বদলে যাওয়া মানুষ (২)

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি
লিখেছেন আনোয়ার সাদাত শিমুল (তারিখ: মঙ্গল, ১২/০৯/২০০৬ - ১:০০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


বদলে যাওয়া মানুষ (1)[উৎসর্গ: "পোকা মানব" শুভ ভাই; যিনি মানুষের মাথায় ভাবনার পোকা সৃষ্টি করেন!]সেই বৃষ্টিভেজা বিকেলের সামান্য আলাপচারিতা আনিসের মনে সাহসের জোয়ার আনে। সিলভিয়াদের পুকুর ঘাটে "লাভ মী" কিংবা "আই অ্যাম ওকে, আর ইউ?" লেখা লাল-নীল গেঞ্জী পরে অপেক্ষা করে। চা-চানাচুরের পাশাপাশি সিলভিয়ার সাথে গল্প জমে। অথচ আনিস তার প্রিয় কথাগুলো বলতে পারে না, সিলভিয়ার কথাগুলোও জানা হয় না। আনিসের বাবা আর সিলভিয়ার মা বিয়ের আয়োজন শুরু করে। বৃষ্টির মওসুম শেষ হোক। পঁচিশে কার্তিক বিয়ে, পরদিন বৌ-ভাত।পুকুর ঘাটের বিকেলগুলো যেন চোখের পলকে চলে যায়। আনিসের পরের সন্ধ্যাগুলোয় এক ধরনের একাকীত্ব পেয়ে বসে। এর চেয়েও বড় একটি ভাবনা আনিসকে বিষন্ন করে আজকাল। ইদানিং তার আছরের নামাজটা কাজা হয়ে যাচ্ছে। সিলভিয়া আনিসকে যেতে দেয় না, সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে থাকতে বলে। আনিসের ভালো লাগে না। গত নয় বছর সৌদি আরবে সময়মতো নামাজ পড়ার যে অভ্যাস রপ্ত হয়েছে বাংলাদেশে এসে সিলভিয়ার জন্য তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আনিস ভেবে পায় না সিলভিয়া কেন নামাজ পড়ে না! মুসলমানের মেয়ে পরকালের চিন্তা ছাড়া কীভাবে চলে? গ্রামের মানুষগুলো থেকে কি আল্লাহ খোদা উঠে গেল? সিলভিয়াকে এত্তো করে বলার পরও মাথায় ঘোমটা দেয় না।একদিন জোর করে বলায় সিলভিয়া ক্ষেপে গিয়ে বলেছিল - আপনার হুজুর হুজুর ভাব নিয়া আপনি চলেন, আমি পারব না। হুজুরের সাথে হুজুরাইন সাজার ইচ্ছা আমার নাই।শুনে আনিসের খুব কষ্ট হয়, বলে - নামাজ পড়লে, ঘোমটা দিলে হুজুর হয়ে যায়? আল্লাহ খোদা না মাইনা তুমি ক্যামনে চলবা? তোমার মরণের ডর নাই?এবার সিলভিয়া খিলখিল করে হাসে। হাসি আর থামতে চায় না। হাসির শব্দে বাতাস যেন উলটা দিকে বয়। পুকুরে ঢেউ উঠে। হাসি থামিয়ে সিলভিয়া বলে - আপনি দেখি মজিদের ছোট ভাই। হি:হি:হি: না, আপনি ছোট ভাই না... হি:হি: আপনি হি:হি: আপনি নিজেই মজিদ। হি:হি:হি:হি: - শুনেন মজিদ ভাই, আমার সাথে কথা বইলা আর কাম নাই। আজান দিছে, যান - মসজিদে গিয়া নামাজ পড়েন, আল্লাহ-বিল্লাহ করেন। বেগানা নারীর সাথে আড্ডা জমাইয়েন না। হি:হি:হি:হি:...