পৌষসংক্রান্তি ও একজন জরিনাবু’

দেবদ্যুতি এর ছবি
লিখেছেন দেবদ্যুতি [অতিথি] (তারিখ: মঙ্গল, ১৯/০১/২০১৬ - ৪:৩৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

জরিনাবু’কে আমার সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে পৌষ সংক্রান্তির দিনে, পৌষ সংক্রান্তির রাতে, পৌষ সংক্রান্তির আগে-পরে কয়েকদিন। সবচেয়ে বেশি নাকি শুধু এই নির্দিষ্ট সময়েই মনে পড়ে, সে কথা খেয়াল করে ভাবিনি কখনও অবশ্য। হতেও পারে, কেবল এই সময়টাতেই আমি তার কথা ভাবি। নেহাতই ‘হিন্দুয়ানি’ উৎসব পৌষ সংক্রান্তির সাথে গোলেনূর বেগমের মেয়ে জরিনাবু’ ঠিক কীভাবে জড়িয়ে গেছে, তা খোলসা করার আগে তার পরিচয়টা দেওয়া প্রয়োজন মনে হয়।

সময়টা আশির দশকের শুরু, আমার জন্মেরও বেশ কয়েক বছর আগের কথা। জরিনাবু’রা মানে জরিনা’বু, তার মা মানে আমাদের বেটি, বাবা মানে আমাদের জামাই আর মজিবর, ভুলু ইত্যাদি পাঁচ ভাই নিয়ে ওদের পরিবারটা নদীর ভাঙনে সর্বস্বান্ত হয়ে সুদূর উলিপুর থেকে পাড়ি জমিয়েছিল আমাদের এলাকায়। সাথে জরিনাবু’র বছর দুয়েকের ছেলে জলিল, জলিলের বাপ মরে গিয়েছিল নাকি তাদের ছাড়াছাড়ি হয়েছিল এ নিয়ে ছোটবেলায় নানারকম কথা শুনেছি, বড় হয়ে ব্যাপারটা জানতে ইচ্ছে করেনি আর। তো উলিপুর থেকে এ ঘাট সে ঘাট করে তারা এসে পৌঁছায় আমাদের পাশের পাড়ায়, তারপর তাদেরই পরামর্শক্রমে আমার দাদুর কাছে। আমার দাদু থাকতে দিয়েছিল পরিবারটাকে। আমরা যখন বুঝতে শিখেছি একটু আধটু, তারপর থেকে জরিনাবু’দের সকলকে প্রায় সারাদিন আমাদের বাড়িতেই থাকতে দেখেছি। জলিল ঘুমাতো দাদার সঙ্গে এক খাটে, ওরা ছোটবেলায় এক ক্লাসে পড়ত বোধহয়। জরিনাবু’কে দেখেছি এ বাড়ি, সে বাড়ি কাজ করে দিত, আমাদের বাড়িতেই বেশি। সে প্রসঙ্গ যাক, জরিনাবু’র পরিচয় আপাতত এটুকুতেই থাক।

জরিনাবু’র কথা মনে থাকবার হাজারটা কারণ থাকলেও বিশেষ করে পৌষ সংক্রান্তিতে মনে হবার কারণ ওর অসাধারণ পিঠার হাত, বিশেষ করে তেলের পিঠা বা পুয়া পিঠার খামির বানানোতে জরিনাবু’র জুড়ি ছিল না তল্লাটে। আমাদের এলাকায় পৌষ সংক্রান্তি মানে কেবলই পিঠা-পুলি খাবার উৎসব, সারা বছরের প্রথম পিঠা তৈরি করা হয় এ দিনে, এখন অবশ্য ব্যতিক্রম হয় প্রায় সব বাড়িতেই তবে পৌষ সংক্রান্তি এখনও আছে প্রায় আগের মতোই। পুরান ঢাকার মতো ঘুড়ি উৎসব অথবা অন্য কোনো অনুষ্ঠানের কোনো ধারণাই আগেও ছিল না, এখনও নেই। সে যাই হোক, বছরের প্রথম পিঠা খাওয়া নিয়ে আমাদের উৎসাহের কোনো কমতি থাকতো না। আর সেই দিন জরিনাবু’র মতো ব্যস্ত মানুষ পাওয়া ছিল ভার।

