ক্ষণজন্মা আলো চিরন্তন অন্ধকার

বর্ণদূত এর ছবি
লিখেছেন বর্ণদূত [অতিথি] (তারিখ: বুধ, ১৫/১০/২০০৮ - ৬:২৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ঐ নগরের অনেক কিছুই আমাদের কাছে বিভ্রান্তিকর মনে হতে পারে। যদিও এই বিভ্রান্তিই তাদের জন্যে স্বাভাবিক। এই যেমন, ওখানকার বাসিন্দারা সব উল্টো করে হাঁটে। আর তাই কেউ হাঁটলে মনে হতে পারে পিছোচ্ছে। বস্তুত পে এভাবেই তারা চলাচল করে। ওখানে প্রাথমিক স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর পর কেউ আর পড়ে না, সবাই পড়ায়। মোটামুটি স্ব শিতি মহাজ্ঞানীদের বসবাস ধরা চলে। ওখানকার পত্রপত্রিকা আর বইয়ে যা লেখা থাকে তা পড়ে উল্টোটাই সঠিক ধরতে হয়। যেমন, কোনো পত্রিকায় খবর বেরুলো,
সকলকিছু মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে
নিশ্চিত ধরে নিতে হবে পণ্যের এমন মূল্যবৃদ্ধি কেউ কখনো দেখেনি আগে। কিংবা অমুককে এবার এবার সর্বোচ্চ পুরস্কার নগর উন্নয়ন পদক এর জন্য মনোনীত করা হয়েছে। তাহলে ধরে নিতে হবে তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর হতে আর দেরী নেই। অথবা নগর প্রশাসনের কোনো গ্রন্থে লেখা আছে, এ নগর পত্তন করেছেন তিনি। ধরে নিতে হবে নগরের জন্মে তিনিই সবচেয় বেশি বিরোধিতা করেছেন। যদি সংবাদ ওঠে, নগর প্রশাসক পরপর ৭ বার ওনেস্টি পুরস্কার জয় করেছেন। নিশ্চিত থাকা যেতে পারে তারচে বড় দুর্নীতিবাজ আর কেউ নয়। এই হলো মোটামুটি ঐ নগরের অবস্থা। তবে দূরবর্তী নৈব্যক্তিক অবস্থান থেকে বিষয়গুলো আমরা যেভাবে উপলব্ধি করতে পারছি, ওখানকার বাসিন্দারা তা পারে না, তাদের কাছে এসবই সভ্যতার ধারাবাহিকতার অংশমাত্র। আর তাই এই উল্টোরথও তাদের কাছে বিভ্রান্তিকর মনে হয় না। হবেই বা কী করে, নগরের প্রশাসন আর মিডিয়া এমন ভাবে গুয়েবলস থিউরি মেনে চলে, যে কোনো বিভ্রান্তি কিংবা দিবালোকের মতো সত্যকেও তারা বারবার উল্টো করে প্রচার করায় সেই ডাহা মিথ্যেটাও একসময় সত্যে (!) আর চূড়ান্ত সত্যটাও রূপান্তরিত হয় ঘৃণ্য মিথ্যায় (!)। ওখানকার বিচারালয়গুলোতে বিচারকগণ চোখে কালো কাপড় পড়ে বসেন। কেননা আইন অন্ধ (!), তবে সবার জন্যে সমান কিনা এ বিষয় নিয়ে সেখানকার কারো কোনো প্রশ্ন নেই, অবশ্য সবার জন্যে সমান অর্থাত সাম্য বিষয়টি তাদের বোঝার প্রয়োজন হয় না, কেননা, ওখানে কারো বিচার শুরু হলে, নগর প্রশাসন থেকে শুরু করে মিডিয়াগুলো আগেভাগেই যেভাবে তার সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য পরিবেশন করা শুরু করে, তাতে করে বিচারকের তেমন কোনো কষ্টই করতে হয় না, তিনি চোখে কালো পট্টিবাঁধা অবস্থাতেই সঠিক (!) সিদ্ধান্ত দিয়ে দিতে পারেন অনায়াসে।
