মানুষ কি সত্যই 'ব্ল্যাঙ্ক স্লেট' হয়ে পৃথিবীতে জন্মায়?

অভিজিৎ এর ছবি
লিখেছেন অভিজিৎ (তারিখ: বুধ, ১৭/০৬/২০০৯ - ১০:৩৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমি আমার আগের লেখায় বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান নামের নতুন শাখাটি সম্বন্ধে কিছুটা আলোকপাত করেছিলাম। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান নামের সাম্প্রতিক এই শাখাটি আমাদের কি বলতে চাচ্ছে? সাদা মাঠাভাবে বলতে চাচ্ছে এই যে, আমাদের মানসপটের বিনির্মাণে দীর্ঘদিনের বিবর্তনীয় প্রক্রিয়ার একটি ছাপ থাকবে, তা আমরা যে দেশের, যে সমাজের বা যে সংস্কৃতিরই অন্তর্ভূক্ত হই না কেন। ছাপ যে থাকে, তার প্রমাণ আমরা দৈনন্দিন জীবনের অনেক কিছুতেই কিন্তু পাই। মিস্টিযুক্ত কিংবা চর্বিযুক্ত খাবার আমাদের শরীরের জন্য খারাপ, কিন্তু এটা জানার পরও আমরা এ ধরনের খাবারের প্রতি লালায়িত হই। সমাজ- সংস্কৃতি নির্বিষেশেই এটা ঘটতে দেখা যায়। কেন? বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, একটা সময় মানুষ জঙ্গলে থাকত, খুব কষ্ট করে খাবার দাবার সংগ্রহ করতে হত। শর্করা এবং স্নেহজাতীয় খাবার এখনকার মত এত সহজলভ্য ছিলো না। শরীরকে কর্মক্ষম রাখার প্রয়োজনেই এ ধরণের খাবারের প্রতি আসক্তি তৈরি হয়ে গিয়েছিলো। তখন তো আর কারো জানার উপায় ছিলো না যে, হাজার খানেক বছর পর মানুষ নামের অদ্ভুত এই ‘আইলস্যা’ প্রজাতিটি ম্যাকডোনাল্ডসের বিগ-ম্যাক আর হার্শিজ হাতে নিয়ে কম্পিউটারের সামনে বসে বসে ব্লগ আর চ্যাট করে অফুরন্ত অলস সময় পার করবে আর গায়ে গতরে হোদল কুৎকুতে হয়ে উঠবে। কাজেই খাবারের যে উপাদানগুলো একসময় ছিলো আদিম মানুষের জন্য শক্তি আহরণের নিয়ামক কিংবা ঠান্ডা থেকে বাঁচার রক্ষাকবচ, আজকের যান্ত্রিক সভ্যতার যুগে সেগুলোর মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার হয়ে উঠেছে তাদের জন্য মরণ-বিষ। কিন্তু এগুলো জেনেও আমরা আমাদের লোভকে সম্বরণ করতে প্রায়শঃই পারি না; পোলাও বিরিয়ানি কিংবা চকলেট বা আইসক্রিম দেখলেই হামলে পড়ি। আমাদের শরীরে আর মনে বিবর্তনের ছাপ থেকে যাবার কারণেই এটি ঘটে। এধরণের আরো উদাহরণ হাজির করা যায়। আমরা (কিংবা আমাদের পরিচিত অনেকেই) মাকড়শা, তেলাপোকা কিংবা টিকটিকি দেখলে আঁতকে উঠি। কিন্তু বাস ট্রাক দেখে সেরকম ভয় পাই না। অথচ কে না জানে, প্রতি বছর তেলাপোকার আক্রমণে যত মানুষ না মারা যায়, তার চেয়ে ঢের বেশি মানুষ মরে ট্রাকের তলায় পড়ে। অথচ ট্রাককে ভয় না পেয়ে আমরা ভয় পাই নিরীহ তেলাপোকাকে। এটাও কিন্তু বিবর্তনের কারণেই ঘটে। বনে –জঙ্গলে দীর্ঘদিন কাটানোর কারণে বিষধর কীটপতংগকে ভয় পাবার স্মৃতি আমরা নিজেদের অজান্তেই আমাদের জিনে বহন করি। সে হিসেবে, বাস ট্রাকের ব্যাপারগুলো আমাদের জন্য অপেক্ষাকৃত নতুন, তাই এগুলোকে ভয় পাবার কোন স্মৃতি আমরা এখনো আমাদের জিনে (এখনো) তৈরি করতে পারিনি। সেজন্যই বোধ হয় বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা লিডা কসমিডস এবং জন টুবি আধুনিক মানুষকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলেন – ‘Our modern skull house a stone age of mind’।

বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান অনেক কিছু খুব পরিস্কার এবং বোধগম্যভাবে ব্যাখ্যা করলেও, এর অনেক উপসংহার এবং অনুসিদ্ধান্ত এতই বিপ্লবাত্মক (Radical) যে এটি অবগাহন করা সবার জন্য খুব সহজ হয়নি, এখনো হচ্ছে না। এর অনেক কারণ আছে। একটা বড় কারণ হতে পারে - আমাদের মধ্যকার জমে থাকা দীর্ঘদিনের সংস্কার। অধিকাংশ মানুষ মনে করে, শিশুরা জন্ম নেয় একটা স্বচ্ছ্ব স্লেটের মত, মানুষ যত বড় হতে থাকে – তার চারপাশের পরিবেশ ও পারিপার্শিকতার মাধ্যমে ঐ স্বচ্ছ্ব স্লেটে মানুষের স্বভাব ক্রমশঃ লিখিত হতে থাকে। অর্থাৎ, ভাল-মন্দ সবকিছুর জন্য দায়ী হচ্ছে একমাত্র পরিবেশ। খারাপ পরিবেশে থাকলে স্লেটে লেখা হবে হিংস্রতা কিংবা পাশবিকতার বীজ, আর ভাল পরিবেশ পেলে স্লেটও হয়ে উঠবে আলোকিত। ব্রিটিশ দার্শনিক লক (১৬৩২ -১৭০৪ খ্রীষ্টাব্দ) এই ‘ব্ল্যাঙ্ক স্লেট’ মতবাদের প্রবক্তা ছিলেন। এখনো অনেকেই (বিশেষতঃ যাদের আধুনিক জেনেটিক্স কিংবা বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান পড়া হয়ে উঠেনি) এই মতবাদে বিশ্বাস করেন। বিশেষ করে রাজনীতিবিদদের মধ্যে এই ধারণাটি বোধগম্য কারণেই খুবই জনপ্রিয়। এই কিছুদিন আগেও ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর আর্নল্ড শোয়ার্জনেগার তার এক বক্তৃতায় বললেন –

‘একটি শিশু যখন ৬ বছর বয়সে প্রথম স্কুলে যেতে শুরু করে তার মন থাকে যেন শুন্য এক বাস্কেট। তারপর ধীরে ধীরে তাদের বাস্কেট ভর্তি হতে শুরু করে। ১৮ বছর বয়স হতে হতে তাদের শূন্য বাস্কেট প্রায় পুরোটাই ভর্তি হয়ে উঠে। এখন কথা হচ্ছে কাকে দিয়ে শিশুটির এই বাস্কেট পূর্ণ হবে? এটা কি ভাল একজন শিক্ষক, অভিভাবক, বন্ধু নাকি অসৎ মানুষজনদের দিয়ে?’

এই ব্ল্যাঙ্ক স্লেট তত্ত্ব সমাজবিজ্ঞানে খুবই জনপ্রিয় এবং বোধ্য কারনেই। সমাজবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতা এমিল ডার্খেইম ১৮৯৫ সালেই বলেছিলেন যে, ‘সমাজবিজ্ঞানের প্রধান অনুকল্পই হল প্রতিটি মানুষকে ব্ল্যাঙ্ক স্লেট হিসেবে চিন্তা করতে হবে। মানুষ হচ্ছে ব্ল্যাঙ্ক স্লেট – অন হুইচ কালচার রাইটস’। এর পর থেকে ‘ব্ল্যাঙ্ক স্লেট’ দর্শনটি সমাজবিজ্ঞানের জগতে স্বততঃসিদ্ধ হিসেবেই পরিগন্য হয় – ‘সব মানুষ আসলে জন্মগতভাবে সমান, খারাপ পরিবেশের কারণেই মানুষ মূলতঃ খারাপ হয়ে উঠে’।

কিন্তু এই ‘ব্ল্যাঙ্ক স্লেট’-এর ধারণা কি আসলে মানবমনের প্রকৃত স্বরূপকে তুলে ধরে? এম.আই.টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের (বর্তমানে হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের) অধ্যাপক অধ্যাপক স্টিভেন পিঙ্কার ২০০৩ সালে একটি বই লেখেন ‘The Blank Slate: The Modern Denial of Human Nature’ শিরোনামে। তিনি বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোন থেকে সমাজে গেঁথে যাওয়া এবং জনপ্রিয় এই ‘ব্ল্যাঙ্ক স্লেট’তত্ত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে একে একধরণের ‘ডগমা’ হিসবে আখ্যায়িত করেন। যারা ব্ল্যাঙ্ক স্লেট বইটি পড়েননি, তারা ইউটিউব থেকে অধ্যাপক পিঙ্কারের নীচের লেকচারটি শুনে দেখতে পারেন, বইটির সারমর্ম পেয়ে যাবেন –

পিঙ্কার দাবী করেন, আমাদের কানে যতই অস্বস্তিকর শোনাক না কেন, কোন শিশুই আসলে ‘ব্ল্যাঙ্ক স্লেট’ হয়ে জন্ম নেয় না। বরং একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে যে,প্রতিটি শিশু জন্ম নেয় কিছু না কিছু জন্মগত বৈশিষ্ট্যকে পুঁজি করে। এই বৈশিষ্ট্যগুলোর ছাপ পরিণত অবস্থাতেও রাজত্ব করে অনেক ক্ষেত্রেই। শুধু মানুষ কেন - প্রানী জগতের দিকে দৃষ্টি দিলেও ব্যাপারটা খুব ভালমতই বোঝা যাবে। গুবরে পোকাকে ধরবার জন্য ইঁদুর যত তাড়াতাড়ি ছুটতে পারে, কবুতর তত তাড়াতাড়ি পারে না। বিড়াল যত ভালভাবে রাতে দেখতে পায়, মানুষ তা পায় না। এই বিষয়গুলো কোনভাবেই ‘ব্ল্যাঙ্ক স্লেট’ তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। ব্যাখ্যা করা যায় না একই প্রজাতির মধ্যে বিদ্যমান বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের পার্থক্যগুলোও। একই প্রজাতির অংশ হওয়া সত্ত্বেও কেউবা শ্লথ, কেউবা ক্ষিপ্র, কেউবা বাঁচাল, কেউবা শান্ত, কেউবা অস্থির, কেউ বা রয়ে যায় খুব চুপচাপ। জিনগত পার্থক্যকে গোনায় না ধরলে করলে প্রকৃতির এত ধরণের প্রকরণকে কোন ভাবেই সম্পূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে না।

