার গহীন অরণ্যের গল্প শুনি। ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সি’র বুড়ো সান্তিয়াগো ঘুমের মধ্যে যে সিংহদের দেখতেন তিনি তাদের সাথে সেদিন হুটোপুটি খেলায় মেতে ওঠেন। এমন সময় জাগতিক শিকারীর পিস্তলটা তিনি হাতে তুলে নেন। ট্রিগারটা চাপ দিতেই টুপ করে বুলেটটা মগজে ঠাই নেয়। তিনি খেলার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েন। আমি এতক্ষণে টের পাই, হেমিংওয়ের শরীর থেকে ভেসে আসছে অরণ্যের গন্ধ।
হেমিংওয়ে চলে গেলে আমি আমার মৃত্যুর কথা ভাবতে শুরু করি। শুধুমাত্র একটা কাজ বাকি থাকে। কেমন করে আমার মৃত্যুর দৃশ্যটা আঁকবো এটা ঠিক করে নিতে হবে।
মনের মধ্যে দৃশ্যটা দেখি।
শান্ত একটা সমুদ্র। কোন হুল্লোড় নেই।
একা একটা ছোট্ট নৌকা নিয়ে সেই সমুদ্রে ভেসে যাচ্ছি। মাথার উপর আকাশে গোল চাঁদ ভেসে আছে। ছেড়াখোঁড়া মেঘগুলো সেই চাঁদের সাথে লুটোপুটি খেলে। ওদের খেলার এই হুল্লোড় সমুদ্রেও নাচন তোলে। ঢেউ গুলো রূপালী ফেনা তুলে এ ওর উপর ঝাপিয়ে পড়ছে - বাতাসের শো শো গর্জন ওদের নাচের সাথে তাল জুড়েছে। দূরে- অনেক দূরে বন্দরের ছোট ছোট আলোকবিন্দু চোখে পড়ে। আমি চিৎ হয়ে গলুইয়ে শুয়ে একটার পর একটা সিগারেট টানতে টানতে আকাশ দেখি। অনন্ত একটা অনুভূতি মাথার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। কতক্ষন কেটে যায় জানি না। প্যাকেট থেকে সিগারেট নিতে গিয়ে দেখি - একটাই আছে। সময়টা এসেছে। হাত দিয়ে কোমরে গোজা ছুরিটা বের করে উঠে বসি। হাতের মুঠোয় ছুরিটাকে ধরে নৌকার খোলের উপর ঘাই মারি। ভেজা ভেজা কাঠের পিচ্ছিলতায় ছুরির ফলাটা ঠিকমত দাঁত বসাতে পারে না। খরখরে চোখে একবার দেখি ওকে। জীবনের সমস্ত শক্তি বাহুতে এনে আমি সর্বশক্তি দিয়ে আবার আঘাত করি। ছুরিটা কাঠের তৈরী শক্ত খোলটার গায়ে এবার একটা দাগ বসাতে পেরেছে। আমি দাগটা লক্ষ্য করে একটার পর একটা ঘাই মেরে যাই। একমনে। আর কিচ্ছু মাথায় কাজ করে না। হটাৎ টের পাই, গলুই ভেদ করে ছুরির আগায় সমুদ্রের স্পর্শ লেগেছে। একটু থমকে যাই। এক মুহূর্তের জন্য। ছুরিটা বের করে আনতেই নৌকার ভেতরে জলের ফোয়ারা উঠে। এক সমুদ্র শূন্যতা বুকে নিয়ে নৌকার গলুইয়ে মাথা রেখে আমি আবার শুয়ে পড়ি। পায়ের নিচে জলের স্পর্শ টের পাই। ওরা বাড়ছে। ধীরে ধীরে আমার পা বেয়ে শরীরের উপর দিকে উঠে আসছে। আয়েশ করে শেষ সিগারেটটা ধরিয়ে আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করি। চাঁদটাকে অপূর্ব মায়াবীনি মনে হয়। ফ্রিদার মত। আমি ঝুমির মুখটা মনে করতে চাই না। বাস্তবতার কোন কথা মনে করতে চাই না। মাকে দেখি। আমি আসছি মা - ফিসফিস করে বলি। পানি বাড়তে বাড়তে নৌকাটা প্রায় পুরো ভরে এসেছে। আমার শরীরের নিচের দিকটা পানিতে ভিজে জ্যাবজেবে। হটাৎ টের পাই, নৌকাটা আমার নিচ থেকে খসে গেল। একটা অতল চেতনা এক মুহূর্তের জন্য আমার পুরো শরীর ঢেকে ফেলে। আমি সমুদ্রে তলিয়ে যাই।
মৃত্যুটা এরকম হলে বেশ হতো। আমার মৃত্যুটা এরকম হলে খুব ভাল হতো। ভাবি আমি। মনে মনে সমুদ্রটাকে দেখতে পাই।
: এত বাতাস। কোত্থেকে আসে বিনুদি?
: সমুদ্র থেকে। ওখানে মস্ত বড় একটা হাওয়ার কল আছে। ওখানে হাওয়া তৈরী হয়। সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে কত্ত বড় বড় জাহাজ আসে। বাক্স বোঝাই করে ওরা ওদের দেশে হাওয়া নিয়ে যায়।
বিনুদি ঠোট উল্টায়।
: সমুদ্র কোথায়?
: এইতো, বেশি দূরে না - যাবি নাকি?
: হ্যা
আমার আর বিনুদির সাথে সমুদ্রে যাওয়া হয় নি। এই এখন যাচ্ছি। বাসের মধ্যে জানালা দিয়ে বাইরের ছুটে চলা দৃশ্যগুলো দেখতে দেখতে বিনুদির সাথে ছেলেবেলার হারিয়ে যাওয়া কথাগুলো আবার মনে পড়ে। বাসটা যখন এসে আমাকে সমুদ্রে নামিয়ে দিল তখনও সন্ধ্যার আলো ফিকে হয় নি। পশ্চিম আকাশটা লাল করে রাত নামছে। আমি পায়ে পায়ে সমুদ্রের কাছে এসে দাড়াই। পায়ের কাছে ঢেউগুলো চুমু খেয়ে আবার ফিরে যায়। ওদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে থাকি একমনে।
এরপর শেষ হয়ে যাবে সমস্ত-
আমার অথবা আমার না
বলা কিংবা না বলা কথা।
একটা দীর্ঘশ্বাস বাতাসে মিলিয়ে যায়। এদকি ওদিক তাকিয়ে দেখি। খুব বেশি মানুষ নেই। কয়েকজন ছেলে ছোকরার দল একটা ফুটবল নিয়ে মজা করছে। উজ্জ্বল লাল পোশাক পরেছে সবাই মিলে। আজ! সন্ধ্যার আবছায়াতেও টকটকে আগুনের মত জ্বলতে থাকে ওরা। কেন জানি ওদের মানুষ মনে হয় না। আকাশের দিকে তাকাই। এখনও চাঁদটা ওঠে নি। আর একটু পরেই চাঁদ উঠবে। মাঝে মাঝে চাঁদের রঙ খুব লাল হয়, আজকেও কি তাই হবে? আমি ভাবি। লাল রঙটা জীবনের রঙ। আমি যে এখনও বেঁচে আছি সেটা মনে করিয়ে দিতে বুঝি লাল রঙটা সবদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। নিভে যাওয়ার আগে শেষবারের জন্য এত উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে। মনের মধ্যে বিভিন্ন মুখ একে একে উঁকি দিয়ে যায়। ঝুমি, বিনুদি, ভাইয়া, বাবা, আমার ফেলে আসা শহরটার অলি গলি। ফিদ্রার মুখটা দেখতে খুব ইচ্ছা করে। কেমন ছিল ও? কোনদিন জানা হবে না। সেতুর কবিতাটা মনে পড়ে খামোকাই।