মোট কথা আমরা যারা এখন এ সময়ে বসবাস করছি, ঐ নগরে গেলে নিশ্চিত ভাবেই আমাদের পাগল সাব্যস্ত করা হবে। আজব চিড়িয়া হিসেবে চিড়িয়াখানায় পাঠালেও বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই।
ঐ নগরের পাশ ঘেঁষে এক সুরঙ্গ চলে গেছে কোথায় কে জানে! কেউ বলে, এই সুরঙ্গ চলে গেছে পৃথিবীর শেষ প্রান্তে। আবার কেউ বলে এই পথ দিয়েই ভবিষ্যতে চলে যাওয়া যায়। এই দু'টো মতবাদকে উল্টে নিলে দাঁড়াচ্ছে, নগরটিই পৃথিবীর শেষপ্রান্তে কিংবা ভবিষ্যত নয় এই পথে সবাই বর্তমানটুকুই খোয়ায়। কিন্তু এসবই পরস্পরবিরোধী অনুমান মাত্র, নিশ্চিত করে কিছুই জানা যায় না। অনগ্রসর, মিডিওকার মগজগুলোতে এ সুরঙ্গ নিয়ে নিয়ত হাইপোথিটিক্যাল গবেষণা চলে শুধু। তাদের গবেষণালব্ধ ফলাফল কংক্রিট কোনো সিদ্ধান্তে আসতে না পেরে নগর প্রশাসনের ইতিহাস গ্রন্থের দেয়া তথ্যকেই মেনে নেয় আনত মস্তকে,
এই পথে চলে গেলে মহানন্দলোক। চিরপ্রশান্তির অঞ্চল।
কিন্তু সেই মহানন্দলোকে সবাই যেন পাড়ি না জমায় সেকারণে নগরবাসীদের অর্থে সেই সুরঙ্গমুখে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কালো পোশাকধারী একটি বাহিনী এ সুরঙ্গের নিরাপত্তায় নিয়োজিত। তাদের হাতে অত্যাধুনিক অস্ত্র। সুরঙ্গমুখের অল্প দূরেই সুউচ্চ টাওয়ার বসানো। যেখান থেকে অর্ধেক নগরই পর্যবেণ করা যায়। আরো আছে শিকারী প্রশিতি কুকুর। কুকুরগুলো সারণই বসে বসে লোল ঝরায়, আর যেনবা যোগ্য শিকারের আশায় ওঁত পেতে থাকে। প্রতিদিন এ সুরঙ্গ দেখার জন্যে অসংখ্য মানুষ ভিড় জমায়। কিন্তু দূর থেকে বিশাল ফটক ছাড়া আর কিছুই দর্শণার্থীরা দেখতে পায় না। তবু ভিড় কমে না।
বর্ণিত এ নগরেই এক কবির বাস। সোজা হাঁটার দায়ে এ কবিকে বেশ কয়েকবার হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল, চিকিতসার মাধ্যমে তাকে স্বাভাবিক (!) করে তোলার জন্য। চিকিতসা শেষে বেরিয়ে এসে কবি ফের সোজা হাঁটেন আবার হাসপাতালে যান। শেষবার বেরিয়ে কবি আর সোজা হাঁটার সুযোগ পাননি। কেননা তার দু'পা কেটে নেয়া হয়েছিল। বিষয়টির ব্যাখ্যা দিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপ জানিয়েছে, কবির কাজ কবিতা লেখা। বেশি ঘোরাফেরা করলে তার কবিতা লেখায় বিঘ্ন ঘটতে পারে। তাই তাকে গৃহে রাখার স্থায়ী বন্দোবস্ত করা হয়েছে। তাকে দুপায়ের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে।
গৃহে থেকে থেকে কবি কিছু উদ্ভট কথাবার্তা লিখলেন। সেই কথাগুলো এ রকম:
