কলসেন্টার কর্মীঃ সেবার নরকে সাইবার কুলি

দিনমজুর এর ছবি
লিখেছেন দিনমজুর [অতিথি] (তারিখ: মঙ্গল, ১৪/১০/২০০৮ - ৫:৫৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কল সেন্টারঃ চলুন ঘুরে আসি
গাড়ি কোম্পানী ফিয়াটের মিলানে অবস্থিত কলসেন্টারটি প্রথমেই আপনাকে মুগ্ধ করবে। ভেতরে প্রচুর স্পেস, দেয়ালগুলো বহুরঙা। অসংখ্য তরুণ তরুণী কানে হেড সেটসহ বড় বড় ফ্ল্যাট-স্ক্রীণ মনিটরের সামনে বসে আছে, কেউ হাঁটা চলা করছে আর কেউবা ভেন্ডিং মেশিনের সামনে বসে কফি খাচ্ছে কিংবা ধূমপান করছে। তারা বিভিন্ন ভাষায় কথা বলছেঃ ইতালীয়, ফরাসি, জার্মান, স্পেনিশ, পুর্তগীজ, পোলীয়......। দৃশ্যটা দেখে বোঝা দায়- কোথায় এসে পড়লাম- সাইবার ক্যাফে নাকি কোন স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলের নিউস রুমে।

কাজ শুরুও হয় বেশ রিলাক্সড ভাবে। জয়েন করার পরপরই আপনাকে একটা ট্রেনিং দেয়া হবে। যেখানে বলা হবে কোম্পানী কবে কোন পুরস্কার পেয়েছে, বলা হবে যে এখানে সবাই খুব ভালো, সবার সাথে সবাই ভালো আচরণ করে কেননা এখানে কাজ মানেই আনন্দ। আর আপনাদের কাজ হলো সারাক্ষণ হাসা- এমনকি ফোনে কথা বলার সময়ও- কেননা তাহলেই কাস্টমাররা খুশি থাকবে আর ফিয়াট কিংবা আলফা রোমিও কেনা অব্যহত রাখবে। কাজ শুরুর কয়েক সপ্তাহ পার হয়ে গেলে, যখন আপনি ইতোমধ্যেই কয়েকশ কলের অভিজ্ঞতা অর্জন করে ফেলেছেন এবং চারপাশ থেকে আপনার দিকে স্বাগতম বাণী আসা বন্ধ হয়ে গেছে, তখনই আপনি বুঝতে শুরু করবেন কোথায় এসে পড়েছেন আপনি!

এখানে কর্মীর সংখ্যা প্রায় সাতশ যার অধিকাংশই নারী- সার্বক্ষণিক কিংবা খণ্ডকালীন। এরা প্রায় সবাই দশ মাস বা বার মাসের চুক্তির ভিত্তিতে কর্মরত। এদের একটা অংশ বিভিন্ন প্রাসাশনিক কাজ সামলায় কিন্তু বেশীর ভাগই বসে আছে ফোনের সামনে- ভাষা, কাজের ধরণ ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে তৈরী বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে এরা কাজ করছে।

আগমনী বিভাগের কর্মীদের কাজ বাহির থেকে আসা বিভন্ন ফোন রিসিভ করা- প্রাইভেট কাস্টমারের কমপ্লেন কিংবা বিভিন্ন প্রশ্ন-থেকে শুরু করে গাড়ির ডিলার কিংবা গ্যারেজের কর্মচরীদের ওয়ারেন্টি বিষয়ক প্রশ্ন কিংবা স্পেয়ার পার্টসের অর্ডার নেয়া কিংবা বাতিল করার কাজ এদের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। আর বহির্গমন বিভাগের কাজ হলো ফোন করে ইনস্যুরেন্স কিংবা অন্যান্য সার্ভিস বিক্রি করা।

কলসেন্টার টেকনোলজি হলো অসংখ্য পিসি, টেলিফোনী যন্ত্রপাতি, নতুন পুরাতন অসংখ্য সফ্‌টওয়ার, ফ্যাক্স মেশিন ইত্যাদির সমন্বয়---- যেখানে তার আর হেডসেট সহ আপনি একজন ডাণ্ডাবেড়ি পরিহিত বন্দী কিংবা একজন মস্তিষ্ক রোগী যার মাথা তারের মাধ্যমে কম্পিউটারের সাথে যুক্ত। আর দশটা কলসেন্টারের মত এখানেও রয়েছে এসিডি (অটোমেটিক কল ডিস্ট্রিবিউশান) মেশিন যা কল আসার সাথে সাথে হিসাব করে কোন দেশ থেকে এটি এসেছে, কোন ভাষাভাষি কর্মীদলের কাছে এটি দেয়া যায় এবং নির্দিষ্ট ভাবে কোন কর্মীটি এখন ফ্রি আছে। কোন কোন ক্ষেত্রে এর সাথে যুক্ত হয় একটি সিটিআই (কম্পিউটার টেলিফোনী ইন্টিগ্রেশান) মেশিন যার মানে হলো ঐ নির্দিষ্ট কলটি যার কাছে যাবে তার মনিটরে কলার ব্যাক্তির যাবতীয় তথ্য ভেসে উঠবে। এভাবে কলসেন্টার এজেন্টের কানে সরাসরি কলটি হাজির হবে- ম্যানুয়ালি গ্রহণ বা বর্জনের কোন সুযোগ এক্ষেত্রে নেই। কর্মীটি কেবল একটি বিপ কিংবা মেশিন ভয়েস শুনবে- যার সাথে সাথেই কাস্টমার তার সাথে অনলাইনে চলে আসবে......

