বুদ্ধির ক্রমবিকাশ - ২

দিগন্ত এর ছবি
লিখেছেন দিগন্ত (তারিখ: বুধ, ০১/০৮/২০০৭ - ১২:৫৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সুতরাং একটা বিষয়ে একমত হওয়া যেতে পারে যে বুদ্ধির ক্রমবিকাশ একরকম মস্তিষ্কের ক্রমবিকাশের মাধ্যমেই ঘটেছে। আর মস্তিষ্ক হল স্নায়ুতন্ত্রের কেন্দ্রস্থল। তাই স্নায়ুতন্ত্র থেকে শুরু হয়ে ধীরে ধীরে বিবর্তনের পথে মস্তিষ্ক গঠিত হয়েছে। অন্যভাবে ভাবলে বলা যায়, আমাদের বুদ্ধি আমাদের বহির্জগতের সাথে তথ্য আদান-প্রদানে সাহায্য করে। তথ্য আমরা বহির্প্রকৃতি থেকে গ্রহণ করি, প্রক্রিয়াকরণ করি আর শেষে আমাদের আচরণের মাধ্যমে তা প্রতিফলিত হয়।

স্নায়ুতন্ত্রের কাজ হল এই সব প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করা।
আদিমতম প্রাণী থেকে আরম্ভ করে মানবপ্রজাতি পর্যন্ত বিবর্তনের ইতিহাসে অন্যতম এক ভূমিকা নিয়েছে এই স্নায়ুতন্ত্র। বিবর্তনের মূলনীতি যদি ভেবে দেখা যায় – যে বৈশিষ্ট্য বাঁচার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়, তাই পরবর্তীকালে ভিন্ন প্রজাতির উৎপত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্নায়ুতন্ত্রের বিবর্তনের ক্ষেত্রে যে মূলনীতি কাজ করে, তা হল – “ভালর কাছে যাওয়া আর খারাপ থেকে দূরে থাকা”। বিবর্তনের পথে, ভাল বলতে বোঝায় যা কিছু বাঁচার বা বংশবিস্তারের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলে – যেমন খাদ্যসংগ্রহ, প্রজননের স্থান নির্ণয় বা শিকার করা। আর খারাপ থেকে দূরে থাকা হল ক্ষতিকর রাসায়নিক বা শিকারীর নজর এড়িয়ে যাওয়া।

যদি এককোষী প্রাণীর কথা ভাবা যায়, তারা ক্রমাগত কিছু রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শে আসতে থাকে - কিছু ভাল (খাদ্য) আবার কিছু ক্ষতিকর। স্বাভাবিকভাবেই, সঠিক রাসায়নিক চিনে নেবার আংশিক ক্ষমতাও এধরনের কোষকে বিবর্তনের পথে বেশী সুবিধা প্রদান করে। একটি উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, একটি গোলাকার এককোষী প্রাণী কোনো এক পার্শ্বে ক্ষতিকর রাসায়নিকের সংস্পর্শে এলে যদি শরীরে কোনো রাসায়নিক উৎপাদনের মাধ্যমে সংকুচিত হয়ে উপবৃত্তাকার ধারণ করতে পারে, তার সেই প্রতিক্রিয়া তাকে বিবর্তনের ক্ষেত্রে সুবিধা দেবে। জীবজগতে এরকম এককোষী প্রাণী প্রচুর দেখা যায়।

auto

এবার আসা যাক বহুকোষী জীবের ক্ষেত্রে। বহুকোষী জীবকে অনেকগুলো এককোষী জীবের সমষ্টি বলে গণ্য করা যায়। এদের মধ্যেও একইরকম প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। জেলিফিসের বহির্ত্বকে অবস্থিত কিছু কোষ স্পর্শ বা আলোর উপস্থিতি অনুভব করতে পারে।

প্রাথমিকভাবে বহুকোষী জীবে অনুভূতি পরিবাহিত হয় আন্তর্কোষীয় রাসায়নিক বিনিময়ের মাধ্যমে। খুব স্বাভাবিকভাবেই, যে কোষগুলো দীর্ঘতর, তারা এ কাজে বেশী পারদর্শী ছিল। তাই মানুষের স্নায়ুকোষ যে সবচেয়ে লম্বা কোষ, এটা কোনো অঘটন নয়।