আনিস কী বলবে ভেবে পায় না। মসজিদের দিকে হেঁটে চলে। পেছনের সিলভিয়া বেগমের খিলখিল হাসি। আনিস বুঝতে পারে - সিলভিয়া অনেক পড়ালেখা করা মেয়ে, অনেক কিছু জানে। কিন্তু এই মজিদ লোকটা কে? আনিস ছোটবেলার কথা ভাবে - গ্রামের মজিদ নামের কারো কথা মনে পড়ে না। আত্মীয়-স্বজনদের মাঝেও মজিদ নামের কেউ নেই। মজিদ কি তবে সিনেমার কোন গুন্ডার নাম? নাকি সিলভিয়ার প্রেমিক! এ ভাবনার আনিস কোন দিশা খুঁজে পায় না। অবশেষে রাতে সিলভিয়ার মোবাইলে ফোন করে- মজিদ লোকটা কে?আবার সিলভিয়ার হি:হি:হি:হি: হাসির শব্দ। কী করেন মজিদ ভাই? নামাজ শেষ হইছে? হি:হি: অজু করছিলেন নামাজের আগে? হি:হি:হি:চার.আনিসের স্কুল জীবনের ঘনিষ্ট বন্ধু- বর্তমানে লোকাল কলেজের ইংরেজীর মাস্টার আব্দুল আহাদের কাছে মজিদের কথা বলার পর আনিস যা শোনে - তাতে তার রক্ত গরম হয়ে যায়, মাথায় খুন চাপে। খোদাভীতির কারণে আনিস নামাজ পড়ে। সিলভিয়াকেও তাই নামাজ পড়তে আর মাথায় ঘোমটা দিতে বলেছিল সে। কিন্তু আজ আহাদ লালসালু-র যে মজিদের কথা বললো - আনিস নিজেকে সেরকম ধর্মীয় লেবাশ সমৃদ্ধ নারী লোলুপ-লম্পট মনে করে না। আর আনিস দেখেছে - সৌদি আরবের পর্দানশীল মেয়েরা কত্তো সুখী। আল্লার রহমত তাদের নিত্যসংগী।সিলভিয়া বেগমের এ অস্থির আচরণের সাথে আনিস নিজেকে মিলাতে পারে না। আনিস চেয়েছিল শান্ত-শিষ্ট-বাধ্যগত একটা বৌ। সংসারী একটা বৌ - যে বৌ ঘরে থাকবে, ভালো ভালো রান্না করবে, নিত্য নতুন সেলাই করবে, বাচ্চাকাচ্চা আর শ্বাশুড়ীর যত্ন নিবে। অথচ সিলভিয়া পুরোপুরি অন্যরকম। ডিগ্রি পাশের পর সে নাকি চাকরি করবে। গৃহস্ত বাড়ীর বৌ কেন চাকরি করবে - তার উত্তর আনিসের জানা নেই। আনিস উলটা পালটা অনেক কিছু ভাবে। সিলভিয়াকে ফোন করে না আর। সিলভিয়া ঘোষণা দেয় - সে আনিসকে বিয়ে করবে না। মেট্রিক ফেল - অশিক্ষিত - একগুঁয়ে - ব্যাকডেটেড আনিসের কোন যোগ্যতা নেই সিলভিয়াকে বিয়ে করার। আনিসও বেঁকে বসে। দুই পরিবারের মুরুবি্বরা এসব শুনে হাসে, বলে - পোলাপানের পাগলামি।পাঁচ.আশ্বিন মাস পেরিয়ে কার্তিকের শুরু। তখনো আনিস সিলভিয়ার মনোমালিণ্য কমেনি। দুই পরিবার বিয়ের আয়োজনে ব্যস্ত। কার্ড ছাপিয়ে আত্মীয়-স্বজনদের দাওয়াত দেয়া শুরু হয়েছে। আনিস মায়ের মুখে তাকিয়ে কিছু বলতে পারে না। ওদিকে ঘটনা ঘটায় সিলভিয়া। আনিসের সাথে জোর করে বিয়ে দেয়ার প্রতিবাদে বিয়ের আগের মংগলবার বিষ খায় সে। হাসপাতালে নিয়ে অনেক কষ্টে বাঁচানো যায়। থানা পুলিশ নিয়ে সে এক ধুন্দমার কান্ড। সব আয়োজন ভেস্তে যায়। আনিস পরদিন ঢাকা রওনা দেয়। প্ল্লেনের টিকিট রি-কনফার্ম করে। মা জিগ্গেস করে - আর কবে আসবি বাবা?আনিস জবাব দিতে পারে না।প্লেন ছাড়ার পর মায়ের কথা খুব মনে পড়ে।প্লেনের ঝিঝি শব্দের মাঝে সিলভিয়ার চঞ্চল হাসিটা বারবার ফিরে আসে।আনিস চোখ মুছে।(সমাপ্ত)


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।