অচলপত্র প্রসঙ্গে যৎকিঞ্চিৎ-২

দিগন্ত চৌধুরী এর ছবি
লিখেছেন দিগন্ত চৌধুরী [অতিথি] (তারিখ: বুধ, ২১/০১/২০১৫ - ৮:৪৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আগের কিস্তি


অচলপত্রের একটি প্রচ্ছদ : রবীন্দ্র-হতবার্ষিকী

অচলপত্রের নিয়মিত বিভাগগুলোর একটির কথা দিয়ে আগের কিস্তি শেষ করেছিলাম। এবার আরেকটি বিভাগের কথা দিয়ে শুরু করছি। অচলপত্রের আরেকটি জনপ্রিয় বিভাগ ছিল "সাহিত্য দুঃসম্বাদ"। এরও লেখক স্বয়ং দীপ্তেন্দ্রকুমার সান্যালই। সমসাময়িক সাহিত্যের ভেতরকার ভণ্ডামি বিষয়ে তীব্র বক্র-বচনই ছিল এখানে মূখ্য। যেমন, এক লেখক তাঁর "পলাতকা" নাম্নী উপন্যাসের নিবেদন অংশে বলেছিলেন : "এই উপন্যাসের নায়ক-নায়িকারা সম্পূর্ণভাবে কাল্পনিক।" এই কথা শুনে দী-কু-সা'র তৎক্ষণাৎ মন্তব্য : "গম্ভীরভাবে ভাঁড়ামো করা বলে একেই। জীবনকে বাঙালী লেখক আবার দেখল কবে যে, তার চরিত্র কাল্পনিক ব্যতিরেকে অন্য কিছু হবে। তার সমস্ত রচনাই তো জীবন থেকে পলাতকা কল্পনা-কাহিনীমাত্র! তাই না?"

আবার জীবন-বাস্তবতার নামে ভেকধারী আবর্জনা রচনার ব্যাপারেও দীপ্তেন্দ্রকুমার সমানভাবে ক্ষিপ্ত ছিলেন। আরেক জায়গায় লিখেছেন "খররৌদ্রে মাইলের পর মাইল ঘুরলেই যদি সাহিত্যিক হওয়া যেত তাহলে তো প্রত্যেক জীবন-বীমার দালালরাই তা হত।"

আরেকটি বিভাগ ছিল "পড়বার সময় পাঁচ মিনিট" নামে। এখানে অবশ্য দীপ্তেন্দ্র একাধিপতি ছিলেন না। নানাজনে এই কলামে মূলত তিন চার পাতার রম্যরচনা লিখে থাকতেন। নারায়ণ দাশশর্মা লিখেছিলেন একটি চমৎকার রচনা এই কলামে, "পিঠ" শিরোনামে :

ইংরেজী Patron শব্দটির বাংলা অনুবাদ হয়েছে পৃষ্ঠপোষক। এমন সুন্দর অনুবাদ বড় দেখা যায় না। Patronদের সব কারবারই পেছনে, পিঠের দিক থেকে; কক্ষনো কোন Patronকে কোন কাজের সামনে দেখা যায়। তাঁদের যেটুকু পুষিয়ে নেওয়ার সেটুকু সবার পৃষ্ঠ থেকেই নিয়ে থাকেন। ওঁদের পেট-ron না পিঠ-ron বলাই বোধহয় উচিত হবে। অবশ্য নজর তাঁদের পেটের দিকেই : নিজের পেট মেদ বহুল করবার এবং আপনার পেট ফাঁসাবার।

এবং দীপ্তেন্দ্র। তাঁর উপস্থিতি একছত্র এখানে নয় আগেই বলেছি। কিন্তু মাঝে মধ্যেই তাঁর কলমের ঝিলিক এই কলামে মিলতো। যেমন মিলেছিল "খবরকাগজ----খবরদার" শীর্ষক এই রচনাতে :

