বাছাই ফ্রিদা/ ফ্রিদা ইউসানার ব্লগ থেকে

কর্ণজয় এর ছবি
লিখেছেন কর্ণজয় (তারিখ: মঙ্গল, ২৬/০৬/২০০৭ - ৫:৩০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

চাদের আলোয় হাজার মাইলের দূরত্ব



ছোটবেলায় বাবা একবার সূতোয় বাধা একজোড়া বেলুন কিনে এনেছিল - টুকটুকে লাল একটার রঙ , আর একটা সাদা। ওদের খালি ফন্দি কখন উড়ে যাবে। ছোট ভাইয়া সাদা আর আমি লাল বেলুনটা হাতে নিয়ে দৌড়ে বেড়াই ঘরময় -ঘর পার হয়ে সামনের উঠোন ,দুভাইবোন সেখানে এস দাড়িয়ে আকাশের নিচে বেলুন দুটোকে দেখি। আকাশী আকাশের নিচে দুটো বেলুন বাতাসে কেমন দোল খায় - ছোটভাইয়া বলে
- জানিস বেলুনটা ছেড়ে দিলে চাদের দেশে চলে যাবে।
- এহ বাজে কথা
- সত্যি
দস্যি ছোট ভাইয়া এটা বলেই কোথায় দৌড়ে চলে গেল। ও এক মূহূর্ত যদি একজায়গায় থাকতে পারে। আর আমার এ ছোট্ট বাসাটার বাইরে বের হতে ইচ্ছে করতো না আর বাইরের পৃথিবীর টো টো ছেলে ছিল ছোটভাইয়া। ও যা বলতো আমি সব বিশ্বাস করি। আমি লাল টুকটুকে বেলুনটার দিকে তাকিয়ে ওর কথা কানে বেজে ওঠে। সত্যিই বেলুন টা চাদের দেশে যাবে- আমি সূতোটা ছেড়ে দেই। বেলুনটা উড়তে নীল আকাশে উড়ে চলে যায়।
আজো বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে ঐ বেলুনটা চাদে দেশে চলে গেয়েছিল।

আমার হটাৎ ঘুম ভেঙে গেলে চাদের দিকে তাকিয়ে মনে হয় এই চাদটা আমার ছোট ভাইয়া, আমার মা, আমার বাবা দেখছে। হাজার মাইলের দূরত্ব এক মূহূর্তে ঘুচে যায়। আমি ফোন করি - ছোট ভাইয়া চাদের দিকে তাকাও - আমি এই চাদের দিকে তাকিয়ে আছি -ভাইয়া হো হো হেসে ওঠে - ধুরো - এখনতো এখানে খটখটে রোদ।
আমার চাদটা আর ভালো লাগে না। চাদের আলোয় তখন হাজার মাইলের দূরত্ব।

আমার চোখে রঙ
____________________________________________________________
আমি রঙ দেখি... এই কালো চোখের মনি জুড়ে কতবর্ণের রঙ - ছোটবেলা থেকেই রঙ দেখেই কোন জিনিষ মনে রাখতাম। আকার দিয়ে মনে রাখা যায়, গন্ধ দিয়ে মনে রাখা যায়, আকারের গঠন দিয়ে মনে রাখা যায়, শব্দ দিয়ে মনে রাখা যায়। কতভাবেই না মানুষ মনে রাখে।

ছোট্ট বেলায় জানালার ঘুলঘুলিতে একবার চড়াই ছানা দিয়েছিল - তার একটা নিচে পড়ে গেলে ভাইয়া সেটিকে নিয়ে কি লাফালাফি- দ্রিম দ্রিম শব্দে আমার বুকের কাছটায় বাড়ি দিচ্ছিলো - আহা ছানাটা - কেমন অসহায় চোখ - কেমন কাপছিল - ভাইয়াটা এমন দস্যি কোনদিন আমার কথা শুনবে -আমার শত বলাতেও ও শোনে নি- কিছুন আমোদ জাগিয়ে ও মরে গেলো- আমি চড়াইটিকে আজো মনে করতে পারি কালচে খয়েরী আর ছাই ছাই রঙের মিশেলে, এই রঙ গুলোর মিশেল এখনও আমার কাছে অসহায় কোন দৃষ্টির চিহ্ন মনে হয়।

