প্রিয় সাগ্নিক

দেবদ্যুতি এর ছবি
লিখেছেন দেবদ্যুতি [অতিথি] (তারিখ: সোম, ১৫/০৮/২০১৬ - ১০:৩৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রিয় সাগ্নিক,

তোর বয়স এখন ঠিক দুই মাস তেইশ দিন। এই দুই মাস আমার পুরোটাই কেটেছে একমাত্র তোকে নিয়েই। তোর চোখ, তোর মুখ, তোর নাক, চুল, আঙুল, তোর শ্বাস-প্রশ্বাস এসব নিয়েই দেখতে দেখতে কেমন এতগুলো দিন পার হয়ে গেল, দ্যাখ। তোর সবকিছু আমার কতটা প্রিয় তুইতো বুঝতে পারিস, সোনা আমার। আর কারও না বুঝলেও চলে এসব, না বুঝলেই ভালো বরং, অন্যেরা এসব কথা যত কম জানবে ততই কম জ্বালাবে, তাই না?

সাগ্নিক, পিচ্চি মেয়েটা আমার- একসময় যে আমি তোকে চাইনি, সেজন্য তোর খুব রাগ? সেজন্যই তুই আসার সময় চোখদুটো একদম বন্ধ করে রেখেছিলি- আমার মুখ দেখবি না বলে? এত্ত রাগ কী করে পুষে রেখেছিলি বল তো! এইতো তোর একটুখানি শরীর, ওখানে এই ভয়ঙ্করী রাগ কোথায় ধরে বল? এমন সর্বনাশা রাগ কেন তোর, মা? কেন? তুই তো আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারতি বড় হয়ে, পারতি না? আমি তোকে চাইনি এমন নয় রে, আমি তোকে ঠিক ওই সময়টায় চাইনি। আমার নতুন চাকুরি, নতুন পোস্টিং কিছুই ঠিক হয়নি তখনও, একগাদা দৌড়াদৌড়ি বাকি- আমি তোকে ওই সময় পৃথিবীতে এনে কোনো কষ্ট দিতে চাইনি মা। আমি চেয়েছি আমার রাজকন্যা পৃথিবীতে আসবে যখন তার কোনো কষ্ট হবে না, সবকিছু খুব বেশিরকম ঠিকঠাক থাকবে তখনই।

আর তাছাড়া এসব তো সেই বহুদিনের কথা। তারপর তো আমি তোকে ভালবেসেছি, সাগ্নিক। তোর কষ্ট হবে ভেবে অফিস ছুটি নিয়েছি অনেকদিন, তারপর নতুন চাকুরিতে জয়েন করবার দিন তারিখ পাওয়ার আগে সে চাকুরি ছেড়েও দিয়েছি। তোর কোনো কষ্ট হোক, চাইনি তো আর। আমার ভেতর যখন একটু একটু করে বড় হচ্ছিলি তুই, আমি তখন সেরকমই একটু একটু একটু করে ভালবেসেছি তোকে। সেই সময়টায় আমার নিজের যে আমিটাকে আমি কোনোদিন কল্পনাও করতে পারিনি সেই আমিই সবকিছু ছাপিয়ে দখল করে নিতে শুরু করলো আমার সমস্তটা। নিজের সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে আমি তোকে ভালবেসে ফেললাম, সাগ্নিক। কেমন চুপচাপ ফোটা ফোটা বৃষ্টির মতো, মুঠো মুঠো রোদের মতোই একটু একটু করে তুই ছড়িয়ে গেলি আমার শরীরটার ভেতর, আমার মন-প্রাণ-আত্মার ভেতরেও। তোর বাবা আর আমি মিলে কত নতুন স্বপ্ন দেখা শুরু করলাম তুই তার প্র্রত্যেকটার কথা জানিস সাগ্নিক। অথচ দ্যাখ তুই তোর সমস্ত রাগ আর সমস্ত অভিমান নিয়ে তুই ঠিকই চলে গেলি আমাদের বড় বেশি একলা করে দিয়ে।

আমাদের সারা জীবনে আমরা কখনও এতটা একলা ছিলাম না রে। আমার সারা জীবনে এত কষ্ট আমি কখনও পাইনি সাগ্নিক। তোকে একবারের বেশি দেখা হয়নি আমার। ওই একবারেই তোর পাতলা চুল, বন্ধ চোখের পাতা, আমার মতো বোঁচা নাক আর তোর বাবার মতো লম্বা লম্বা আঙুল সব আমার বুকের ভেতর গেঁথে গেছে।