দিনের শুরুতে, সঠিক ভাবে বললে শিফ্‌টের শুরুতে, কল সেন্টার এজেন্টটিকে তার পিসিতে লগ ইন করে বেশ কিছু সফ্‌টওয়ার চালু করতে হয়, যেমনঃ কলের বর্ণনা লিখে রাখার সফ্‌টওয়ার, স্পোয়ার পার্টস অর্ডার দেয়ার সফ্‌টওয়ার ইত্যাদি। কিছু প্রোগ্রামস উইন্ডোস ভিত্তিক অর্থাৎ ক্লিক করে করে কাজ করা যায় আর কিছু প্রোগ্রাম রয়েছে ডস ভিত্তিক অর্থাৎ কমান্ড লিখে কাজ করতে হয়। প্রত্যেকটি পিসি আবার নেটওয়ার্কিং এর মাধ্যমে একটি কেন্দ্রিয় ডাটাবেসের সাথে যুক্ত। একজন প্রথম পর্যায়ের এজেন্টকে কাজের পুরো কাঠামো সম্পর্কে পুরোপুরি না জানলেও চলে। কোন ক্ষেত্রে হয়তো একটা তথ্য খুঁজে দিলেই একটি কলের কাজ শেষ আবার কোন ক্ষেত্রে হয়তো তাকে একটি কলের মাঝে কোন একটি ফ্যা করতে হলো তার আবার কথা, কথা শেষ হওয়া মাত্রই এসিডি মেশিনের জাদুকরী কর্মদক্ষতায় আরেকটি কল.....। সাধারণ ভাবে নিজেই নিজের কাজ শেষ করা যায়, কোন ক্ষেত্রে সহকর্মী কিংবা টিম লিডারের পরামর্শ নেয়ার প্রয়োজন হয়। যদি কোন সমস্যা সমাধান করা না যায় তাহলে কাস্টমারকে মিস্টি করে বুঝিয়ে বলা যে কিছই করার নেই। কোন কোন ক্ষেত্রে একটি কেসকে দ্বিতীয় লেভেলে পাঠানোর কাজও করতে হয় যেমন কোন টেকনিক্যাল সমস্যা কিংবা কোন স্পেয়ার পার্টসের অর্ডার ইত্যাদি। প্রথম লেভেলে সমাধান করা যায়নি এরকম সমস্যা দ্বিতীয় লেভেলকে দেখতে হয় এবং তা সমাধান করতে হয় একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে।

নামে কলসেন্টার হলেও কাজটি কিন্তু কেবল কল করা নয়। কল গ্রহণ করা, লোকের সাথে কথা বলা, প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা, শোনা, উত্তর দেয়া.... এবং একই সাথে আপনার হাতটিকে কিন্তু ব্যাস্ত থাকতে হচ্ছে কম্পিউটারে নাম্বার এবং তথ্য ঢোকানো, উপযুক্ত বাটনে ক্লিক করা, স্ক্রীণে ভেসে উঠা তথ্য থেকে প্রয়োজনীয়টি খুঁজে নেয়া...... মাঝে মাঝে দেখলে মনে হয় কর্মীটি যেন মনিটরের উপর হামাগুড়ি খাচ্ছে..... সামান্য তথ্যের বিনিময়ে পার পাওয়াগেলে ভাল নইলে কেউ হয়তো ফোন করে ফিয়াটের বিভিন্ন সমস্যার জন্য আপনাকে গালাগালি করবে, কারো কাছে আপনি স্রেফ একজন চাকর যার কাজ দ্রুত, সুন্দর ভাবে এবং বাধ্যগত ভাবে তার প্রয়োজনটি মেটানো, কেউ হয়তো এত রেগে থাকবে যে আপনি তাকে কিছুই বোঝাতে পারবেননা আর কেউ হয়তো রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়ার ভিড় থেকে ফোন করবে যার একটি কথাও আপনি বুঝবেননা কিন্তু এদের প্রত্যেককে আপনার সন্তুষ্ট করতে হবে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই- নইলে সর্বক্ষণ মনিটর করতে থাকা টিমলিডার আপনার হাতে নোটিশ ধরিয়ে দেবে। টিম লিডারের কাজই হলো আপনাকে কন্ট্রোল করা। তাদের একটা প্রোগ্রাম থাকে যার মাধ্যমে তারা মনিটর করে কোন কর্মী ঘন্টায় কয়টা কল ধরল, গড়ে কতক্ষণ সময় প্রতিকলে ব্যয় করলো, কয়টা সমস্যা সমাধান করলো কিংবা কতক্ষণ অলস থাকার চেষ্টা করলো।

ফলে কল, কল আর কল---- মগজের ভেতর একটা কনভেয়ার বেল্ট ঘুরতে থাকে। একটা কল প্রসেস করার সাথে সাথেই আরেকটা কল তারপর আরেকটা। নির্মম এসিডি মেশিন কাউকে ফ্রি থাকতে দেয়না। কাজটা প্রচন্ড ক্লান্তিকর - যেহেতু একই কাজ আবার করতে হয়, যেহেতু কাস্টমাররা একই প্রশ্ন করতে থাকে আর আপনিও একই উত্তর দিতে থাকেন, যেহেতু একই সফ্‌টওয়ারের মাধ্যমে একই সিকোয়েন্সে আপনি তথ্য ঢোকাতে থাকেনঃ নাম, নম্বর, আরেকটা নম্বর, আরেকটা.... যেহেতু সারাক্ষণ আপনাকে মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়, যেহেতু মানুষকে বুঝতে এবং বোঝাতে আপনার বেগ পেতে হয়..... যতক্ষণ না শিফ্‌টের শেষ হয় আর আপনার মাথা ভনভন করতে থাকে এবং আপনার অবস্থা এমন হয় যে বাড়ি ফেরার বাসে বসে পত্রিকার পাতাতেও আপনি আর মনোযোগ রাখতে পারেননা। (১)

কলসেন্টারের কেন্দ্রীভবন ও আউটসোর্সিং
বিশ্বব্যাপি কলসেন্টারগুলো মূলত পশ্চিম ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র এবং এশিয়ার ভারত, ফিলিপাইন, শ্রীলংকা ইত্যাদি দেশে অবস্থিত। আমেরিকার কলসেন্টারে বলা হয় কয়েক মিলিয়ন কর্মী কাজ করছে, ব্রিটেনে অর্ধ মিলিয়ন, জার্মানী, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়ায় দেড় লক্ষ থেকে আড়াই লক্ষ। নব্বই দশকের আগপর্যন্ত ব্রিটেন এবং আয়ারল্যান্ডেই পশ্চিম ইউরোপের অধিকাংশ কলসেন্টার স্থাপিত হতো মূলত ইংরেজীভাষাভাষী কর্মীর প্রাচুর্যের কারনে। একইভাবে কোন একটি দেশের মধ্যেও কোন একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের বিশেষ সুবিধাকে কেন্দ্র করে কলসেন্টার গড়ে উঠে যেমন ভারতের দিল্লী বা মুম্বাই কিংবা ইংল্যান্ডের স্কটল্যান্ড, লন্ডন, ওয়েলস্ ও উত্তর ইংল্যান্ড ইত্যাদি।(২)
যেসকল কারনে কোন একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে কলসেন্টার গড়ে উঠে সেগুলো হলঃ
# পর্যাপ্ত এবং সস্তায় শ্রমিক প্রাপ্তি (উচ্চ বেকারত্ব, ছাত্র বেশী থাকে এরকম জায়গা)
# কাছাকাছি পূর্ব অভিজ্ঞতা কিংবা তথাকথিত কলসেন্টার ট্রেনিং সংস্থাথেকে ট্রেনিং পাওয়া শ্রমিকের প্রাপ্যতা
# কোন কোন অঞ্চলে কাঠামোগত সংস্কারের নামে করা শিথিল শ্রম আইন যেমন জার্মানীতে রবিবার এবং ব্যাংক হলিডেতে কাজের অনুমতি প্রদান
# অন্যান্য টেকনিক্যাল সরবরাহ যেমন যন্ত্রপাতি স্থাপন এবং রক্ষাণাবেক্ষণ ইত্যাদির সুবিধা কিংবা কাস্টমার যেমন বিভিন্ন মিডিয়া বা সফ্‌টওয়ার কোম্পানীর সহজলভ্যতা ইত্যাদি

