বনানিয়র্ক ইউনিভার্সিটির হিসাব বিজ্ঞানের শিক্ষক মাজিদ মাহমুদের ক্লাস ছিল না আজ। ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হওয়ায় ছয়তলা ভবন সর্বস্ব ক্যাম্পাসে ছাত্র-শিক্ষকের আনাগোণা ছিল কম। কিছু নিরাপত্তাকর্মী এখানে ওখানে আধো ঘুমে আধো জাগরণে মোবাইল ফোনে গান শুনছিল। সে গানের হাল্কা সুর মাজিদ মাহমুদের কানেও আসছিল। চার তলার অফিস রুমে তিনি পরীক্ষার খাতায় ডেবিট ক্রেডিট দেখায় মনোযোগী ছিলেন, তবুও হিন্দি গানটির সুর তার কানের সুড়ঙ্গ পেরিয়ে মাথার ভেতরে চলে যাচ্ছিল। হিন্দি গান তেমন শোনেন না, অথচ মনে হচ্ছিল এ গানের সঙ্গে তার বিশেষ কোনো স্মৃতি আছে। কী স্মৃতি তা তিনি মনে করতে পারছেন না, কিন্তু আনমনে মাথা নাড়ছেন গানের তালে তালে। চায়ের তেষ্টা পেয়েছে খুব। মনে মনে ভাবছেন, হাতের খাতাগুলো চেক করা হলেই ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ডে খুপড়ি ক্যান্টিনে গিয়ে চা খেয়ে আসা যাবে। সিগারেটের জন্য আবার রাস্তার ওপর টং দোকানে যেতে হবে। ধুমপান ও রাজনীতিমুক্ত বনানিয়র্ক ইউনিভার্সিটির আইন কানুন খুব কড়া, শিক্ষকদের চেয়ে মালিকপক্ষ বেশি শক্তিশালী এখানে।
হঠাৎ দরজায় টোকা পড়ার শব্দ শুনে মাজিদ মাহমুদ মাথা তুলে তাকান।
দুই তরুণ, বয়সে এবং বেশভূষায় ইউনিভার্সিটির ছাত্র বলে মনে হয় আবার মনে হয়ও না এমন, দরজায় টোকা দিয়েই অর্ধেক শরীর রুমের ভেতরে ঢুকিয়ে বলছে, “স্যার, আসতে পারি?”
মাজিদ মাহমুদ হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে বলেন, “কী ব্যাপার?”
দুজন তরুণ তখন রুমের ভেতরে ঢুকে মাজিদ মাহমুদের মুখোমুখি রাখা চেয়ারে বসে। মাঝে কেবল টেবিল, টেবিলের ওপর পরীক্ষার খাতা, কলম, ক্যালেন্ডার, স্কেল এবং একটি দৈনিক পত্রিকা।
“স্যার, আমরা দেশের বাইরে যাওয়ার ব্যাপারে কথা বলতে এসেছিলাম।”
“মাস্টার্স করতে নাকি ক্রেডিট ট্রান্সফার?” মাজিদ মাহমুদ অপেক্ষাকৃত লম্বা চুলের তরুণটির দিকে তাকান।
তরুণটি জবাব না দিয়ে পাশের বন্ধুটির দিকে তাকায়, বন্ধুটি তখন ডান হাতের তর্জনীর নখ দিয়ে বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলির নখ খুটছিল। মাজিদ মাহমুদ দেখেন - স্বাভাবিকের চেয়ে লম্বা তার নখ, নখের ফাঁকে ময়লা, তিন আঙ্গুলে তিন রঙের তিনটি আংটি; ঝলসানো, মলিন এবং নখের ময়লার মতোই কুৎসিত।
কোনো সাড়া না পেয়ে মাজিদ মাহমুদ খানিক ক্লান্তি এবং আলস্যে হাই তোলেন। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে চশমা খুলে চোখ কচলান। চশমা খুললেই তিনি, কাছে এবং দূরে দুটোই, ঝাপসা দেখেন। ঝাপসা চোখে দেখলেন, ডানপাশের লম্বা চুলের তরুণটি তার চশমা হাতে নিয়ে মুঠোবন্দী করেছে। মাজিদ মাহমুদ কিছু বলতে চাইছিলেন, তখনই ময়লা নখের তরুণটি উঠে দাঁড়ায়। কিছু একটা মাজিদ মাহমুদের কপালে তাক করে সে বলে, “স্যার, আপনাকে বিদায় নিতে হবে। গুড বাই।”
বুঝতে কষ্ট হলো না কপালে ঠেকানো জিনিসটি পিস্তল ছাড়া আর কিছু নয়। ‘গুড বাই’ উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে হালকা তুড়ি বাজানোর মতো একটা শব্দ হয়। মাজিদ মাহমুদ কতোটা জোরে চিৎকার করলেন তা তিনি নিজেই জানেন না। কারণ, ততক্ষণে কপাল পেরিয়ে বুলেট বিঁধে গেছে মাথার খুলিতে। কৈশোরে ক্রাইম ফিকশনের ভক্ত ছিলেন, তাই তিনি অনুমান করেন – পিস্তলে সাইলেন্সার লাগানো ছিল। কপাল থেকে রক্ত গড়িয়ে চোখে পড়লে চেয়ার থেকে ধীরে ধীরে হাঁটু মুড়ে ফ্লোরে শুয়ে পড়েন তিনি। নিথর চোখে দেখেন, শুকনো ফ্লোরে জলোচ্ছ্বাসের মতো তার রক্তের ঢেউ উঠছে। একটু পর এ প্রবল স্রোত তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে গভীর সমুদ্রে। চা অথবা পানির তেষ্টা আরো তীব্র হয়ে ওঠে।
দুই
থানায় তিনি আগেও এসেছেন একবার, তবে নিজের জন্য নয়।
