জিনিয়া

বইখাতা এর ছবি
লিখেছেন বইখাতা (তারিখ: বুধ, ০৫/০৮/২০০৯ - ৯:৫৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১.
অনেক চেষ্টা ক’রেও জিনিয়া লোকটাকে খসাতে পারে না। কালো, মাঝারি লম্বা, মধ্যবয়স্ক, নীল-কালো ছাপা, চকচকে শার্ট গায়ে একটা লোক। লোকটা কখনো ওর পাশে পাশে - কখনো পেছনে পেছনে - কখনো সামনে সামনে হাঁটে - হাঁটতে হাঁটতে একটু পর পর জিনিয়ার মুখের দিকে তাকায়। জিনিয়া হাঁটার গতি কমালে সেও কমায়, গতি বাড়ালে সেও বাড়ায়। ’ভালো যন্ত্রণায় পড়া গেল ’ - জিনিয়া এইরকম ভাবে। এমনকি রাস্তা পার হয়ে এপাশে এলে একটু পর লোকটাও আসে। তাই একটু এগিযে সামনের ফুটওভারব্রিজের কাছের মানুষের ভীড়ে মিশে না যাওয়া পর্যন্ত কোনোভাবে যেন এই উৎপাতটা তাকে একটা ঠেলা বা ধাক্কা না দেয় - সতর্ক হতে হয়।

এখন সন্ধ্যা শেষপ্রায়। ফুটপাত অন্ধকার, নোংরা, দুর্গন্ধভরা। জিনিয়া ফুটপাত ছেড়ে বড় রাস্তা দিয়ে হাঁটতে চেষ্টা করে । কিন্তু বড় বড় বাস এত বেশি গতিতে একের পর এক যায় যে তাকে চাপা দিয়ে যাবে এই ভয়ে সে আবার ফুটপাতের দিকে সরে আসে - সাবধানে - লোকটার সাথে তার দূরত্ব আবার না কমে যায় ! কাজ শেষে ফেরার সময় প্রায় প্রতিদিন এই এক ঘটনা। কেউ না কেউ পিছু নেবে। ’কেন পিছু নেবে ! আমাকে কী রাস্তার মেয়েমানুষ মনে হয় ! ইশারা দিলেই অন্ধকার কোনায় কী গলিতে ঢুকে যাবো !’ রাগে গা টা জ্বলে যায়। কিন্তু কী ই বা করার আছে !

ফার্মগেটের এই হস্টেলটায় থাকে আসলে ইন্টারমিডিয়েটের পর ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসা মেয়েরা। কর্মজীবি মহিলাদের পছন্দ না করলেও কী মনে করে এর মালিক তার অনুরোধে ’না’ করেনি। থাকার অনুমতি পাওয়া গেছে। এটাকে আসলে ঠিক হস্টেলও বলা যায় না। বাড়ির মালিকের খাবার হোটেলের ব্যবসা আছে - সেই সাথে ব্যবহার-না-করা, কিছুটা ভাঙাচোরা এই বাড়িটা দিয়ে আরেকটা ব্যবসার চেষ্টা। বাড়িটা পুরানো, গলির অনেকটা ভেতরে, দিনের বেলাতেও ঘরে আলো আসে না এমন। তিনতলায় ভাড়া দেওয়া দুইটা পরিবার। একতলায় একটামাত্র ঘর - ভাঙা, বাতিল জিনিসপত্রে ঠাসা। দুইতলায় দুইপাশে দুইটা বড় বড় ঘর। চারজন করে মোট আটজন মেয়ে। একটা কমন বাথরুম আর একটা আয়নাসহ বেসিন।

