হিবি

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি
লিখেছেন অছ্যুৎ বলাই (তারিখ: বুধ, ৩১/১০/২০০৭ - ৩:৪১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমি পিপোফিশোটাইপ* মানুষ। আন্ডারগ্রাডের শেষ বছরে বন্ধুরা যখন হরদম টোফেল আর জিআরই ফাইট দিয়ে চলেছে, আমি তখন কঠিন মনোযোগের সাথে ল্যাব রিপোর্টের চোথা বানাতে ব্যস্ত। পাশ করেই দেশের বাইরে যেতে হবে নাকি! এতদিন ঘাম ছুটিয়ে পড়াশুনা করলাম, এবার কিছুদিন আরাম-আয়েশ চলুক, তারপর না হয়। আরাম-আয়েশ অবশ্য বেশিদিন চললো না। একটা জব ইন্টারভিউ দেয়া, আরেকটা না দেয়ার অভিজ্ঞতা এবং তারপর একটা জব করার কিছুদিনের মধ্যেই বুঝলাম চলবে না। আরামের দিন শেষ!

জিআরই দেয়া সম্ভব নয়, হুটহাট করে টোফেল দিলাম। ভিসা না দিলেও নর্থ আমেরিকার বাইরে হায়ার স্টাডির চিন্তা মানে প্রেস্টিজ পাংচার - এরকম একটা ভয়ঙ্কর ধারণা তখন ভয়ঙ্করভাবেই প্রতিষ্ঠিত, হয়তো এখনও এই ধারণার খুব একটা বিবর্তন হয় নাই। কিন্তু শুধু টোফেল দিয়ে নর্থ আমেরিকার কোথাও অ্যাপলাই করার সময় তখন শেষ। এক বন্ধু কাম ক্লাসমেট কাম কলিগের পরামর্শে জার্মানির এক ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির শেষসীমার ঠিক আগেভাগেই আবেদনপত্র পাঠাতে সক্ষম হলাম। ইউনিভার্সিটি হিসেবে এইটা নাকি ইউরোপের মধ্য ওয়ান অফ দ্য বেস্ট। যাক তাইলে প্রেস্টিজ পুরোপুরি পাংচার হয় নাই!

জার্মানিতে আসার পরপরই বড়ভাইদের প্রথম উপদেশ হলো, হিবির জন্য অ্যাপলাই শুরু করে দাও। আমি পিপোফিশো মানুষ। হিবি কি জিনিস, তখনো জানি না। না জানা বিষয় যত সিম্পলই হোক, তা ক্লিয়ার হতে প্রশ্ন করতে আমি কখনো হীনমণ্যতায় ভুগি না। জানা গেলো, হিবি (HiWi = Wissenschaftliche Hilfskraft) হলো অনেকটা নর্থ -আমেরিকার আরএ'র ইকুইভ্যালেন্ট। জার্মান W এর উচ্চরণ একটু ভেজাইলা, ঠিক ব-এর মত সফটও না, আবার ভ-এর মত স্ট্রংও না, ব-কে একটু টেনে ভ-এর কাছাকাছি এনে ছেড়ে দিলেই হয়। যাহোক, এই উচ্চরণ কিছুদিনের মধ্যেই রপ্ত হয়ে গেল এবং উচ্চরণ রপ্ত হওয়ার আগেই পুরোদমে শুরু হয়ে গেলো হিবি (আসলে হিবি হিসেবে জব) খোঁজা।