গত বছর হরতালের আগের দুপুরে তার এক ছাত্রকে রাজনৈতিক কর্মী সন্দেহ করে পুলিশ থানায় নিয়ে এসেছিল। সেদিন পরীক্ষার হলে ছাত্রটি অনুপস্থিত কেন জানতে চাইলে সহপাঠীরা জানায়, ইউনিভার্সিটি আসার পথে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে গেছে। পরীক্ষার হলে অস্থির লাগে মাজিদ মাহমুদের, কেবলই মনে হয় – ছাত্রটিকে থানায় পুলিশ পিটিয়ে আধমরা করে ফেলেছে। তার বুক ধড়পড় করে। পরীক্ষা শেষ হতেই তিনি ছুটে যান বিভাগীয় চেয়ারম্যান স্যারের রুমে। ভীষণ আত্মকেন্দ্রীক চেয়ারম্যান স্যার থানা পুলিশের নাম শুনেই থতমত খান। মাজিদ মাহমুদকে বলেন, “শোনেন, যেহেতু তাকে ক্যাম্পাসের বাইর থেকে ধরা হয়েছে, আমরা এসবে না জড়ানোই ভালো। ঐ ছেলের ফ্যামিলি আছে, তারাই সামাল দিক।”
সাহস নিয়ে মাজিদ মাহমুদ বলেন, “স্যার, ও তো আমাদেরই স্টুডেন্ট, ভালো ছেলে, আমি চিনি ওকে। আপনিসহ থানায় চলুন, নইলে একটা ফোন করুন থানায়।”
সামনের গ্লাসে রাখা পানিতে চুমুক দিয়ে চেয়ারম্যান স্যার কিছুটা উচ্চস্বরে বলেন, “চেনেন মানে? কতোটুকু চেনেন? সে কী আপনার রিলেটিভ? পাড়া প্রতিবেশী কেউ?”
মাজিদ মাহমুদ ধমক খেয়ে ঢোক গিলে্ন, “না স্যার, ক্লাসেই চিনি, ছাত্র হিসেবে...”
“তাহলে? কেন শুধু শুধু ঝামেলায় জড়াচ্ছেন? আজ আর ক্লাস না থাকলে বাসায় চলে যান, নিরাপদে যাবেন, নিজ দায়িত্বে যাবেন। মনে রাখবেন, থানার পাশে কানাও যায় না। আর আপনাকেও যদি পুলিশ ধরে নিয়ে যায়, আপনাকে বাঁচাতেও আমি থানায় যাবো না। আমিই বা আপনাকে কতোটুকু চিনি?”
চেনা অচেনার এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জটিলতায় অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো যখন গোলকধাঁধা মনে হয়, তখন মাজিদ মাহমুদ সিঁড়ে ভেঙে ভেঙে ছয়তলা থেকে নিচে নেমে আসেন। রিকশা নিয়ে সোজা থানায় চলে যান। থানায় পৌঁছে মনে হয় চেয়ারম্যান স্যারের কথাই ঠিক, থানার পাশে কানাও যায় না। কিংবা যারা আসে তারা অন্ধের মতো হয়ে যায়। কল্পনায় ছিল, থানায় সরাসরি ওসি সাহেবের রুমে চলে যাওয়া যায়। অথচ এখানে ওসি কিংবা দারোগা কে, কাকে গিয়ে কী বলতে হবে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। স্থানে স্থানে মানুষের ভীড়, জটলা। তাদের দেখেই মনে হয় অসহায় বিপন্ন মানুষ, চোখে মুখে উৎকন্ঠা, কন্ঠে আহাজারি। বারান্দার এক কোণে এক শিশু মায়ের কোলে ভবন কাঁপানো চিৎকারে কাঁদছে। চারপাশের ব্যস্ত মানুষদের ভীড়ে কেবল এ নারীকেই ব্যস্ত মনে হয় না। জীর্ণ শাড়ী আর শীর্ণ শরীরে, ততোধিক শীর্ণ ও ক্রন্দনশীল সন্তান কোলে নিয়ে তিনি শূন্য চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। মাজিদ মাহমুদ ভাবেন, একেই জিজ্ঞেস করা যায় ওসি’র রুম কোনদিকে। দু’কদম এগুতেই তিনি দেখেন, মহিলাটি দেয়ালের দিকে মুখ করে খানিক আড়াল নিয়ে ব্লাউজের ভেতর থেকে স্তন বের করে শিশু সন্তানের মুখে পুরে দিচ্ছেন। স্পষ্ট কিংবা অস্পষ্টভাবে এক ঝলক স্তন দেখে মাজিদ মাহমুদ বিব্রত হন। অন্যদিকে মুখ করে হাঁটতে থাকেন যেন কিছুই দেখেননি তিনি। অপরাধময় আনন্দবোধের আবেশ টের পান তিনি। পরক্ষণে মনে মনে নিজেকে ধিক্কারও দেন। সু-মন আর কু-মনের সংঘাতে থানার ডান দিকে হাঁটতে গেলে দেখেন এক পুলিশ তার দিকে এগিয়ে আসছে।
সালাম দিয়ে হাত বাড়ালে, জানা যায় – পুলিশটির নাম এস আই হুমায়ূন কাদির।
লেকচারার, বনানিয়র্ক ইউনিভার্সিটি, পরিচয় সম্বলিত একটি ভিজিটিং কার্ড বিনয়ের সঙ্গে বাড়িয়ে দিলে এস আই হুমায়ূন কাদির হাসি মুখে মাজিদ মাহমুদকে নিজের রুমে নিয়ে যান। ‘স্যার’ সম্বোধন করেন।
মাজিদ মাহমুদ অবাকই হন। থানায় এসে কানা হওয়ার যে বিভ্রমে তিনি ছিলেন, তা অনেকটা কেটে যায়। চা পানির প্রস্তাব প্রত্যাখান করে তিনি মূল কথায় আসেন। বলেন, তার এক স্টুডেন্টকে সন্দেহবশতঃ থানায় নিয়ে আনা হয়েছে, অথচ ছেলেটি আজ সকালে পরীক্ষা দিতে যাচ্ছিল। থানা কর্তৃপক্ষ যদি চায়, তাহলে ভার্সিটি রেকর্ডও এনে দেখানো যাবে যে এই ছেলেটি কোনো ক্লাস কিংবা পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিল না এবং এ সরল ছেলেটির পক্ষে রাজনৈতিক সহিংসতায় জড়িত থাকা সম্ভব নয়।
মাজিদ মাহমুদ যতোটা আবেগ-উৎকন্ঠা এবং গুরুত্ব দিয়ে কথাগুলো বলছিলেন তার চেয়ে দ্বিগুন তাচ্ছিল্যে এস আই হুমায়ূন কাদির সব উড়িয়ে দেন, বলেন – “স্যার, আপনি হলেন শিক্ষক মানুষ। আপনাকে বিশ্বাস করবো না তো কাকে করবো?”
