একটি প্রীতি ফুটবল ম্যাচ এবং …

দেবদ্যুতি এর ছবি
লিখেছেন দেবদ্যুতি [অতিথি] (তারিখ: শনি, ০৬/০৫/২০১৭ - ৬:২৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

খেলাটা বেশ জমে উঠেছে এতক্ষণে। প্রীতি ফুটবল ম্যাচের প্রায় আধাঘণ্টা চলে যাওয়ার পর এবার দুই দলেই দারুণ উত্তেজনা উত্তেজনা ভাব বোঝা যায় মাঠের বাইরে থেকেই। হলদে আলো মরে আসতে থাকা এই ফ্যাকাশে শেষ বিকেলে সেই উত্তেজনার ভাগিদার হতে কপালের মাঝে উড়ে আসা গুঁড়ো চুল সরিয়ে জ্যোতি চোখ তুলে তাকায় মাঠের মাঝখানের নানা রঙের ছোট্ট ভিড়টায়। খেলাটা এই ট্রেনিং সেন্টারের প্রশিক্ষক আর প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে, এমন খেলা আজই প্রথম ওদের। উত্তেজনার চোটে কে যে কোন দলের- তা বোধহয় ভুলেই গেছে খেলোয়াররা নিজেরাও। সবুজ নরম ঘাসের মাঠে গড়াতে থাকা সাদা-কালো বলটার ডানে-বাঁয়ে-সামনে-পেছনে এই মুহূর্তে সাদা-কালো-নীল-সবুজ হরেক রঙের কেডস পরা জোড়া পাগুলো কেবল ছুটতে ব্যস্ত।

দুই সারি চেয়ারের পেছনের সারিতে বসে জ্যোতি মাঝমাঠে তাকিয়ে ডান পাশের কোণা থেকে ভেসে আসা ধারাভাষ্য শোনে। মাথার উপরে গগণশিরিষের উঁচু মাথা থেকে অবশ্য মৃদু কিচিরমিচিরও ভেসে আসছে, আর পেছনে রাস্তার ওপারে কয়েকজন মানুষের অস্পষ্ট টুকটাক কথা; ওরা কী নিয়ে কথা বলে কে জানে- হতে পারে খেলা নিয়েই অথবা পেছনের একলা বারোভাজাওয়ালার ছোলা-বাদাম-ঝালমুড়ি নিয়ে। সারির শেষ মাথায় ডানদিকে চেয়ার টেবিল নিয়ে বসে হাসান স্যার দারুণ মজারু ধারাভাষ্য দিয়ে যাচ্ছেন। অবশ্য ক্লাসেও তিনি এমনই সরস। সেই চমৎকার ঘোষণা শুনতে শুনতেও জ্যোতির চোখে ধাঁধা লেগে যাবার জোগাড় খেলোয়ারদের ব্যতিব্যস্ততা দেখে। ওই যে, আসাদ আর শোভনদা কী ব্যস্ত মাইরি আর ওদিকে মাহফুজ স্যার- বাব্বা! বলটাকে পায়ে লাগানোর জন্য অন্য আর কাউকে সুযোগ দেয়ার মধ্যে নেই তারা কেউ। আর মাহফুজ স্যার ক্লাসে অদ্ভুত চুপচাপ ভঙিতে ক্লাস নিলেও এখন সে কী চটপটে! একই মানুষ তো নাকি- জ্যোতির মাথায় এ প্রশ্নটাও চক্কর মারে একবার।

“এই, হাঁ টা বন্ধ করে খেলা দ্যাখ, এখানে মশার অভাব নেই!”- শালার শাহীনটা আর মানুষ হলো না। এমন মুহূর্তে এই বেরসিক কথার কী মানে? তবে মশার অভাব নেই বটে এ তল্লাটে। মাঠের চারপাশেও গাছপালার অভাব নেই সেন্টারের অন্যান্য জায়গার মতো। তাছাড়া শেষ বিকেলে আবছা অন্ধকার নেমে আসতে শুরু করেছে একলা ক্যাম্পাসটায়, এই সময়ে মশা যে এখানে ঝাঁক বেঁধেই থাকবে তাতেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। তবু খেলায় মনোযোগ নষ্ট করার দোষে শাহীনের দিকে একবার কটমট করে তাকিয়ে অজান্তেই হাঁ হয়ে যাওয়া মুখটা এবার বন্ধ করে ফেলে জ্যোতি।