তবে কলসেন্টার ব্যাবসায়ীরা মূলত উচ্চ বেকারত্বের হার এবং বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক এলাকা যেখানে সহজে এবং সস্তায় শ্রমিক পাওয়া যায় সেসব অঞ্চলকে পছন্দ করে। আবার যে কারনে কোন একটি অঞ্চলে কলসেন্টার স্থাপিত হয় ঠিক সেই কারনেই সেটি অন্যত্র স্থানান্তরিত হয়ে যায়। আর কে না জানে, মিল-কারখানা কিংবা খনির চেয়ে কলস্থানান্তর কত সহজ; যে কোন কলকেই খুব সহজেই এক স্থান থেকে অন্যস্থানে পাঠিয়ে দেয়া যায়- কাষ্টমার বুঝতেই পারেনা সে ঠিক কোন অঞ্চলের কর্মীর সাথে কথা বলছে-কেননা ট্রেনিং এর একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো বাচন থেকে আঞ্চলিকতার বিলোপ।

আউটসোর্সিং বিভিন্ন ভাবে কাজ করেঃ
# কাস্টমারদের সব কলই পাঠিয়ে দেয়া হয় এঙ্টার্নাল সার্ভিস প্রদান কারী কোন কলসেন্টার কোম্পানীতে।
# সাধারন জিজ্ঞাসা মূলক কলগুলোকে আউটসোর্সিং করে দেয়া হয় কিন্তু গুরুত্বপূণ কলগুলোকে নিজস্ব কলসেন্টার বা কাস্টমার কেয়ার সার্ভিসের কাছে পাঠানো হয়।
# নিজস্ব কলসেন্টার কাজ করে শুধু সপ্তাহের কাজের দিনগুলোতে এবং অফিস আওয়ারের মাঝে। এর বাইরের সময়ের কলগুলো সামলায় ভিন্ন টাইম জোনে অবস্থিত কোন দেশের কলসেন্টারের সস্তা শ্রমিকেরা।

এরকম বিভিন্ন ধরনের আউটসোর্সিং বিগত কয়েক দশক ধরে দেখা গিয়েছে। বিশেষ করে আউটসোর্সিং শুরু হয় তখনই যখন দেখা যায় দেখা যায় নিজস্ব কলসেন্টার কিংবা কোন একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের এঙ্টার্নাল কলসেন্টারের শ্রমিকের মজুরী বাড়াতে হচ্ছে। যেমনঃ

# নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে ব্রিটিশ এয়ার ওয়েজ তাদের কলসেন্টারটি দক্ষিণ লন্ডন থেকে গ্লাসগোতে স্থানান্তôর করে দেয় যার মূল কারণ ছিল মজুরী।
# নব্বই দশকের শেষের দিকে শোনা যেতে থাকে যে আমেরিকান কোম্পানীগুলো ভারতীয় কলসেন্টার দিয়ে তাদের কাস্টমার সার্ভিস চালিয়ে নিচ্ছে যেমনঃ জিই ক্যাপিটাল(ফাইনান্স) কিংবা আমেরিকান এপ্রেস(ক্রেডিট কার্ড ) ইত্যাদি।
# স্প্যানিস টেলিকম কোম্পানী টেলিফোনিকার সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান এতেন্তেôা টেলিকমিউনিকেশান ২০০১ সালে তাদের কলসেন্টার স্থাপন করে মরোক্কতে কেননা সেখানে প্রচুর স্প্যানিশ ভাষী শস্তôা শ্রমিক রয়েছে।
# একই ভাবে জার্মানীতে ডাক সরবরাহকারী কোম্পানী অট্টো হুমকী দেয় যে এসেন এর কমীরা যদি ৫০০ ডয়েস মার্ক মজুরী হ্রাস মেনে না নেয় তাহলে তারা তাদের কলসেন্টারটিকে পূর্ব জার্মানীতে সরিয়ে নেবে। অন্যদিকে পূর্ব জার্মানী থেকে কলসেন্টারগুলো সরে যায় পশ্চিম পোল্যান্ডে।

কলের পর কল-বাড়ে শ্রমের মাত্রা, গড়ে উঠে মুনাফার পাহাড়
“অফিসে মাত্র ঢুকেছি। পিসিতে লগইন করে বসা মাত্রই টিম লিডার হাতে একটি কাগজ ধরিয়ে বললঃ ‘এই নাও তোমার গতকালকের পরিসংখ্যান। তুমি নির্ধারিত সীমার চেয়ে একমিনিট পচিঁশ সেকেন্ড বেশী বিরতি নিয়েছ।’ আমি মনে মনে বলছি মহিলা মরেনা কেন! কিন্তু এটা কেবল শুরুঃ ‘তাছাড়া তোমার অপ্রস্তুত থাকার সময় অন্যান্য এজেন্টদের চেয়ে ১০% বেশী আর তুমি গড়ে প্রতি ঘন্টায় ২০টি কলের টার্গেট ও ধরতে পারনি। কাজেই তুমি আর বোনাস পাচ্ছনা।’ মহিলা চলে যাচ্ছে না কেন যেন আমি এক কাপ কফি খেতে পারি? কিন্তু তিনি বলেই চলেছেনঃ ‘আমরা তোমাকে সাহায্য করবো। আগামীকাল তোমার ট্রেইনার এসে তোমার কথোপকথন শুনবেন এবং তোমাকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেবেন।’ ট্রেইনার আসবে! অসহ্য! সে আবারও ঘ্যান ঘ্যান করবে কাস্টমারের সাথে কথাবলার সময় আমার হাসির অনুপস্থিতি নিয়ে এবং পরামর্শ দেবে কথার মাঝে আমি যেন ’সমস্যা ’ শব্দটি যেন উচ্চারণ না করি.......।” (৩)

কলসেন্টারে কাজের স্ট্রেস বা চাপের দুটি ধরন আছেঃ
১। কাজটি একঘেয়ে যেহেতু একই কাজ বারবার করতে হচ্ছে
২। কাজটি প্রচন্ড কষ্টকর যেহেতু একের পর এক কাজ আসতেই থাকে