এরপর আঁটককৃত ছাত্রটিকে আধ ঘন্টার মধ্যে ছেড়ে দেয়া হয়, সব কিছু ঘটে অবিশ্বাস্য দ্রুততায়। মাজিদ মাহমুদকে কয়েকটি কাগজে স্বাক্ষরও করতে হয়। বিদায়ের সময় এস আই হুমায়ূন কাদির হ্যান্ডশেক করে খানিক নিচু স্বরে বলেন, “স্যার, আপনার ভার্সিটিতে আসবো একদিন, আমার এক শালী ভর্তি হতে পারে। স্কলারশীপ পাওয়া যায় নাকি?”
মাজিদ মাহমুদ বিনয়ী এবং কৃতজ্ঞ কন্ঠে বলেন, “অবশ্যই আসবেন, আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।”
থানার গেইট পার হতেই ছাত্রটি মাজিদ মাহমুদকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ শব্দে কান্না শুরু করে। কোনভাবেই থামানো যায় না তাকে। তার নাকের চোখের পানিতে মাজিদ মাহমুদের শার্টের বুকের অংশ ভিজে যায়। রাস্তায় লোক জড়ো হতে শুরু করলে, ছাত্রটিকে নিয়ে তিনি রিকশায় ওঠেন। পড়তি বিকেলে হাল্কা বাতাসে তিনি টের পান শার্টের ভিজে যাওয়া অংশে শীতল ভাব অনুভূত হচ্ছে। শার্ট ও চামড়া ভেদ করে এ ঠান্ডা অনুভুতি সারা বুকে বরফের মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে।
তিন
বছর খানেক পর থানায় এসে গেট দিয়ে ঢুকতেই প্রথম বার থানায় আসার স্মৃতি মনে পড়ে যায় নিহত মাজিদ মাহমুদের। গতবার বুকের যে অংশে শীতল অনুভব হয়েছিল এবার সেখানে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। এ প্রথম তিনি খেয়াল করেন, শুধু কপালে নয় তার বুকেও গুলি করা হয়েছে। রক্ত সব শুকিয়ে গেছে। কপালে হাত দিয়ে তিনি অনায়াসে আঙুল ঢুকিয়ে দিতে পারেন মাথার ভেতর, কিন্তু বুলেটের নাগাল পান না। বুকের ভেতর হাত দিতে ভয় লাগে তার।
থানায় সরাসরি এস আই হুমায়ূন কাদিরের রুমে চলে যান তিনি। রুমে কেউ নেই। পুরো থানায় একজন দর্শনার্থীও নেই। বারান্দায় শুয়ে থাকা এক ভবঘুরে জানায়, আজ থানার সরকারী ছুটির দিন কিংবা পৃথিবীর সব অপরাধী বিলীন হয়ে গেছে। তাই থানাটি এখন পুরনো রাজবাড়ির মতো খাঁ খাঁ শুন্যতায় ডুবেছে। মাজিদ মাহমুদ দেখেন, পাশের রুমেই এস আই হুমায়ূন কাদির কথা বলছিলেন উচ্চপদস্থ কারো সঙ্গে। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত রুম, সিসিটিভি চলছে – দেখে মনে হয় এটিই ওসি’র রুম। মাজিদ মাহমুদ অনুমতি না নিয়েই ঢুকে পড়েন, বলেন – “আমাকে খুন করা হয়েছে!”
ওসি পেপসি খাচ্ছিলেন স্ট্রতে মুখ লাগিয়ে। মুখ থেকে স্ট্র সরালেন না। এস আই হুমায়ূন কাদির উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। মাজিদ মাহমুদের গায়ে হাত দিয়ে বললেন, “বসুন, বসুন। কীভাবে হলো এসব?”
“ভার্সিটির অফিস রুমেই ছিলাম, হঠাৎ দুটো ছেলে এসে...” কথা শেষ করতে পারলেন না তিনি, ওসি বাধা দিয়ে বললেন, “আপনারা আগের পরিচিত?”