আয়নার সামনে এখন জিনিয়া। নিজের চেহারা খুঁটিয়ে দেখে। চেহারা, শরীর, পোশাক - পরিচ্ছদ - সবকিছু মিলিয়ে সে আসলে কী রকম ? একটা পুরুষমানুষের চোখে তাকে কেমন দেখায় ? জিনিয়া বোঝার চেষ্টা করেও সফল হয়না কারণ বেসিন-সংলগ্ন আয়নায় তার শরীরের খুব অল্পই দেখা যায়। তারপরও আয়নায় চোখ রেখে, যতটুকু দেখা যায় তার বাইরেটা মনে মনে ভেবে নিয়ে সে গভীর চিন্তায় মগ্ন - ঠিক কী কারণে তাকে সত্যি করে কেউ কখনো ভালবাসার কথা বললো না ! শুধু ব্যবহার করার কথাই ভাবলো ! আর রাস্তাঘাটে অহরহই বদলোকগুলি পিছু নেয় ! এইসব ভাবতে ভাবতে মেজাজ খারাপ করলেও শেষ পর্যন্ত জিনিয়া বিষণœ আর ক্লান্ত বোধ করে। এর কারণ কি তার চেহারা, নাকি তার অতি সাধারণ পোশাক পরিচ্ছদ নাকি অন্যকিছু - জিনিয়া কিছুক্ষণ ভাবে, কিন্তু কোন উপসংহার টানতে পারে না !
লম্বাটে মুখ, বড় কপাল, বিশেষত্বহীন সাধারণ চোখ, ঈষৎ চাপা নাক, ফর্সাঘেঁষা গায়ের রঙ - একবারে ভদ্র , নিরীহ চেহারা একটা - এরকমই মনে করে জিনিয়া। দীর্ঘশ্বাস ফেলতে গিয়েও সে চেপে যায় কারণ তার রুমমেট পেছন থাকে তাকে কৌতুহলের সাথে নিরীক্ষণরত।

একজন কোনোমতে শুতে পারে এইরকম একটা খাটে ব’সে, দেয়ালে হেলান দিয়ে জিনিয়া সাধারণ জ্ঞানের বইটা হাতে নেয়। বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে যেকোনো একটা পোস্টে যদি চাকরি পাওয়া যায় তাহলে একটু নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে। অন্তত বাপ-মা -ভাইবোনগুলি তো নিশ্চিন্ত হবে। সরকারী চাকরির একটা দাম আছে। পড়তে পড়তেই মনে পড়ে হাসান ভাইয়ের কথা। ক্লাস ফাইভে তখন জিনিয়া আর হাসান ভাই সেভেনে। সন্ধ্যায় মাগরিবের আজানের সময় যখন সবাই ছাদ থেকে নেমে আসতো তখন চুপিসারে জিনিয়া ছাদে - আর হাসান ভাই এসে তাকে বেশি কিছু না অবশ্য, এই একটু সাপটে ধরতো বুকের সাথে - আর তারপরে কোনোদিন একটা চকলেট, কোনোদিন হলুদ চকচকে কাগজে মোড়ানো তেঁতুলের বা বরইয়ের আচার - দুইটাকায় কিনতে পাওয়া যায় - আর মুখে চোর-চোর কণ্ঠে, ’জিনিয়া তুই খুব ভালো রে ! কাউকে এই কথা কখনো বলিস না কিন্তু !’ যদিও চকলেট বা আচার না, হাসান ভাইয়ের নায়ক নায়ক চেহারাটাই জিনিয়ার খুব ভালো লাগতো, তাই তো হাসান ভাইয়ের কথামতো প্রতি সন্ধ্যায় জিনিয়ার ছাদে যাওয়া। সেই হাসান ভাই যখন বছর দুই পর তার ক্লাসেরই ফার্স্টগার্ল মিতুর সাথে প্রেম করে আর জিনিয়ার দিকে ভুলেও ফিরে তাকায় না, তখন জিনিয়া মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে যে তাকে ক্লাসের ফার্স্টগার্ল হওয়া লাগবে।

পুরানো কথা ভাবতে ভাবতে জিনিয়ার ক্ষুধা লাগে। সে ভাবতে থাকে আজকে রাতের খাবারের সাথে কী দিবে। সাধারণত থাকে ভাতের সাথে একটা ভাজি আর একটা যেকোনো মাছ, ডালও থাকে একবাটি, সপ্তাহে একদিন মাংস আর একদিন ডিম। মাসিক ব্যবস্থা আছে। মালিকের হোটেল থেকে খাবার দিয়ে যাবে।