পিঠা বানানো শুরু হতো শেষ বিকেলে। এলাকার নিয়ম অনুসারে প্রথমে সাদা পিঠা (চিতই), তারপর তেলের পিঠা (পুয়া), এরপর পুলি, নারকেল পিঠা ইত্যাদি যার যা খুশি। তেলের পিঠা ফুলকো আর নরম হওয়ার জন্য এর খামির হওয়া চাই একদম খাপে খাপ। আর এ কাজে সবচেয়ে পারদর্শী মানুষটার নাম জরিনা’বু। দুপুর হতে না হতেই জরিনাবু’র জন্য ঘরে ঘরে ছোটাছুটি পড়ে যেত, কে তাকে আগে পাবে এই নিয়ে। তবে আমি প্রতিবারই দেখেছি জরিনাবু’ বরাবর তার ‘বড় মামি’ মানে আমার মায়ের জন্য সবচেয়ে আগে খামিরটা বানিয়ে দিয়ে তারপর ছুটতো অন্য সবার বাড়ি। জরিনাবু’র এবাড়ি সেবাড়ি ওবাড়ি ছুটে ছুটে তেলের পিঠার খামির বানাতে বানাতে সন্ধ্যা হয়ে যেত, ফলাফল যে বাড়িতে সবচেয়ে পরে গেছে, সে বাড়ি থেকে একগাদা বকাঝকা, অবশেষে আমাদের বাড়িতে পিঠা-পুলি আর রাতের খাবার খেয়ে, সব বাড়ি থেকে পিঠা নিয়ে বাড়ি ফেরা ছিল ওর সংক্রান্তির দিনের রুটিন। নিমন্ত্রণ থাকতো অবশ্য ওদের সবারই।

সংক্রান্তির পর পিঠা খাওয়া হতো পুরো মাঘ এবং ফাল্গুনের প্রায় অর্ধেক সময় জুড়ে। এখনকার মতো যখন খুশি তখন পিঠা খাওয়ার চল সে সময় ছিল না আমাদের বাড়িতে। তো সেই পুরো সময়টা জুড়েই কারও বাড়িতে একটু বেশিরকম পিঠার আয়োজন হলে অথবা আত্মীয় এলেই আবার ডাক পড়তো জরিনাবু’র, তেলের পিঠার খামির বানাতে। কারও ডাকই ফেলত না জরিনাবু’, সবার বাড়িতেই হাসিমুখে কী ঢিমা গুড় (শক্ত গুড়ের ডেলা), কী দানা গুড় (দানাদার প্রায় তরল গুড়) দিয়ে চালের আটা আর জল মাখিয়ে মাখিয়ে জরিনাবু’ তৈরি করতো সবচেয়ে ভালো পিঠার খামির।

অনেক বছর হয় জরিনাবু’ মারা গেছে ক্যান্সারে। অন্য সময় তেমন মনে পড়ে কী পড়ে না; বাড়ি যাওয়া-আসার পথে ওদের বাড়িটা দেখলে, বেটি বা মজিবর ভাইদের সাথে দেখা করতে ঐ বাড়িটায় গেলে জরিনাবু’কে মনে পড়ে খুব। আর সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে পৌষ সংক্রান্তি এলে। আজকাল যখন সবকিছুই হয় ‘হিন্দুয়ানি’ না হয় ‘মুসলমানিত্বে’ ভাগ হয়ে যাচ্ছে চোখের পলক ফেলবার আগেই, তখনও পৌষ সংক্রান্তি এলেই আমার সবচেয়ে মনে পড়ে জরিনাবু’কেই। মনে হয়, জরিনাবু’র মতো ভালো তেলের পিঠার খামির কেউ বানাতে পারে না এখনও।


মন্তব্য

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

আমাদের ছেলেবেলায় মফস্বল শহরে পৌষসক্রান্তির মেলা বসতো। আহা সে কী আনন্দ!
চলুক

দেবদ্যুতি এর ছবি

এখনও তো পৌষমেলা হয়, ভাবনাদা’- সেই যে পৌষমেলায় পিঠাপুলির নাম নেই, বাঙালিয়ানার ছিটেফোঁটা নেই কেবল বিদেশি জামাকাপড় আর ক্রোকারিজে ভরা!!! ছেলেবেলার মেলাগুলো হারিয়ে গেল একদম, দূরে কোথায়...