যে কাগজে সত্যিকার খবর ছাড়া আর প্রায় সব কিছুই থাকে তাকেই সব দেশে বলে খবর কাগজ। শুধু মাত্র দৈনিক একবার প্রকাশিত হয় বলেই অনেক কাগজ যা পত্রও নয়, সংবাদ বলতেও মাত্র দেশে দেশে, রাজায় রাজায় বিসম্বাদ বোঝে, তাকেই আমরা দৈনিক সংবাদপত্র বলতে একরকম বাধ্য হই। যারা এ কথাকে অত্যুক্তি বলে মনে করবেন তাদের জন্যে আমার একটি গল্প মনে পড়ছে। গল্প আমার নয়, কার তা মনে নেই। এক ছোকরা হকার রাস্তায় রাস্তায় হাঁকছে "জোর খবর, বাইশ জনকো ফাঁসায়া"। শ্রোতাদের মধ্যে একজন রোজ রোজ ঠকে কাগজ কেনা একদম ছেড়েই দিয়েছিল, কিন্তু বাইশ জন ফাঁসবার খবরে সে একটু উতলা হল। বাইশকোপের চেয়ে আকর্ষণীয় বলে সে এক আনার একটি কাগজ কিনলো। কিন্তু হা হতোস্মি, ২২জন ছেড়ে একজনেরও ফাঁসবার খবর কাগজের কোথাও নেই। এমনকি আইন আদালতের পৃষ্টাতেও নয়। ভারি রাগ হল ক্রেতাটির। কিন্তু হকার ততক্ষণে সেখান থেকে আরেক মোড়ে চেঁচাচ্ছে : ২৩জনকো ফাঁসায়া, জোর খবর। বাস্তবিকই ফাঁসবার জন্যে তবুও আমরা সকালে একদিন চায়ের সঙ্গে খবরের কাগজ না পেলে হাঁসফাঁস করছি।

পাগলে কী না বলে, ছাগলে কী না খায় এবং খবরের কাগজে কী না লেখে? খবরের প্রয়োজন আছে, কাগজও মানুষের দরকার। কিন্তু খবর কাগজ কেন? No-Use PAPER মানেই তো News Paper ; যারা লেখাপড়া শেখেনি, তারা খবর কাগজ পড়তে পারে না, কিন্তু আশ্চর্য, যারা লেখাপড়া শেখেনি তারাই খবর কাগজ চালাবার সবচেয়ে উপযুক্ত পাত্র। পৃথিবী জুড়ে জীবিকার লিস্ট-এ বেকারের পরেই জার্নালিস্ট।

কার্যত, দীপ্তেন্দ্রকুমার সান্যালের সম্পাদনা ও রচনার এমন যুগপৎ ধারের কোনও পত্রিকা বাংলা ভাষায় পরে আর বের হয়েছিল কিনা আমার জানা নেই। ভবিষ্যতে হবে কিনা সেই প্রশ্ন কালের গর্ভেই নিহিত থাক আপাতত। ক্ষণজন্মা দীপ্তেন্দ্রকুমার (১৯২৪-১৯৬৬) যে সাহস ও তীক্ষ্ণতার পরিচয় দেখিয়েছিলেন অচলপত্র সম্পাদনা করতে গিয়ে, তার তূল্য কাউকেও তো দেখি না। আপনি দেখেন কি? আপাতত অচলপত্রের কিছু কার্টুন অচলপত্র সংকলন থেকে তুলে দিয়ে শেষ করি ।

১।

২।

৩।

৪।

৫।


মন্তব্য

গগন শিরীষ  এর ছবি

পড়তে দারুন লাগল।দীপেন্দ্রকুমার এর কথা জানা ছিলনা।

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

চলুক

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

মেঘলা মানুষ এর ছবি

চলুক ভালো লাগছে অচলপত্রের এই টুকরা পাঠ।

মাসুদ সজীব এর ছবি

পৃথিবী জুড়ে জীবিকার লিস্ট-এ বেকারের পরেই জার্নালিস্ট।

গড়াগড়ি দিয়া হাসি গড়াগড়ি দিয়া হাসি

দীপ্তেন্দ্রকুমার সান্যালের সেন্স অব হিউমার অসাধারণ ছিলো। আচ্ছা উনি কি সাহিত্য চর্চা করেছেন, কোন পুস্তক রচনা করেছেন?

-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।

দিগন্ত চৌধুরী এর ছবি

হ্যাঁ। বেশ কিছু বই লিখেছিলেন স্বনামে ও ছদ্মনাম ''নীলকণ্ঠ''-এও। উপন্যাস লিখেছিলেন আট-নয়টা তো হবেই। গল্পের বই রয়েছে দুখানা। রম্যরচনার বইও দশের বেশি হবে। এছাড়া কিশোর উপন্যাস, জীবনী, অনুবাদ মিলিয়ে আরো কখানা বই আছে। তবে বেশিরভাগই এখন মেলে না। ছাপা নেই।

_______________

মূর্খ থাকি, সামাজিক নয়।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

বাহ! অচলপত্র সচল থাকুক। হাসি

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

বাহ !
চলুক

আবদুর এর ছবি

মজা পেয়েছি ভায়া, আরো চাহি

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

প্রথম পর্বটা লগিন না করলেও পড়েছি। এই সিরিজটা চলুক।

... দীপ্তেন্দ্রকুমার ভদ্রলোকের রসবোধ দারুণ ছিলো, বোঝাই যাচ্ছে। ওনাকে নিয়েই সম্ভব হলে আরেকটি লেখার দাবি রেখে গেলাম।

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

বাহ্, দারুণ! দুটো পর্বই খুব ভাল লেগেে। চুক।

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

মজার।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।