এস আই হুমায়ূন কাদির জবাবে জানালেন আগে একবার কথা হয়েছিল, থানাতেই। ওসিকে কী এক জরুরী কাজে বাইরে যেতে হবে এমন ইঙ্গিত পেলে এরপর পাশের রুমে, যেখানে বসে এক বছর আগে কথা হয়েছিল সেখানেই, মাজিদ মাহমুদ এবং এস আই হুমায়ূন কাদির মুখোমুখি বসেন। এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলে মাজিদ মাহমুদ কাঁপা কাঁপা হাতে ঠোঁট পর্যন্ত নিতে পারেন, কিন্তু চুমুক দিতে পারেন না। তৃষ্ণা মিটলো না। এস আই হুমায়ূন কাদির জিজ্ঞেস করেন, “কোল্ড ড্রিংকস খাবেন?”
মাজিদ মাহমুদ সম্মতি দিলে তিনি কাকে যেন ফোন করে বলেন, “দুইটা ঠান্ডা পাঠাও, তাড়াতাড়ি।”
এরপর শুকনো গলায় যতো দ্রুত সম্ভব সংক্ষেপে সকালে ঘটে যাওয়া দৃশ্যগুলোর বর্ণনা দেন মাজিদ মাহমুদ। মনোযোগ দিয়ে শোনেন এস আই হুমায়ূন কাদির। প্রশ্নও করেন ক্ষণে ক্ষণে –
“ওরা কি আপনার স্টুডেন্ট ছিল?”
“হতেও পারে, নাও হতে পারে।”
“কিন্তু, আপনি বলছেন – নখে ময়লা ছিল, আংটি ছিল...”
“অনেক স্টুডেন্টই তো এগুলো পরে...”
“কারো সঙ্গে কোনো শত্রুতাও নেই আপনার?”
“না, কখনোই ছিল না।“
“তাহলে খুন হলেন কেন?”
“জানি না।”
“তাহলে কী হবে এখন?”
“আপনি আইনের লোক, আপনিই বলুন।”
“যেহেতু খুনের ঘটনা, প্রথম কাজই হলো মামলা করতে হবে। মামলা করবে কে?”
মাজিদ মাহমুদকে ক্লান্তি চেপে ধরে। মনে হয় তার ভীষণ ঘুম পায়। তখন এক কিশোর, সম্ভবতঃ কোনো এক হোটেলের কর্মচারী, দু’হাতে দু’টো আরসি কোলা নিয়ে আসে।
এস আই হুমায়ূন কাদির এক চুমুকে প্রায় অর্ধেক গিলে ফেলেন, কিন্তু খুন হয়ে যাওয়া মাজিদ মাহমুদ অনেক চেষ্টায়ও এক ঢোক আরসি কোলা মুখে নিতে পারলেন না। দেখে এস আই হুমায়ূন কাদির বলেন, বোতলে মুখ দিয়ে ঢকঢক করে খাওয়ার চেষ্টা করেন, পারবেন।
সে চেষ্টাও ব্যর্থ হলো। কেবল কালো রঙের আরসি কোলা মাজিদ মাহমুদের শার্টে জমাট বাঁধা কালো রক্তের সঙ্গে মিশে গেল।
চার
এস আই হুমায়ূন কাদিরের মোটর বাইকের পেছনে চেপে মাজিদ মাহমুদ যখন তার কর্মস্থল বনানিয়র্ক ইউনিভার্সিটির সামনে নামেন তখন চারপাশ ফাঁকা। কোলাহলময় ক্যাম্পাস যেন মাজিদ মাহমুদের মতোই খুন হয়ে গেছে। শরীরে শুকিয়ে যাওয়া ক্ষত রক্ত আর ভেতরে বিদ্ধ বুলেট নিয়ে নিথর দাঁড়িয়ে আছে। প্রধান ফটকে সিক্যুরিটি গার্ড ছিল কিনা সেদিকে খেয়াল করলো না দু’জন। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলরের অফিসে উঠে দেখা গেল – স্থুলকায়া অফিস সহকারীটি কম্পিউটারে ফেসবুক নিয়ে ব্যস্ত। পুলিশ দেখে বিব্রত হলো সে। মাজিদ মাহমুদের বুলেটবিদ্ধ কপাল কিংবা বুক তার চোখে পড়লো কিনা বোঝা গেল না। মাজিদ মাহমুদের মনে পড়ে, এ স্থুলকায়া মহিলাটি ভাইস চ্যান্সেলরের অফিস সহকারী বলে প্রবল ক্ষমতার অধিকারী, শিক্ষকদের সঙ্গে কখনো বিনয়ী হতে দেখা যায়নি তাকে।
মহিলাটি জানালো, ভিসি এবং প্রো-ভিসি মহোদয় দু’জনই কনফারেন্স ট্যুরে দেশের বাইরে গেছেন।
বিভাগীয় চেয়ারম্যানের রুমে গিয়ে দেখা গেল, তিনিও আসেননি আজ। আসবেন কিনা নিশ্চিত না – জানালো ডিপার্টমেন্ট সেক্রেটারী।
চেয়ারম্যান স্যারকে মোবাইল ফোনে কল করলেন এস আই হুমায়ূন কাদির।
ওপাশ থেকে জানালেন – প্রেশার বেড়ে গেছে তার, রাতে ঘুম হয়নি, তাই আজ ক্যাম্পাসে আসবেন না তিনি।
এস আই হুমায়ূন কাদির বললেন – যেহেতু খুনের ঘটনাটি ক্যাম্পাসেই ঘটেছে এবং খুন হয়ে যাওয়া মানুষটি তারই বিভাগীয় শিক্ষক, তাই পুলিশ তার সঙ্গে কথা বলতে চায়। প্রয়োজন হলে তার বাসায়ও যেতে রাজী আছে পুলিশ।
বাসায় পুলিশ যাওয়ার প্রস্তাবটি চেয়ারম্যান স্যার মেনে নিতে পারলেন না, জানালেন – কষ্ট হলেও তিনি ক্যাম্পাসে আসবেন। চল্লিশ মিনিট সময় লাগবে তার।
এস আই হুমায়ূন কাদির ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন রেখে দেন।