“শোন, এইসব খেলাটেলা বাদ দে তো। কালকের অ্যাসাইনমেন্টের কী করলি”- বেরসিকটা আবারও বেমক্কা বাজে প্রশ্ন ছুঁড়েছে। নাহ্, এই শাহীনটার জীবনে রসকষ শখ আহ্লাদ বলে সত্যি কিছু নেই রে। এত লাখ লাখ মানুষের সাথে প্রতিযোগিতা করে দেশের নাম্বার ওয়ান সরকারি চাকুরিগুলোর একটা পেয়েছিস, এখন ট্রেনিং করতে এসেছিস বাবা চুপচাপ করে যা। তা না, এখানেও যেন ওর ফার্স্ট হতেই হবে। না, এবার ওকে কিছু একটা বলতেই হয়। ওদিকে একটাও গোল নেই মাঠে, শুধু দুপাশের গোলপোস্টের দিকে মরিয়া হয়ে দৌড়ানো খেলোয়ার আর থেকে থেকে উড়ন্ত বল, সেদিকে কোনো মন নেই এই বদের! দূর- জ্যোতি মুখ খুলবার আগেই বাঁয়ে ইশারা করে বসে আছে বদটা। “নে নে, এবার দুইটা জিলাপি আর পিঁয়াজু খা। অনেকক্ষণ কিছু খাস নাই”- বাঁ দিক থেকে সবাইকে দিতে দিতে জিলাপি আর পেঁয়াজুর থালা হাতে করে আসা লোকদুটোর দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকে জ্যোতি। ইস! আর দেখো না, লোকগুলোর মুখে সে কী বিগলিত হাসি! এই জিলাপি ভাজলো কোথায় ওরা তা অবশ্য বুঝে উঠতে পারে না ও কারণ আশেপাশে চুলার চ’ও কোথাও নেই।

নিজের সামনে এলে অন্তত একটা খাবে খাবে করেও নেয় না জ্যোতি, সামনের সারিটা সব ফ্যাকাল্টিদের জন্য আর জ্যোতির সামনে দুটো চেয়ার বাদেই মোল্লা স্যারের পাশে সবসময়ের মতো একদম ফিটফাট স্যুটেড বুটেড হয়ে জিহাদুল স্যার বসে। স্যারের দিকে তাকিয়ে পেঁয়াজু খাওয়ার ইচ্ছেটা মনেই চেপে রেখে দেয় জ্যোতি। অন্য সবাই অবশ্য নিয়েছে, তনু ওকে ইশারা করে নিতে। না থাক, কাজ নেই বাবা মাত্র একটা পেঁয়াজু খেয়ে কাল ক্লাসে বেদম লেকচার শোনার। জিহাদুল স্যার এমনিতে নিপাট ভালোমানুষ, চমৎকার ক্লাসও নেন। কিন্তু খাবারদাবারের বেলায় সেইরকম কড়াকড়ি। নিজে আজেবাজে জিনিস খান না, সময়ের খাওয়া একদম ঠিকঠাক সময়ে আর সেই খাবারেরও হাজারটা নিয়ম এসব তারা রোজই শোনে, রোজ মানে ওই যেদিন যেদিন স্যারের ক্লাস থাকে। স্যারের জীবনের মূলমন্ত্র স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস! রাতের খাবারটাও স্যার সেরে নিতে বলেন বিকাল পাঁচটার মধ্যেই। স্যারের ক্লাস সে জলবায়ু পরিবর্তন হোক আর অফিস ম্যানেজমেন্ট- অর্ধেক ক্লাসজুড়ে যদি স্বাস্থ্য আর খাওয়া নিয়ে কথা না থাকে তবে সেটা তাঁর ক্লাসই নয়।

কালও জিহাদুল স্যারের ক্লাস আছে, রুটিন দেখেছে জ্যোতি। আর সেই ক্লাসে গরম তেলে ভাজা এই জিলাপি আর পেঁয়াজু খাওয়া নিয়ে কত যে কথা শোনাবেন তার ঠিক নেই। তার উপর কিসে যেন স্যারের মনে হয়েছে জ্যোতি বেচারা সময় পেলেই কেএফসির পানে ছোটে। ক্লাস থাকলেই –“জ্যোতি, নো মোর কেএফসি” সংলাপটা একবার হবেই এটা ট্রেনিংয়ের ত্রিশজনের মুখস্ত হয়ে গেছে এই কদিনে। আর তাছাড়া স্যারের ওই কথাগুলো শুনলে ভয়ও লাগে বাবা; এখনও এই মাঠের কিনারে বসে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া বিগলিত হাসির পেঁয়াজু আর জিলাপি বাহকদের দেখে মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে জ্যোতির মনে হয়- এত রোগশোক কেন পৃথিবীতে!

আশেপাশের পেঁয়াজু কামড়ানোর কুড়মুড় শব্দ থেকে মনোযোগ সরিয়ে জ্যোতি মাঠের দিকে মনোযোগটা আটকাতে চেষ্টা করে। হাফ টাইমের আর বোধহয় একদমই দেরি নেই। দুই দলেরই সেই রকম চেষ্টা চলছে অন্তত এই কয়েক মিনিটে একটা গোল করে যেতে। অবশ্য অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে সেন্টারের প্রশিক্ষকেরাই এবার একটা গোল খেতে যাচ্ছেন। ওই যে, আসাদ ভাই কেমন করে যেন একাই বলের দখল পেয়ে গেছেন শেষ সময়ে, সেই জোর দৌড় দৌড়াচ্ছেন সেটা পায়ে নিয়ে। তার আশেপাশের পা থেকে বল নিরাপদ দূরত্বেই আছে। জ্যোতি শ্বাঃস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে। হাসান স্যারের ধারাভাষ্য এখন সবচেয়ে ক্ষিপ্র আর মজারু। কোনোখান থেকে কুড়মুড় শব্দটাও আর আসছে না। তার মানে জ্যোতি বুঝতে পারে, সবাই এখন চোখ স্থির রেখেছে বলের উপর।