১৯৮০র দশকে টম ইনসেল নামে এক বিজ্ঞানী প্রেইরি ভোলস এবং মোন্টেন ভোলস নামে দু’ প্রজাতির ইঁদুর নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখেন প্রেইরি ভোলস নামের ইঁদুরগুলো নিজের মধ্যে একগামী সম্পর্ক গড়ে তুলে, যৌনসঙ্গির প্রতি আজীবন বিশ্বস্ত থাকে, বাচ্চা হবার পর তাদের পরিচর্যা করে বড় করে তুলতে অনেকটা সময় এবং শক্তি ব্যয় করে। আর মোন্টেন ভোলসগুলো স্বভাবে ঠিক উলটো। তারা স্বভাবত বহুগামী, এমনকি বাচ্চা জন্মানোর পর সামান্য সময়ের জন্য বাচ্চাদের পরিচর্যা করার পর আর এদের দিকে নজর দেয় না। টম ইনসেল প্রেইরি ভোলস এবং মোন্টেন ভোলস এর ব্রেন বিশ্লেষণ করে তেমন কোন পার্থক্যই পেলেন না, কেবল প্রেইরি ভোলস নামের ইঁদুরগুলোর ব্রেনে অক্সিটোসিন নামে এক ধরণের হরমোনের আধিক্য লক্ষ্য করলেন। তিনি আরো লক্ষ্য করলেন মোন্টেন ভোলস ইঁদুরগুলোর ব্রেনে এই হরমোন একেবারেই নগন্য। কেবল, বাচ্চা জন্মানোর পর সামান্য স্ত্রী মোন্টেন ভোলসের মস্তিস্কে এই হরমোনের আধিক্য সামান্য সময়ের জন্য বেড়ে যায়। টম ইনসেল দেখলেন সেই সামান্য সময়টাতেই স্ত্রী ইঁদুর আর তার বাচ্চার মধ্যে প্রগাঢ় বন্ধনের উপস্থিতি থাকে। টম ইনসেল কৃত্রিমভাবে ইঁদুরদের ব্রেনে অক্সিটোসিন প্রবেশ করিয়ে তাদের স্বভাব এবং প্রকৃতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ্য করলেন। দেখা গেলো, এই হরমোনের প্রভাবে মোন্টেন ভোলস ইঁদুরগুলো তাদের পছন্দের বহুগামী স্বভাব পরিবর্তন করে তার যৌনসঙ্গির প্রতি বিশ্বস্ত থাকা শুরু করে দিয়েছে। বিজ্ঞানীরা এ ধরণের আরো গবেষণা করে দেখেছেন, জিন ম্যানিপুলেশন করে নিম্ন স্তরের প্রাণীদের মধ্যে আগ্রাসন, নমনীয়তা, হিংস্রতা, ক্ষিপ্রতা বা শ্লথতা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যগুলির তারতম্য তারা ঘটাতে পারেন। অর্থাৎ, বংশানুর বৈশিষ্ট্যের তারতম্যের কারণে প্রাণীদের স্বভাবেও পরিবর্তন আসে। এখন কথা হচ্ছে, মানুষও কিন্তু প্রকৃতিজগত এবং প্রাণীজগতের বাইরের কিছু নয়। অথচ, বংশাণুজনিত পার্থক্যের কারণে মানুষে মানুষে স্বভাবগত পার্থক্য হতে পারে - মানুষের ক্ষেত্রে এই রূঢ় সত্যটি মানতে অনেকেই আপত্তি করবেন।