আমার পৃথিবীটা কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে তুই বুঝতে পারিস? এত ভালবেসেও তোকে কেন আমি, আমরা রাখতে পারলাম না রে? কোথায় ভুল হচ্ছিল তুই বললেই তো পারতিস, আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করতাম ভুলটা শোধরাতে, তোর চেয়ে তো আর কেউ, আর কিছুই গুরুত্বপূর্ণ ছিল না সে সময়। সাগ্নিক, এই দুমাসে আমি একটাও বই শেষ করতে পারিনি খুব চেষ্টায় দু একটা সিনেমা দেখেছি। তুই আর আমি খুব গান শুনতাম, মনে আছে? তুই চলে যাওয়ার পর এই প্রথম আমি গান শুনব বলে ইউটিউবে ঢুকলাম- শাহানা গাইছে ‘মোর ভাবনারে কে হাওয়ায় মাতালো…..’ জানিস, আমার এখন কোনো ভাবনা নেই যেগুলো হাওয়ায় মাততে পারে, আমি ভাবতেই ভুলে যাচ্ছি দিনদিন, রাজকন্যা….

….. মার চিঠিটা পড়তে পড়তে কেমন কান্না আসতে থাকে সাগ্নিকের। মা যা ভাবে, করে, লেখে সব বুঝতে পারে, পড়তে পারে সাগ্নিক। মা বোধহয় চিঠিটা এখনও শেষ করেনি। কলমটা চিঠির উপর রেখে টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে খুব কাঁদছে মা। এই বাসাটায় মা একলা থাকে, ও চলে যাওয়ার কিছুদিন পরেই মার নতুন চাকুরিটায় জয়েন করে এই বাসাটায় চলে আসতে হয়েছে। বাবা আসে মাসে একবার, ছুটিতে, দিনদশেক থাকে। সেই সময়টা খুব ভালো লাগে সাগ্নিকের। আজ বাবা এখানে থাকলে মার নিশ্চয়ই খুব ভালো লাগত। মাকে ও চেনে মাত্র তো এই ক’মাস। ও যেদিন জন্মালো সেই দিনই তো মা-বাবা সবাইকে ছেড়ে চলে এলো, সেদিন তার শরীরটার বয়স ছিল পাঁচ মাস দুদিন, তাহলে সেই দিনগুলো হিসেব করলে মার সাথে ওর পরিচয় সাত মাস পঁচিশ দিনের। এই এত দিনে মাকেই তো ও সবচেয়ে বেশি ভালবেসেছে, মা-ই ওর নাম সাগ্নিক পূর্ণা রেখেছিল। মাকে ছেড়ে চলে আসতে চায়নি কিছুতেই কিন্তু তবু মার কাছে আর থাকা হয়নি ওর। সাগ্নিক জানে সবসময় চাওয়ামতো সবকিছু হয় না জীবনে। মার জন্য আবার মন খুব খারাপ হয়ে যায় ওর। ওর খুব খুব ইচ্ছে করে মার চুলগুলোতে একটু হাত বুলিয়ে দেয়...


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

এটা কষ্টের গল্প। সত্যিকারের কষ্টের গল্প আমার পড়তে ইচ্ছে করেনা। ভুল করে পড়ে ফেললাম। না পড়লেই ভালো ছিল।

--মোখলেস হোসেন।

দেবদ্যুতি এর ছবি

এটা ভীষণরকম মন খারাপের গল্প। আমিও না লিখলেই ভালো করতাম....

...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”

গগন শিরীষ  এর ছবি

এ ধরনের লেখা আগেও পড়েছি,তবু মন খারাপ হয়।এ দু:খগুলো মনে হয় অনি:শেষ।

দেবদ্যুতি এর ছবি

এই কষ্টের কোনো শেষ থাকে না।

...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”

শিশিরকণা এর ছবি

মাঝে মাঝে যখন গুমোট দুপুরে হঠাত একটু হাল্কা বাতাস আপনার চুল ছুয়ে যাবে, বুঝবেন সাগ্নিক ওর লম্বা আঙুলগুলো দিয়ে আপনার চুলে একটু বিলি দিয়ে দিলো। সব সময় কি আর স্বরযন্ত্র ব্যবহার করে ভালোবাসি বলতে হয়? আরও কত উপায় আচে ভালবাসা জানান দেবার।

~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~

দেবদ্যুতি এর ছবি

ভালোবাসা, শিশিরকণা....

...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”

সোহেল ইমাম এর ছবি

বিষাদ দিয়ে আঁকা ফুল, রেখায় পুস্প সৌন্দর্য কিন্তু ঘ্রাণে বিষন্নতা। এড়ানো যায়না শব্দ গুলো বোধের ভেতর ঢুকে পড়ে। কলম চলুক।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

দেবদ্যুতি এর ছবি

ধন্যবাদ।

...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”

নীড় সন্ধানী এর ছবি

এটি যদি সত্যি সত্যি গল্প হতো তাহলেই ভালো হতো। মন খারাপ

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

দেবদ্যুতি এর ছবি

এটা সত্যি সত্যি গল্প হলে কারও কারও জীবন থেকে অনেককিছুই হারিয়ে যায় যে!

...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।