অন্ধকার, সময় এবং ব্রহ্মাণ্ডের বিস্তৃতি সমান, এক এবং অভেদ। পরমাণুর ফিউশন প্রক্রিয়া শেষ হলে সূর্য নিভে যাবে। কোনো একদিন সব নক্ষত্র একে একে হারাবে তার জ্যোতি। তখন! শুধুই হু হু করা অন্ধকার। আমাদের এই মায়াময় পৃথিবীর সব অংশে একই সময় আলো পৌঁছোয় না। এতো পরাক্রমশালী সূর্যের সেই সামর্থ্য নেই যে একই সঙ্গে আলোকিত করবে এই ছোট্ট চরাচর। তাকেও নিয়মমাফিক অখণ্ড সময়ের দাসত্ব মেনে আলো দিতে হয় এক অংশের পর অন্যকোনো অংশে। এই অন্তহীন ব্রহ্মাণ্ডের সমস্তকিছুই আলোকিত হয়না কখনো। যতোটুকু আলোর সংস্পর্শে আসে তারচে’ অনেক বেশি অংশ অনালোকিত। সেই অনেক বেশি অংশ এতো বিস্তৃত যে, মানবীয় বিবেচনায় তা ধারণ করা সম্ভব নয়। এই অসম্ভব আজ কিংবা ভবিষ্যতের জন্যও সমান সত্য।
অথচ আমরা নিত্য পূজো দিয়ে যাই আলোর উতস মুখে। ঘৃণা করি অন্ধকার। কিন্তু অন্ধকার শক্তিমান চিরকাল। অন্ধকারে ভয় জাগে, জাগে শঙ্কা, সম্ভ্রম আর থেকে যায় অপার রহস্য।
একদিন খেয়ালে কি বেখেয়ালে মাতৃগর্ভ অন্ধকারে প্রকৃত জন্ম আমার। ক্ষণকাল পর এসে দেখি আলোর পৃথিবী। বেড়ে উঠি আলো-অন্ধকারে। বরাদ্দ কিংবা যাপিত সময় অন্তে পাড়ি দেই অনন্তলোকে। এই মির‌্যাকল শুধুমাত্র একবারের তরেই সম্ভব আর কখনো কোনো কালেই দেখা যাবে না পুনরাবৃত্তির চমক। অনন্তলোক সেও অন্ধকারময় অনুভূতিহীন অচৈতন্যে বিলীন হওয়ামাত্র। তার কোনো অগ্র পশ্চাত নাই। কোনো কালে ছিল না, কোনো কালে থাকবে না। অন্ধকার তবে কি? ইন্দ্রিয় আর মনন দিয়ে তার এক ভাসা ভাসা রূপ আমার জানা। আলোর মহল আমার দেখা। আলোহীনতায় টের পাই অন্ধকার, আলোর জগতে চোখ বুঁজে গেলে টের পাই দৈর্ঘ্য-প্রস্থহীন অন্ধকার। তবে কি অনন্তযাত্রা আর অন্ধকারের অনুভূতি সমার্থক? না তা নয়। চোখ বুঁজলে আমার সক্রিয় ইন্দ্রিয় অন্ধকারের ঘ্রাণ নিতে পারে। জানিনা অনন্তযাত্রা চিরপ্রশান্তির অভিজ্ঞতাবাহী কিনা। যদি তাই হবে তবে বেঁচে থাকাতেই এতো আনন্দ খুঁজে পাই কেন? নাকি যে অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়নি এখনো তার স্বাদ বুঝতে অপারগ এই মন! সব রহস্য শেষ হলে আদিতে যেমন সমান ছিল অন্ধকার, সময় এবং ব্রহ্মাণ্ডের বিস্তৃতি, ঠিক সেই একই সমান্তরালে এসে এই তিন মিলে অভেদ হবে পুনর্বার।
কবির এসব কথা-বার্তা গ্রন্থাকারে প্রকাশ হওয়ার পর, চারিদিকে গুঞ্জন শুরু হয়। কেউ বলে বসেন, পাগলের প্রলাপ, কেউ বলে, ভীষণ সময়োপযোগী লেখা, কেউ বলে কিছুই হয়নি আবার কেউবা এর সঙ্গে অবিশ্বাস আর বিদ্রোহের গন্ধ খুঁজে পায়। কিন্তু এতোসব আলাপচারিতার ফলে কবির এ গ্রন্থটির বিক্রি হু হু করে বাড়তে থাকে। এরই মাঝে একদিন শোনা যায়, এ গ্রন্থের প্রকাশককে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু গ্রন্থের ডামাডোলের আড়ালে প্রকাশকের নিখোঁজ হবার খবরটি তেমন করে কারো নজর কাড়ে না। শুধু কবি কিছুটা বিমর্ষ হয়ে পড়েন। অজানা কিছুর আশঙ্কায় কবি নিয়ত প্রস্তুতি নিতে থাকেন।