বংশানুর বৈশিষ্ট্যের তারতম্য যদি মানুষের স্বভাবের পরিবর্তনের বলিষ্ট ব্যখ্যা হয়, তবে কাছাকাছি বা প্রায় একই বংশানুযুক্ত লোকজনের ক্ষেত্রে একই স্বভাবজনিত বৈশিষ্ট পাওয়া উচিত। স্টিভেন পিঙ্কাররা বলেন তাই পাওয়া যাচ্ছে। পিঙ্কার তার ‘ব্ল্যাঙ্ক স্লেট’ বইয়ে অভিন্ন যমজদের (আইডেন্টিকাল টুইন) নিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণার বেশ কিছু মজার উদাহরণ হাজির করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, অভিন্ন যমজদের একে অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ভিন্ন পরিবেশে বড় করা হলেও তাদের মধ্যে এক আশ্চর্য্জনক সাদৃশ্য থেকেই যায়, শুধু চেহারায় নয় - আচার, আচরণ, অভিরুচি, খাওয়া দাওয়া এমন কি ধর্ম কর্মের প্রতি আসক্তিতেও। ইউনিভার্সিটি অব মিনিসোটার গবেষকেরা একসময় পঞ্চাশ জোড়া অভিন্ন যমজদের নিয়ে গবেষণা করেন, যে যমজেরা জন্মের পর পরই কোন না কোন কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে ভিন্ন ধরণের পরিবেশে বড় হয়েছিলো। তাদের নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে গবেষকেরা লক্ষ্য করলেন, তারা আলাদা পরিবেশে বড় হলেও তার বিচ্ছিন্ন হওয়া সহোদরের সাথে আচার-আচরণে অদ্ভুত মিল থাকে। সবচেয়ে মজার হচ্ছে অভিন্ন যমজ সহোদর অস্কার এবং জ্যাকের উদাহরণটি। জন্মের পর পরই বিচ্ছিন্ন হয়ে অস্কার বড় হয়েছিলো চেকোশ্লাভাকিয়ার এক নাৎসী পরিবারে, আর জ্যাক বড় হয়েছিলো ত্রিনিদাদের ইহুদী পরিবারে। তারপরও তারা যখন চল্লিশ বছর পরে প্রথমবারের মত মিনিসোটায় একে অপরের সাথে দেখা করতে আসলেন, তখন দেখা গেলো তারা দুজনেই গাঢ় নীল রঙের শার্ট পড়ে উপস্থিত হয়েছেন, তাদের দু'জনের হাতের কব্জিতেই রাবারব্যান্ড লাগানো। দু'জনেই কফিতে বাটার টোস্ট ডুবিয়ে খেতে পছন্দ করতেন; তাদের দু'জনেই বাথরুম ব্যবহার করতে গিয়ে টয়লেট ব্যবহারের আগেই একবার করে ফ্ল্যাশ করে নিতেন, এমনকি দু'জনেরই একটি সহজাত মুদ্রাদোষ ছিলো – দু’জনেই এলিভেটরে উঠে হাঁচি দেয়ার ভঙ্গি করতেন, যাতে লিফটের অন্য সহযাত্রীরা আঁতকে উঠে দু'পাশ থেকে সরে যায়। থমাস বুচার্ড নামের আরেক গবেষকের গবেষনায় জিম স্প্রিঙ্গার এবং জিম লুইস নামের আরেকটি অভিন্ন যমজের চাঞ্চল্যকর মিল পাওয়া গিয়েছিলো যা মিডিয়ায় রীতিমত হৈ চৈ ফেলে দেয়। জন্মের পর ভিন্ন পরিবেশে বড় হবার পরও জিম-যমজদ্বয় যখন একত্রিত হল, দেখা গেল – তাদের চেহারা এবং গলার স্বরে কোন পার্থক্যই করা যাচ্ছে না। একই রকম বাচনভঙ্গি, একই রকম চাহনি, একই রকম অবসাদগ্রস্থ চোখ। তাদের মেডিকেল-হিস্ট্রি থেকে জানা গেল, তারা দুজনেই উচ্চ রক্তচাপ, হেমোরইডস এবং মাইগ্রেনের সমস্যায় ভুগছেন। তারা দু’জনেই সালীম সিগারেটের ভক্ত, দুজনেরই টেনশনে নখ কামড়ানোর অভ্যাস আছে এবং দুজনের জীবনের একই সময় ওজন বাড়া শুরু হয়েছিল। শুধু তাই নয় – তাদের দুজনের কুকুরের নাম ‘টয়’। তাদের দুজনের স্ত্রীদের নাম ‘বেটি’, এবং তাদের দুজনেরই আগে একবার বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটেছিল। এবং এদের প্রাক্তন স্ত্রীদের নামও কাকতালীয় ভাবে এক - ‘লিন্ডা’। এখানেই শেষ নয় - দুজনের প্রথম সন্তানের নামও ছিলো একই – ‘জেমস অ্যালেন’; যদিও নামের বানান ছিলো একটু ভিন্ন। আরেকটি ক্ষেত্রে দেখা গেল দুই যমজ মহিলা হাতে একই সংখ্যার আংটি পড়ে এসেছিলেন। তাদের একজন প্রথম ছেলের নাম রেখেছিলেন রিচার্ড এন্ড্রু, আর অপরজন রেখেছিলেন এন্ড্রু রিচার্ড। সংশয়বাদী দৃষ্টিকোন থেকে দেখলে এসমস্ত মিলগুলোকে নিতান্তই ‘কাকতালীয়’ কিংবা ‘অতিরঞ্জন’ ভাবার যথেষ্ট অবকাশ থাকলেও মূল উপসংহার কিন্তু ফেলে দেয়ার মত নয় – আমরা আমাদের স্বভাব-চরিত্রের অনেক কিছুই হয়ত আসলে বংশানুর মাধ্যমে বহন করি এবং দেখা গেছে অভিন্ন যমজদের ক্ষেত্রে এই উপরের ‘কাকতালীয়’ মিলগুলো অসদ যমজদের থেকে সবসময়ই বেশি থাকে। শুধু মিনিসোটার যমজ গবেষণা নয়; ভার্জিনিয়া, অস্ট্রেলিয়া, হল্যান্ড, সুইডেন এবং ব্রিটেনের গবেষকেরাও তাদের গবেষণা থেকে একই ধরণের ফল পেয়েছেন। এ ধরনের বেশকিছু গবেষণার ফলাফল লিপিবদ্ধ আছে উইলিয়াম ক্লার্ক এবং মাইকেল গ্রুন্সটেইনের ‘Are We Hardwired?: The Role of Genes in Human Behavior’ নামের বইটিতে। লেখকদ্বয় বলেছেন –

‘For nearly all measures personality, heritability is high in western society: identical twins raised apart are much more similar than the fraternal twins raised apart’

ছবি - একটি মজার কার্টুন - জন্মের পর পরই পৃথক হয়ে যাওয়া দুই যমজের হঠাৎ দেখা! (কার্টুনিস্ট - চার্লস এডামস); কার্টুনটি স্টিভেন পিঙ্কারের ‘ব্ল্যাঙ্ক স্লেট’ বইটি থেকে নেওয়া।