“এখন শরীর কেমন লাগছে?” প্রশ্ন শুনে মাজিদ মাহমুদ জানালেন তলপেটে প্রচন্ড ব্যথা করছে। বাথরুমে গেলে ভালো লাগতো। ধুমপানমুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কার্যালয়ে এস আই হুমায়ূন কাদির সিগারেটে আগুন জ্বালাচ্ছেন তখন। একটি সিগারেট হাতে বাথরুমে যেতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু নিজেকে সংবরণ করলেন মাজিদ মাহমুদ।
কমোডের সামনে দাঁড়িয়ে অনেক কষ্টে প্যান্টের জিপারে টান দিলেন, তীব্র চাপ পেলেও ব্লাডার থেকে সাড়া এলো না। অর্ধেক জিপার টেনে তিনি বাথরুমের আয়নায় নিজের চেহারায় তাকিয়ে থাকেন। আবার কপালে ছিদ্র করে ঢুকে যাওয়া বুলেটের সন্ধানে আঙ্গুল ঢুকান তিনি। রক্ত শুকিয়ে যাওয়ায় ব্যথা লাগলো এবার। নিজের মুখে তাকালেন আয়নায়, খুন হয়ে যাওয়া মানুষ কেমন হয় আগে দেখেননি তিনি। এ প্রথম দেখছেন এবং নিজের মুখই দেখছেন। আজ সকালে খুন হয়েছেন তিনি। ঠোঁট জোড়া ধুসর হয়ে গেছে, চোখ দুটো ঢুলোঢুলো হয়ে আসছে, ক্লান্তি লাগছে আবার। ঘুম পাচ্ছে।
সম্ভবতঃ বাথরুমের ফ্লোরেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎ দরজায় ধাক্কাধাক্কি এবং ডাকাডাকিতে জেগে উঠলেন তিনি।
চেয়ারম্যান স্যার চলে এসেছেন।
থানা পুলিশ প্রসঙ্গে ভীত লোকটি ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। মাজিদ মাহমুদের বুলেটবিদ্ধ কপাল বুক আর রক্ত মাখা জামা দেখে তোতলাতে শুরু করেছেন তিনি।
চেয়ারম্যানের স্যারের রুমে গিয়ে তিনজন মিলে বসলে এস আই হুমায়ূন কাদির ঘটনা বিস্তারিত বলেন। খানিক ঘুমানোয় নিহত মাজিদ মাহমুদ কিছুটা চাঙ্গা বোধ করছেন। চেয়ারম্যান স্যার তাকে জিজ্ঞেস করেন, “ঐ দুই ছেলের কাউকে চেনেন আপনি? ক্যাম্পাসে দেখেছেন কখনো?”
না-বোধক জবাব দিলে চেয়ারম্যান স্যার আচমকা স্বরূপে ফিরে আসেন। রাগী কন্ঠে উত্তেজিত হয়ে বললেন, “আপনি সব সময় ঝামেলায় জড়িয়ে থাকেন, নিজের মতো করে নিরিবিলি থাকতে পারেন না? কতোবার নিষেধ করেছি, শোনেন নি। এখন হলো?”
এস আই হুমায়ূন কাদির চেষ্টা করেন পরিস্থিতি সামাল দিতে, “স্যার, এখন তো ঘটনা ঘটে গেছে, আপনাদের সহায়তা দরকার।”
“কী সহায়তা চান বলুন?”
“স্যার, আপনারা বাদী হয়ে থানায় একটা মামলা করুন। খুনের মামলা।”
মাজিদ মাহমুদ স্পষ্ট দেখতে পেলেন চেয়ারম্যান স্যার আতঙ্কে গলার স্বর আরো উঁচু করেছেন। চিৎকার করে বললেন, “আমাদের ভিসি, প্রো-ভিসি স্যার দেশে নেই। আপার ম্যানেজমেন্টের পারমিশন ছাড়া আমি কিছু করতে পারবো না। গভর্ণিং বডিও এসব মেনে নেবে না। মামলা টামলা আমরা কেন, ভিক্টিমের ফ্যামিলিই করুক!
এস আই হুমায়ূন কাদির অনেক চেষ্টা করেও চেয়ারম্যান স্যারকে বোঝাতে ব্যর্থ হলে মাজিদ মাহমুদ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান।
পাঁচ
জিনিয়া বাসাতেই ছিল।
ডুপ্লেক্স বাড়িটি জিনিয়ার বাবা লিখে দিয়েছিল মেয়ের নামে দু’বছর আগে। বিয়ের উপহার ছিল। দুষ্ট লোকেরা বলতো বিয়েতে যৌতুক পেয়েছে মাজিদ। বিয়ের দুমাস পরে বাবা-মা’কে ছেড়ে মাজিদ মাহমুদ যখন জিনিয়া’স গার্ডেনে গিয়ে ওঠেন তখন দূর-নিকট আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবেরা তীব্র বিদ্রুপ এবং ধিক্কার ছুড়ে দিয়েছিল তার প্রতি। এদের অধিকাংশই ঈর্ষাজনিত সমস্যায় আক্রান্ত ছিল – এ কথা জিনিয়া সরাসরি না বললেও মাজিদ মাহমুদ টের পেয়েছিলেন আগে।
কাজের লোক দরজা খুলে দিলে এস আই হুমায়ূন কাদির ধীর পায়ে মাজিদ মাহমুদকে অনুসরণ করে তাদের বেডরুমের দরজা পর্যন্ত এসে থেমে যান। পর্দার আড়ালে দেখা যাচ্ছিলো জিনিয়া লাগেজ গুছাচ্ছে। সম্ভবতঃ কোনো দূর যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছে সে।
সাউন্ড সিস্টেমে কিশোর কুমার বাজছে – “একদিন পাখি উড়ে যাবে যে আকাশে, ফিরবে না সে তো আর।” মাজিদের মনে পড়ে আজ সকালে ভার্সিটির সিক্যুরিটি গার্ডের মোবাইলে এ গানের হিন্দি ভার্সন শুনেছে সে।
মাজিদকে দেখে একটু চমকাল জিনিয়া। বললো, “এ কোন নাটক করতে এসেছ তুমি?”