মেয়েরা পেপার ওয়েটের নীল কাঁচের ভেতরে জমে থাকা বাতাসের মতো-
চারিদিক এক কাঠিন্যের শীতল আবরনের মধ্যে জমে থাকা
একরাশ অনুকম্পা।
একটু হাসি মনে মনে। ওদের সাথে আর কখনই দেখা হবে না। কষ্টের কথা। কিন্তু খুব একটা কষ্ট হচ্ছে না । একটু খালি খালি লাগছে। যখন বিনুদি বেড়াতে এসে ফের শশুর বাড়ি চলে যেত তখন যেমন বুকের কাছটায় যেমন একটু ফাঁকা ফাঁকা লাগতো ততটুকুই। এরচেয়ে একটুও বেশি নয়। বরঞ্চ একটা কেমন জানি নিজেকে একটু বড় বড় মনে হয় আমার। মনে হচ্ছে, আর সবার চেয়ে আমি একটু আলাদা। সবাইকে একটু ছোট ছোট মনে হচ্ছে। আমার মাথাটা যেন একটা তালগাছ ছুঁয়েছে। একটা পাখি সেই তালগাছটার ডালে বসেছে। একটু পর পর ডেকে উঠছে। সত্যিই অনেকদিন পর ভাল লাগছে। সূর্যটার শেষ আলোটাও মুছে গেছে। অন্ধকারটা এখনই দ্রুত জাকিয়ে বসবে। তারপর...। সময় হয়ে এলো। চারপাশটা দেখে নিতে চোখ ফেরাই।
একটা বিশ্বাসহীন পৃথিবী। একটা শূন্য সময়।
একটা দিকহারা পাখির মত উড়ে চলা এখন শেষ হবে। ডানাদুটো গুঁটিয়ে একটু পরেই আমি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করবো। জন ডেনভারের গানটা শুনতে ইচ্ছে করে। ঝুমি চলে যাওয়ার পর থেকেই গানটা আমার ভেজা চোখের অঝোর কান্না থামাতো। শুকনো চোখে কান্না ঝরাতো। আবার সেই কান্না থামাতো। একটা ক্যাসেটের এপিঠ ওপিঠ জুড়ে শূধু এই গানটাই রেকর্ড করে এনেছিলাম। অনেকদিন গানটা শোনা হয় নি। শেষবারের জন্য গানটা শুনতে খুব ইচ্ছে করে। সমুদ্রের তীর থেকে একটু দুরেই ঝলমলে মার্কেট। আমি সেখানে গিয়ে একটা সস্তাদরের ওয়াকম্যান দরাদরি না করেই কিনে আনি। ডেনভারের ক্যাসেটের খোঁজে কয়েকটা দোকানে ঢু দেই। শেষ পর্যন্ত একটা দোকানে পেয়েও যাই। কয়েক জোড়া ব্যাটারী কিনে আমি আবার সৈকতে ফিরে আসি। তখন ঘন অন্ধকার। আকাশে সত্যি সত্যি দেখি একটা লাল চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় আমি সমুদ্রের কোলে ওয়াকম্যানটায় ক্যাসেটটা ভরে কানে হেডফোন গুজে গানটা ছাড়ি। গানটা শূনেই সমুদ্র ধরে হেটে যাবো। মানুষের সাধ পূরণ হয় না। নৌকায় চেঁপে আমার মৃত্যুর শেষ ইচ্ছেটা পূরণ হলো না। আমি সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ভাবি। এই সমুদ্রের কোথাও লুকিয়ে আছে বিনুদির হাওয়া কল। আমার দুঃখটা ভোলাতেই সেখান থেকে হাওয়ারা এসে সবকিছু উড়িয়ে নিতে চায়। ডেনভার মিষ্টি গলায় গান গেয়ে ওঠে।

ঙOn the road of experience, I'm trying to find my own way.;
Sometimes I wish that I could fly away 0 0.i
When I think that I'm moving, suddenly things stand still
I'm afraid 'cause I think they always will

And I'm looking for space
And to find out who I am
And I'm looking to know and understand
It's a sweet, sweet dream
Sometimes I'm almost there
Sometimes I fly like an eagle
And sometimes I'm deep in despair

All alone in the universe, sometimes that's how it seems
I get lost in the sadness and the screams
Then I look in the center,
suddently everything's clear nd myself in the sunshine and my dreams

And I'm looking for space
And to find out who I am
And I'm looking to know and understand
It's a sweet, sweet dream
Sometimes I'm almost there
Sometimes I fly like an eagle
And sometimes I'm deep in despair

On the road of experience, join in the living day
if there's an answer, it's just that it's just that way

When you're looking for space
And to find out who you are
When you're looking to try and reach the stars
It's a sweet, sweet sweet dream
Sometimes I'm almost there
Sometimes I fly like an eagle
But sometimes I'm deep in despair
Sometimes I fly like an eagle,
like an eagle
I go flying flying ….