সাইকোপ্যাথ এবং সিরিয়াল কিলারদের নিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোও আমাদের জন্য অস্বস্তি বাড়িয়ে দিয়েছে পুরোমাত্রায়। আমি যখন এ লেখাটি লিখতে শুরু করেছি, তখন আমেরিকান মিডিয়া ‘ক্রেগলিস্ট কিলার’ খ্যাত ফিলিপ মার্ডফকে নিয়ে রীতিমত তোলপার। ফিলিপ মার্ডফ বস্টন মেডিকেলেরর ছাত্র। পড়াশোনায় ভাল। চুপচাপ শান্ত বলেই পরিচিতি ছিলো তার। একজন গার্লফ্রেন্ডও ছিলো তার। সামনেই বিয়ে করার কথা ছিলো তাদের। ফিলিপ আর তার ভাবীবধুর ছবি সমন্বিত ওয়েবসাইটও সে বানিয়ে রেখেছিলো। কে জানত যে, এই গোবেচোরা ধরণের নিরীহ রোমান্টিক মানুষটিই রাতের বেলা কম্পিউটারে বসে বসে ক্রেগলিস্ট থেকে মেয়েদের খুঁজে নিয়ে হত্যা করত! পুলিশের হাতে যখন একদিন ফিলিপ ধরা পড়লো, সহপাঠিরা তো অবাক। এমন গোবেচরা ছেলেটির মধ্যে এমন দানব লুকিয়ে ছিল? গার্লফ্রেন্ডটি তখনো ডিনায়ালে – ‘ফিলিপের তো মাছিটা মারতেও হাত কাঁপত, সে কি করে এত মানুষকে হত্যা করবে? পুলিশ নিশ্চয় ভুল লোককে ধরেছে’। আমেরিকায় প্রতি ২৫ জনে একজন মনোবিকারগ্রন্থ সাইকোপ্যাথ আছে বলে মনে করা হয়। মনোবিজ্ঞানী মার্থা স্কাউট তার ‘The Sociopath Next Door’ বইয়ে অন্ততঃ তিনটি জার্নাল থেকে রেফারেন্স হাজির করে দেখিয়েছেন যে, আপনার প্রতিবশিদের মধ্যেই হয়ত লুকিয়ে আছে একজন মনোবিকারগ্রন্থ সাইকোপ্যাথ। তারা আমার আপনার মত একই রকম ‘ভাল পরিবেশে’ বাস করছে, দৈনন্দিন জীবন যাপন করছে কিন্তু আপনার আমার মত সচেতনতা জিনিসটাকে মাথায় ধারণ করে না। এই ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করেছেন রবার্ট হেয়ার তার ‘Without Conscience: The Disturbing World of the Psychopaths Among Us’ বইয়ে। কোন নিয়ম, নীতি, ভালবাসা, দায়িত্ববোধ তাদের মধ্যে তৈরি হয় না। আসলে এসমস্ত ‘মানবিক’ বৈশিষ্ট্যগুলো দিয়ে একজন সাইকোপ্যাথের কাজকে ব্যাখ্যার চেষ্টাই হবে বোকামি। অত্যন্ত স্বার্থপর ভাবে মনোবিকারগ্রন্থ সাইকোপ্যাথ তার মাথায় যেটা থাকে, সেটা করেই ছাড়ে। যখন কোন সাইকোপ্যাথের মাথায় ঢোকে কাউকে খুন করবে, সেটা সম্পন্ন করার আগ পর্যন্ত তার স্বস্তি হয় না। পিঙ্কার তার বইয়ে জ্যাক এবট্‌ নামক এক সাইকোপ্যাথের উদ্ধৃতি দিয়েছেন খুন করার আগের মানসিক অবস্থা তুলে ধরে–

‘তুমি টের পাবে যে তার জীবন-প্রদীপ তোমার হাতে ধরা ছুরির মধ্যে দিয়ে তির তির করে কাঁপছে। তুমি বুঝতে পারবে হত্যার জিঘাংসা তোমাকে ক্রমশঃ গ্রাস করে নিচ্ছে। তোমার শিকারকে নিয়ে একটু নিরালয়ে চলে যাবে যেখানে গিয়ে তুমি তাকে একেবারে শেষ করে দিতে পারো। ... মাখনের মধ্যে ছুরি ঢুকানোর মতই সহজ একটা কাজ – কোন ধরনের বাধাই তুমি পাবে না। তাদের চোখে শেষ মুহূর্তে এক ধরণের অন্তিম কাতরতা দেখবে, যা তোমাকে আরো উদ্দীপ্ত করে তুলবে’।

আমার আগের লেখা যে শুরু করেছিলাম মন্টু মিয়াকে দিয়ে ইলাস্টিক দিয়ে জানালার কাঁচ ভাংগতো- সেই মন্টু মিয়া হয়ত মনোবিকারগ্রন্থতার একটু ছোট স্কেলের উদাহরণ। বড় বড় উদাহরণগুলোর কথা আমরা সবাই কম বেশি জানি। জ্যাক দ্য রিপার, 'বিটিকে কিলার' ডেনিস রেডার,'গ্রীন রিভার কিলার' গ্রে রিজ ওয়ে, 'সন অব স্যাম' ডেভিড বার্কোউইজ, 'বুচার অব রুস্তভ' আঁদ্রে চিকাতিলো, চার্লস এং, ডেরিক টড লি, জন ওয়েন গেসি প্রমুখ। কিন্তু সবচেয়ে অস্বস্তিকর যে বিষয়টি তুলে এনেছেন তার বইয়ে পিঙ্কার, সেটি হল - ‘‘মনোবিকারগ্রস্তদের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিরাময় করা যায় না’’। তিনি বলেন,

Psychopaths, as far we know, cannot be 'cured'. Indeed, the psychologists Marine Rice has shown that has shown that certain harebrain ideas for therapy, such as boosting their self esteem and teaching them social skills, can even make more dangerous.