ভর্তি পরীক্ষা দিবে অথচ মেয়েগুলির পড়াশুনার দিকে মন নাই ! সমানে আড্ডা দিয়ে যাচ্ছে। বিরক্ত লাগে জিনিয়ার যদিও তারও পড়াশুনার দিকে মন ছিলো না তেমন একটা। সে একটা এনার্জি প্লাস বিস্কুটের প্যাকেট খুলে মেয়েগুলিকে সাধে। কেউ আগ্রহ দেখায় না তাই জিনিয়া একা একাই বিস্কুট চিবায়।

রাতে জিনিয়ার ঘুম আসে না। তপন ভাইয়ের কথা মনে পড়ে, আর পুলক ভাই, সাব্বির ভাই, অপু ভাই - সবার চেহারা আর টুকরো টাকরা কথা, ঘটনা মনে পড়ে - আর ঘুম আসতে চায় না। এদের যেকোনো একজনের সাথে তার বিয়ে হতে পারতো। হয়না, কারণ তারা চায়না। অথচ একসময় এদের ভাব দেখে মনে হতো যেন এরা তাকে কতই না পছন্দ করে ! আর জিনিয়াও তা বিশ্বাস করে কতরকম স্বপ্ন দেখে গেছে ! কিন্তু শেষপর্যন্ত কেউ তাকে আর পাত্তা দিলোনা ! মাঝে মাঝে জিনিয়ার প্রতিশোধ নিতে ইচ্ছা করে। কিন্তু সে ক্ষমতা তার নাই। সে একজন নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে - মাঝারি মানের পড়াশোনা জানা - হস্টেলে থাকা - একটা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের অল্প বেতনের অফিস সহকারী।

সাব্বির ভাইয়ের কথাই ধরা যায়। এটা বেশিদিনের ঘটনা না। সাব্বির ছিলো ডিপার্টমেন্টের বড়ভাই। ক্যান্টিনে, রাস্তায়, করিডোরে সাব্বিরের সাথে কিন্তু জিনিয়ার কখনোই কথা হয়নি। যা হতো তা শুধু দৃষ্টিবিনিময় ! সাব্বির তাকিয়ে থাকতো মুগ্ধ চোখে, জিনিয়া প্রথম প্রথম লজ্জা পেলেও পরে সেও তাকাতো সাব্বিরের দিকে। শুধুই চোখে চোখে কথা। এর বেশি কিছু না। আর ঠিক একবছর পর একদিন জিনিয়ার বান্ধবী যখন খবর দিলো যে সাব্বিরের বিয়ে ঠিক এক সপ্তাহ পর - তারই পছন্দের মেয়ের সাথে, তখন জিনিয়া বিশ্বাস করতে পারেনি। এটা ঠিক যে সাব্বির তাকে কোনো কথা দেয়নি, কিন্তু তারপরও জিনিয়া মারাত্মক অপমান বোধ করে - আর সেই সাথে একটা নিস্ফল রাগ।
২.
অফিসে দুপুরের খাওয়ার সময় জিনিয়ার মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠে। টিনার কল। আজকে আবার আদিবের সাথে দেখা করবে টিনা, তাই জিনিয়াকেও সাথে যেতে হবে। এই এক ঝামেলা ! টিনাকে পছন্দ না করলেও তার ডাক জিনিয়া কখনোই অগ্রাহ্য করতে পারেনি। এর কারণ কি টিনার অনেক টাকা আর জিনিয়ার টাকা নাই বলে, নাকি টিনা অনেক সুন্দর আর স্মার্ট কিন্তু জিনিয়া একেবারে আত্মবিশ্বাসহীন, তেনা-তেনা টাইপ বলে - এটা জিনিয়া জানেনা এবং এটা নিয়ে ভাবেও না।