কবির এই গ্রন্থটি এ নগরের বিক্রির সর্বকালের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এ গ্রন্থ একবার পাঠ করার পর দ্বিতীয়বার কেউই তাদের গৃহ কিংবা কর্মস্থলের সেলফ এ খুঁজে পায়নি।
এ গ্রন্থের জন্যে নগর প্রশাসন থেকে কবিকে সর্বোচ্চ নাগরিক পুরস্কার নগর উন্নয়ন পদক এর জন্য মনোনীত করা হলো। মনোনয়ন দানের কারণ হিসেবে জানানো হলো, কবির এই অসামান্য গ্রন্থ এ নগর সাহিত্যের ইতিহাসে একটি উল্লেখ্যযোগ্য সংযোজন। এ গ্রন্থ রেকর্ড সংখ্যক বিক্রি হওয়ায় নগর প্রশাসন প্রভূত কর অর্জন করেছে। যা নগরের উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। আর তাই একজন কবি হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে নগর উন্নয়ন পদক এ ভূষিত করা হবে।
কবিকে পুরস্কৃত করার আগেরদিন রাতে সুরঙ্গমুখের অদূরে একটি কালো কফিন আনা হয়। কফিনটি কবরস্ত করার পরিবর্তে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। পোড়ানোর কাজে কোনো কাঠ ব্যবহার করা হয়নি। কাগজ দিয়েই পোড়ানো হলো সেই কফিন। এতো রাশি রাশি কাগজ কেন পোড়ানোর কাজে ব্যয় হলো নগরবাসীদের যারা কৌতূহলবশতঃ ঐ দৃশ্য অবলোকন করল তারা ঠিক ঠাহর করতে পারলো না। শুধু বাতাসে পোড়া মাংসের গন্ধ ছড়ানোতে নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত শিকারী কুকুর গুলো একটু উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিল। তারা তাদের চিতকারের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছিল।
পরদিন কবির পুরস্কার গ্রহণের অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হলো সেই সুরঙ্গমুখের কাছে। একটি মঞ্চ করা হল। প্রতিবারই যেখানে মঞ্চ করা হয়। চারপাশজুড়ে নেয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। কালো পোশাকধারীরা শিকারী কুকুরগুলোকে নিয়ে ভাবলেশহীন টহল দিচ্ছে। প্রতিবার এইদিন নগর উন্নয়ন পদক এ ভূষিত ব্যক্তিটি থাকেন উচ্ছ্বসিত। কেননা তিনি তখন মহানন্দলোকে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর থাকেন। আর এ যাবতকালে প্রত্যেকেই নগর প্রশাসনের স্তূতি গাইতে গাইতে প্রবেশ করেছেন সুরঙ্গে। এরপর আর কখনোই সেই ব্যক্তিকে দেখা যায় না কোথাও। অবশ্য তার প্রয়োজনও হয় না। মহানন্দলোক থেকে কেউ কি আর ধূলো-মাটির পৃথিবীতে ফেরে!
এবার প্রথমবারের মতো কোনো কবি এ পদক পাওয়ায় নাগরিকদের সমাগম একটু বেশিই। ব্যতিক্রমের প্রতিই মানুষের আকর্ষণ অধিকমাত্রায় থাকে।