“জিনিয়া, আমি খুন হয়ে গেছি, আমি বিদায় নিতে এসেছি” মাজিদ কাঁপা কাঁপা গলায় বলে।
লাগেজের কোণায় হেয়ার ড্রায়ার ঢুকাতে ঢুকাতে জিনিয়া বলে, “জাহান্নামে যাও, অপদার্থ কোথাকার!”
“জিনিয়া, তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে? এমন অবস্থায় রেখে?”
নিহত স্বামীর এমন কাতর কন্ঠও তাকে স্পর্শ করে না। এক টানা বকে যায় সে, “আর কতো বাধা দেবে, আর কতো? তোমার ছোটো মনের ইতরামি আর কতো সহ্য করবো? কী চেয়েছিলাম আমি? কী দিয়েছ আমাকে? কী পারো তুমি?”
খাটের এক কোণে হাল্কা ঠেস দিয়ে বসে মাজিদ, বলে – “জীবনের শেষ অনুরোধ, সত্যি করে বলো তো – তুমি অফিসের কাজে যাচ্ছ নাকি উড়ো এসএমএস যা লিখেছিল তা-ই সত্যি – রোহানকে বিয়ে করেছো তুমি, হানিমুনে যাচ্ছ ফিজি? আজ দুপুর বারোটায় ফ্লাইট?”
“আমি কিচ্ছু বলবো না, ফর গড সেক – আর জ্বালিও না আমাকে!” বলতে বলতে জিনিয়া দেখে দরজার পর্দার ওপাশে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে।
এস আই হুমায়ূন কাদিরকে দেখে রাগে ক্ষোভে চিৎকার করে ওঠে সে, “হু দ্য হেল ইয়্যূ আর? কোন সাহসে এখানে এসেছেন? কার অনুমতি নিয়েছেন?”
মাজিদ মাহমুদ কিছু একটা বলতে চাচ্ছিলেন, জিনিয়া তাকে থামিয়ে আবার ধমক দেয়, “জানেন আমি কে? জানেন আমার এক ফোনে আপনাকে কাল সকালেই দিনাজপুর ট্রান্সফার করে দেবে?”
এস আই হুমায়ূন কাদির এরকম অসহনীয় ক্ষমতাশীলদের প্রতাপ এবং ধমক দেখে-শুনে অভ্যস্ত। বিনীত হয়ে তিনি ক্ষমা চেয়ে নেন, বলতে চান – একটা মামলা করা খুব প্রয়োজন। কিন্তু জিনিয়া নিরাপদ দূরত্বে থেকে এক অদৃশ্য হাতে ঠেলতে ঠেলতে তাদের বাসা থেকে বের করে দেয়।
অন্য সময় হলে মাজিদ মাহমুদও চিৎকার করতো। কিন্তু সে খুন হয়ে গেছে, একটু পর মারা যাবে। তাই সব রাগ অভিমান ভুলে সে জিনিয়ার পক্ষেই কথা বলে। রাস্তায় নেমে এস আই হুমায়ূন কাদিরের মোটর বাইকে ওঠার আগে বলে, “ভালোবেসে নিজ পছন্দে বিয়ে করেছিলাম, হার্ভাড এমবিএ, ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির জাঁদরেল অফিসার।”
এস আই হুমায়ূন কাদির এ গল্পে আগ্রহ দেখায় না, বলে – “আপনার বাবা-মা কেউ নেই? কিংবা ভাই-বোন?”