টিনার সাথে জিনিয়ার পরিচয় এক প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টির বিকালে। জিনিয়া রাস্তায় - সম্পূর্ণ ভেজা - রাস্তা প্রায় ফাঁকা - একটা দুইটা বাস , সিএনজি যাচ্ছে - পানির স্রোত এসে পড়ছে জিনিয়ার গায়ে, রীতিমত বেহাল অবস্থা। কীভাবে হস্টেলে ফিরে যাবে, আদৌ কী যাওয়া যাবে নাকি পাঁচ মিনিট পর পর হওয়া বজ্রপাতে এই রাস্তাতেই মরে পড়ে থাকা লাগবে - এই চিন্তায় জিনিয়া যখন ব্যাকুল তখুনি তার পাশে থামে একটা সাদা গাড়ি আর গাড়ির দরজা খুলে জিনিয়াকে ভেতরে আসতে বলে অদ্ভুত সুন্দর একটা মেয়ে। ওইটাই টিনা।

টিনার চেহারা ধারালো সুন্দর, তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় তার লম্বা কালো রেশমী চুল। এই চুল দেখেই নাকি আদিব ওর প্রেমে পড়ে গেছিল। খুব খেয়ালী, চুপচাপ, বুদ্ধিমতী মেয়ে টিনা। বন্ধুবান্ধব তেমন নাই তার। জিনিয়ার সাথে তার আচরণ ঠিক বান্ধবীসুলভ না, একটু অবজ্ঞা আর করুণা মেশানো থাকে তার আচরণে, সাথে আবার একটু ভালবাসা আর নির্ভরতাও ! অপমানিত বোধ করলেও টিনার ডাক জিনিয়া কখনো অগ্রাহ্যও করতে পারেনা - এর পেছনে আছে তার একধরণের বেযাড়া কর্তব্যবোধ যেটার জন্ম সেই ঝড়বৃষ্টির বিকালে। তবে এইরকম কর্তব্যবোধের যে কোনো মানে হয়না, প্রত্যেকবারই টিনার ডাক পাবার পর জিনিয়া একবার ক'রে তা স্বীকার করে।

টিনা কোনো ছেলের সাথে ঘুরে বেড়ায় জানলে টিনার বাবা মেয়েকে ঘরের বাইরে আর একপাও ফেলতে দেবে না তাই আদিবের সাথে দেখা করতে গেলে জিনিয়াকে যেতে হয় টিনার বাসায়, একসাথে বের হয়ে আসতে হয়, একসাথেই থাকতে হয় বেড়ানো শেষ না হওয়া পর্যন্ত - যাতে জরুরী কোনো পরিস্থিতি সামাল দেয়া যায়। এই ব্যাপারটাও খুব খারাপ লাগে জিনিয়ার । ওদের দুইজনের কথাবার্তার মধ্যে তার কী কাজ ! প্রতিবাদ করে কোনো লাভ নাই। টিনাকে কিছুতেই এড়ানো যায় না। আদিব অবশ্য হাসিমুখেই তাকে সহ্য করে - ’তুমি না থাকলে জিনিয়া , টিনার সাথে আমি কীভাবে দেখা করতাম !’ - বিরক্ত লাগলেও মুখে হাসিহাসি ভাব ধরে রাখতে হয় কেননা এটাই ভদ্রতা !

সংসদ ভবনের রাস্তায় আনমনে হাঁটাহাঁটি করে জিনিয়া - একটু দূরে টিনা আর আদিব - ওদের কথা বলার সুযোগ দিয়ে এদিকে টিনা একা একাই হাঁটে; আর তখনই একটা লোক - লিকলিকে আর তেলতেলে মুখ, বয়স বোঝা যায় না - জিনিয়ার পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। একটু পরেই ফিসফিস করে লোকটা - ঘিনঘিনে কণ্ঠে - ’আমারে বিয়া করবা ? ’
কান্না পায় - প্রচন্ড কান্না পায় জিনিয়ার - একছুটে টিনাদের কাছে যাওয়া যেতো - তা যাবেনা কারণ ওরা বিরক্ত হতে পারে ! এইসব সময়ে টিনার ওপরও যেকোনো প্রকার প্রতিশোধের একটা প্রবল আকাঙ্খা জাগে বুকের ভেতর। কিন্তু সেটা প্রায় অসম্ভব তাই জিনিয়া আর কত অপমান, যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে ভাবতে ভাবতে হন হন করে হাঁটে না প্রায় দৌড়ায় সামনের মানুষের জটলার দিকে।