মেয়েদের কি বেশি মায়া? আমি দেখেছি ছেলেরা কেমন জানি নিষ্ঠুর মজা করতে পারে-দস্যির মতো। দস্যিপনার রঙ কি জানেন? ফর্সা শ্যামলা বললে যে রঙ ভাসে সেই রঙ - আমার ঠিক বড় বুনো ভাইটার গায়ের রঙ। এখন ও কতো শান্ত বরঞ্চ আমি ওর তুলনায় আজ একটু বেশিই নিষ্ঠুর , সেই ছোটবেলায় গড়া ছবি আজো পালটাতে পারে নি।

একটা কথা মনে হয় হয়ত মানবেন হয়তবা না- মেয়েরা বড় হলে বুঝি একটু বেশি নিষ্ঠুর হয় কোথাও কোথাও, বিশেষ করে ছোট ছোট ব্যাপারে হয়তবা ছোট গন্ডিতে থাকতে থাকতে ছোট ব্যাপারগুলিই তাদের জীবনে অনেক বড় হয়ে যয়ি, খুটিনাটি আর খুটিনাটি থাকে না- গভীরতা পায় বিস্তৃতির তুলনায়, গভীরতার রঙ কি- আমার কাছে ফরসা লালচে একটা রঙ ,আমার মায়ের মুখের রঙ।উদাসীনতার রঙ ম্যামলা- সে রঙ আমার বাবার আপনাদের এই রঙভাবনা হয়ত বোকার মতো মনে হতে পারে কিন্তু এই এতদিনেও ছোটবেলার রঙ যে কথা বলেছিল রঙ সেই কথাই যে এখনও বলে যায়।
লিখতে চেয়েছিলাম আরো অনেক রঙের কথা কিন্তু সোনালী রঙটা ঝামেলা বাধালো। ছোটবেলায় আমার দাদু একটা সোনালী রঙের ঘড়ি দিয়েছিল তাই দেখে আমার সময় মেনে চলতে হতো - সেই থেকে সময়ের রঙ সোনালী
আর সোনালী রঙ এখন আমায় অন্যকোথাও ডাকছে।।