আপাদমস্তক সাদা পোশাকে আবৃত নগর প্রশাসকসহ আরও কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তি মঞ্চে এলেন। কবি তখনও আসেননি। একে একে মাননীয়গণ তাদের বক্তব্য শেষ করলেন। প্রত্যেকেই নগরের সার্বিক কর্মকাণ্ডে সন্তোষ প্রকাশ করলেন। সেই সাথে যেসব মাননীয়গণ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন, কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত সেসব প্রতিষ্ঠানে আর্থিক এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির জন্য নগর প্রশাসকের কাছে আবেদন জানালেন।
অবশেষে পুরস্কৃত কবিকে তার বক্তব্য দেয়ার জন্য দোলনায় করে নিয়ে আসা হচ্ছে। কালো পোশাক পরিহিত দীর্ঘদেহী দুই পালোয়ান রক্তজবা দিয়ে সাজানো কবির দোলনাটি বহন করে নিয়ে আসে। বেতের তৈরি সেই দোলনায় কবি তাঁর দুই উরু বের করে গম্ভীর ভঙ্গিতে বসে আছেন। সবাই দেখতে পেল হাঁটুর নিচ থেকে কর্তিত দুই উরুতে দুটি মালা পরানো। মঞ্চে এসেই কবি গম্ভীর কণ্ঠে বল্লেন, দোলনা থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জ্ঞান অর্জন করো। প্রকৃত সত্যকে জানো। চারপাশে ফিসফিস আওয়াজ শোনা যায়। হঠাত এমন অপ্রাসঙ্গিক কথা কেন? কবির মুখে হাসি নেই কেন? তবে কি এ পুরস্কার কবিকে সুখী করেনি? কবি বলতে থাকেন,
এ সুরঙ্গ পৃথিবীর শেষপ্রান্তে নয়, এ নগরীই পৃথিবীর শেষপ্রান্তে, সভ্যতার ক্ষয়িষ্ণু চর্চায় ধ্বংসের শেষ সীমায় এসে ঠেকেছে এ নগর। সুরঙ্গ কোনো মহানন্দলোকে নয়, অনন্ত অন্ধকারে পৌঁছে গেছে। এখানে প্রবেশ করলে সবাই বর্তমানটুকু খোয়ায়। অর্থাত মৃত্যু। অবশ্য মৃত্যুই প্রত্যেকের ভবিষ্যত গন্তব্য হলে, যারা ভাবেন এই সুরঙ্গ ভবিষ্যতে চলে গেছে তারা আসলে এক অর্থে সঠিক কথাই বলেন।
সবার মধ্যে কলরোল শুরু হয়। কিসব আবোল-তাবোল কথা বলছে কবি! তবে কি লোকটি শেষ পর্যন্ত পাগল হয়ে গেল। সবাই কবির প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠে (!) আহা, শেষ পর্যন্ত কবির মাথাটাই বিগড়ে গেল, তাই এ বিশাল পুরস্কারের মর্ম বুঝতে পারলো না। এমন ধরনের চিন্তায় যখন সবাই ব্যস্ত তখন কবি আবারো বলতে শুরু করেন,
কবিকে মেরে ফেলা হলে বুঝতে হবে সে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
কবিকে আর কোনোকিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কবি উপহাস ভরা ভঙ্গিতে রক্তজবা দিয়ে সাজানো তার দোলনা থেকে একটি রক্তজবা খসিয়ে ছুঁড়ে দিলেন নগর প্রশাসকের দিকে। নগর প্রশাসকের মুখবেয়ে ফুলটি ডানহাতে স্থান করে নেয়। সদাস্মিতহাস্যমুখ নগর প্রশাসক হাত উঁচিয়ে ফুলটি সবাইকে দেখালেন। সমবেত সকলে হৈ হৈ করে উঠল। যেন এমন বিরল দৃশ্য কেউ কখনো দেখেনি আগে। শুধু নগর প্রশাসকের চোয়াল আচানক শক্ত হয়ে উঠল।