সমাজের নৈতিকতা এবং মূল্যবোধ শেখানোর মাধ্যমে যে মনোবিকারগ্রস্থ মানুষদের স্বভাব অনেক সময়ই পরিবর্তন করা যায়না সেই সত্যটি (?) পিঙ্কার তার বইয়ে তুলে ধরেছেন উপরে উল্লিখিত জ্যাক এবট্‌-এর একটি বাস্তব ঘটনা উল্লেখ করে। ঘটনাটি হল, পুলিতজার পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক নর্মান মেইলার জেলখানায় বন্দী দাগি আসামী জ্যাক এবট্‌ -এর কিছু চিঠি পড়ে এতই মুগ্ধ হন যে, যে তিনি নর্মান মেইলারকে জামিনে মুক্তি পেতে সাহায্য করেন। নর্মান মেইলার সে সময় গ্যারি গিলমোর নামের আরেক অপরাধীকে নিয়ে একটি বই লেখার কাজ করছিলেন। জ্যাক এবট্‌ তার নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে লেখককে সহায়তা করার প্রস্তাব দেন। জ্যাক এবট্‌ -এর রচনা এবং চিন্তা ভাবনা নর্মান মেইলারকে এতটাই অনুপ্রাণিত করেছিল যে, তিনি এবট্‌কে ‘প্রথাবিরুদ্ধ বুদ্ধিজীবী এবং সম্ভাবনাময় লেখক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন; শুধু তাই নয়, তাঁকে লেখা এবটের চিঠিগুলো সংকলিত করে তিনি ১৯৮০ সালে এবটের একটি বই প্রকাশ করতে সহায়তাও করেন, বইটির নাম ছিলো -‘In the belly of the beast’ । বইটি সে সময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো।
auto

নর্মান মেইলারের তদ্বিরে ছাড়া পাওয়ার পর এবট্‌ বেশ নামীদামী মহলে অনেক বিদগ্ধ লোকজনের সাথে নৈশভোজেও আমন্ত্রিত হতেন। অথচ এর মধ্যেই - ছ' সপ্তাহের মাথায় নিজের সাইকোপ্যাথেটিক চরিত্রের পুনঃপ্রকাশ ঘটালেন এবট এক রেস্তোরার বেয়ারাকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে। ভাগ্যের কি পরিহাস - এবট যেদিন দ্বিতীয় হত্যাকান্ড সম্পন্ন করে পুলিশের খাতায় নাম লেখাচ্ছিলেন, ঠিক তার পরদিনই তার বই -‘In the belly of the beast’ -এর চমৎকার একটি রিভিউ বেরিয়েছিলো নিউইয়র্ক টাইমস-এ । পত্রিকার সম্পাদক খুব আগ্রহ ভরেই সেটি ছাপিয়েছিলেন এবটের আগের দিনের হত্যাকান্ড সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল না থেকে।

এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন। আমরা খুব স্বতঃসিদ্ধভাবে ধরে নেই মনোবিকারগ্রস্থ কিংবা শিশুনিপীড়নকারীরা নিজেদের শিশুবয়সে নিপীড়নের শিকার হয়েছিলো, সেজন্যই বোধহয় তারা বড় হয়ে অন্য মানুষদের মেরে কিংবা শিশুদের ধর্ষণ করে নিজেদের জিঘাংসা চরিতার্থ করে। এ ব্যাপারটি অনেকাংশেই ঠিক নয়। আমি যে বিটিকে খুনি ডেনিস রেডার,'গ্রীন রিভার কিলার' গ্রে রিজ ওইয়ের উদাহরণ দিয়েছি, তারা কেউই শিশু বয়সে নিপীড়নের শিকার হয়নি। ডেনিস রেডার ছোটবেলায় খুব ভাল পরিবেশেই বড় হয়েছিলেন। তিনি বিবাহিত ছিলেন, স্ত্রী, এবং দু ছেলে নিয়ে আর দশটা সাধারণ পরিবারের মতই জীবন যাপন করতেন। নীচে পাঠকদের জন্য বিটিকে সিরিয়াল কিলার ডেনিস রেডারের উপর একটা ডকুমেন্টরী দেয়া হল –

অন্যান্য পর্বগুলো এখানে --

পর্ব -২ | পর্ব-৩ | পর্ব -৪ | পর্ব -৫

জোন রজার্স তাঁর ‘Sex: A Natural History’ বইটিতে লিখেছেন যে বেশীর ভাগ শিশু যৌন নিপীড়নকারীদের নিজেদের জীবনে শিশু নিপীড়নের কোন ইতিহাস নেই বলেই প্রমাণ মেলে। বংশাণুবিজ্ঞানী ফ্রেড বার্লিনের উদ্ধৃতি দিয়ে রজার্স তার বইয়ে বলেছেন যে, ‘ বিকৃত যৌন আচরণ শেখান নয়, এটা জৈবিকভাবেই অঙ্কুরিত’। অবশ্য তিনি এটাও বলতে ভুলেননি যে সমাজকে রক্ষা করার জন্যই অপরাধীদের অবশ্যই শাস্তি দেয়া হয়, কিন্তু একই সাথে ঐ আচরণকে অর্থাৎ এই প্রকৃতিকে বোঝার চেষ্টাও আমাদের চালিয়ে যাওয়া উচিৎ। স্টিভেন পিঙ্কারও তাঁর বইয়ের ৩১১ পৃষ্ঠায় বলেন যে কানাডীয়রা আমেরিকানদের মত একই টিভি শো দেখে কিন্তু কানাডায় অপরাধজনিত হত্যার হার আমেরিকার ১/৪ ভাগ মাত্র। তার মানে সহিংস টিভি শো দেখে দেখে আমেরিকানরা সহিংস হয়ে উঠেছে – এই সনাতন ধারণা ঠিক নয়। আমাদের দেশে আমরা প্রায়ই বলি ‘হিন্দি ছবি দেখতে দেখতে পোলাটা বখে গেছে’ কিংবা বলি ‘ছোটবেলায় বাবা মা পিস্তল জাতীয় খেলনা কিনে দেয়াতেই আজকে পোলা মাস্তানি করে বেড়াচ্ছে’। এ ধরণের ‘বিশ্লেষণ’ আসলে কতটুকু বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারাকে তুলে ধরে? সত্যি বলতে কি - ‘জেনেটিক ডিটারমিনিজম’ ঠেকাতে আমরা নিজের অজান্তেই এভাবে ‘কালচারাল ডিটারমিনিজমের’ আশ্রয় নিয়ে নেই। খুন খারাবির পেছনে জেনেটিক কোন প্রভাব থাকতে পারে, এটা অস্বীকার করে আমরা দোষারোপ করি ছোটবেলার খেলনাকে। কিংবা ধর্ষণের পেছনে পর্ণগ্রাফিকে। কিন্তু এই মনোভাবও যে আসলে উন্নত কোন কিছু নয় তা ম্যাট রীডলী তার ‘এজাইল জিন’ বইয়ে ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে – Cultural determinism can be as cruel as genetic determinism। একই কথা বলেছেন নারীবাদী ডারউইনিস্ট হেলেনা ক্রনিন তার ‘Getting Human Nature Right’ প্রবন্ধে একটু অন্যভাবে- ‘কেউ যদি বংশানু নির্ণয়বাদকে ভয় পায়, তবে তার একই কারণে পরিবেশনির্নয়বাদকেও ভয় পাওয়া উচিত’। পিঙ্কারও তার বইয়ে সহিংসতা নিয়ে আমাদের সনাতন ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বলেন, এ সমস্ত মাস্তানমার্কা শিশুরা যুদ্ধ বা সহিংস খেলনার সাথে পরিচিত হবার অনেক আগেই সহিংস প্রবণতার লক্ষণ দেখায়। ভায়োলেন্স নিয়ে পিঙ্কারের চিন্তার উদ্রেগকারী একটি লেকচার দেয়া হল এখানে -