৩.
ঘটনাটা জিনিয়াকে স্তম্ভিত করে দেয়। একদিন তার অফিসের সামনে টিনা, এটা বিশেষ কোনো ব্যাপার না কারণ টিনা প্রায়ই তার অফিসে আসে। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো টিনার লম্বা চুলের গোছা আর নাই, কাঁধ পর্যন্ত কাটা চুল। হতভম্ব জিনিয়াকে টিনা নিস্পৃহভাবে জানায় যে আদিবের সাথে নাকি তার সব সম্পর্ক শেষ - আকস্মিক এই সংবাদে জিনিয়া কোনো কথাই বলতে পারে না। আদিব টিনাকে সত্যিকার অর্থে কখনোই ভালবাসেনি আর সেইজন্যই সে আদিবের চেহারা আর কখনো দেখতে চায় না - আবেগহীন কন্ঠে টিনা আবারও জানায়। টিনা তার মনোমুগ্ধকর চুল কেটে ফেলেছে বলে আদিবের সাথে সম্পর্ক শেষ, নাকি সম্পর্ক শেষ বলে টিনা চুল কেটে ফেলেছে এই ব্যাপারটা ভাবতে ভাবতে এর কোনো সমাধান না পাওয়ায় এবারও জিনিয়া কোনো কথা বলতে পারেনা, আর এজন্যই বোধহয় শীতল চোখে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে টিনা চলে যায়।

সেদিন রাতে সে প্রায় কিছুই খেতে পারেনা টিনার দুঃখে; এই মেয়েটা তাকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যাপারে অবজ্ঞা করলেও একটা প্রবল ব্যক্তিত্ব ছিল তার, যেটা জিনিয়াকে অপ্রতিরোধ্যভাবে আকর্ষণ করতো। আর তাই সে বুঝতে চেষ্টা করে টিনা আর আদিবের মধ্যে ঠিক কী নিয়ে সমস্যা হতে পারে ! ভাবতে ভাবতেই সে ঘুমায় আর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে পুলকভাইকে, প্রায় প্রতিরাতেই মনে পড়ে কারণ পুলকভাইয়ের সাথে তার বিয়ে ঠিক ছিল একসময়। পুলকদের অবস্থা তাদের চেয়ে একটু ভালো, এটা ছিলো জিনিয়ার জন্য পরম স্বস্তির ব্যাপার। কিন্তু মোটামুটি ধরণের একটা চাকরী পাবার পরই পুলক জানায় যে জিনিয়াকে বিয়ে করা নাকি তার পক্ষে সম্ভব না। তার দরকার আরো সুন্দরী আর স্বচ্ছল পরিবারের মেয়ে। তার এই সিদ্ধান্তে জিনিয়া শুধু রাগে, দুঃখে আপনমনে পুলকসহ দুনিয়ার সব পুরুষমানুষকে অভিশাপ দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি।
৪.
ছুটির দিনে ভোরবেলায় মোবাইল ফোন বাজলে জিনিয়া যারপরনাই বিরক্ত হয়। কিন্তু এই সাতসকালে তাকে কার এতো দরকার পড়লো দেখে জিনিয়ার ঘুম মাথায় ওঠে। আদিব ! কিন্তু জিনিয়ার তো আদিবের সমস্যা সমাধানের কোনো ক্ষমতা নাই। টিনা তো তার কথার কোন দামই দেয়না ! এইটা কী আদিব জানেনা ! দশ মিনিটের মধ্যে জিনিয়া বাইরে এসে দেখে বাইরে রাস্তায় উদভ্রান্তের মতো বিধ্বস্তপ্রায় আদিব। জিনিয়া বলতে যাবে যে ’আদিব ভাই, টিনাকে বুঝানোর সাধ্য আমার নাই’ - এইসময় আদিব যা বলে তা শুনে জিনিয়ার মনে হয় এই ভীড়ের ফার্মগেটে আসলে কোন মানুষ নাই, কোন রাস্তাঘাট নাই, বাড়িঘর নাই, শূন্যের ওপর ভাসমান জিনিয়া আর তার সামনে করুণ মুখে দাঁড়িয়ে আদিব।