গানটা শেষ হয়ে যায়। কিন্তু গানটা যেন শোনাই হয় নি। আবার শুনতে ইচ্ছে হয়। ক্যাসেটটা রিউইনড করে গানটা আবার দেই। তারপর আবার। সামনে নিঝুম অন্ধকার এসে সমুদ্রে ডুবে গেছে। চোখের উপর সাদা ফেনাগুলো অন্ধকারে জেগে উঠে গড়িয়ে গড়িয়ে বালুর উপর মুখ থুবড়ে পড়ছে। গানটা দুইবার তিনবার চারবার পরপর বেজেই চলে। কিন্তু শোনার তৃষ্ণা মেটে না। একটানা গানটার ভেতরে ডুবে গেলে সময়ের হিসেবটা উধাও হয়ে যায়। সমস্ত স্বত্তাজুড়ে গানটা বাজতে থাকে। সেই শৈশব থেকে আজকের এই মুহূর্ত পর্যন্ত পাড়ি দেওয়া জীবনটার কথা মনে হয়। এর মধ্যে কোথাও নিজেকে খুঁজে পেলাম না। না পাওয়ার, না মেলানোর বেদনা নিয়েই শেষপর্যন্ত চলে যাচ্ছি। তবুও এই চলে যাওয়াটা মিষ্টি মনে হয়। গানটার মত। খুব মিষ্টি গান। মায়ের কথা মনে পড়ে। গানটা মাকে খুব শোনাতে ইচ্ছে করে। কিন্তু মাতো ইংরেজী বোঝে না। তাহলে কী করে গানটা মাকে শোনাবো? বাংলা করে নিবো নাকি গানটা, একবার মনে হয়। কিন্তু সমস্যাটা হলো, আমারও এই ভাষাটা ভাল করে শেখা হয় নি যে। যে ভাষায় মায়ের সাথে কথা বলা যায় না সে ভাষা আমি শিখবো কেন- এটা মনে হতো সবসময়। ধুর! মাকে আবার ঠিকঠাক করে বলতে হয় নাকি? যা বুঝি তাই বলবো, যা মনে আসে তাই বলবো, আমার মত করে ।
যেই না ভাবা- সাথে সাথে দেখি আমি আর আমি নেই। কাঁধের নিচটায় হাতদুটোর জায়গায় দুটো পাখা। মাথার উপর নিঃসীম আকাশ। আমি ভয়ে কেঁপে উঠতেই দেখি পাখাদুটো নড়ে উঠলো। আমি কিছু একটা আকড়ে ধরার জন্য হাতদুটো বাড়িয়ে দিতেই পাখা দুটো ঝাপটিয়ে উঠলো আর আমি শূন্যে উঠে গেলাম। এই বুঝি পড়ে গেলাম। ভয়ে পাখা দুটোর কি কাপুনি! কি আশ্চর্য্য- পাখাদুটোর কাপুনির সাথে সাথে আমি আরো উচুঁতে ... উচুঁ থেকে আরো উচুঁতে উড়ে যেতে থাকি। ঈগল পাখির মত। উড়তে উড়তে একসময় দেখি নিচের নিঃসীম সমুদ্র দেখা যাচ্ছে না। চারপাশে তারারা ঝিকিমিকি করছে। আমি তারাদের দেশে পৌছে গেছি। আমি চারপাশে তাকিয়ে দেখি। মা কোথায়? মা তো এখানেই থাকেন। হটাৎ একটা উজ্জ্বল তারা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। হাসি চুইয়ে চুইয়ে আলোর বন্যা বইছে। মা!। আমি মায়ের কাছে ছুটে যাই। মা আমাকে জড়িয়ে ধরে। ‘কীরে আমার ছোট্ট বাবুসোনা- কী হয়েছে?’
আমি দুহাতের সমস্ত শক্তি দিয়ে মাকে আঁকড়ে ধরি। মায়ের গন্ধে আমি মৌ মৌ করে উঠি। মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। আদর আর আদর।
আমি মায়ের বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে বলি - মা তোমাকে একটা গান শুনাবো বলে এসেছি।
মা আমাকে আদর করতে করতেই বলেন।
শোনা।
আমি তড়বড়িয়ে উঠি। আধো আধো কি যে বলি, হিসেব থাকে না - ।
‘আমি উড়ি উড়ি উড়ি। আমি উড়ে যাই। একটা ঈগল পাখির মত। ডানা মেলে। খুজে ফিরি। আমাকেই। চারদিকে তাকাই। সবকিছূ যেন তখন থমকে যায়। ভয় হয় সবকিছূ এরকমই থাকবে। স্থির। অনড়। এর মধ্যে কোথায় আমি? কোথায় আমার ঠিকানা, আমিই বা কে? ভাবি আমি আর উড়ে চলি। উড়তে উড়তে আমি শুধু খুঁজে চলি, আর খুঁজে বেড়াই। নিজেকে খুজতে খুজতে কখনও কখনও কান্নায় দুচোখ বুজে আসে। পৃথিবীতে মনে সবকিছুই একা. নিঃসঙ্গ। বিষাদের ছায়া মেঘের মত আমাকে ঢেকে ফেলে। হটাৎ সবকিছূ পরিষ্কার হয়ে যায়। চারপাশে প্রসারমান মহাবিশ্ব- এর মাঝে আমি। সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত আমাকে দেখি - এইতো আমি। তবু উড়ে যাই। ডানা মেলে। ঈগলের মত। প্রাণময় প্রতিটি মূহূর্তে নিজেকে মেলাতে গিয়ে উত্তর খুঁজে পাই। এই তো পথ। আকাশের তারাগুলো নেমে আসে। ওদের দিকে হাত বাড়াতে গিয়ে মনে হয় - একটা মিষ্টি স্বপ্ন। আমি উড়ে বেড়াই আর খুঁজে বেড়াই। কোথায় আমি? আমি কে? উড়ে যেতে যেতে মনে হয় - এই আমি। আমি এই।
মা আমাকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বলেন-
তাইতোরে। জীবনতো আসলে একটা স্বপ্নই, নিজেকে খুঁজে চলার স্বপ্ন। দুঃখ আর আনন্দের মূহূর্তের আলিঙ্গন করে উড়ে চলা মজার নামইতো জীবন।
মা কপালে চুমু খান। সাথে সাথে আমার সব কষ্ট মুছে যায়। আনন্দে ভরে উঠি। মায়ের কাছে বিদায় নিয়ে চলে আসি। ঈগলের ডানা মেলে উড়তে উড়তে দেখি পৃথিবী ঝলমলে নীল পোশাক পড়ে আছে। অপূর্ব লাগে ওকে। অন্য সব গ্রহ থেকে আলাদা। স্বপ্নের মত। আমি ওখানে থাকি, ভাবতেই ভাল লাগে। আমি উড়ে উড়ে উড়ে উড়ে এই পৃথিবীতে ফিরে আসি। তখন রাত প্রায় শেষ।
সূর্যের আলোক কণারা ঝাকে ঝাকে সোনার রথ চালিয়ে পৃথিবীতে ভোর আনে। পৃথিবী নতুন আলোয় রাঙা হয়ে ওঠে। পাহাড়, সমুদ্র ,নদী। অরণ্য, শষ্যক্ষেত্র, লোকালয়। সবকিছু। সবজায়গাতেই মনে হয় - আমি আছি। ঈশ্বরের মত। মৃত্যুর কথা ভুলে যাই।
ভুলে যাই - আমার এতক্ষনে মরে যাওয়ার কথা ছিল।
সমুদ্রের জলে স্নান করে আমার শহরে ফিরে আসি । শহরের রাস্তাটা ঠিক যেমন ছিল ঠিক তেমনি আছে। কিন্তু একটু প্রসস্থ লাগে। সকালে যেমন প্রতিদিন মানুষ বের হয়- তেমনি স্রোত নেমেছে। আমি স্রোত ঠেলে এগিয়ে যাই। হটাৎ চোখে পড়ে সেই স্রোতের মধ্যেই এক বন্ধু হনহনিয়ে হেটে চলেছে। আমি ওকে চিৎকার করে ডাকি। ও থমকে দাড়ায়। আমি অনেকদিন পরে কারো কাঁধে হাত রাখি।
: কোথায় যাচ্ছিস? জিজ্ঞাসা করি।
: বাজনা শূনতে।
: বাজনা?
: ইন্ডিয়া থেকে কয়েকজন ক্লাসিকাল বাজিয়ে এসেছেন। একটু শূনে আসি। যাবি নাকি?
আমি ওর সাথে ভিড়ে গেলাম।