পাঠকদের মনে হয়ত চিন্তা আঁকিবুকি করতে শুরু করেছে এই ভেবে যে, এবটের মত উদাহরণগুলো যদি সত্যি হয়ে থাকে তবে তো আমাদের কপালে ঘোর ‘খারাবি’ আছে। সব কিছু যদি ‘জিন’ই নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করে তবে তো তা আমাদের ‘জেনেটিক ডিটারমিনেজম’ বা বংশানু নির্ণয়বাদের দিকে ঠেলে দেবে। চিন্তা করে দেখুন - সব কিছু যদি জিনেই লেখা থাকে তাহলে আর আমাদের চেষ্টা করেই বা কি লাভ? ‘জিনেই লেখা আছে ছেলে বড় হয়ে সিরিয়াল কিলার হবে’, আর ‘মনোবিকারগ্রস্থ মানুষদের স্বভাব পরিবর্তন করা যায়না’ - তা তো উপরেই দেখলাম। এই আপ্তবাক্যদ্বয় মেনে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকলে আর ভাগ্যবাদীদের সাথে পার্থক্য থাকল কোথায়?

না রসিকতা করছি না একেবারেই। আমার এই কথাকে হাল্কা কথা ভেবে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিলে কিন্তু ভুল হবে। আমি হাল্কাভাবে ভাগ্যের কথা বললেও জেনেটিক্সের এই সমস্ত নতুন দিক বেরিয়ে আসার সাথে সাথেই একদল ‘বিশেষজ্ঞ’ মানুষের আচার ব্যবহার, আনন্দ, হাসি কান্না, দুঃখ যাবতীয় সবকিছুকেই ‘জিনের’ মধ্যে খুঁজে পাওয়া শুরু করে দিলেন। এক দিকে রইলো ব্ল্যাঙ্ক স্লেট ওয়ালারা - যারা সবকিছু পরিবেশ বদল করেই সমাধান করে ফেলতে চান, আর আর অন্যদিকে তৈরি হল আরেক চরমপন্থি ‘জেনেটিক ডিটারমিনিস্ট’-এর দল – যারা পরিবেশ অস্বীকার করে সব কিছু বংশানু দিয়েই ব্যাখ্যা করে ফেলেন। এই গ্রুপের একদল আবার আরো এক কাঠি সরেস হয়ে ‘জিন কেন্দ্রক ভাগ্যবাদ’ কিংবা ‘বংশানু নির্ণয়বাদ’ প্রীচ করা শুরু করে দিলেন। যেমন, জিনোম প্রজেক্ট শেষ হবার পর পরই যুগল-সর্পিলের আবিষ্কারক অধ্যাপক জেমস ওয়াটসন বলা শুরু করলেন –

‘আগে মানুষ ভাবত আকাশের তারায় বুঝি ভাগ্য লেখা আছে। এখন মানুষ বুঝবে, ভাগ্য তারায় লেখা নেই, তার ভাগ্য লেখা রয়েছে জিনে’!

কিন্তু সত্যই কি তাই? ব্যাপারটা কি এতই সরল? ওয়াটসনের কথা মত মানুষের সমস্ত ভাগ্য কি তাহলে জিনেই লেখা আছে?

এ নিয়ে আলোচনা করা যাবে আগামী পর্বে...


মন্তব্য

সাইফ এর ছবি

হাতি পোস্ট কিন্তু বরাবরের মতই তথ্য ভর্পুর, অজানা বিষয়ে আমাদের কিছু আলো দানের জন্য আপনাকে বিশেষ ধন্যবাদ

মূলত পাঠক এর ছবি

দুর্দান্ত লেখা! পরের পর্ব তাড়াতাড়ি চাই!

