ঐ চলেছে গরুর গাড়ি

আবু রেজা এর ছবি
লিখেছেন আবু রেজা [অতিথি] (তারিখ: রবি, ০৩/০৮/২০০৮ - ১১:২২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ওকি গাড়িয়াল ভাই
কত রব আমি পন্থের দিকে চায়া রে।
যে দিন গাড়িয়াল উজান যায়,
নারীর মন মোর ঝুরিয়া রয় রে।

ওকি গাড়িয়াল ভাই
হাকা গাড়ি চিলমারীর বন্দরে রে।

দূর থেকে বাতাস ভেসে আসছে গান। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে কে গাচ্ছে এ গান! কে আবার? গাড়োয়ান ভাই। গাড়োয়ান ভাই গরুর গাড়ি চালায়। ছুটে চলে দূর-দূরান্তে, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। মাল নিয়ে ছুটে চলে বন্দর থেকে বন্দরে, এক গঞ্জ থেকে আরেক গঞ্জে। দূরের যাত্রাপথে সুরেলা কণ্ঠে ভাওয়াইয়া গান ধরে গাড়োয়ান ভাই। আর কোঁ-ওঁ-ওঁ-ওঁ শব্দে ছুটে চলে গরুর গাড়ি। আহ্ কী মিষ্টি সুর! আর কী মিষ্টি কোঁ-ওঁ-ওঁ-ওঁ আওয়াজ।
বাতাসে কোঁ-ওঁ-ওঁ-ওঁ শব্দ ভেসে আসছে। এ নিশ্চয়ই গরুর গাড়ির শব্দ। কে যাচ্ছে গো, কে? বেড়ার ফাঁকে দাঁড়িয়ে দেখে এ বাড়ির বউ। তাই তো গরুর গাড়িই যাচ্ছে। পর্দার ফাঁকে দেখা যাচ্ছে বড় বাড়ির বউ। নিশ্চয়ই নাইওর যাচ্ছে বাপের বাড়ি। ছোট ছোট ছেলেপুলেরা গরুর গাড়ির পেছন পেছন ছুটে চলছে। গরুর গাড়ি বাতাসে ছড়িয়ে দিচ্ছে কোঁ-ওঁ-ওঁ-ওঁ আওয়াজ। এ বাড়ির বউও স্বপ্ন দেখে নাইওর যাবার।
শত বছর আগের কথা। তখন এমনই ছিল গ্রাম বাংলার অবস্থা। যেখানে নৌকা চলত না, গরুর গাড়িই ছিল সেখানকার একমাত্র যানবাহন। গঞ্জ, নদীবন্দর, ছোট শহর, হাট-বাজার সব জায়গায় সচল ছিল গরুর গাড়ি। মালপত্র আনা নেওয়া হতো গরুর গাড়িতে। অভিজাত পরিবারের সদস্যরা যাতায়াত করতো গরুর গাড়িতে। আত্মীয় বাড়ি বেড়াতে যেত গরুর গাড়ি চড়েই। বাড়ির বাইরে গরুর গাড়ির আওয়াজ শুনেই বোঝা যেত অতিথি এসেছে। গরুর গাড়ি এসেছে যখন তখন নিশ্চয়ই এসেছে কোনো বিশেষ অতিথি!
গরুর গাড়ি আমাদের দেশের অনেক পুরনো যানবাহন। তখন এটাই ছিল আমাদের অন্যতম প্রধান যানবাহন। গরুর গাড়ি চলার জন্য বিশেষ কোনো রাস্তার দরকার হয় না। মেঠোপথ, উঁচু-নিচু জমি, বালুচর সব জায়গা দিয়েই গরুর গাড়ি চলতে পারে অনায়াসে। আমাদের দেশের অনেক এলাকায় এখনো পাকা রাস্তা হয় নি। সেখানে অবাধে চলতে পারে গরুর গাড়ি। উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত এলাকায় এখনো চলাচলের প্রধান বাহন গরুর গাড়ি। সেখানে মালামাল পরিবহণ ও মানুষ চলাচলের প্রধান বাহন হচ্ছে গরুর গাড়ি।
গরুর গাড়ি সম্পূর্ণরূপে আমাদের দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি। আমাদের দেশের বাঁশ, কাঠ ব্যবহার করা হয় গরুর গাড়ি তৈরিতে। গরুর গাড়ি খুব বড় বড় দুইটি চাকা থাকে। চাকা দুইটি কাঠের তৈরি। কাঠের চাকায় পুরানো থাকে লোহার রিং। তার উপর আবার রবারের টায়ারও পরনো হয়। কাঠের চাকায় খোদাই করে নানান নকশা করা হয়। এই চাকা যখন ঘোরে তখন কোঁ-ওঁ-ওঁ-ওঁ শব্দ হয়।
কাঠমিস্ত্রি ও কামারের যৌথ চেষ্টায় গরুর গাড়ির চাকা তৈরি হয়। চাকার উপর একটি ফ্রেমের উপর থাকে বাঁশের পাটাতন। এই পাটাতনের উপর মালামাল বহন করা হয়। যে সব গরুর গাড়িতে মানুষ যাতায়াত করে, তাতে থাকে ছই। এই ছই নৌকার ছইয়ের মতোই। ছই রোদ বৃষ্টি থেকে যাত্রীকে রক্ষা করে। আর সামনের দিকে থাকে গাড়োয়ানের বসার জায়গা।
এখন যন্ত্রচালিত যানবাহনের যুগ। মালামাল বহনের জন্য রয়েছে ট্রাক, লরি, মালগাড়ি। মানুষের যাতায়াতের জন্য রয়েছে মোটরগাড়ি, রেলগাড়ি, বেবী ট্যাক্সি, রিকশা ইত্যাদি। মানুষ এখন খুব একটা প্রয়োজন না হলে গরুর গাড়ি ব্যবহার করে না। আধুনিক যানবাহনের ভিড়ে গরুর গাড়ি অনেকটা হারিয়ে গেছে। তারপরও মিটিমিটি করে এর অস্তিত্ব টিকে আছে।
গরুর গাড়ির একটি সুবিধা হলো এতে কোনো জ্বালানি লাগে না। ধোঁয়া হয় না। পরিবেশের কোনো ক্ষতি করে না। এটি খুবই পরিবেশ সহায়ক একটি যানবাহন।