জোনাকী আর নানু কেউ ফেরে না
_____________________________________________________________
মানুষ মারা গেলে কোথায় যায়?
গুটি গুটি পায়ে নানুর খুকীমা (নানু এ নামে আমাকে ডাকতো) হেটে বেড়ায় আর জিজ্ঞাসা করে।
বড় ভাইয়া কোথা থেকে এসে ছো মেরে কোলে তুলে বলে - জোনাকী পোকা হয়ে যায়।
জোনাকী পোকা- আমি জোনাকী পোকা দেখবো।
নানু বাড়ির সবুজ ছোট্ট শহরের পাশ দিয়ে রূপা রঙের নদীর উপরে রঙধনুর মতো একটা উচু ব্রীজ। ব্রীজের উপরে নানুর খুকী মা বড় ভাইয়ার হাত ধরে দাড়িয়ে নিচে বিরাট বিরাট কালো রঙ করা নৌকা দেখে।
কত বড় নৌকা- ভাইয়াটা এত উচু যে ওর মুকের দিকে তাকালে আকাশ দেখা যায়। আকাশের নিচে ভাইয়ার মুখ।
ছোট খুকীমার আনন্দ ধরে না : কোথায় যায় এই নৌকা- সমুদ্দুরে?
হু -
সমুদ্র মানে সেই অচিন দেশ। গল্পের বইতে ছবি দেখেছিল খুকিমা। একটা মস্ত পাল তোলা জাহাজ নীল নীল ঢেউ এ দুলতে দুলতে যাচ্ছে।
জোনাকীর কথা তখন খুকী মা বেমালুম ভুলে গেছে। ওর চোখে তখন বড় বড় দাড়, নেঅকার ফুলে ওঠা পাল, মাঝিমাল্লার ছুটোছুটি।
বড়ভাইয়া সিগারেট ধরায়, খুকী মা জানে এ কথা বাসায় বলতে হয় না। খুকী মা মুখ দিয়ে বিচিত্র সব শব্দ করে আর হাওয়ায় ভাইয়ার চুল ওড়ে। সন্ধ্যার আগে জোনাকীর কথা মনে হয় না।
কিন্তু আলো নিভে আসতেই কোথা থেকে যে আসে এত জোনাকী, প্রথমে একটা দুটো তারপর থোকায় থোকায়... বাবুপাড়ার ব্রীজটা যেন আকাশের উপওে, নিচে লক্ষ লক্ষ জোনাকী খালি জ্বলছে আর নিভে নিভে আবার জ্বলছে.. তারাদের মধ্যে।
খুকীমার মনে পড়ে নানুর মুখ.- এত জোনাকীর মধ্যে কোনটা নানু সেটা বুঝতে পারে না কেবল অন্ধকারে শীত শীত লাগে আর একটু একটু ভয় লাগে। ভাইয়ার হাত জোরে চেপে ধরে সে, ফিসফিস করে বলে বাড়ি যাবো।
জোনাকী দেখবি না...
খুকীমা জোরে কেদে ওঠে - সে জোনাকী দেখবে না।
খুকীমা কি জানে জোনাকী মানে অন্ধকার।
ভাইয়া খুকীমাকে আকড়ে ধরে হেটে চলে শহরের আলোর দিকে।
পেছনে অন্ধকারে উড়ে বেড়ায় লক্ষ লক্ষ জোনাকীর দল। ওরা কখনও শহরে আসে না।
নানুও আর ফেরে না।

আচ্ছা- কান্নার রঙ কি?
____________________________________________________________
পত্রিকা কিংবা পর্দা জুড়ে যুদ্ধের লাল রঙে সাতার কাটতে কাটতে বেদনায় নীল রঙে ভেসে যেতে কাতরে উঠি, সবুজ গালিচা পাতা মাঠটায় বেগুনি রঙের বুনো ফুল ফুটেছে, যে কেউ সুতোয় বেধে কান থেকে ঝুলিয়ে দিলেই কি সুন্দর ঝুমকা হাটার তালে তালে দুলতে শুরু করে,মন বিষন্নতার হলুদ রঙ ঝেড়ে ফেলে গা থেকে আলগা পালকের মতো মাথা উচু করে তাকায় আকাশে- আসমানী রঙ সেখানে কমলা রঙের জ্বলজ্বলে সূর্য গায়ে মেখে জুড়ে আছে পুরোটা দিগন্তেরও বাইরে ...ঐ আকাশটাকে ছোবে বলে একটি পাখি কান্না জুড়েছে -আচ্ছা - কান্নার রঙ কি?