এই দুটি ক্ষেত্রেই পুঁজিপতির একটি মাত্র উদ্দেশ্য কাজ করে। আর তা হলো কাজকে যতটা সম্ভব উৎপাদনশীল ও লাভজনক করে তোলা যায়। এই উদ্দেশ্যে সে কাজকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে ফেলে এবং প্রত্যেক কর্মীকে ছোট্ট একটি ভাগের দ্বায়িত্ব দেয়। শ্রমিকের কাজকে পর্যবেক্ষণ এবং কাজের সময় পরিমাপের মাধ্যমে এই ছোট কাজগুলোকে ভালো করে বিশ্লেষণ করা হয় এবং একটা নির্দিষ্ট সিকোয়েন্স বা পর্যায়ক্রমও ঠিক করে রাখা হয়। কলসেন্টারে এটা করা হয় কল হ্যান্ডল করার প্রক্রিয়াটিকে কয়েকটি নির্ধারিত পর্যায়ে বিভক্ত করা এবং কলার বা কাস্টমারের সাথে কথা বলার প্রমিত বাগধারা বা স্টান্ডার্ড ফ্রেজ ঠিক করে দেয়ার মাধ্যমে। এই ভাবে কলসেন্টারগুলোতে কাজকে পরিমাপ এবং তুলনাযোগ্য করে তোলা হয়- যা কলের নির্দিষ্ট ছন্দ নির্ধারন করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ(যেমনঃ প্রতি ঘন্টায় ২০টি কল করতে হবে বা ধরতে হবে)।

শ্রমের মাত্রা বৃদ্ধি করার জন্য মালিকেরা আরেকটা জিনিস ব্যবহার করে তা হলো টেকনোলজি। এরা সেই টেকনলজিই ব্যবহার করে যার মাধ্যমে একাধারে শ্রমের মাত্রা বাড়ানো এবং শ্রমিককে নিয়ন্ত্রণ দুটোই করা যায়। কম্পিউটার এবং টেলিফোনের সংযোগের ফলে কলের ছন্দ দ্রুত করা এবং শ্রমিককে কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা দুটোই সম্ভব হয়েছে (কলের পরিমাণ, বিরতি, সময় ইত্যাদি পরিসংখ্যানের মাধ্যমে)। নির্দিষ্টি সফ্‌টওয়ার ব্যবহারের মাধ্যমে কাজের ক্রমধারা স্থির করা সম্ভব হয়েছে কেননা এর বাইরে গেলেই সফ্‌টওয়ার কাজ করবেনা। এসিডি মেশিনের ব্যবহারের ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফোন সরাসরি কর্মীর কাছে চলে আসে- কর্মীকে ম্যানুয়ালি ফোন রিসিভও করতে হয়না। এইভাবে ম্যানেজমেন্ট কলগ্রহণের পরিমাণের উপর থেকে কর্মীর নিয়ন্ত্রণ সরিয়ে দিয়েছে। এতো গেল ইনকামিং কলের কথা। আউটগোয়িং কলের ক্ষেত্রেও রয়েছে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত পাওয়ার ডায়ালিং যার মাধ্যমে কর্মী একটি কল শেষ করে নিঃশ্বাস নেয়ার আগেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে আরেকটি কল করা হয়ে যায়। জার্মানির একটি কলসেন্টার শ্রমিকের অভিজ্ঞতা শোনা যাকঃ
“আমি কোয়েলেতে কাজ করি আর প্রতিদিন লক্ষ করি কেমন করে তারা আমাদের ৮ ঘন্টার কাজকে যত বেশী সম্ভব শ্রমঘন করার চেষ্টা করে। তারা ২০০০ সালের জুলাই মাস থেকে নির্দিষ্ট প্রমিত বাক্যাংশ ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক করেছে এবং এর জন্য আমাদের উপর নজরদারীও করে। শুধু বাইরে থেকে আসা কলই নয় তারা নিজেরাও সময় সময় আমাদের পারফরমেন্স পরীক্ষার জন্য কল করে। এরপর এগুলো দলগত ভাবে বিশ্লেষণ করা হয় এবং আমাদের সামনে ডকুমেন্টেশান করা হয়। আমাদের নিজেদের ক্যাসেট প্লেয়ার মনে হওয়া দিয়ে তাদের কিছুই যায় আসে না। আর আমাদেরকে বলা হয় আমরা যেন আমরা যেন কোয়ালিটি রক্ষা করি, কাস্টমারকে প্রয়োজনীয় সময় দেই, কথপোকথনের সময় একটা উষ্ণ পরিবেশ তৈরী করি এবং সবসময় যেন কন্ঠে সেই নন্দিত হাসির ছোঁয়া ধরে রাখি। কোয়ালিটি ম্যানেজাররা এগুলো দিয়েই আমাদের পারফরমেন্সের মূল্যায়ন করে। সুতরাং আমাদেরকে প্রমিত বাগধারা ব্যবহার করতে হবে, সর্বোচ্চ গুনাগুন রক্ষা করতে হবে এবং একই সাথে ঘন্টায় গড়ে ২২টি কলের টার্গেট ছুঁতে হবে। এরপরও চাপে ভেঙে না পড়ার কোন কারণ আছে?”(৪)