সাধারণভাবে, যে যে জীববৈশিষ্ট্য জীবনধারণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তারা সবই বিবর্তনের পথে জীবের এক একটি অঙ্গের বিশিষ্ট কাজ হয়ে দাঁড়ায়। স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম দেখা যায় না। তাই, উন্নততর কীটপতঙ্গের স্নায়ুতন্ত্র কেন্দ্রীভূত হয়ে একটি মস্তিষ্ক গঠিত হয়। কেন্দ্রীয়করণের সুবিধা খুবই সুস্পষ্ট। এর ফলে শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে আসা অনুভূতির একত্রে প্রক্রিয়াকরণ সম্ভবপর হয়। যেমন, কান থেকে আসা শব্দ আর চোখ থেকে আসা দর্শন অনুভূতি একত্রে কেন্দ্রীভূত হলে তাদের সহজে প্রক্রিয়াকরণ বা অনুধাবন করা যায়। তাই কীটপতঙ্গের ক্ষমতাও পূর্ববর্তী জীবের থেকে অনেকটাই উন্নত – বিষ দিয়ে শিকার ধরা, সাঁতার কাটা, বা মৌমাছির নৃত্য এই সাধারণ মস্তিষ্ক দ্বারা পরিচালিত হয়।

মেরুদন্ডীদের ক্ষেত্রে এই স্নায়ুতন্ত্রের মূল পথটি মেরুদন্ড দিয়ে সুরক্ষিত। শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে অনুভূতি বয়ে আনে আর প্রতিক্রিয়া ফিরিয়ে দেওয়ার এক হাইওয়ের মত কাজ করে সুষুম্নাকান্ড। এভাবেই স্নায়ুতন্ত্রে, এমনকি মস্তিষ্কেও আলাদা আলাদা বিশিষ্ট অংশে একেকটি কাজ করার প্রবণতা দেখা দেয়। যেমন, চোখের জন্য একধরণের স্নায়ুতন্ত্র ও তাকে প্রক্রিয়াকরণের জন্য একটি মস্তিষ্কের বিশেষ অংশ কাজ করে। এর সুবিধা হল এরকম একটি জটিল গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের যাতে একটি অংশ খারাপ হয়ে গেলেও অন্যগুলো কাজ চালিয়ে যেতে পারে – আর এই সুবিধার ফলে বিবর্তনের মাধ্যমে এই বৈশিষ্ট্য উন্নততর জীবের মধ্যে প্রতিয়মান হয়।

মস্তিষ্কের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিবর্তন হল স্মৃতি-সংরক্ষণ। আগেই বলেছি ভাল থেকে খারাপকে আলাদা করার কাজে সমগ্র স্নায়ুতন্ত্রের ভূমিকা আছে। এই কাজে যদি আগের অভিজ্ঞতার সাহায্য পাওয়া যায় তাহলে সুবিধা বেশি – তাই যে অংশ এই কাজে পারদর্শী, তাও নির্বাচনের মাধ্যমে পরবর্তী প্রজাতির বৈশিষ্ট্য হয়ে যায়। যেমন, আগে কোনো খাবার খারাপ বলে নির্বাচিত হয়ে থাকলে, পূর্ব-অভিজ্ঞতার কারণে জীব সেই ফল আবার খাওয়া থেকে বিরত থাকে। এজন্যে মস্তিষ্কের অবস্থা (state) পরিবর্তিত হতে হবে। এই বৈশিষ্ট্যকে বলে স্থিতিস্থাপকতা। সবশেষে বলা যায় মস্তিষ্কে স্নায়ুকোষের সংখ্যা বা আকার বেড়ে চলেছে যাতে আরো জটিলতর সমস্যার সমাধানে আরো বেশী তথ্য চলাচল করতে পারে আর মস্তিষ্কও আরো পারদর্শী হতে পারে।

তাহলে ভাল আর খারাপের বিভেদ করার জন্য যে সিস্টেমের উদ্ভব, তাই ক্রমে চতুর্মুখীভাবে বিবর্তিত হয়ে মস্তিষ্ক গঠিত হয়। এই চারটি বিবর্তনের অভিমুখ হল – কেন্দ্রীয়করণ (Centralization or Cephalization), অংশীয়করণ বা এককীকরণ (modularization), স্থিতিস্থাপকতা (Plasticity) আর স্নায়ুকোষের সংখ্যা বৃদ্ধি।