...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”

অনার্য তাপস এর ছবি

তাদের সাথে ঠিক হিন্দুয়ানি মুসলমানি ব্যাপারটা হয়নি। একটা অন্যরকম ব্যাপার আছে। সেটা এখনো। এখনো কিন্তু বেটি দেখা হলেই বলে- তোর পেট ঝুল ঝুলে ক্যান? খাসনি? এটাকে ধর্ম দিয়ে মাপা যায় না। ছোটবেলায় তোরা তাদের কোলেপিঠেই বড় হয়েছিস। মজিবর কিন্তু এখনো কোরবানির ঈদে খাসির মাংস দিয়ে যায় আমাদের। কিংবা রমযানের ঈদে সেমাই-চিনি। গত প্রায় ত্রিশ বছরে কোন সমস্যা হয়নি।
আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ক্লাশ ওয়ার্ক এ ওদের কথা লিখেছি। কেন লিখেছি জানি না। কিন্তু প্রাসঙ্গিক কোন উদাহরণ দিতে হলেই আমি এই পরিবারটার কথা লিখতাম। হয়তো শিশুতোষ স্মৃতি মগজে বসে গেছে তাই। অথবা আসলে লেখাই উচিৎ তাই। এই মানবিক সম্পর্কগুলো আমরা ক্রমশই হারিয়ে ফেলছি।

দেবদ্যুতি এর ছবি

হুম, জলিলও ছুটিতে বাড়ি গেলে অন্তত একবার দেখা করতে আসে! নিজের কথা তো তেমন মনে নেই, মণিটা বড় হয়েছে বেটির কোলেই, এ কথা সর্বজনস্বীকৃত।

আজকাল হতাশ লাগে মাঝেমাঝে, সবকিছু কেমন ভাগ হয়ে যাচ্ছে ছোট ছোট করে; আস্ত একটা মানবিকতাই বোধহয় আর থাকছে না...

...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”

এক লহমা এর ছবি

চলুক
শেষের আগের প্যারাগ্রাফ-টাকে মাঝে রেখে আর বাকিটাকে ক্যানভাস করে সুন্দর একটা চেখভীয় গল্প দাঁড়িয়ে যেত মনে হয়। হাসি

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

দেবদ্যুতি এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

চেখভ খুব কম পড়েছি কিন্তু যা পড়েছি তার সবই অতিমাত্রায় পছন্দের, লহমা’দা হাসি কিন্তু তার ধারায় গল্প, সে আমি বাবা লিখতেই পারব না। আর তুমি যে আমাকে গল্প লেখার ব্যাপারে বুদ্ধিসুদ্ধি দিতে চাইলে, তার কী হলো? এই গল্পটায় আবার হাত দেব ভাবছি কিন্তু, বলে দিও তোমার পরামর্শগুলো, কেমন?

...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”

মন মাঝি এর ছবি

পৌষসংক্রান্তিতে সিলেটের শেরপুরে (সিলেট আর মৌলভীবাজারের মাঝে) বিরাট মাছের মেলা বসে একরাতের জন্য। বিকেল থেকে ভোরবেলা পর্যন্ত চলে। এসময় এখানে বিশালাকারের সদ্য ধরা তাজা হাওরের মাছ পাওয়া যায়। এইবার কাছাকাছি এলাকায় ছিলাম, এই মেলা দেখার ইচ্ছা ছিল।

****************************************

দেবদ্যুতি এর ছবি

ইচ্ছা ছিল বলছেন তার মানে, মেলা দেখতে পারেননি?

...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

দেবদ্যুতি এর ছবি

হাসি

...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”

আয়নামতি এর ছবি

পিটুনি দেবার কাজ তোমারে! এত্ত পিঠার কথা কেউ বলে এভাবে?
ইশশশ এই একটা জিনিসের প্রতি আমার ভীষণ লোভ জানো!
লিখতে থাকো বালিকা। হাসি

দেবদ্যুতি এর ছবি

ভাবলাম পিঠাপুলির কথা বলেটলে যদি তোমাকে দেশে আনা যায়! লোভ করেই চলে আসো না বাপু, তোমাকে নিজে বানিয়ে কিছু পিঠা খাওয়াই হাসি

...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

এভাবে খাদক আমদানী করার দরকারটা কি শুনি?
স্বদেশী পণ্যের ব্যাপারে সেই কবে কবি বলেছেন-

স্বদেশের খাদকেতে, নাই যার মন-
কে বলে মানুষ তারে? দ্যুতি সেই জন!

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

দেবদ্যুতি এর ছবি

স্বদেশের খাদকেরে কোথা খুঁজে পাই
ডানে দেখি বাঁয়ে দেখি কোথাও সে নাই
তাইলে কেমন করে হবেক সে কাজ
আশেপাশে থাকলে দিবেন আওয়াজ... হাসি

...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”

আয়নামতি এর ছবি

এই না হইলে তুমি! দেশে গিয়ে পিঠা খাইতে চাইলে আবার পিঠে কিছু পড়ার সম্ভাবনা নাই তো?
হিংসুটে তো কম নাই আশেপাশে। তাদের কারণে পেটে যেনু টান না পড়ে বাপু। দেঁতো হাসি

আয়নামতি এর ছবি

সাক্ষীরে ডিজিএম। শয়তানী হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।