মানব সম্পদের কি দারুণ ব্যবহার!
ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয় থেকে মৃত্তিকা বিজ্ঞানে মাষ্টার্স পাশ করা আমার এক বন্ধু অনেক দিন বেকারজীবনের অভিশাপ বহনের পর অবশেষে সিটিসেলের কলসেন্টারে চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে তার বেকারত্বে অভিশাপ মোচন করে। কলেজ জীবনে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিযোগীতায় কবিতা আবৃত্তিতে তাকে কখনও দ্বিতীয় হতে দেখিনি। তার সুললিত কণ্ঠ আর শুদ্ধ বাচন ভঙ্গিমার কি দারুন ব্যবহার সে এখন করতে বাধ্য হচ্ছে! আরেক বন্ধু ইতিহাসে অনার্স পাশ করার পর চাকরী করছে গ্রামীণ ফোনের কাস্টমার কেয়ার ডিপার্টমেন্টে কাস্টমার ম্যানেজার হিসাবে- ম্যানেজার হলেও কাজ কিন্ত একই- অভিনয় এবং আবৃত্তিতে অর্জিত দক্ষতা দিয়ে ফোনের অপর প্রান্তের রাগী কাস্টমারকে ম্যানেজ করা। তালিকা আরও বড় করা যায়। কিন্তু সব ক্ষেত্রেই চিত্রটি মোটামোটি একই। পুঁজিপতিরা নাকি মানুষকে সম্পদ হিসাবে ভাবতে ভালবাসে- অবশ্য ততক্ষণ পর্যন্তই, যতক্ষণ পর্যন্ত তার দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতাকে মুনাফার পাল্লায় পরিমাপ করা যায় এবং লাভজনকভাবে বিক্রি করা যায়। আর এই কেনা-বেচার খেলায় ‘বেচারা সম্পদ’ তার প্রকৃত মূল্য হারিয়ে কখন যে হাতুড়ি বা স্ক্রু-ড্রাইভারের মত স্রেফ একটা সরল যন্ত্রে পরিণত হয়, যাকে খুব সহজেই আরেকটা দিয়ে প্রতিস্থাপন করা যায়! পুঁজিবাদী অর্থনীতির এ সাধারণ চিত্র সবচেয়ে বেশী প্রকট মনে হয় যখন দেখি আমার সেই বন্ধুদের মত অসংখ্য মেধাবী তরুণ-তরুণী উচ্চশিক্ষা অর্জনের পর কিছু অর্থের বিনিময়ে স্রেফ কথা বলে বলে তার,মেধা ও জীবনি-শক্তির অপচয় করতে বাধ্য হচ্ছে। এই বন্ধুদের আমি যখনই ফোন করেছি দুই মিনিট কথা বলার জন্য আমাকে কমছেকম দশমিনিট লাইনে থাকতে হয়েছে- কেননা একটু পরপরই কাস্টমারের ফোন এসে বাগড়া দেয়। এখানে যেসব কম্পানির নাম উল্লেখ করেছি সেগুলো সহ বাংলাদেশের ব্যাংকিং, হাসপাতাল, টেলিযোগাযোগ ইত্যাদি যেসব খাতে কলসেন্টার চালু রয়েছে তার সবগুলোই কিন্তু ইনহাউস অর্থাৎ কোম্পানির নিজস্ব কলসেন্টার-এদের মুনাফার মূল উৎস কলসেন্টার নয়, কলসেন্টার মুনাফা অর্জনে সহায়ক মাত্র। তাতেই যে অবস্থা, বুঝতে খুব একটা কষ্ট হয়না বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ রেগুলেটরি কমিশান (বিটিআরসি) কতৃক যে কোম্পানিগুলোকে কলসেন্টারের লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছে এবং লাইসেন্স পাওয়ার পর বিভিন্ন ওয়েবসাইটে সস্তা! সস্তা! বলে যে প্রচারণা এরা শুরু করেছে , এসব কলসেন্টারের অবস্থা কেমন হবে।

বর্তমানে বাংলাদেশে যেমন কলসেন্টারকে কর্মসংস্থান এবং বৈদেশিক মুনাফা অর্জনের একটি নতুন উপায় হিসাবে উপস্থাপনের চেষ্টা চলছে, আজ থেকে ঠিক ১৫ বছর আগে ভারতেও ঠিক একই প্রচেষ্টা হয়েছে। প্রাথমিক উচ্ছ্বাস কেটে যাওয়ার পর আজ যখন কলসেন্টার,সেখানকার কাজের পরিবেশ, কর্মীর উপর তার প্রভাব ইত্যাদির দিকে তাকানো শুরু হয়েছে, ততদিনে পুরো একটা প্রজন্ম কখনও ভোর, কখনও বিকাল, কখনও বা মধ্যরাত্রির শিফ্ট ডিউটি পালন করতে করতে, একটার পর একটা ফোনের চাপ সহ্য করতে করতে, একঘেয়ে কাজ একটানা করতে করতে...... কানে এবং মস্তিস্কে নিদারুণ ক্ষত সহ, তিরিক্ষি মেজাজ ধারনকারী, খিটখিটে, অসহিষ্ণু, অস্থির ও অমনোযোগী একটা সমাজ-বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি ভারতের শ্রমমন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে ভি•ভি গিরি জাতীয় শ্রম সংস্থা কলসেন্টার সম্পর্কিত একটি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে।(৫) গবেষণা রিপোর্টে কলসেন্টারে কাজ করা তরুণ-তরুণীদের স্রেফ সাইবার কুলি হিসাবে অভিহিত করে বলা হয়ঃ “এই কলসেন্টার এজেন্টদেরকে সার্বক্ষণিক মনিটরিং এর মধ্যে এমন একটি জঘন্য পরিবেশে কাজ করতে হয় যার সাথে কেবল ঊনবিংশ শতকের কয়েদখানা কিংবা প্রাচীন রোমক দাস-জাহাজের পরিবেশের তুলনা চলে..... এখানে ক্যাফে, পপকর্ণ বুথ কিংবা পিংপং টেবিল ইত্যাদি আয়োজনের মাধ্যমে একদিকে কাজকে আনন্দায়ক বলে অভিহিত করার চেষ্টা করা হয় অন্যদিকে প্রতি ঘন্টায় ইমেইল বা কলকরা বা গ্রহণ করার হার এমন উঁচু মাত্রায় বেঁধে দেয় হয় যার ধারে কাছে পৌঁছতে গিয়েও কলসেন্টার এজেন্টটিকে নিজেকে নিঃশেষ করে দিতে হয়।” রিপোর্টটিতে বিনিতা রাওয়াত নামের ইংরেজী সাহিত্যে মাষ্টর্স এক তরুণীর কথা তুলে ধরা হয় যে মনে করে রবার্ট ব্রাউনিং কিংবা জেন অস্টিনকে বোঝার মাধ্যমে ব্রিটিশ সোসাইটি সম্পর্কে তার একটি অন্তদৃষ্টি তৈরী হয়েছে যা সে তার থেকে ৪০০০ মাইল দুরের কোন ব্রিটিশ কাস্টমারকে ম্যানেজ করতে কাজে লাগাতে পারে। বিনিতার মত উচ্চশিক্ষিত কর্মীরাই কলসেন্টারগুলোতে কাজ করছে। এ বিষয়ে রিপোর্টটি বলা হয়ঃ “বিনিতা ভারতের সাইবার কুলিদের প্রাইম উদাহরণ- জনগণের অর্থে ব্যায়বহুল শিক্ষায় শিক্ষিত একজন উচ্চমেধার গ্রেজুয়েট, যে কলসেন্টার ইনডাস্ট্রির জন্য নিজেকে নিঃশেষ করা এবং বুদ্ধিহীন পুনরাবৃত্তিমূলক একটি কাজ করার মাধ্যমে নিজের মেধার অপচয় করছে।” রিপোর্টটিতে কাজের ধরণ এবং চাপ সম্পর্কে বলতে গিয়ে জামিনী নামের ২০বছর বয়সী একতরুণী যে কিনা এইচ.সি.এল নামের একটি কলসেন্টার কোম্পানীতে কাজকরে, তাকে উদ্ধৃত করা হয়েছেঃ “কাজের কঠিন চাপ। এত বিপুল পরিমাণ কল আসে যে আমরা নিঃশ্বাস নেয়ারও সময় পাইনা অথচ কাস্টমাররা প্রায়ই বিরক্ত যে তাদেরকে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছে। ঘন্টাগুলো ভাগ করা। যদি আপনার বাথরুম চাপে, তবে আপনার জন্য বরাদ্দকৃত পিরিয়ড আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আমার বাবা মা চান যেন আমি এ কলসেন্টারের চাকুরী ছেড়ে দেই কেননা তারা দেখছেন কেমন করে আমার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ছে।” শুধু ভারত নয় শ্রীলংকা, নেপাল, ফিলিপিন সব দেশেই একই অবস্থা। তরুণ-তরুণী কাজে যোগ দেয়ার পর ভীষণ কাজের চাপ, উচ্চ শ্রম-শোষণ আর হতাশার কারণে যারা পারে তারা দ্রুতই অন্যত্র চলে যায়। যেমনঃ নেপালের কাঠমুন্ডুতে বসবাসকারী তরুণ সঞ্জয় দাস। সে চার বছর ধরে কাঠমুন্ডুর বিভিন্ন কলসেন্টারে কাজ করার পর অবশেষে গত বছর চাকুরী ছেড়ে দিয়েছে। সঞ্জয়, যে একজন সুপারভাইজার হিসাবে মাসে ২০,০০০ রূপী বেতন পেত, বলেছে, শতকরা আশিভাগেরও বেশী নতুন যোগদানী তরুণ কয়েক মাসের মধ্যেই চাকুরী ছেড়ে দেয়। নেপালী তরুনরা কলসেন্টারে কাজ করে মাসে ৬,০০০ থেকে ৪০,০০০ রূপী পর্যন্ত অর্জন করতে পারে। কলসেন্টারের কাজের পরিবেশ সম্পর্কে সঞ্জয়ের বক্তব্যঃ “এখানে ঢোকা মাত্রই আপনি টের পাবেন এটা ঠিক স্বাভাবিক পরিবেশ নয়.... বেতনটা ভাল পেলেও তার বিনিময়ে স্বাস্থ্যটা আপনাকে ত্যাগ করতে হবে.....।” সঞ্জিবের মতো মাসে ২০,০০০ রূপী বেতনভোগী একজন সুপারভাইজারের কাছে বেতন ভালো মনে হলেও ২১ বছর বয়সী সুশান্ত কৈরালা, যে কাঠমুন্ডুর রেড ক্যারিয়টে ৪ মাস কাজ করেছে, তার অভিজ্ঞতা কিন্তু অন্য কথা বলেঃ “লোভনীয় অফার দেখে চাকুরীতে ঢুকি। কিন্তু প্রতিশ্রুত বেতন না পেয়ে চাকুরী ছেড়ে দিয়েছি। তারা আমাকে ৬,০০০ রূপী দেবে বললেও বাস্তবে দিচ্ছিল মাত্র ৪,০০০ রূপী করে.....”(৬)