আদিব জিনিয়াকে ভালবাসে। আদিব জিনিয়াকেই ভালবাসে, আর কাউকে না। কীভাবে, কখন, কিসের জন্য এই অবিশ্বাস্য, অকারণ, রহস্যময় ভালবাসার সূত্রপাত আদিব জানেনা ! শুধু জানে যে সে জিনিয়াকেই ভালবাসে আর জিনিয়াকে ছাড়া তার চলবে না !

আদিব কথা শেষ করে জিনিয়ার দিকে তাকায় প্রার্থনার ভঙ্গিতে। জিনিয়াও তাকায় - আদিবের চোখের নিচে কালি, মেয়েদের মতো কোমল, সুন্দর, মায়া জাগায এমন একটা মুখ। চুপচাপ কিছুক্ষণ সে দেখে আদিবকে, আর তারপর স্পষ্ট সুরে দৃঢ়তার সাথে কোন সংশয়ের অবকাশ না রেখে উচ্চারণ করে একটাই সহজ ও কঠিন শব্দ - ’না’। এটা ছিলো আদিবের জন্য একটা অপ্রত্যাশিত জবাব। এখন কী করা উচিত, কী বললে বা কীভাবে বললে জিনিয়া তাকে ফিরিয়ে দেবে না বুঝতে না পেরে আদিব এলোমেলো, আবেগ-ভরা কথা বলে অনেকক্ষণ। তবে এতে জিনিয়ার মুখের একটা পেশীও কাঁপে না, চোখের ভাষার কোন পরিবর্তনও হয়না। অনমনীয়, অবিচলিত ভাবে জানায় একই কথা - সে আদিবকে প্রত্যাখ্যান করলো।

এরপর নির্ভার হয়ে ঘুরে দাঁড়ায় জিনিয়া । হাঁটতে থাকে তার হস্টেলের দিকে - পরিপূর্ণভাবে তৃপ্ত - মনে ও শরীরে ! পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে স্তম্ভিত, বিপর্যস্ত ও হতাশ আদিব।

হয়তো এটা তার ছোটবেলা থেকে পেয়ে আসা অজস্র অবহেলা, অবজ্ঞা আর প্রত্যাখানের তীব্র, তীক্ষè, সংক্ষিপ্ত কিন্তু গভীর অর্থবাহী একটা জবাব - অথবা অন্য কিছু - যেটা শুধুমাত্র জিনিয়াই অনুভব করে।


মন্তব্য

স্নিগ্ধা এর ছবি

আগেও তো বলেইছি - আপনার গল্প লেখার হাতটা খুবই, খুবই ভালো!

নামকরণ নিয়ে অবশ্য একটু দ্বিমত আছে - কেমন যেন গল্পের থীম আর নামটা ঠিক যায় নি মনে হচ্ছে।

হয়তো এটা তার ছোটবেলা থেকে পেয়ে আসা অজস্র অবহেলা, অবজ্ঞা আর প্রত্যাখানের তীব্র, তীক্ষè, সংক্ষিপ্ত কিন্তু গভীর অর্থবাহী একটা জবাব - অথবা অন্য কিছু - যেটা শুধুমাত্র জিনিয়াই অনুভব করে।

এই প্যারাটা পড়লে মনে হয় যেন বলাটা সম্পূর্ণ হয় নি - আরো একটু হলে ভালো হতো।

তবে, সব মিলিয়ে - দারুণ হাসি

বইখাতা এর ছবি

অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে সহৃদয় ও সুচিন্তিত মতামতের জন্য।
আমি যে গুটিকয়েক গল্প লেখার চেষ্টা করেছি, তার প্রত্যেকটাতেই আমি নামকরণ নিয়ে সমস্যায় পড়েছি। এটার বেলায়ও আমি কোনো নাম খুঁজে না পেয়ে ’জিনিয়া’ - ই রেখেছি।