মন্তব্য

কীর্তিনাশা এর ছবি

উত্তর বঙ্গে এখনো কিছু গরুর গাড়ি দেখা যায়, মানে কিছুদিন আগে চাপাইনবাবগঞ্জ গিয়েছিলাম বেড়াতে সেখানে দেখলাম কিছু গরুর গাড়ি। তবে এই গতির যুগে এই বাহনের আর কিছুদিন পর যাদুঘরেই ঠাঁই হবে।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

আবু রেজা এর ছবি

লেখাটি পড়েছেন এজন্য ধন্যবাদ। মন্তব্যের জন্যও ধন্যবাদ।

তবে এই গতির যুগে এই বাহনের আর কিছুদিন পর যাদুঘরেই ঠাঁই হবে।

আসলে ইতোমধ্যে জাদুঘরে ঠাঁই নিয়েছে। শুধু লেখার মধ্যে স্মৃতিটুকু ধরে রাখা।

যে জন বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গ বাণী
সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

পরিবেশ সহায়ক ঠিক আছে। নিউমার্কেট থেকে মাছ কিনে এই বাহনে কলাবাগান আসতে আসতে সেই মাছই পরিবেশ দূষক হয়ে যাবে। দেঁতো হাসি

____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

আবু রেজা এর ছবি

ধন্যবাদ লেখাটি পড়ার জন্য এবং মন্তব্যের জন্য।

যে জন বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গ বাণী
সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।

রাফি এর ছবি

আপনার এই লেখাগুলো একটা সিরিজ করে ফেলেন।
আমাদের ঐতিহ্যের সংরক্ষনে এটা একটা বিরাট কাজ হবে বলে আমার বিশ্বাস।

পল্লীএলাকার আর সব উপাদান নিয়ে আরো লেখা আশা করছি।

---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!