আপনাদেরও কি এমন হয় , মনে হয় এই ঘটনাটা আগেও ঘটেছিল?
_________________________________________________________
লালচে একট পাহাড়ে একটা কাঠের বাংলো - নিচে উপসাগরের যে অংশটা খাড়ির মতো ঢুকে গেছে তার দিকে ঝুকে আছে , মাথার উপরে আকাশটা কেমন তামাটে রঙের। কোনদিন আমি ঐ বাড়ি, ঐ রকম লালচে পাহাড় আর তামাটে আকাশ আমি দেখিনি কিন্তু ঠিক এই রকম একটা জায়গা যেন আমার খুব চেনা।মিনাক্ষি হৈ চৈ করে বেড়াচ্ছে - এবং এইরকম একটা জায়গায় নিয়ে আসার জন্য কেন আমি তাকে ধন্যবাদ দিচ্ছি না এটা নিয়ে অনর্গল বকে যাচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমি ঠিক এই জায়গায় আগে এসেছি, এবং সেবার মিনাক্ষিও সাথে ছিলো, সবচেয়ে বড় কথা ঠিক যা যা ঘটছে অবিকল যেন আগে ঘটেছে - ও হৈচৈ করে ঘুরে এক বোতল বিয়ার, আর কাগজে মুড়ানো এক বার্গার ছুড়ে দিয়ে নেচে বেড়াতে লাগলো।আমি পরিস্কার বুঝতে পারছিলাম এই সময়টা অতীতের কোন প্রতিবিম্ব। এই ঘর থেকে একটা বুড়ো বের হলো , লালচে মুখে বয়সের রেখা, সাদা চুল সরিয়ে মাঝখানে টাক বেরিয়ে গেছে, লোকটা যখন বের হলো তখনই মনে হলো আগে লোকটা ঠিক এইভাবে জলের দিকে তাকাবে।লোকটা রেলিং ঝুকে জলের দিকে তাকিয়ে দুরে দৃষ্টি দিল।
আমি বুঝতে পারি না - মিনাক্ষিকে ডাক দিয়ে বলি - মিনাক্ষি আগে কি আমরা এখানে একসাথে এসেছিলাম , মিনাক্ষি গটমট করে তাকিয়ে তাকে, এই এক ওর স্বভাব, তারপর অনুযোগের সুর গলায় ঢেলে দিয়ে বলে - ক্রেডিট দিতে চাস না সেটা বললেই হয় -
মিনাক্ষি রেগে মেগে চলে গেলো - কিন্তু আমি নিশ্চিত আমি আর মিনাক্ষি ঠিক এইদিনে এইভাবে এই আকাশের নীচে এই বাড়িটার সামনে যেখানে একটা বুড়ো এইভাবে উপসাগরের জলের দিকে তাকিয়েছিল -
আমি কাউকে বুঝাতে পারি না আমার এটা প্রায়ই হয় - ঠিক এই সময়টাই আমার জীবনে আরেকবার অতীতে এসেছিলো কিন্তু ডায়েরীতে লেখা নেই।
আপনাদেরও কি এমন হয় , মনে হয় এই ঘটনাটা আগেও ঘটেছিল?

]
সে এবং আমি
_________________________________________________________
আমি তাকে বলিনি তাকে দিন শেষে রাতও আসে
আমি তাকে ঐ কথাটি বলে উঠতে পারি নি এখনো
দনান্তে সূর্যের রক্তিম অবসানে এইযে অন্ধকার তাতেও ওঠে আশার আশাবরী মায়াবিনী চাদ
হয়ত তারই আশ্বাসে ভেবেছি মনে মনে
কিছুই ঘটবে না কোথাও
পৃথিবীর স্বপ্নের খেলাঘর কিংবা বেচে থাকার অন্ধ গলি-
রয়ে যাবে সব একই অবিকল - অবিরল - অবিনাশী।।

জন্মান্ধের রঙ
___________________________________________________________
শুনছো ... জীবনে অথবা বালুচরে ঘর বাধার তীব্রমমতার কোন মোহে অন্ধ জলদহে বিলীন জনপদের ভেঙে যাবার শব্দ শুনছো তুমি ........কেমন জন্মান্ধের রঙ ঢেউ তোলেশব্দের তরঙ্গ মেলেযেন সংশপ্তক পাখি উড়ে যায়অন্ধকারে - আধার জাগায় ।।


মন্তব্য

সুমন চৌধুরী এর ছবি

আস্তছেলের গুলা বেশী ভাল্লাগছে....
.......................................
ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

ঝরাপাতা এর ছবি

দুটোর স্বাদ দুরকমের মনে হয়েছে আমার কাছে। আস্তছেলের লেখাগুলো বোঝার জন্য বার বার অর্থ জেনে নিতে হয়েছে যার জন্য পড়ার গতিময়তা বজায় রাখতে পারিনি। কিন্তু এগুলো স্বচ্ছন্দে একটানে পড়া যাচ্ছে। ভালো লেগেছে- জোনাকী আর নানু কেউ ফেরে না।

একটুকরো আপেল হবো ভাবিনি- কবিতাটি কি আবার পোস্ট করবেন? খুব ভালো লাগা একটা কবিতা।
_______________________________________
রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।