জার্মান মার্ক পাই নি। তবে মার্ক নাকি অনেক ভালো ছিলো, ইউরো এসেই জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, এরকম অভিযোগ অজস্র জার্মানের। অবশ্য হিবিজবের রেট নিয়ে এরকম দুর্ণীতি হয় নি। ঘন্টায় ১৫.৬৮ মার্ক চুলচেরা হিসেব কষে দাড়িয়েছে ৮.০২ ইউরোতে। ছাত্রদের আবার কাজকর্মের সময় প্রিডিফাইন্ড। মাসে ৮২ ঘন্টা, প্লাস ৯০ ফুল ডেইজই সর্বোচ্চ লিমিট। ৯০ দিনের হিসেবটা রাখা হয়েছে সম্ভবত সামার ভ্যাকেশনের দিকে খেয়াল রেখে। এখন অবশ্য ৯০ ফুল ডেইজ অথবা ১৮০ হাফ ডেইজ করে দিয়েছে। জীবন-ধারণের জন্য এই সময়সীমা কোনো সমস্যা নয়, সমস্যা হলো সময়মতো কাজ পাওয়া। ৮২ ঘন্টার হিবি অনেক ডিপার্টমেন্ট দিতে চায় না, তারা ছাত্রদের মঙ্গলার্থী, এতে ছাত্রদের পড়াশুনার সময়ে টান পড়বে বলে তাদের ধারণা, অবশ্য আসল কারণটা অর্থনৈতিক। আমার দীর্ঘসময় কেটেছে ৬০ ঘন্টার হিবি করে, যাতে মাসে আয় ৪৩৫ ইউরো, ব্যয় ৪০০, আর বাকি ৩৫ সঞ্চয়। ৯০ দিনের কাজ মূলত ইউনিভার্সিটির বাইরে করা জব। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অড জব পাওয়ার একটা প্রধান শর্ত জার্মান ভাষা জানা; দেশ থেকে আসা বেশিরভাগ ছাত্রই এই কোয়ালিফিকেশনে ধরা। তার সাথে আছে প্রপার চ্যানেল পাওয়া। বিশেষ করে সাউথ ইন্ডিয়ান স্টুডেন্টদের এই বিষয়ে রমরমা অবস্থা। কিন্তু কোনো এক বিচিত্র কারণে অছাত্র বাংলাদেশিদের সাথে ছাত্রদের একটা দূরত্ব তৈরি হওয়ায় (ব্যতিক্রম আছে, তবে সেটা বোধহয় এক্সাম্পল নয়, এক্সেপশন) প্রপার চ্যানেলের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয় এখানকার ছাত্ররা। শিল্পোন্নত শহরগুলোয় বিভিন্ন কোম্পানিতে স্টুডেন্ট জব করার একটা সুযোগ থাকে; কিন্তু অধিকাংশ শহরেই সেটা সম্ভব হয় না। সুতরাং ছাত্রদের একটা বৃহত অংশের জন্য হিবি জবই একমাত্র আয়ের উৎস।

পড়াশুনা টিউশন ফি ফ্রি ছিলো এতদিন। বলা যায়, নামমাত্র পরিমাণের একটা সেমিস্টার ফি ছিলো শুধু। এখন জার্মান ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদরাও স্মার্ট হয়ে যাচ্ছেন। সেমিস্টার ফি একলাফে বেড়ে গেছে অনেকগুণ। হাই ট্যাক্স রেটের কারণে হোক আর রাজনৈতিক কারণেই হোক, জার্মানিতে জীবনধারণের খরচ ইউরোপের অনেক দেশের তুলনায়ই কম। কিন্তু তারা আর পিছিয়ে থাকবে কেন? ট্যাক্স রেট ১৬ থেকে ১৯% হয়েছে; কিন্তু তারপরও হু হু করে দাম বাড়ছে জিনিসপত্রের। শুধু রেট বাড়েনি হিবি জবের। ৫৫ সেন্টের দুধ একলাফে ৭৭ সেন্ট হয়েছে; কিন্তু হিবি রেট এখনও ঘন্টায় ৮.০২!


মন্তব্য

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

* পিপোফিশোটাইপ মানে প্রচন্ড অলস। দুই মহাঅলসকে একবার এক ঘরে আটকে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। একজনের পিঠে আগুনের আঁচ লাগে। 'পিঠ পোড়ে' শব্দে অনেক পরিশ্রম হয় বিধায় সংক্ষেপে 'পিপো' আর অন্যের উত্তরে ঘর থেকে না বেরিয়ে 'ফিরে শোও' এর পরিবর্তে 'ফিশো'।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

সৌরভ এর ছবি

হাহ হা
"পিপো ফিশো" র ব্যাখ্যাটা মজা পাইলাম।

ঘন্টায় আট ইউরো খারাপ না বোধহয়!
জাপানে ঘন্টায় আট-দশ ডলার মতো হইলো অ্যাভারেজ। তবে দুধের দাম বেশি মনে হইলো।



আমি ও আমার স্বপ্নেরা লুকোচুরি খেলি


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

হ, দুধের দাম বাড়ায় বিপাকে। দুধের ওপর থেকে মূল্যবৃদ্ধির কালো হাত সরিয়ে নেয়ার জন্য আন্দোলন চলবে।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

হিমু এর ছবি

দুদু খাবো, হিভি চাই! দিতে হবে দিতে হবে!!


হাঁটুপানির জলদস্যু

দ্রোহী এর ছবি
অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

খালি বাজে কথা!