ছয়
পশ্চিম মনিপুরের রাস্তাগুলোয় সারা বছর খোঁড়াখুড়ি চলে।
অপ্রশস্ত রাস্তায় রিকশার সারি, মাঝে মাঝে টয়োটা এলিয়ন করোলাও চলছে। পথচারীরা দেয়ালের সঙ্গে সেঁটে যাচ্ছে বারবার। এস আই হুমায়ূন কাদিরের মোটরবাইক দ্রুত গতিতে চিপাচাপা পেরিয়ে মাজিদ মাহমুদের পৈত্রিক বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়।
টিনশেড বাড়ি, সামনে খালি জায়গা। আম, পেয়ারা, কাঁঠাল আর কৃষ্ণচূড়ার ছায়া ঢাকা বাড়ী।
ষাটোর্ধ্ব এক রমণী, সাদা শাড়ি পরা – ঘোমটা মাথা, পিঁড়িতে বসে মাথা ঝুঁকে আলু কাটছিলেন।
আট/নয় মাস আগে আব্বা মারা যাওয়ার পরে এবং চল্লিশার সময় মাজিদ এখানে শেষবারের মতো এসেছিল। এ কয়েক মাসে আম্মা যেন শুকিয়ে অনেক ছোট হয়ে গেছেন। আশেপাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে আম্মা মাথা তুলে তাকায়।
গুলিবিদ্ধ মাজিদের কপাল বুক দেখে তিনি হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। এক ঝটকায় আলু-বটি ছুঁড়ে ফেলে মাজিদকে জড়িয়ে ধরেন।
“আব্বা, আমার আব্বা, কেমনে হইলো আব্বা, কে করলো আব্বা, কী হইছে আব্বা” বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি। শারীরিক দূর্বলতায় ভেঙ্গে পড়েন মাজিদ মাহমুদও।
“আম্মা তুমি কাইন্দো না, আম্মা, আমার কষ্ট হচ্ছে না আম্মা। তুমি আমারে মাফ করে দিয়ো আম্মা।” খুন হওয়ার পরে এ প্রথমবারের মতো মাজিদ কান্নায় বিলাপে মাতে।
মাজিদের শুকিয়ে যাওয়া রক্ত তার আম্মার শাড়িতে মেখে যাচ্ছে। আম্মাও শাড়ির আঁচল দিয়ে ছেলের মুখের রক্ত, বুকের রক্ত মুছে দিচ্ছেন। মাতমের সুরে সুরে বলছেন, “আমি জানতামরে আব্বা, আমি জানতাম এমন হবে। তোর বাপও মরার আগে বলে গেছে হাজার বার, তুই বাঁচতে পারবি না আব্বা, তোরে মেরে ফেলবে ওরা।”
ছেলের বুলেটবিদ্ধ কপালে বারবার চুমু খান আম্মা।
ছেলেও আম্মাকে চুমু দেয়, আবার বলে – “আম্মা তুমি আমারে মাফ করে দিও, আম্মা মনে কষ্ট রাইখো না।”
“না-রে আব্বা, কোনো কষ্ট নাই আব্বা। তোর কষ্ট দেখে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে, কারা তোর এই হাল করলো বল, আমারে বল, আমি এই বটি দিয়া ওদের কোপামু, বল আব্বা বল।”
এস আই হুমায়ূন কাদির সুইচ বোর্ড খুঁজে সিলিং ফ্যান চালু করেছেন। ঘটঘট শব্দ করে ঘরে বাতাস ছড়াচ্ছে ফ্যান। মাজিদ ফ্যানের নিচে ফ্লোরে হাঁটু ভাজ করে বসে বলে, “আমি চিনি না আম্মা, আমি কাউরে চিনি না। আমার খুব পিপাসা লাগছে, এক গ্লাস পানি দাও আম্মা।”
আম্মা অস্থির হয়ে ওঠেন। কলসিতে রাখা পানি গ্লাসে ঢেলে কাঁপা কাঁপা হাতে ছেলের মুখে তুলে দেন, অর্ধেকের বেশি পানি গড়িয়ে পড়ে গেল। তবুও তার অস্থিরতা কমে না, “আব্বা কী খাবি বল? শিং মাছ আর আলুর ঝোল দিয়ে ভাত খাবি? লেবু দেবো সঙ্গে?”
এস আই হুমায়ূন কাদির বিলাপরত আম্মার পাশে গিয়ে বসে, “খালাম্মা, আপনার ছেলে তো মারা গেছে। এখন একটা মামলা করা দরকার। আপনি থানায় চলেন, বাদী হয়ে একটা মামলা করেন।”
শুনে তার গালে ঠাস করে এক চড় মেরে আম্মা বলেন, “আমার আব্বাজান মইরা গেলে মামলায় কী হইবো রে পুলিশ? মামলা কি আমার আব্বাজানেরে আবার জিন্দা কইরা দিবো?” বলে আবার তিনি ছেলে মাজিদের বুকের ওপর কান্নায় ভেঙে পড়েন।
মাজিদ মাহমুদ টের পান, তার জীবনী শক্তি ফুরিয়ে আসছে। হাল্কা পানি পানের পর তার ঘুম পাচ্ছে আবার, চোয়াল শক্ত হয়ে আসছে, নিঃশ্বাস ভারী হচ্ছে।
তারপর কী হয় মাজিদ মাহমুদ মনে করতে পারেন না।
অফিস রুমে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর যেভাবে পড়েছিল সেখানেই নিজেকে খুঁজে পান তিনি। সামনের চেয়ারে বসা এস আই হুমায়ূন কাদির, বলে – “স্যার, কেউ তো মামলা করতে রাজী হলো না।”
মাজিদ মাহমুদ বলে, “এস আই সাহেব, আপনিই মামলা করেন, আপনি পারবেন আমার জন্য লড়তে।”
এস আই হুমায়ূন কাদির দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, “স্যার, একটু আগে ফোন পেয়েছি, আমার ট্রান্সফার অর্ডার হয়ে গেছে, আগামীকালই দিনাজপুর জয়েন করতে হবে।”
“আমার কী হবে?” মাজিদ মাহমুদ ক্ষীণ করুণ কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন।
“আপনি ঘুমান, চোখ দুটো বন্ধ করার চেষ্টা করুন। ভালো লাগবে। সাংবাদিকরা এসে গেছে বাইরে। একটু পরেই টেলিভিশন চ্যানেলগুলোয় ব্রেকিং নিউজ যাবে – রাজধানীর বনানিয়র্ক ইউনিভার্সিটির তরুণ শিক্ষক মাজিদ মাহমুদ তার অফিস কক্ষে দুর্বৃত্তের গুলিতে খুন হয়েছেন।”
শেষ বারের মতো চোখ বন্ধ করার আগে, মাজিদ মাহমুদ দেখেন, তার রুমে কেউ নেই। দুই তরুণ গুলি করে ধাক্কা মেরে চেয়ার যেভাবে ফেলে গেছে সেভাবেই আছে।
মায়াহীন পৃথিবীর সমস্ত বেদনার ভার চোখে নেমে এলে মাজিদ মাহমুদ দেখেন - শুকনো ফ্লোরে জলোচ্ছ্বাসের মতো তার রক্তের ঢেউ আরো তীব্র হয়েছে, আছড়ে পড়েছে এখানে ওখানে। প্রবল স্রোত তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এক অজানা, অচেনা, গভীর সমুদ্রে।
মন্তব্য
ভালো লাগলো গল্পটা, বলার ভঙ্গি এত সহজ লাগছিল, মনে হচ্ছিল উপন্যাস হলেও পড়ে শেষ করে ফেলতে পারব।
শুভেচ্ছা
অনেকদিন পর শিমুলের গল্প পেলাম। আর একটানে পড়ে মুগ্ধ হলাম।
নিয়মিত বিরতিতে আরো গল্প আসুক।
দুর্দান্ত!