পুঁজির ধর্মঃকলসেন্টার স্থাপনের ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা
একটি কলসেন্টার যেভাবে কাজ করে তা কোন দুর্ঘটনা নয়, কোন মহাপরিকল্পনার ফসল নয় কিংবা নতুন নতুন কর্মসংস্থান তৈরীর জন্য মহান পুঁজিপতিদের কোন প্রকল্পও নয়। বরং বিগত কয়েক দশকের ক্রমহ্রাসমান মুনাফার হার, শ্রেণী সংগ্রাম এবং পুঁজির আপন ধর্মের প্রতিক্রিয়ায় এর উদ্ভব। উদাহরণ স্বরূপ আমরা যদি ব্যাংকিং সেক্টরের দিকে তাকাই তাহলে দেখবো যে ব্যাংকিং সেক্টরে কলসেন্টার মানে হলো শ্রমিকের নির্দিষ্ট ধরনের ব্যাবহার এবং অবস্থান ভেঙ্গে ফেলার মাধ্যমে শোষণের হার বৃদ্ধি করণ। একজন ব্যাংকারকে ট্রেনিং দেয় বেশ সময় এবং খরচ সাপেক্ষ ব্যাপার।আবার ব্যাংক কর্মীর দক্ষতা যত বাড়তে থাকে তার দাবীদাওয়া এবং উচ্চাশাও তত বাড়তে থাকে। যেকারণে ব্যাংকিং সেক্টরের মজুরী বেশ বেড়ে যায় এবং কাজের উপর ব্যাংক কর্মীদের নিয়ন্ত্রণও বেশ জোরদার হতে থাকে। আশির দশকের শেষে এবং নব্বই দশকের গোড়ারদিকে ইতালি, জার্মানি এবং আরো অন্যান্য দেশে লাগাতার ধর্মঘটের মাধ্যমে শোষণের হার বাড়ানোর জন্য ইতিপূর্বে নেয়া বিভন্ন পদক্ষেপ যেমন মজুরী হ্রাস, শ্রমের আরো বিভাজন কিংবা কাজের ইন্টেনসিটি বা মাত্রা বাড়ানোর পদক্ষেপ বেশীদূর যেতে পারেনি।

এধরনের দক্ষ শ্রমিকের ক্ষমতা কমানোর জন্য শুরু করা হলো কাজের নতুন ধারাঃ ব্রাঞ্চ অফিস। এসব কলসেন্টারে একজন দক্ষ শ্রমিকের কাজকে বেশকয়েকজন কলসেন্টার কর্মীর মাঝে ভাগকরে দেয়া হলো। এক্ষেত্রে একজন কর্মীকে তার নির্দিষ্ট কাজটি শেখাতে সময় লাগে এক বা দুসপ্তাহ কেননা কাজের সম্পূর্ণ প্রসেসটিকে ভেঙে কয়েকটি সরল ধাপে ভাগকরে এক একেজন কলসেন্টার কর্মীকে তা শেখানো হয়। এই পদ্ধতিতে পুঁজিপতির পক্ষে শ্রমের মাত্রা বা ইন্টেনসিটি বাড়ানো (বিভিন্ন নতুন টেকনোলজি ব্যবহারের মাধ্যমে) সম্ভব হলো এমন পর্যায়ে যেখানে একদিনে একজন কলসেন্টার কর্মী শতশত কাস্টমাররের একাউন্ট ইনফরমেশান প্রদান করে। পুঁজিপতিরা এভাবে একদিকে কলসেন্টারের কাজকে ‘অদক্ষ’ ও ‘হালকা’ বলে কম মজুরী প্রদান করে, অন্যদিকে শ্রমের মাত্রা বৃদ্ধির মাধ্যমে শোষনের হার বৃদ্ধি করে চলে। কলসেন্টারগুলোকে ’ব্যাটারি কারখানা’ এবং ‘কমিনিউকেশান এসেম্বলি লাইনে’র সাথে তুলনা করা হয়ে থাকে। এই তুলনা এসেছে শ্রমিকের প্রতক্ষ অভিজ্ঞতা থেকেঃ শব্দময় বড় বড় অফিস, কল প্রতি পিস রেট, কাজের চাপের ধরণ ইত্যাদি কারণে।