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

আড্ডাবাজ এর ছবি

কস্টের সংলাপগুলো সর্বত্রই এক। পুরনো দিনের কথা খুব মনে করিয়ে দিল লেখাটা। আজকাল ব্লগিং কি বন্ধ করে দিয়েছেন? জাগো বাংলাদেশ ইউরোপীয়ান শাখায় কিছু ব্লগার দরকার? এপ্লাই করবেন না কি?

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

খুব দৌড়ের ওপর আছি বস। আর আমি তো কখনোই তেমন রেগুলার ব্লগার না। সাইটটা দেখি। অনেক ধন্যবাদ।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

দ্রোহী এর ছবি

যা পাই তার শতকরা সত্তুর ভাগ আবার বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়ে দিতে হয় মাঝে মাঝে। কিভাবে চলে দিন জানি না।

আম্রিকা আসছি.........হে হে ভালো আছি আমি........খুব ভালো।


কি মাঝি? ডরাইলা?

অমিত এর ছবি

পে চেকটা পাওয়ার পর যখন দেখি গাদাগাদা টাকা ট্যাক্স এ চলে গেসে তখন বুকটা ফাইটা যায়। তবে দ্রোহী ভাই, আপনি তো এই বছর মুভ করলেন অন্য স্টেটে। এর পরের ট্যাক্স ফাইল ফিল আপ করার সময় এটা বলতে ভুইলেন না। ভাল রিটার্ন পাবেন।

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

আমি যে ১৯% এর কথা বলেছি, ওইটা আসলে VAT. জব হোলডারদের ট্যাক্স অনেক বেশি। অবিবাহিত পিএইচডি স্টুডেন্টদের প্রায় ৫০%ই চলে যায় ইনকাম ট্যাক্স আর হেলথ ইন্সুরেন্স এ।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

এই লিখাটাকে আবার টেনে তোলার উদ্দেশ্য বলা যায়, জার্মানির কিছু সুনাম করা। লিখায়ই যেটা বলেছি, আমেরিকা-কানাডার বাইরে কোথাও পড়তে যাওয়াটাকে দেশে অনেকেই এখনও লো-স্ট্যান্ডার্ড ঘটনা হিসেবে দেখে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। মাস লেভেলে আমাদের হায়ার স্টাডির অর্থ মূলত অর্থ উপার্জন। এ দিক দিয়ে বিবেচনা করলে পিএইচডি স্টুডেন্টরা ইউরোপে অনেক বেশি মজায় থাকে। জবের ক্ষেত্রে ফ্রেশ গ্রাজুয়েটদের স্যালারি একই রকম, তবে জব-সিক্যুরিটি এবং ছুটির পরিমাণ ইউরোপে বেশি।

আরেকটা বড় বিষয় হলো, এখানে ইউনিভার্সিটির Ranking বা গ্রেড নিয়ে নাক উঁচু ভাবটা নেই বললেই চলে। পিএইচডির ক্ষেত্রে সাধারণত একটা মিনিমাম গ্রেড থাকার দরকার হয়, যেটাও ক্ষেত্রবিশেষে নমনীয়। জবের ক্ষেত্রে গ্রেড কোনো ব্যাপার না। সবচেয়ে ভালো বিষয় হলো, ডিগ্রি থাকলেই চলে, ইউনিভার্সিটির Rank কত, কোন ইউনিভার্সিটির প্রোডাক্ট এটা নিয়ে মোটেই মাথা ঘামানো হয় না। বরং জোর দেওয়া হয় যে কাজের জন্য নিয়োগ পাবে, সেই কাজে তার দক্ষতার ওপর। বিষয়টা অনেক বেশি pragmatic.

বুয়েটের হাই-জিপিএদের অধিকাংশের ওপর আমি তিতিবিরক্ত যে কারণে, তাহলো এদের অনেকেই তার চেয়ে কম গ্রেডের স্টুডেন্টদেরকে less qualified মনে করে, একটা অবাস্তব অহমিকা তৈরি হয়, যা থেকে সারাজীবনে কখনোই আর বেরোতে পারে না।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

অয়ন এর ছবি

বুয়েটের হাই-জিপিএদের অধিকাংশের ওপর আমি তিতিবিরক্ত যে কারণে, তাহলো এদের অনেকেই তার চেয়ে কম গ্রেডের স্টুডেন্টদেরকে less qualified মনে করে, একটা অবাস্তব অহমিকা তৈরি হয়, যা থেকে সারাজীবনে কখনোই আর বেরোতে পারে না।

এটা শুধু বুয়েট ক্যানো সব জায়গাতেই এইরকম মনোভাব॥

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।