নুরুজ্জামান মানিক এর ছবি

অনেক কিছু জানছি , শিখছি ,অনেক জটও খুলছে ।
ধন্যবাদ শ্রদ্ধাভাজনেষু অভিজিৎ ভাই ।

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

অনীক আন্দালিব এর ছবি

এই পর্বটাও চমৎকার লাগলো। তবে কিছু কিছু প্রশ্নও জাগছে। হয়তো ব্ল্যাঙ্ক শ্লেট আইডিয়াটা মগজে গেঁথে গেছে, কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে সামাজিক শিক্ষার অনুষঙ্গ সরাসরি নাকচ করে দিতে পারছি না। জীনের প্রভাব অনস্বীকার্য, সেটা আরও অনেকেই বলেছেন লিখেছেন দেখে আরো জোর দিয়ে বলতে পারছি। কিন্তু সামাজিকীকরণের প্রভাবেও মূল আচরণগুলো তৈরি হয়। আমার এক বন্ধু থাইল্যাণ=ড ঘুরে এসে বললো, ওখানে রাস্তায় হাঁটা যায় না সামুদ্রিক কাঁচা খাদ্যের গন্ধে। খাওয়া দাওয়া নিয়ে তার বেজায় সমস্যা হয়েছে। অথচ থাইল্যাণ্ডের মানুষের তো সেই গন্ধটা আপন এবং রসনা-উদ্রেককারীই লাগে! একই প্রজাতির হওয়া সত্ত্বেও আলাদা এই স্বভাব কি পুরোটাই জীনগত নাকি সামাজিক প্রভাবগত?

সাইকোপ্যাথ নিয়ে বিশ্লেষণটুকু পড়তে পড়তে হ্যানিবল লেক্টারের মুভির কথা মনে পড়ে গেল। সঠিক শিক্ষা ও চর্চা আসলেই তাদেরকে ভয়ানক করে তোলে।

পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।

রিয়াজ এর ছবি

বিষয়বস্তু আর আলোচনা চমৎকার। তবে এই তত্ত্ব সমর্কে পড়ে বেশ ধাঁধায় পড়ে গেছি। এসেন্সিয়ালিসমের চরম রূপ এই তত্ত্ব। এই ধারায় আরো লেখা আসতে থাকুক।

গৌতম এর ছবি

লেখাটি পড়ে অনেক কিছু জানতে পারলাম। ধন্যবাদ, অভিজিৎ।

অফটপিক, মুক্তমনার বাংলা ব্লগে লেখার জন্য রেজিস্ট্রেশন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আঁতিপাতি করে খুঁজেও এর সিস্টেমটা বুঝলাম না। কীভাবে এর সদস্য হওয়া যায় এ সম্পর্কে জানাবেন কি?
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

::: http://www.bdeduarticle.com
::: http://www.facebook.com/profile.php?id=614262553/

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

রায়হান আবীর এর ছবি

লেখাটার কিছু কিছু অংশ (বিশেষ করে উদাহরণ কয়েকটা) মারাত্মক রকম অতিরঞ্জিত মনে হচ্ছিল। ঠিক মোল্লারা যেমন কোন বিষয়ে অতিরঞ্জিত উদাহরণ দিয়ে থাকেন তেমন।

তবে শেষ প্যারায় এসে বুঝলাম আপনার লেখাটা কোন দিকে যাচ্ছে। দেঁতো হাসি জটিল লাগলো। প্রচন্ড আগ্রহ নিয়ে পরের পর্বের অপেক্ষায়।

সাদা-মডু এর ছবি

এই লেখাটি অতি সম্প্রতি অন্য একটি কমিউনিটি ব্লগে প্রকাশিত। সচলায়তনের নীতিমালার সাথে সাংঘর্ষিক বিধায় এটি প্রথম পাতা থেকে সরিয়ে আপনার ব্লগে প্রকাশিত হলো। অনুরোধ রইলো, পরবর্তীতে সচলায়তনে নতুন লেখা দেয়ার। ধন্যবাদ।

অভিজিৎ এর ছবি

জনাব সাদা মডু,
আমি আগেই বলেছিলাম সচলায়তনের জন্য লেখা এই সিরিজটির সাথে তথ্য এবং স্ট্রাকচারে মুক্তমনার লেখাটির সাথে বেশ পার্থক্য থাকবে। আমি এখানে এপিজেনেটিক্স-এর বিষয়গুলো ইচ্ছে করেই আনিনি। মুলতঃ ব্ল্যাঙ্ক স্লেটকেই বিস্তৃত করেছি। বিটিকে কিলার ডেনিস রেডারের যে ভিডিও গুলো দেয়া হয়েছে তা একেবারেই নতুন। উপসংহারেও মুক্তমনার পর্বটির সাথে মিল নেই। আমি জেমস ওয়াটসনের কথা দিয়ে পর্বটি শেষ করেছি। এগুলো কোনকিছুই কিন্তু ওই লেখাটির সাথে মেলে না। এমনকি শিরোনামও বদল করেছি, যাতে এই পর্বটি ফোকাসড থাকে এবং সচলায়তনের নীতিমালার সাথে মেলে।

এনিওয়ে, আপনাদের রায়ই চূরান্ত বলে মেনে নিচ্ছি এ ব্যাপারে। এ সিরিজটি সচলায়তনে আর প্রকাশ করা হবে না।



পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)


পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)

রায়হান আবীর এর ছবি

পাঠকের কথাটা ভাববেন না? লেখাটা আবার প্রথম পাতায় ফিরিয়ে আনার অনুরোধ জানাই।

নিলয় নন্দী এর ছবি

অসাধারণ লেখা। পুরনো হলেও ধার কমেনি একরত্তি।
আমরা যারা সচলের সেরকম পুরনো পাঠক নই, তাঁদের উচিত খুঁজে খুঁজে সচলের ভালো লেখাগুলো পড়ে ফেলা।
অভিজিৎদাকে ধন্যবাদ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।