হায় আল্লাহ্! নিজের চোখকেই বিশ্বাস হতে চায় না জ্যোতির। এত দূর থেকে বল নিয়ে গিয়েও শেষ কিকটা করার সময় আসাদ ভাই পড়ে গেছেন! আর সেই ফাঁকে সঞ্জয় স্যার বল নিয়ে চম্পট! দূর! মনটাই খারাপ হয়ে যায় জ্যোতির, আসাই ভাই কী চমৎকার একটা গোল করতে পারতেন পড়ে না গেলে। আর আসাদ ভাইয়ের লেগেছেও মনে হয় ভালোরকম, এখনও শুয়েই আছেন একইরকম করে।

খেলা দেখার আনন্দটাই মাটি। অবসন্ন চোখ মাঠের উপর থেকে ঘুরিয়ে আনতে আনতে জ্যোতির চোখ আটকে যায় সামনের সারিতে। মাঝমাঠের খেলোয়াড়দের দিকে তাকিয়ে খুব শান্ত মনে জিলাপিতে কামড় দিয়ে যাচ্ছেন জিহাদুল স্যার! আর তার বাঁ হাতে দুটো পিচ্চি পেঁয়াজু ধরে রাখা! কী অদ্ভুত! পৃথিবীতে এই কাণ্ড কী করে ঘটছে অনেক চেষ্টা করেও এই সরল প্রশ্নের কোনো সহজ উত্তর খুঁজে পায় না জ্যোতি, এক্কেবারে ছোটবেলার সরল অঙ্কের মতো প্যাঁচ লেগে গেছে রে!

শাহীন বদ কী যেন বকবক করেই যাচ্ছে এখনও। জ্যোতির কানে ঢোকে না একটা বর্ণও। পেঁয়াজুতে কামড় বসানো জিহাদুল স্যারের শান্ত আর তৃপ্ত মুখের দিকে তাকিয়ে ওর মনে পড়ে স্যারের কথা- গরম তেলের রান্না বা ভাজাভুজি খাওয়া মানে ক্যান্সার কোষকে নিজের কোলে বসিয়ে অন্নপ্রাশন খাওয়ানো…

“দোস্ত, আসাদ ভাইয়ের পা মনে হয় গেছে রে!”- শাহীনের ফিসফিসানো কথা শুনে মাঠের ওই পাশে শুয়ে থাকা আসাদ ভাইয়ের দিকে তাকাতে তাকাতেও জ্যোতির মনে পড়ে- “জ্যোতি, নো মোর কেএফসি প্লিজ”…


মন্তব্য

আয়নামতি এর ছবি

গুরুবাক্য মানতে গিয়ে পেঁয়াজু, জিলাপি হাত ছাড়া হলো তো! ওদিকে গুরু তো ঠিকই চালিয়ে গেলেন। মন খারাপ
গপটা তোমার ট্রেনিংকালের নাকি? ভালোই লিখেছো, তবে 'দেবদ্যুতি'কে মিস করলেম এখানে।

'গুঁড়ো চুল সরিয়ে জ্যোতি চোখ তাকায় মাঠের মাঝেখানে' কিছু একটা গপাস হইছে মনে হচ্ছে। লেখালিখি চলুক সুইটি হাসি

দেবদ্যুতি এর ছবি

তাই তো! 'চোখ তুলে' তাকায় হতো আর 'মাঝখানে' বানানটাও ভুল হয়ে গেছে রে। ঠিক করে দিচ্ছি।

আর এই গল্পের একটা গল্প আছে। তবে বড্ড দুর্বল হয়েছো, কী বলো? লেখালেখি কেমন যেন প্যাঁচ খেয়ে গেছে আজকাল।

...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”

গগন শিরীষ  এর ছবি

কিঞ্চিত অতৃপ্তি রয়ে গেল গল্পটা পড়ে,আরেকটু কিছু যেন আশা করেছিলাম।

দেবদ্যুতি এর ছবি

ইস! কী করব বলুন তো- মাঝেমাঝে লেখাগুলো বড্ড কাঁচা হয়ে যায়!

...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”

এক লহমা এর ছবি

হাসি গল্প লেখা চলুক।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

দেবদ্যুতি এর ছবি

চলছেই না লহমা'দা আজকাল। গল্পগুলো পালিয়ে গেছে কোথায় যেন! তুমি লেখো না কেন আজকাল?

...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”

দেবদ্যুতি এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে! আর দেবদ্যুতির সাথে আজকাল আমারই দেখা হচ্ছে না। দেখা হবে নিশ্চয়ই।

...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”

সোহেল ইমাম এর ছবি

হ্যাঁ দ্যুতিদি লেখাটা সচ্ছন্দ গতিতে এগোলেও মনে হলো দেবদ্যুতির সাথে দেখা হলোনা। স্মৃতিচারণের আমেজটা ভালো লাগলো।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।