..................................................................
#Banshibir.
গল্পটা এতো ভালো লাগলো !!
... শহুরে দৈনন্দিন পটেই আপনার লেখাগুলো খুব মানানসই হয় শিমুল ভাই।
চমৎকার গল্প!
একটু কূটকাটি এবার
'তখন' কে অতিরিক্ত মনে হচ্ছে না?
তিনি দু'বার না হলেই ভালু।
শুন্য-শূন্য টাইপোটা শুধরে নেবেন ভাইয়া। আপনাকে নিয়মিত লিখতে দেখে ভালো লাগছে
আরো লিখুন।
অনেক ধন্যবাদ। এমন একনিষ্ঠ মনোযোগী পাঠক পাওয়া লেখকের সৌভাগ্য। ঠিক করে দিয়েছি
নীড়পাতায় আজ দুর্ধর্ষ সব লেখা, লেখক।
খুব ভাল লাগলো।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
গল্প বলার ধরনটা ভালো লাগলো শিমুল ভাই!
অলমিতি বিস্তারেণ
হা হা, মাজিদ মাহমুদ বেটা একটা বেকুব! এত কিছু করতে পারলো আর কেসটা করতে পারলোনা।
দারুণ হয়েছে গল্পের থিমটা।
আজ সবার আগে এ গল্পটাই পড়া হয়েছিল, তারপর থেকে দারুণ সব পোস্ট। কে বলে শেষ ভাল যার...
আমিতো দেখলাম শুরু ভাল যার, সব ভাল তার আজকের গল্পটা পড়ে আর ঢাকামেট্রোর দাবী জানালামনা!
অভিনব এক গল্প পড়লাম অনেক দিন পরে। আপনার গল্প মুগ্ধ করেছে আমাকে। । আশা করি অনিয়মিত খাতা থেকে আপনার নাম টা এবার কাটা যাবে :)। শুভেচ্ছা ও শুভকামনা।
মাসুদ সজীব
দারুণ!
-----------------------------------------------------------------
কাচের জগে, বালতি-মগে, চায়ের কাপে ছাই,
অন্ধকারে ভূতের কোরাস, “মুন্ডু কেটে খাই” ।
ঠিক, মাজিদ মাহমুদ-এর এ রকমই হওয়ার কথা।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
খুব ভাল লাগলো
অসাধারণ আংগিক! অসাধারণ নির্মান! আর এখানেই গল্পটির মূল আবেদন!
হিমু ভাইয়ের সাথে সুর মিলিয়ে বলতে চাই, "নিয়মিত বিরতিতে আরো গল্প আসুক।"
.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল
গল্পটা খুব ভালো হয়েছে। বর্তমানের একটা ছাপ আছে।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
ভালো লেগেছে। উহু, একটু ভুল হল। খুবই ভালো লেগেছে।
গোঁসাইবাবু
অসাধারণ একটা গল্প হইছে শিমুল ভাই। আর বনানিয়র্ক ইউনিভার্সিটি নামটা চরম হইছে। এই রকম একটা ইউনিতে একসময় কিছুদিন কামলাও দিছি।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
দারুন!
****************************************
সবার এত এত প্রশংসা পেয়ে আমি অনেক আনন্দিত এবং গল্প লেখার ব্যাপারে অনুপ্রাণিত।
ব্যস্ত জীবনে নানান ঝুট ঝামেলার মাঝে এ দীর্ঘ গল্প পড়ে কমেন্ট করেছেন, তাই সবার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা, ধন্যবাদ।
দুর্ধর্ষ!! অনেকদিন পর আপনার সেরকম একটা গল্প পড়লাম। এবং একবারো মনে হয়নি গল্পটা অনেক দীর্ঘ।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
দুর্ধর্ষ!
নিয়মিত চাই গল্প
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
আসাধারন গল্প
তাসিন হোসেন
একটানে পড়ে শেষ করে অবাক হয়ে গেলাম এত লম্বা একটা গল্প পড়ার সময় টেরই পেলাম না!! এটাই আপনার লেখার সবচেয়ে আকর্ষক দিক।
____________________________
ভালো লাগল, আপনার অন্য গল্প গুলোও পড়ে ফেলতে হবে জলদি
facebook
আপনার লেখার কথা শুনেছিলাম। আজ পড়লাম প্রথম। অনেক বেশি ভালো লাগল।
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
আরো লিখুন বোকা তুষার
কতদিন হলো শিমুলের গল্প পড়া হয় না...
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
নতুন মন্তব্য করুন