জীববিজ্ঞানী উইলিয়াম কেলভিনের মতে, বরফ যুগের তাপমাত্রার আকস্মিক হ্রাস মানুষের মস্তিষ্কের ক্ষমতা একেবারে অনেকটা বৃদ্ধি করেছিল – কারণ আকস্মিক পরিবেশ পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে মস্তিষ্কই ছিল তার একমাত্র হাতিয়ার। তার মতে একসময়, মস্তিষ্কের একেকটি অংশ একাধিক কাজ করত। ধীরে ধীরে কোনো কোনো কাজ যত মানুষকে প্রকৃতিতে সুবিধা দিয়েছে, তত তা বিশিষ্ট অংশের কার্যকারিতায় পরিণত হয়েছে। যেমন, মস্তিষ্কের ভাষাকেন্দ্র আসলে চলন ও গমনে সাহায্যকারী কেন্দ্রের বিবর্তিত রূপ। বিবর্তনের এই ধারা সম্পর্কে মস্তিষ্কের বিবর্তন নিয়ে জীববিজ্ঞানী স্টেফান গাল্ডের ব্যবহৃত পরিভাষা খুবই জনপ্রিয় – এক্সাপটেশন (Exaptation)। জীবজগতের অধিকাংশ জটিল বৈশিষ্ট্য এভাবেই ধাপে ধাপে ক্ষুদ্র পরিবর্তনের মাধ্যমে এবং একই অঙ্গের একাধিক ব্যবহারের মাধ্যমে উদ্ভূত হয়। মস্তিষ্ক তারই একটি আদর্শ উদাহরণ।

মস্তিষ্ক কিভাবে প্রজাতিভেদে সরল থেকে জটিল ও জটিলতর আকার ধারণ করল, তা বোঝা গেল। কিন্তু মস্তিষ্কের বিবর্তনের আরো একটি মাত্রা আছে। একই জীবের জীবদ্দশায় শিশুবয়স থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স অবধি তার মস্তিষ্ক একইরকম থাকে না – পরিবর্তিত হয়। কিভাবে আপাত সরল শিশুমস্তিষ্ক পরিণত হয় প্রাপ্তবয়স্কের জটিল মস্তিষ্কে, তা বিবর্তনের অন্য এক মাত্রা।


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

লেখাগুলো পড়তে হবে তো!

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

দিগন্ত এর ছবি

ধন্যবাদ। আমি আরো ২-৩ টি প্রবন্ধ লিখব একই বিষয় নিয়ে।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

কেমিকেল আলী এর ছবি

অনেক যত্ন নিয়ে লিখছেন তা পড়লেই বুঝা যায়। ধন্যবাদ

সৌরভ এর ছবি

ধারা ভাঙা লেখা।
মস্তিষ্ক ব্যাপারটা আমার কাছে সবচেয়ে অদ্ভূত সৃষ্টি বলে বোধহয়।

"ব্যাপারটা" বলছি এই অর্থে, মস্তিষ্ক কখনো কখনো আমার কাছে ভীষণ অ্যাবস্ট্রাক্ট বলে মনে হয়।
এই যে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়া বা নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলা।
এই যে ভালবাসা বা ঘৃণার বোধ - সব আপেক্ষিক ব্যাপারগুলো নিয়ে একটা ধোঁয়াটে ভাব পুরো ব্যাপারটায়।


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

ভাল লেখা ,,, আগেরবারের মতোই

"বরফ যুগের তাপমাত্রার আকস্মিক হ্রাস মানুষের মস্তিষ্কের ক্ষমতা একেবারে অনেকটা বৃদ্ধি করেছিল " প্রসঙ্গে
তবে পরিবেশের আকস্মিক বদল বিবর্তনের স্পীড আসলেই বাড়ায় কিনা তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মাঝে বেশ বড়সড় মতভেদ আছে

লেখাটা চলুক, পড়ে মজা পাচ্ছি
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

দিগন্ত এর ছবি

জ্বিনের বাদশা, সেজন্যই আমি বিজ্ঞানীর নামও দিয়ে দিয়েছি, যার মতামত দিচ্ছি। এ নিয়ে এখনও মতভেদ আছে।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

সিরাত এর ছবি

লেখাটা একটু ডেনস, তাই চার দিলাম।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।