লেকের ধারে সুন্দর পুরনো ধাঁচের একটা ছিমছাম একতলা বাড়ি। এই একতালা একতালা বাড়িগুলো এখন আর নেই। বাড়িটা দেখেই মন ভরে যায়। বাড়ির গেট থেকে সিমেন্টের চওড়া রাস্তা ভেতরে চলে গিয়েছে। রাস্তা ঘেঁষে গালিচার মত লন, রোদে তরতাজা সবুজ। লনের পাড় ঘেসে অনেকগুলো ফুলগাছের ঝাড়, কয়েকটায় ফুল ফুটেছে... লাল, সাদা, বেগুনী, হলুদ। চওড়া রাস্তা ধরে একটু গেলেই গাড়িবারান্দার ঝুল। তিনটা সিঁড়ি বেয়ে ছোট্ট একটু ফাকা জায়গা। একদিকে সিড়ি আর একদিকে ড্রইং রুমে ঢুকবার জন্য কাঠের বড়সড় দরজা। দরজার সাথে মিল রেখে ড্রয়ইরুমটা। বিশাল হলরুমের মত। এখানেই আসর বসবে। অনুষ্ঠান শুরু হয় নি। শাড়িপড়া রঙবেরঙের মেয়েরা এর সাথে ওর সাথে হাসি বিনিময় করছে। বেশির ভাগ ছেলেদের গায়েই পাঞ্জাবী। ওরাও মেয়েদের মত পারিপাটি হয়ে এসেছে। একটু হাসি, চুড়ির টুংটাং শব্দ, এখানে ওখানে ছোট ছোট ছুটোছুটি। মিষ্টি একটা গন্ধ সারাক্ষণ ঘরটা জুড়ে ঘিরে থাকে। একটা রিনরিনে আমেজ চারিদিকে। বেশ ভাল লাগে। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখি। রবীন্দ্রনাথের মত সবকিছু। ওদের মধ্যে নিজেকে একটু বেমানান মনে হয়। কিন্তু তারপরও আমার ভাল লাগে। একটু পরেই আসর বসবে। দুইভাগে অনুষ্ঠানটা হবে। প্রথম ভাগে ভোকাল। মধ্যেখানে বিরতি। তারপর সেতার। আমি ঝুলবারান্দা ঘেষা দরজাটার গোড়ায় নিজের জায়গা করে নেই। ওখানে খোলা বাতাস খেলা করে।
সামনে শামিয়ানা পাতা সেখানে পাঁচজন বসে। তবলা, সেতার, বাঁশি আর একটা নাম না জানা যন্ত্র নিয়ে চারজন আর গাইয়ে। গাইয়ের গলাটা ভরাট। তার গলার ওঠা নামার ভেতরে একটা স্পন্দন টের পাই। যদিও ক্লাসিকাল মিউজিকের ভাষাটা ভাল বুঝি না তারপরও টের পাই স্পন্দনটা আমাকে এই পৃথিবীর বাইরে এক অপরুপ পৃথিবীর দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ভারী সুন্দর। অন্য শ্রোতাদের মুখ দেখে বুঝতে পারি ওরাও আমার মতই মুগ্ধ সুরের টানে ভেসে চলেছে। বাইরে তাকাই। সবুজ লনের ভেতরে রঙীন রঙীন ফুলগুলো হাসছে। কয়েকটা পাখি তাদের ঘিরে পাখা ঝাপটিয়ে নাচছে। এমন সময় লোকটাকে দেখি।
অশিক্ষিত মানুষের মধ্যে যে চোয়াড়ে ভাব থাকে লোকটার চেহারার ভেতর সেটা প্রকটভাবে ফুটে আছে। কালো শরীরে জরিদার একটা সবুজ সিল্কের পাঞ্জাবীর উপর টকটকে লাল কোটি চড়ানো। সেখানে চকমকে সব পুতি জরির সুতোয় নক্সা করে বসানো। প্রায় প্রতিটি আঙ্গুলে পাথরের আঙটি। কয়েক রঙের। হীরা মুক্তো পান্নার হবে নিশ্চয়। লোকটার সবকিছু থেকে একটা অরুচিকর জৌলুস ঠিকরে বেরোচ্ছে। এক অনিন্দ্য সুন্দর মেয়ে ওর পেছন পেছন হেটে আসছে। মেয়েটাকে সাথে নিয়ে বাড়ির পেছন দিকে বোধহয় আর একটা দরজা আছে সেদিকে চলে গেল লোকটা। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি। মেয়েটা সত্যিই সুন্দর। বুকের ভেতরে একটা খাঁ খাঁ শূন্যতা জন্মানোর জন্য এই রকম মেয়েরা পৃথিবীতে আসে। ঐ লোকটার সাথে মেয়েটাকে একটুও মানায় না। আমি ঐ দুজনের সম্পর্কের ধরণটা কল্পনা করতে থাকি। হয়তো লোকটার অনেক টাকা। একটা স্বচ্ছন্দ জীবনের জন্য মেয়েটা ঐ লোকটার সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে। সত্যজিৎ রায়ের কাঞ্চনজঙ্ঘা ছবির একটা দৃশ্য মনে পড়ে। ডাকসাইটে রাগী বাবা পরিবারকে নিয়ে দার্জিলিংে বেড়াতে গেছেন। এই ভ্রমনে তাদের সঙ্গী হয়েছেন বিলেত ফেরত এক মধ্যবয়সী লোক। বাবার ইচ্ছে মেয়ের সঙ্গে একটি লোকটির বিয়ে দেবেন। তার ইচ্ছের বাইরে এই পরিবারে কিছু হয় না। তিনি ইচ্ছের কথা মেয়েকে জানিয়েও দিয়েছেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত যখন লোকটা মেয়েটাকে বিয়ের প্রস্তাব করতে যায় তখন মেয়েটা এই বিয়েতে তার অসম্মতির কথা প্রকাশ দেয়।
: এই উদার প্রকৃতির মধ্যে তোমার হয়তো মনে হচ্ছে, প্রেম - স্বপ্ন, রোমান্টিকতা অনেক বড়। কিন্তু কলকাতায় যখন ফিরে যাবে, ভিড়, হট্টগোল আর ঘেরাটোপের মধ্যে যদি কখনও মনে হয় - সিকিউরিটি থেকে একটা সম্পর্ক জন্ম নিতে পারে, তখন আমাকে জানিও।
এই মেয়েটার হয়তো এরকমই মনে হয়েছে। আমি ভাবি। অ্যান আমেরিকান ট্র্যাজেডির ছেলেটার কথা মনে হয়। ক্যারিয়ার শূন্য মেয়েটার কথা মনে পড়ে। মানুষের কাছে ব্যাপারগুলো অনেক বড়। এইসব ভাবনার ভেতরে আসরে আর মন বসাতে পারি না। আধাসুর আধাচিন্তার মধ্যে প্রথম পর্বটা শেষ হয়। এখন বিরতি।
বিরতি মানে আবার টেবিলে সন্দেশ, সিংগারা, চামচের টুংটাং। মৃদু কথা। অষ্পষ্ট হাসির ছলকে ওঠা শব্দ। ভিড়ের মধ্যে মেয়েটাকে মনে মনে খুঁজি। খুঁজে পেতে সময় লাগে না। হেসে হেসে কাদের কাদের সাথে কথা বলছে। আপাদমস্তক রঙদার সঙ্গী লোকটাও চোখে পড়ে দু একবার। বিরতির সময়টুকু ফুরিয়ে আসলে একজন দুইজন করে সবাই তার তার জায়গায় বসে পড়ে। দরজার পাশে বসে আমি আকাশ দেখি। নীল।
রঙদার লোকটা সেতার হাতে স্টেজে উঠে বসলে আমি চমকে উঠি। তার পেছন পেছন মেয়েটাও। তার হাতেও একটা বাদ্যযন্ত্র। এতক্ষনে বুঝতে পারি। তারা শিল্পী। লোকটাকে আর মেয়েটাকে আর অতটা বেমানান মনে হয় না। তবুও দর্শনদারী তারপর গুণবিচারী বলে একটা কথা আছে। যাকে দেখতেই ভাল লাগে নি তার বাজনাটা আর কতটুকুইবা ভাল লাগবে। তবু বসে থাকি। সেতারের তারগুলোতে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে লোকটা একবার তবল্চির সাথে- একবার মেয়েটার সাথে চোখে মুখে হাতের ইশারা ইঙ্গিতে কি এক অদ্ভুত ভাষায় কথা বলতে থাকেন। আর তার সাথে সাথে বাজনাগুলো একটু একটু করে জমে ওঠে।