আপনি যে প্যারাটার কথা বলেছেন ওখানে আসলে আরো কিছু বাক্য ছিলো, কিন্তু আমার মনে হচ্ছিলো আমি যেন একটু বেশি ব্যাখ্যা দিয়ে ফেলছি, তাই পোস্ট করার আগে মুছে দিয়েছিলাম; এখন মনে হচ্ছে ভুল করেছি।
আবারও আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

আজকাল অণুগল্প পড়তে পড়তে টুইস্ট গুলো আগেই বেশ ধরে ফেলি, যেমন এটার ধরেছি দেঁতো হাসি
তবে গল্পের প্রথমাংশ ভালো লেগেছে, ভিন্ন সমাপ্তির আশায় ছিলাম...
---------------------------------------------------------------------------
- আমি ভালোবাসি মেঘ। যে মেঘেরা উড়ে যায় এই ওখানে- ওই সেখানে।সত্যি, কী বিস্ময়কর ওই মেঘদল !!!

বইখাতা এর ছবি

তাই ! তবে আমি কিন্তু গল্পের শেষে একটা টুইস্ট থাকবে এরকম কোনো পরিকল্পনা করে গল্পটা লিখিনি !
গল্পের কিছু অংশ ভালো লেগেছে জেনে খুশি হলাম।
ধন্যবাদ।

নিবিড় এর ছবি

আপনার গল্পের সবচেয়ে ভাল জিনিস কী জানেন? গল্পের সাবলীলতা, সাধারণ চালে বলে যাওয়া গল্প গুলো একসময় আপনা আপনি পাঠককে গল্পের চরিত্রের সাথে সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়। আর এরকম গল্প গুলো পড়তে দারুন আরাম হয় আর আপনার এই গল্পটাও তার ব্যতিক্রম নয় চলুক
তাই আফামনি আমি আপনার গল্পের এখন থেকে নিয়মিত পাঠক দেঁতো হাসি


মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।

বইখাতা এর ছবি

তোমাকে অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া। ’তুমি’ ক’রেই বললাম (কিছু মনে করছো না তো ?), কারণ যতটুকু জেনেছি, তুমি তো একই ভার্সিটির ছোটভাই !
সত্যি বলতে কী, আমার নিজের লেখা গল্প (মাত্র চারটা যদিও) আমার নিজের কখনো ভালো লাগেনি, আর এ গল্পটা নিয়ে আমি একটু দ্বিধান্বিত ছিলাম পোস্ট করবো কিনা | কারণ আমার মনে হচ্ছিলো এটার মান খুব বেশি খারাপ হয়ে গেছে। তারপরও পোস্ট করলাম।
অনেক ধন্যবাদ তোমাকে।

প্রজাপতি [অতিথি] এর ছবি

আপনার গল্পগুলো আকারে বড় হলেও পড়তে এতটুকু ক্লান্তি লাগে না, অনেক ভাল লাগলো। আমিও এখন থেকে আপনার লেখার নিয়মিত পাঠক হয়ে গেলুম।

বইখাতা এর ছবি

অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে প্রজাপতি। সত্যি খুব কৃতজ্ঞ বোধ করছি।

সাইফ তাহসিন এর ছবি

খালাম্মা বইখাতা, গল্প বড়ই ভালু হইসে, পড়ে কেমন যেন শান্তি শান্তি ভাব নিয়ে শেষ করলাম গল্পটা। শেষে এসে কঠিন মাইর দিসেন, চালায় যান চলুক

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

বইখাতা এর ছবি

আরে আরে ! আমি কী খালাম্মা নাকি ! ঠিক আছে, ব্যাপার না ! অনেক ধন্যবাদ ভাই সাইফ, আশা রাখি চালিয়ে যাবো যতদিন পারি।