তথ্যসূত্রঃ
১) hotlines - call centre,2002
http://www.nadir.org/nadir/initiativ/kolinko/lebuk/e_lebuk.htm
২) ঐ
৩) ঐ
৪) ঐ
৫) Painful truth of the call centre cyber coolies, Graduates burnt out by dreary work, unsocial hours and Big Brother-style observation - all at the end of your telephone
http://www.guardian.co.uk/business/2005/oct/30/india.internationalnews
৬) Call centre workers: a disillusioned lot, By Baburam Kharel
http://mycyberguru.net/portal2/c1ee8c4417f04b630117f685ee99018e.do.html


মন্তব্য

রণদীপম বসু এর ছবি

খুবই চমৎকার একটি লেখা পড়লাম। বিশেষ করে কল সেণ্টার সার্ভিস বা ব্যবসাটি সম্পর্কে আমার পূর্বতন ধারণাটা বেশ ভালোই ধাক্কা খেলো।
এজন্যেই কি 'দিনমজুর' নিক ধরেছেন ?
আসলে আমরা এখন এমন একটা সময়ে হাঁটছি, না বলে দৌঁড়ছি বলাটাই শ্রেয়, যখন আমরা কেউ মুক্তবাজার ব্যবস্থার প্রোডাক্ট, কেউ বা বাই-প্রোডাক্ট। এবং কখনও কখনও ওয়াস্টও !

আপনার লেখার স্টাইল আর বিশ্লেষণটাও চমৎকার লাগলো।
অভিনন্দন জানাচ্ছি আপনাকে। বেশি বেশি লিখুন।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

চমৎকার লাগলো লেখাটি। কলসেন্টারের অনেক বিষয় উঠে এসেছে লেখাটিতে।

বিটিআরসি যে ভাবে মুড়ি-মুড়কির মতো কলসেন্টারের লাইসেন্স দেবে বলেছে, তাতে করে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটা কতটুকু সফল হবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। বিদেশী ক্লায়েন্ট পাওয়া তো অন্যতম পূর্বশর্ত। এরপরেও মান নিয়ে কথা থেকেই যায়। এইসব কলসেন্টারে হয়তো প্রাইভেট ভার্সিটির ইংরেজি জানা ছেলেমেয়েদের রমরমা অবস্থা হবে, কিন্তু আপনার লেখা পড়ার পর আমার মনে হয় না, এরা সেভাবে চাপ নিতে পারবে।

আমার পরিচিত বেশ কয়েকজন বিটিআরসি'তে কলসেন্টার লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছিল। ভাবছি তাদেরকে আপনার লেখাটা দেখাবো, যাতে করে তারা দ্বিতীয়বার ভেবে দেখে বিষয়টা!

নিয়মিত লিখুন।
_______________
বোকা মানুষ মন খারাপ

দিনমজুর এর ছবি

অতিথি লেখক হিসাবে আমার কয়েকটি লেখা সচলায়তনে প্রকাশিত হয়েছিল। সেগুলো আমার এই ব্লগটিতে (দিনমজুর নিকের) আনার উপায় কি?

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

উদ্ধৃতি:
পুঁজিপতিরা এভাবে একদিকে কলসেন্টারের কাজকে ‘অদক্ষ’ ও ‘হালকা’ বলে কম মজুরী প্রদান করে, অন্যদিকে শ্রমের মাত্রা বৃদ্ধির মাধ্যমে শোষনের হার বৃদ্ধি করে চলে।

- দাসপ্রথা বহু আগে বিলুপ্ত হলেও মালিকদের মানসিকতা একটুও বদলায়নি।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

অতিথি লেখক এর ছবি

বিশ্লেষণটা চমতকার ।
নিবিড়

সাকিব এর ছবি

অসাধারন লিখা!!!!!!!!!!

অভ্রনীল এর ছবি

আমিও কেবল নাম শুনেই এসেছি... আসলে কীভাবে কলসেন্টারগুলো কাজ করে তা আপনার লেখা থেকে জানলাম।

এখন তো আবার দেশে কলসেন্টারের হুজুগ... পরিচিত অনেকেই দেখি কল সেন্টারের লাইসেন্সের জন্য হন্য হয়ে ঘুরছে...

_________________________________
| নাদানের ছোট্ট জগৎ |
auto

যুবরাজ এর ছবি

লেখাটা খুব মন দিয়ে পড়লাম। ভালো লেগেছে। বেশি বেশি করে লিখুন। আরেকটা কথা, আপনি কি মিলানের বাসিন্দা? আপনার শহরে আসছি আমি অতি শীঘ্রই।

হাতের কাছে ভরা কলস, তবু তৃষ্ণা মিটেনা।
----------------------------------------------------------------------------

দিনমজুর এর ছবি

নারে ভাই________, বাংলাদেশের বাসিন্দা, বাংলাদেশেই থাকি_____, বাংলাদেশ থেকেই ব্লগাই।

রানা মেহের এর ছবি

বেশ ভালো তথ্যবহুল লেখা দিনমজুর।

-এই বন্ধুদের আমি যখনই ফোন করেছি দুই মিনিট কথা বলার জন্য আমাকে কমছেকম দশমিনিট লাইনে থাকতে হয়েছে- কেননা একটু পরপরই কাস্টমারের ফোন এসে বাগড়া দেয়। -

এ লাইনগুলো আমাকে একটু ধাধায় ফেলে দিয়েছে। আপনি কি তাকে ওয়ার্কিং আওয়ারে ফোন করেছিলেন? যদি তাই হয়ে থাকে তবে তাকে তো ব্যাক্তিগত কাজ বাদ দিয়ে অফিসিয়াল কলই ধরা উচিত। তাই নয় কি?