আস্তে আস্তে সুরটা কেমন জানি হয়ে ওঠে। একটা ঘোরের মত। আমার কেমন জানি লাগে। ঠিক এই রকমটা আগে আর কখনও হয় নি। ওই কুৎসিত কদাকার মুখটা বাজনার সাথে সাথে একটু একটু করে আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। একটু আগে যে পোশাকটা অরুচিকর মনে হচ্ছিল সেটাও অপূর্ব সুন্দর মনে হয়। আমি মুগ্ধ হয়ে লোকটার দিকে চেয়ে থাকি। এত সুন্দর অপূর্ব মুখ। সেতুর কবিতার পৃথিবীর অলৌকিক সন্ধ্যা নামানো সেই সব বড়আপুর দলও ওই লোকটার সৌন্দর্য্যরে কাছে নিশ্চিত মুখ লুকোবে। তাদের মুখ লুকোনো লজ্জ্বাতেই কি না কে জানে - কালো মেঘ করে বাইরে বৃষ্টি নামে। দরজা খোলা পেয়ে বৃষ্টির ছাটগুলো কাচের টুকরোর মত গায়ে এসে পড়ে। ভিজতে ইচ্ছে করে না। আমি ঘরের ভেতর দিকে চেপে আসি। লোকটা তখন তুমুল বাজিয়ে চলেছে। আমি সব ভুলে যাই- বৃষ্টি, মানুষ, পৃথিবী সব। বাজনা, ঐ মুখ আর আমি ছাড়া ব্রহ্মাণ্ডের কোন কিছুর অস্তিত্ব থাকে না। সবকিছূ স্তব্ধ করে একসময় বাজনাটা শেষ হয়ে যায়। সবাই হাততালিতে ভেঙে পড়লেও আমি স্থানুর মত বসে থাকি। কি এক আচ্ছন্নতা আমার মাথার মধ্যে। পাশের লোকটার কনুইয়ের হটাৎ ধাক্কায় আমার ঘোর ভাঙে।
ঘোর ভাঙতেই আমি চমকে উঠি। বাইরেটা খটখটে রোদে ঝলসাচ্ছে। সবুজ লন আর ফুলের ঝাড়গুলো সব সূর্যের প্রখর তাপে শুকনো, অবসন্ন আর মরামরা।
আমি চমকে উঠি। একটু আগেই না বৃষ্টিতে সব ভেসে গেল। বৃষ্টির ঝাপটা আমাকে ভিজিয়ে দিয়ে গেল। বন্ধু এসে তাড়া দেয় - চল্ চল্ চল্...
আমি বোকার মত ওর পিছু পিছু বাইরে নেমে আসি। বৃষ্টির কোন চিহ্ন নেই। বোকা বোকা লাগে নিজেকে। হাটতে হাটতে আমার তানসেনের গল্পটা মনে পড়ে। তানসেন যখন বাজনা বাজাতেন তখন নাকি বাজনার ডাকে বৃষ্টি নামতো। আমি ভেবেও কোন কুল কিনারা পাই নি কিভাবে এটা সম্ভব। এখন বুঝতে পারি - ব্যাপারটা তাহলে এরকমই ছিল। লোকটাকে তানসেন মনে হয়।
তানসেন আমার মনের ভেতরে বৃষ্টি ঝরিয়ে যায়।
আমার সবকিছু ভাল লাগে। মানুষ। এই শহর। ঐ ভিখারিটার ঘ্যানঘেনে সুর। সব জীবনের প্রতিচ্ছবি। স্রোতের মত। সেই স্রোতে মিশে আমি হাঁটতে থাকি।
পথে একটা ইলেকট্রনিক্সের দোকান পড়ে। সেখানে সারি সারি টিভি বিক্রির জন্য রাখা। কাঁচের দেয়ালের ভেতওে রাস্তার দিকে মুখ করে কয়েকটা টিভি চলছে। কয়েকজন শ্রমজীবি মানুষ চোখ বড় বড় করে টিভি দেখছে। এর একটায় চোখ পড়তে আমি জমে যাই। ডেনভার। স্টেজে গিটার হাতে গান গাচ্ছে। লাফিয়ে আমি হামলে পড়ি।
Country road takes me home to the place…
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনি। স্বপ্নের মত। পাশের বাড়িতে সাজ্জাদভাই প্রতিদিন ভোরে এই গানটা বাজাতো। এই গানটা শুনে ঘুম ভাঙতো। ঘরের আরামদায়ক বিছানায় শুয়ে শুয়েও আমি গানটার সাথে সারা পৃথিবীর পথ হেঁটে আবার ঘরে ফিরে আসতাম।
আমি গানটা শুনতে থাকি।
I belong ...
কিন্তু কয়েকটা লাইন মাত্র। শেষ হওয়ার আগেই গানটা বন্ধ করে দেয়। মনটা একটু খারাপ হয়ে যায়। ডেনভারের মুখটা আবার দেখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু ওর বদলে খবর পড়া মেম-সাহেব কি সব বলে যায়। উপরে বিবিসির লোগো দেখে এতক্ষনে বুঝতে পারি খবর হচ্ছে। খবরে ওর গানটা দেখাচ্ছিল। নিশ্চয় কোথাও কনসার্ট হচ্ছে - তারই খবর দেখাচ্ছে। ইশ! যদি যাওয়া যেত। যাবো একদিন। ভাবতে ভাবতে ফেরার জন্য পা বাড়াতে যাই - এমন সময় খবরের পুরোটা কানে ভেসে আসে। জন ডেনভার মারা গেছেন!
আমি হতভম্ব হয়ে টিভিটার দিকে তাকিয়ে থাকি। সেখানে এখন সমুদ্রের মধ্যে একটা প্লেনের ধ্বংশাবশেষ দেখাচ্ছে। এও কি সম্ভব! জন ডেনভার একা একাই একটা ছোট্ট প্লেন চালিয়ে আটলান্টিক মহাসাগরের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিলেন। সেই প্লেনটা নিয়ে তিনি মহাসাগরের অতলে ডুবে গিয়েছেন। আশ্চর্য্য। মাথার মধ্যে ভো ভো করে।
I fly like an eagle…
রক্তের মধ্যে ডেনভারের গলা শুনি। কিছুতেই কিছু মেলাতে পারি না। হাটতে হাটতে চারপাশে তাকিয়ে দেখি। সেই পুরাতন দৃশ্য। রিকশা, মানুষ, উচু দালান, উড়ে যাওয়া কাক। এই দৃশ্যগুলো আমার দেখার কথা ছিল না। এতক্ষনে আমার মরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এই যে আমি বেচে আছি - আমার এই অতিরিক্ত জীবনের সাথে ডেনভারের একটা যোগ আছে। তার গান আমাকে মৃত্যুর হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এসেছে। অথচ একই দিন ডেনভার মারা গেছেন। ডেনভার ঈগলের মত উড়তে উড়তে হটাৎ আকাশ থেকে সমুদ্রের বুকে নেমে আসছেন দৃশ্যটা - চোখের উপর ভেসে ওঠে। আমার বেচে যাওয়া আর ডেনভারের মৃত্যুর মধ্যে কি কোন যোগ আছে? চিন্তাটা কুরে কুরে খায়। কিছুই বুঝতে পারি না। ঘোরের মত লাগে সবকিছু। পরের দিন সব দৈনিক পত্রিকা কিনে এনে ডেনভারের মৃত্যু সংবাদগুলো খুটিয়ে খুটিয়ে দেখি। একটা পত্রিকায় তার দূর্ঘটনার সময়টা লিখেছে। খুব গোলমেলে লাগে ব্যাপারটা। অলৌকিক। ঠিক যেই সময়টায় আমি ডেনভারের সেই ঈগলের ডানা মেলে আকাশে উড়াল দিয়ে মায়ের কাছে গিয়েছিলাম - ঠিক তখনই ডেনভারের প্লেন সমুদ্রে নেমে এসেছিল।
এর মানে কি?
আমার জীবনের বিনিময়ে ডেনভারের মৃত্যু । কিভাবে এটা সম্ভব?
তবে কি লাস্টবেঞ্চি? হটাৎ চিন্তাটা খেলে যায়।
লাস্টবেঞ্চির কাছে আমি মৃত্যুর ব্যাপারে অঙ্গীকার করেছিলাম। জন ডেনভার গান হয়ে আমাকে সেই অঙ্গীকার থেকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছেন। এই কারণেই কি সে ডেনভারের উপর প্রতিশোধ নিলো? ভাবতে ভাবতে জানালার বাইরে তাকাই। চমকে উঠি। শার্সির ওপাশ থেকে একটা নিষ্ঠুর মুখ ভেসে ওঠে। আমার দিকে চেয়ে হাসছে। লাস্টবেঞ্চি। আমার বুকে রাগ জমে। তাতে ও যেন আরও খুশি হয়ে ওঠে। কেমন হলো- গোছের একটা হাসি ছুড়ে দিয়ে টাটা দিয়ে সরে যায় সে।