সাইফ তাহসিন এর ছবি

অনেকদিন পর পর আসেন, তাই একটু খোঁচা দিলাম, তাও যদি একটু তাড়াতাড়ি আনা যায় আপনাকে চোখ টিপি

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

বইখাতা এর ছবি

আচ্ছা ! হাসি

শাহেনশাহ সিমন এর ছবি

বেশ ভাল্লাগলো চলুক

_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না

বইখাতা এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে।

নীল [অতিথি] এর ছবি

চালিেয় যান, অনেক সাবলিল লিখেেছন
নীল

বইখাতা এর ছবি

ধন্যবাদ নীল।

স্বপ্নহারা এর ছবি

জটিল হইসে! তয় পুলাডার কান্ডকীর্তি পসন্দ হয় নাই...দেঁতো হাসি
আপনার লেখা খুব চমৎকার সাবলীল; এই স্টাইলটা আমার খুব পছন্দ!

-------------------------------------------------------------
স্বপ্ন দিয়ে জীবন গড়া, কেড়ে নিলে যাব মারা!

-------------------------------------------------------------
জীবন অর্থহীন, শোন হে অর্বাচীন...

বইখাতা এর ছবি

ধন্যবাদ .....পুলাডার কান্ডকীর্তি আমারো কিন্তু পসন্দ হয় নাই.... !

অমিত আহমেদ এর ছবি

দুর্দান্ত একটা গল্প পড়লাম।
আপনার লেখার হাত, গল্পের বুনোন খুব ভালো।
দুর্দান্ত।

স্নিগ্ধার সাথে একমত হতে পারলাম না। আমার কাছে বরং শেষটুকু বাড়তি বলে মনে হয়েছে। ওই প্যারাটা না রেখে, বুঝে নেয়ার ব্যাপারটা পাঠকের হাতে ছেড়ে দিলেই মনে হয় ভালো হতো। গল্পের নাম হতে পারতো "শোধ", তাহলে পাঠকের অনুমানে সমস্যাও হতো না কেনো এমন জবাব। অন্যের গল্পের নাম দেয়া একটা ধৃষ্টতা, গল্পটা ভালো লেগেছে দেখেই যা মনে এসেছে বলে দিলাম। আশা করি কিছু মনে করবেন না।


ওয়েবসাইট | ব্লগস্পট | ফ্লিকার | ইমেইল

বইখাতা এর ছবি

অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে অমিত।
কিছু মনে করার প্রশ্নই আসে না। আলোচনা - সমালোচনায় বরং যে লিখে তার উপকারই হয়।
গল্পের নাম ’শোধ’ বোধহয় ভালোই হতো। নামকরণ নিয়ে আমি সবসময়ই সমস্যায় পড়ি।
আর শেষের প্যারাটা এবং আরো কিছু লাইন রাখবো নাকি রাখবো না চিন্তা করে লেখাটার উপর বিরক্ত হয়ে গল্পটা পোস্টই করবো না ভাবছিলাম।

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

অসাধারণ গল্প। দুর্দান্ত লিখেছেন।

তবে যদি কিছু মনে না করেন, শেষ প্যারা আমার কাছে খুব বেশি জরুরি মনে হয়নি। তার আগের প্যারাতেই মনে হয়েছে গল্পটা শেষ হয়ে যেতে পারত। গল্পের নামটা পছন্দ হয়নি।

লিখুন আরো। আপনার আরো গল্প পড়ার প্রত্যাশায় থাকলাম।

বইখাতা এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ।
হুম, আমি খুব দোটানায় ছিলাম শেষ প্যারাটা রাখবো নাকি রাখবো না ভেবে। নামটা আসলে গল্পের সাথে যায়নি বুঝতে পারছি, নামকরণ আমার জন্য একটা সমস্যা।
ধন্যবাদ আপনাকে গল্প নিয়ে মতামত রাখার জন্য।

পরিবর্তনশীল এর ছবি

আরো গল্পের অপেক্ষায় থাকলাম। চলুক
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

বইখাতা এর ছবি

ধন্যবাদ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।