---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!

আবু রেজা এর ছবি

ধন্যবাদ রাফি। সিরিজ করার ইচ্ছা আছে। আপনার মন্তব্য আমাকে অনুপ্রাণিত করছে। ধন্যবাদ আবারও।

যে জন বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গ বাণী
সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

আমার দাদার বাড়ি জয়পুরহাট অঞ্চলের একটি গ্রামে। মনে পড়ে গেলো, ছোটোবেলায় জয়পুরহাট স্টেশনে নেমে গরুর গাড়ি করে যেতে হতো। সর্বশেষ যখন গিয়েছি, তখন রিকশা যায় বাড়ির উঠান পর্যন্ত।

যতোই পরিবেশ-বান্ধব হোক, স্রেফ গতির প্রয়োজনেই গরুর গাড়ি বাহন হিসেবে একসময় অবলুপ্ত হয়ে যাবে। তখন গাড়িয়াল ভাই চিলমারীর বন্দরে যাবে অন্য কোনো বাহনে, তা নিয়ে ভাওয়াইয়ার মতো হৃদয়বিদারী সঙ্গীত রচিত হবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে।

পুনশ্চ: আপনার উদ্ধৃত আব্বাসউদ্দিন আহমদের গানের শেষ লাইনটি এরকম : "হাঁকাও গাড়ি তুমি চিলমারীর বন্দরে রে..."

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

আবু রেজা এর ছবি

আমার উদ্দেশ্য হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যের তথ্য ও বিবরণ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা।
গানের ভুল ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। সংশোধনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম।

যে জন বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গ বাণী
সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

যদি কখনো হাইব্রীড প্রজাতির কোন গরুর প্রজনন হয় যা কি না ঘোড়ার গতিতে চলতে পারে, তাহলে হয়তো পুরানো সেইসব দিন কিছুটা হলেও ফিরতে পারে (পরিবেশ দূষণের বিষয়টা মাথায় রেখে)।

কিন্তু তা যেহেতু সম্ভব নয়, তাই সেইসব দিনের কথা স্মরণ করে আহা-উহু করা ছাড়া আর কোন উপায় নাই। ইতিবাচক দিকটা চিন্তা করুন, বেচারা গরুর উপর থেকে কষ্টের বোঝা তো কিছুটা হলেও কমেছে! চোখ টিপি

আবু রেজা এর ছবি

পড়েছেন, মন্তব্য করেছেন - এজন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

যে জন বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গ বাণী
সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।

শেখ জলিল এর ছবি

রাফি লিখেছেন:
[আপনার এই লেখাগুলো একটা সিরিজ করে ফেলেন।
আমাদের ঐতিহ্যের সংরক্ষনে এটা একটা বিরাট কাজ হবে বলে আমার বিশ্বাস।

পল্লীএলাকার আর সব উপাদান নিয়ে আরো লেখা আশা করছি।/quote]
..রাফির সাথে আমিও একমত। আপনার বায়োস্কোপ পড়ে নেশা জেগেছিলো। সচলায়তনে বাংলার লুপ্তপ্রায় লোকজ ঐতিহ্য এ ধরণের সিরিজ নেই। আপনি অনায়াসে চালিয়ে যেতে পারেন এ সিরিজ। পরবর্তী লেখার প্রত্যাশায় রইলাম।

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

আবু রেজা এর ছবি

ধন্যবাদ।
আমার ইচ্ছা সে রকমই।
দেখা যাক কতটুকু করকত পারি।

যে জন বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গ বাণী
সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।