নিজেকে অপরাধী মনে হয়। খুব। মহাশূন্যে তাজউদ্দিন আহমেদকে বলা বঙ্গবন্ধুর কথাগুলো স্পষ্ট বুঝতে পারি। অন্যের মৃত্যুর দায় অনুভব করার চেয়ে পৃথিবীর আর কোন কষ্টই বড় মনে হয় না। ঝুমি, ফ্রিদা সব তুচ্ছ এর কাছে। আমার শূন্য শূন্য লাগে।
আমার কারণেই তাহলে ডেনভার মারা গেলেন। কিছুতেই মানতে পারি না। নিজেকে খুনী মনে হয়। চোখের মধ্যে পানি জমে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসে। একসময় কান্নাও ফুরিয়ে যায়। আমি বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে সব ভুলে যেতে চাই। হটাৎ বেসিনে চোখ পড়ে। রক্তে লাল হয়ে আছে। আঃ! একটা আর্তনাদ বের হয়ে আসে। সেই সময় চোখটা গিয়ে আয়নার উপর পড়ে। একটা খুনীর মুখ দেখার ভয়ে চোখটা বন্ধ করে ফেলেছিলাম প্রায়। কিন্তু অবাক চোখে সেখানে দেখি জন ডেনভারের মুখ ভেসে ওঠে। তিনি একটা পাহাড়ি রাস্তা ধরে হেটে হেটে আসছেন। আয়নার মধ্যে থেকেই তিনি আমার একদম কাছে চলে আসেন। তার মুখে একটা সরল হাসি মেখে হাসছেন। আমি হৃদপিন্ডটা তাকে দেখাতে চাই। কিন্তু মুখ দিয়ে দুর্বোধ্য একটা গা গা শব্দ বের হয় । আমাকে অভয় দিতেই আয়নার ভেতর থেকে তিনি ঝুকে পড়ে আমার কাছে মুখটা এনে গেয়ে ওঠেন ।
I'm walking here beside you, in the early evening chill,
একটা লাইন গেয়েই তিনি অদৃশ্য হয়ে যান। তার জায়গায় আয়নায় আমার মুখ ভেসে ওঠে। আমি কিন্তু আমার প্রতিচ্ছবি নয়। ডেনভারের মতই আমি গিটার হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছি। গ্রাম- শহর - জনপদ পেরিয়ে অরণ্য - পাহাড় ঘুরে ঘূরে গান গাচ্ছি। গান গাচ্ছি ঠিকই কণ্ঠটা ডেনভারেরই।
A thing we've always loved to do, I know we always will.
কেমন একটা ঘোরের মত লাগে। আমি টের পাই এই আমি আর আমি নই। আমার মধ্যে অন্য এক মানুষ জন্ম নিচ্ছে। সেই মানুষটার নাম জন ডেনভার। আমার চোখজোড়া যেন আমার নয়। আমার এই চোখদুটো দিয়ে জন ডেনভার পৃথিবীর আলো অন্ধকারে তার পৃথিবী খুঁজে বেড়াচ্ছেন। এরকম মনে হয়।
আমি টের পাই হাত দুটো আসলে হাত নয়। একজোড়া ডানা। বুকের ভেতর থেকে ডেনভারের গলা শুনতে পাই। fly fly fly। আমি ডানা ঝাপটাতেই শূন্যে উঠে যাই। ঈগল হয়ে উড়ে যেতে থাকি। নিচে চির চেনা পৃথিবী পড়ে পড়ে থাকে। শহরের মিটমিটে আলোর বিন্দু, প্রবাহমান নদীর বুকে ভাসমান নৌকার প্রজ্জ্বোলিত লণ্ঠন, অরণ্যের নিঝুম অন্ধকার পেছনে ফেলে আমি উড়ে যাই। নিচে সমুদ্র। টানা । অন্তহীন জলরাশি। সপ্তডিঙা মধুকর তার বহর সাজিয়ে বন্দরে বন্দরে ধর্ণা দিতে চলেছে। চাঁদের আলোয় ওরা জ্বলজ্বল করে। বাতাসে ভর করে আমি উড়ে যেতে থাকি। হটাৎ উড়নচণ্ডী মেঘ এসে আমাকে ভিজিয়ে দিয়ে খিলখিল হাসিতে ভেঙে পড়ে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে। চাঁদের আলো এসে আমাকে মুছে দিয়ে যায়। এই যাত্রার যেন শেষ নেই। উড়তে উড়তে আমি বাতাসের মধ্যে একটা গানের ঝংকার শূনতে যেয়ে থমকে যাই। Love is why I came here in the first place। ডেনভারের গলা। প্রথমে ভাবি - বুকের মধ্যে ও গুণগুণ করছে। কিন্তু একটু পরেই টের পাই - বুকের মধ্যে নয়, অনেক নিচে সমুদ্রের গভীর থেকে ঐ গান ভেসে আসছে। পাখা দুটো বাতাসে ভাসিয়ে রেখে আমি নিচে তাকাই। অতলান্ত আটলান্টিকের উপর চাঁদের কিরণ পড়েছে। ঢেউগুলো গানের তালে তালে দুলে দুলে উঠছে। অপরূপ মায়াবী লাগে। এখানেই কোথাও ডেনভার সমুদ্রে ডুব দিয়েছিলেন। আমার মধ্যে ডেনভারের সেই মূহূর্তগুলো জেগে ওঠে। তীরের বেগে নিচে নামতে শুরু করলে দুই এক মূহূর্ত লাগে, সমুদ্রটা আমার উপর ঝাপিয়ে পড়ে। তীব্র জলের ঝাপটায় শরীর ভিজে যায়। চোখ দুটো লবণ জলে জ্বলে ওঠে। কিছু দেখতে পাই না। একটু পরে চোখদুটো সয়ে ওঠে ঠিকই, কিন্তু চারপাশে অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। মাথার উপরে নীচে চারদিকে জল আর জল। আমি ডানা দুটোকে মাছের পাখনার মত ঠেলে ঠেলে অন্ধের মত এলোমেলো ঘুরতে থাকি। ডেনভারের শব্দ আমাকে এই অতলান্ত গভীরে নিয়ে এসেছে। কিন্তু কোন শব্দই পাই না। নিরব। নিস্তব্দ। হটাৎ পিচ্ছিল একটা কিছু গা ঘেষেঁ চলে গেল। আঁতকে উঠি। চেয়ে দেখি আজব চেহারার একটা মাছ। সমুদ্রের তলায় কত আজব প্রাণীরা ঘুরে বেড়ায়। অজস্্র বাহু দিয়ে অক্টোপাস যদি জড়িয়ে ধরে। ভয় লাগে। আমি ভয় নিয়ে এদিক ওদিক করি। চারদিকে জলজ অন্ধকার। কিচ্ছু বোঝা যায় না। হটাৎ অদ্ভুত সব শব্দ ওঠে, পানিগুলো কেঁপে কেঁপে ওঠে আবার চুপচাপ। কতক্ষন এভাবে কেটে যায় কে জানে, হটাৎ একটা সোনালী আভা চোখে পড়ে। অন্ধকারে দিশার মত। একটা আশা লাফিয়ে ওঠে। সেই রাতের মত। ভয়ের অন্ধকারের মধ্যে হেটে যেতে যেতে আলোর দেখা পেয়ে সাহস ফিরে পেয়েছিলাম। ঝুমি ছিল সেদিন। ঝুমির সাথে আমার সম্পর্কটা শুরু হয়েছিল ঐ মূহূর্ত থেকেই। সেই আলো আবার ফিরে এসেছে। কোন কিছুই হারায় না। সবকিছু থেকে যায়। ভাবি আমি। দ্রুত পাখনা নেড়ে আলোর দিকে এগোই। কিসের আলো? ভাবি আমি।