যেতে যেতে কবি বলার চেষ্টা করেন,
‌‌‌‌‌‌‌‌‌আমার এই অন্তর্ধান থেকে অজস্র প্রতিবাদী কণ্ঠের জন্ম হোক। কবির মুখ চেপে ধরা হলো। তাঁকে সুরঙ্গমুখের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। বিশালদেহী কালোপোশাকধারী দুই পালোয়ান একটি চাকাওয়ালা চেয়ারে কবিকে বসিয়ে চারহাতে সর্বশক্তিতে সুরঙ্গমুখে ঠেলে দিল। সুরঙ্গে ধাবিত হতে হতে অট্টহাসিতে সবকিছু ভাসিয়ে দিয়ে চিতকার করে কবি বলতে থাকেন,
চিরকাল এমনই হয়, বলেছিলামতো নাকি, অন্ধকারই প্রবল, আলো রুগ্ন আর দুর্বল। আমি অন্ধকারে হারাবো এটাইতো সত্যি। সবকিছুই একদিন অন্ধকারে মিলাবে।
উপস্থিত নাগরিকদের কানে দূরবর্তী কবির এসব কথা পৌঁছেনি। তবে কবির অট্টহাসি তারা শুনতে পেয়েছিল। তারা পুনর্বার দেখে গেল ‌‌নগর উন্নয়ন পদক এ ভূষিত কবি হাসতে হাসতেই সুরঙ্গমুখে প্রবেশ করেছেন, প্রত্যেকেই যেভাবে যান।
কবির শেষ দৃশ্যটি এমন আকস্মিকতায় পূর্ণ ছিল যে, সমাপনী বক্তব্য দিতে আসা নগর প্রশাসক সমবেত নাগরিকের কাছে তেমন কোন পাত্তাই পেলেন না। তারা হট্টগোল করতে করতে যে যার মতো করে অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করতে লাগল। আর এই দৃশ্য দেখে নগর প্রশাসক তার হাতে থাকা রক্তজবাকে অজান্তেই এমন ভাবে পিষ্ট করলেন, তার ডান হাতের পুরো তালুটাই রক্তবর্ণ হয়ে ওঠে। তিনি রাগে ক্ষোভে ফুঁসতে থাকেন। তার ঘাম ছুটে যায়। অবশ্য বাইরে থেকে তার সদা স্মিতহাস্যমুখ দেখে এ বিষয়টি ঠাহর করার কোনো উপায় নেই। শুধু ঘাম মুছতে গিয়ে বেখেয়ালে ডান হাতের চেটো ব্যবহারের পর সবাই দেখতে পেল, সাদা পোশাক পরিহিত রক্তাক্তমুখে দাঁড়িয়ে আছে তাদের নগর প্রশাসক।


মন্তব্য

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

মুগ্ধ হলাম। চলুক
'কবির মৃত্যু' কবিতা মনে পড়ে গেলো।

কপি পেস্টের কারণে 'ক্ষ' হারিয়ে গেছে। এডিট করে নেয়ার অনুরোধ করছি।

Shadhoo [অতিথি] এর ছবি

অনন্য সাধারন, সৃষ্টিশীল লেখা ॥

রণদীপম বসু এর ছবি

একটা সুন্দর লেখা পড়লাম।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

কীর্তিনাশা এর ছবি

আপনার লেখার ধরনে মুগ্ধ হলাম। সচলে আরেকজন শক্তিমান লেখকের আবির্ভাব দেখতে পাচ্ছি। চলুক

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

s-s এর ছবি

চমতকার !!! অভিনন্দন।
যদিও অন্যেরা রেটিং দেয়ার ব্যাপারে কার্পণ্য করেছেন বা ভুলে গেছেন, হাসি আপনাকে দ্বিধাহীন ভাবেই পাঁচ তারকা।
আবারও বলি, চমতকার!
শুভাশীষ।

জীবন জীবন্ত হোক, তুচ্ছ অমরতা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।