আলোর পথ ধরে সাতরে যেতে যেতে আলোর তীব্রতাটা বাড়তে থাকে। এত আলো যে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। একটু সয়ে আসলে চোখের সামনে হীরন্ময় এক প্রাসাদ ভেসে ওঠে। হীরের তৈরী প্রাসাদের গা থেকে ঠিকরে ঠিকরে আলো বের হচ্ছে। ভেতরে যাবো ভাবি, পথ পাই না। স্ফটিকের একটা স্বচ্ছ দেয়াল দিয়ে প্রাসাদটা ঘেরা। আমি দেয়াল ধরে সাতরাতে থাকি। অনেকদুর গেলে শেষ পর্যন্ত প্রাসাদে আসা যাওয়ার রাস্তাটা চোখে পড়ে। রাস্তা মানে - দেয়ালটা একটা বড় অংশ জুড়ে নেই। একটা একটা বিরাট ড্রাগণ দরজা হয়ে সেই ফাকা জায়গাটায় দাড়িয়ে আছে। দুপাশে দুটো বিশাল নীল তিমি স্থির বসে আছে। প্রহরীর মত। কি করবো বুঝতে পারি না। ঠিক এই সময় একটা টুং টাং শব্দ ওঠে। খুব মৃদু। হালকা। কান পাতি। গিটারের ছয় তারের শব্দ। Love is all I ever hoped to find here… । ডেনভার। প্রাচীরের ভেতর থেকে আসছে। কিসের ড্রাগন কিসের কি - খেয়াল থাকে না। আমি ড্রাগনের ফাঁক গলে ঢুকে যাওয়ার জন্য নড়ে উঠতেই তিমি দুটি তার বিশাল মুখ মেলে ধরে। বিশাল মুখগহ্বরের মধ্যে ধারালো মসৃন দুপাটি দাতের সারি ঝকঝক করে ওঠে। ভয় পেয়ে থমকে যাই। কিন্তু ওদের চোখের উপর চোখ পড়তেই ভয়টা কেটে যায়। ওদের চোখগুলো মিষ্টি হাসিতে ভরে আছে। ড্রাগনটার দিকে তাকিয়ে দেখি লেজ নাড়িয়ে সে আমাকে ডাকছে। মুখে হাসি ফুটিয়ে প্রাসাদের ভেতরে ঢুকে পড়ি।
আজব। অবাক কান্ড। চারদিক ছোটবেলার রূপকথার বই পাতা খুলে বসে আছে। বিশাল একটা বাগান। অপরূপ রঙের বর্ণিল সব ফুল ফুটেছে সেখানে। Love is still the only dream I know… গানটার তালে তালে নাকি শান্ত জলের টানে কে জানে, ওরা মৃদু মৃদু দুলছে। জলের নিচে যে এরকম সুন্দর বাগান থাকতে পারে আমার কল্পনাতেও ছিল না। ভাল লাগে খুব। সাতরে সাতরে চারপাশটা দেখি। রঙীন মাছগুলোকে প্রজাপতির মতন লাগে। এই ফুল থেকে ঐ ফুল লেজ নেড়ে নেড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কত চিত্রবিচিত্র রকম তাদের চেহারা। হটাৎ বিষ্ময়ে থমকে যাই। মৎস্য কুমারীর দল। প্রত্যেকে বিশাল এক একটা ঝিনুকের উপর বসে আছে। ওদের মুখের দিকে তাকালে চোখ ফেরানো যায় না, এত সুন্দর ওরা। প্রত্যেকেই। অনিন্দ্যসুন্দর এই মুখগুলোর দিকে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকি। চেনা চেনা মনে হয় ওদের। কোথাও দেখেছি ওদের, কোথায়? মনে পড়ে শেষ পর্যন্ত। ছোটবেলায় পড়তে বসলে এই সব মেয়েরাই চোখের পাতায় এসে ভর করতো। সেই মুখগুলোই এই জলের তলায় এসে মৎস্যকুমারী হয়ে গিয়েছে। আমি ওদের প্রত্যেকের মুখ গুলো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি। এক, দুই, তিন,..., একশো এগারো, একশো বারো, একশো তের। একশো তেরটি মৎস্য কন্যা বিভোর হয়ে ডেনভারের গান শুনছে। এতক্ষনে ডেনভারের দেখা পাই। একটু দুরে একটা অর্কিড গাছের ঝোপের মতো একটা জায়গা। তারই আড়ালে জন ডেনভার গিটার হাতে বসে আছেন।
ফুল গাছগুলোর মধ্যে অনেকগুলো মৎস্যকুমারী তন্ময় হয়ে গান শুনছে।
Love is all I ever hoped to find here,
Love is still the only dream I know
True love is still the only dream I know.
একটা প্রগাঢ় কণ্ঠের ডাক শুনি ‘শুনছো আমে’। ডেনভার যেখানে গান করছেন তার পাশেই জমাট বাধা প্রবালগাত্রের উপর সেখানে কালো চেহারার একটি ছেলে আর একটি মেয়ে বসে আছে। মেয়েটা ছেলেটার হাতে হাত রাখে। ছেলেটা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে বলে ‘আমিতো’।
কলম্বাসের হাত থেকে রক্ষা পেতে সমুদ্রের কোলে ঠাই নেয়ার পর ওদলু তাদেরকে কাছে টেনে নিয়েছেন।
Love is now the reason I must go…
হটাৎ দেখি একটা মৎস্যকন্যার মুখে বিষাদের ছায়া। চোখ দিয়ে কান্না ঝরছে। শুধু চোখ দিয়ে জলের বদলে মুক্তোদানারা টপ টপ করে পড়ছে।
ঘুরে ডেনভারের দিকে তাকিয়ে দেখি তিনি নেই। আমি চারদিকে তাকিয়ে তাকে খুঁজি। কাছে পিঠে তাকে দেখতে পাই না। বুকোর কাছটায় ধ্বক করে ওঠে। ফার্ণের মত দেখতে ঘন একটা ঝোপের আড়ালে তাকে এক ঝলক দেখতে পাই মনে হলো। আমি দ্রুত পাখনা মেরে ছুটতে থাকি। ফার্ণ ঝোপটা পেরোতেই মরুভূমির মত একটা বালির প্রান্তর জেগে ওঠে। চারপাশে সুউচ্চ পর্বতমালা পানির তলের আকাশ ছূয়ে আছে। ঠিক একটা বুনো পশ্চিম। বুঝতে পারি না, কোথায় যাবো। কি করবো। হটাৎ ঘোড়ার টগবগ শব্দ ভেসে আসে। চমকে দেখি একটা কাউবয় ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছে। আমি চিৎকার করে ডাকি। হেই...। ঘোড়াটার মুখ ঘুরিয়ে কাউবয়টা এদিকেই আসে। হ্যাটে মুখটা অর্ধেক ঢেকে আছে। কাছে আসলে চিনতে পারি। ডেনভার। Thanks God. . আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচি।
I’m a country boy… ডেনভার ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নামতে নামতে বলেন। ঘোড়াটার কেশর বুলিয়ে বলেন- এই ঘোড়া মাছটা আমার বন্ধূ। ঘোড়া মাছটা আমার দিকে চেয়ে হাসে। আমিও ওর দিকে দিকে চেয়ে হাসি। কত কি জানার আছে, ভাবি আমি।
কি করে যেন ডেনভার আমার মনের কথাটা টের পেয়ে যান।
: জীবন ততটুকুই যতটুকু তুমি দেখলে। ডেনভার কথাটা আবার উচ্চারন করলেন - ততটুকুই।
আমার মধ্যে ডেনভারের জন্য অনেক কথা জমা হয়ে ছিল। কিন্তু কথাগুলো গলার মধ্যে আটকে থাকে। কিছুতেই কিছু বলতে পারি না। বলতে পারি না, ‘তোমার মৃত্যুর বিনিময়ে আমার যে জীবন সেটার বিনিময়ে তুমি আবার ফিরে এসো। লাস্টবেঞ্চি তোমার উপর যে প্রতিশোধ নিয়েছে সে আমারই জন্য। আমি তার প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই।’
লাস্টবেঞ্চির মত ডেনভারকেও অন্তর্যামী মনে হয়।
: তুমি আমি। এই আমি থেকে তুমিকে কতটা আলাদা করতে পারবে?
ডেনভারের কথায় আমি থমকে যাই। উত্তর দিতে পারি না। ভাবনার মধ্যে ডুবে যাই।
সত্যিতো। আমরা যখন কাউকে ভালবাসি সেও আমি হয়ে যাই। আমরা এভাবেই আরেকজনের সঙ্গে যুক্ত হই। আরেকজনের মধ্য দিয়ে নিজেকে বাচিয়ে রাখি। নিজের মধ্যে আরেকজনকে বাচিয়ে রাখি। আমরা এভাবেই বারবার ফিরে আসি। অভিজ্ঞতা বাড়ে। আমরা বড় হই। বেড়ে উঠি।
ভাবনার রেশটা কাটে যখন তখন কানে দুরগামী ঘোড়সওয়ারের কণ্ঠ থেকে একটা গান ভেসে আসে। ডেনভার আবার সেই জলের তলার আশ্চর্য মরুভূমি দিয়ে ছুটে চলেছেন।

Sometimes we grow together, sometimes we drift apart;
A wiser man than I might know the seasons of the heart.
And I'm walking here beside you, in the early evening chill,
A thing we've always loved to do, I know we always will.
We have so much in common, so many things we share,
That I can't believe my heart when it implies that you're not there.
দিগন্তে মিলিয়ে যাবার ঠিক আগে তিনি ঘোড়া থামালেন। মাথাটা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে শেষবারের তাকালেন। গিটারটা হাতে নিয়ে শে।
On the road of experience,
join in the living day
if there's an answer,
it's just that
it's just that way
আমাকে তিনি ঘোড়া চালিয়ে দিগন্তে মিলিয়ে গেলেন।
আমার কেমন জানি লাগে। একটা শূন্যতা। কিন্তু এই শূন্যতাটা একটু অন্যরকম মনে হয়। এই শূন্যতার দিকে তাকিয়ে সেটাকেও একটা জানালা মনে হয়।
আমি জন ডেনভারকে বুকের মধ্যে নিয়ে সেই জানালা গলে পৃথিবীর মেলায় নিজেকে খোঁজার যজ্ঞে ডানা মেলে ধরি।
লাস্টবেঞ্চির কথা মনে থাকে না। ও-ও আর আসে না।

১* মীর্জা গালিব


মন্তব্য

প্রখর-রোদ্দুর এর ছবি

দীর্ঘ লেখাও ক্ষনিকের মতো লাগে

পোস্টের জন্য কৃতজ্ঞতা।

তারেক অণু এর ছবি

(গুড়)

কর্ণজয় এর ছবি

প্রকাশ করার পরে দেখলাম কয়েকটা জায়গা ভীষণ দূর্বল হয়ে গেছে। বাড়তি। অসংলগ্ন। ঠিকঠাক করে প্রকাশ করলাম।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।