কলসেন্টারের কাজ খুবই একঘেয়ে ক্লান্তিকর, কোন সন্দেহ নেই।
কিন্তু ঠিক একই স্যালারি স্কেলের কিছু কাজ কলসেন্টার থেকেও বাজে হয়। তাদের নিয়েও লিখুন
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

দিনমজুর এর ছবি

আপনার আলোচনার শুরু অনেকটা এভাবে,

তবে শুধু অন্ধকার দিকটা দেখলে মনে হয় আলোচনা পূর্ণ হয় না।

পুরো মন্তব্য পড়ে আলোর দিক যা যা পেলাম সেগুলো হচ্ছেঃ
সেন্টারের ফলে শ্রমের বিশ্বায়ন হচ্ছে সেটা ভুলে গেলে তো চলবে না। গরীবদেশে কাজ আসতো না, এখন ভালোই কাজ আসছে, ছেলেমেয়েরা অন্তত করে খাবার একটা সুযোগ পাচ্ছে, এই বিষয়টা অস্বীকার করা ভুল।____
এই "শিক্ষিত" বেকার যুবসমাজের গতি তাহলে কি? এরা তো আর রিক্সাচালানো শুরু করতে পারেনা... কলসেন্টার অনন্ত একটা সম্মানের জায়গা দিতে পারে।

আপনার এণ্ডিং এ জানিয়েছেন,
কলসেন্টারকে প্যানাশিয়া না ধরে একটা স্টেপিং স্টোন হিসাবে দেখাই ভালো..

আপনার গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার জন্য অনেক ধন্যবাদ, যদিও আমি আপনার সাথে দ্বিমত পোষণ করি। আপনার আলোচনা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, আপনার এই যুক্তিগুলোই আমাদের এখানে বা দেশে দেশে (বিশেষত তথাকথিত ডেভলোপিং দেশগুলোতে) কলসেন্টার নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখে, সে হিসাবে বলা যায়- আপনার এই যুক্তিগুলো পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ায় প্রচারিত দৃষ্টিভঙ্গীরই প্রতিচ্ছবি। কিছুটা আলোচনা করি- আপনার কথিত আলোর দিকসমূহ নিয়ে_____

প্রথম এবং একমাত্র দাওয়াই- যেটা আমার মূল লেখাতেও এসেছে, সেটা হলো কর্মসংস্থান। কলসেন্টার এখানে আসলে কর্মসংস্থান হবে। সেই কর্মসংস্থানের কথা বলেছেন- দুটো বিশেষ পার্সপেক্টিভ (শ্রমের বিশ্বায়নের মাধ্যমে কর্মসংস্থান এবং শিক্ষিত বেকারের কর্মসংস্থান) থেকে। কর্মসংস্থান নিয়েই আগে কিছু বলা দরকার। আজকের পুঁজিবাদী দুনিয়ায়, বেকার সমস্যা তথা কর্মসংস্থানের সংকট- এর প্রকৃত কারণ কি, মুক্ত হওয়ার উপায় কি? সেটি যদি বিবেচনায় না আনি- তবে আমাদের আলোচনা, চিন্তাভাবনা সবেতেই পুঁজিবাদী শাসকগোষ্ঠীর চিন্তাভাবনা প্রকাশটাই প্রধান থাকতে বাধ্য। আজ কেন শিক্ষিতরা (বেকবেঞ্চার বা ফ্রন্টবেঞ্চারেরা) বেকার, কেন তারা সম্মানজনক কাজ পায় না- এ প্রশ্নকে এড়িয়ে গিয়ে মলম লাগিয়ে ব্যাথার উপশম পাওয়ার মত করে যদি বলা হয়ঃ কলসেন্টার হলে তো কিছু শিক্ষিত যুবক অন্তত সম্মানজনক কাজ পাবে- তখন সেটা পশ্চাদ্দেশে নিয়ত বেম্বু প্রবেশকে স্বীকার করে নেয়া ছাড়া আর কিছু হয় না বলেই মনে হয়।

কৃষি অর্থনীতিকে ধ্বংস করলে, নিজস্ব শিল্প গড়ে না তুললে, স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনীতি না গড়ে তুললে- ভিক্ষাবৃত্তির মনোভাব দিয়ে কোনদিনই কর্মসংস্থানের সংকট মেটানো যাবে বলে মনে হয় না। অন্যের শিল্প, অন্যের কাজের উপর নির্ভরশীল থেকে আপাত কিছু মানুষের কর্মসংস্থান- কখনোই দেশের বেকার সমস্যা দূর করতে পারবে না। বিদেশী বিনিয়োগের পক্ষেও একই যুক্তি করা হয়েছে, এইসব কামলা ধরণের কাজ আমদানীর ক্ষেত্রেও একই কথা বলা হচ্ছে। আসল সত্য হচ্ছে, এসবে কিছু হয়নি- হবেও না। বিদেশী বিনিয়োগের ফলে- এখানে কিছু টেকনোক্রেট তৈরী হয়েছে, কিছু মধ্যবিত্তের যথেস্ট সম্মানজনক চাকুরি তৈরি হয়েছে ঠিকই- কিন্তু তা দেশের অর্থনীতিতে কোন ভূমিকাই রাখতে পারেনি (যা রেখেছে তা নেগেটিভ ভূমিকা!)। টেলিকম সেক্টর- এনার্জী সেক্টরে বিদেশী বিনিয়োগে যে কর্মসংস্থান হয়েছে তাতে আমাদের বেকারের সংখ্যা কি উল্লেখযোগ্য কমেছে? বরং, আমাদের এই কর্মহীন মানুষের প্রতিবছরই বাড়ছে!

কর্মহীনের সংখ্যা এই বাড়ার কারণ কিন্তু- আমাদের শিল্প গড়ে না তোলা- উল্টো শিল্প গুলো ধংস করে দেয়া। কর্মসংস্থানের কথা যদি বলেন- তবে সেদিকটাতে লক্ষ দেয়ার কথাই বলবো। আর যদি- শিক্ষিতদের সম্মানজনক কাজের কথাও বলেন- সেক্ষেত্রেও বলবো- দেশীয় শিল্পের বিকাশের কথা, কেননা সেখানে আমাদের অসংখ্য প্রকৌশলী - অসংখ্য উচ্চ শিক্ষিত লোকের দরকার আছে। বর্তমানে যে পরিমাণ শিক্ষিত বেকার আছে, তার চেয়েও বেশী দরকার হবে সে সময়টিতে।

এ বিষয়টি মাথায় রেখে আপনার আলোচনায় চোখ দেই:___

প্রথমে শ্রমের বিশ্বায়নের কথা তুলেছেন। তারপরে বলেছেন, শিক্ষিত (ব্যাকবেঞ্চার)দের সম্মানজনক(!) কর্মসংস্থানের কথা।
মূল লেখাটির কোথাও শ্রমের বিশ্বায়নকে অস্বীকার করা হয়নি। শুধু প্রশ্নতোলা হয়েছে পুজির বিশ্বায়নের তাগিদে এই যে শ্রমের বিশ্বায়ন হচ্ছে তার উদ্দেশ্য ও ধরনটা কি এবং এর ফলে যেরকম দাবী করা হচ্ছে সেরকম উন্নত কর্ম সংস্থান হচ্ছে কিনা? যেসব দেশ থেকে শ্রম আউটসোর্স হয়ে আমাদের মত দেশে আসছে সেসব দেশে কি বেকারত্ব নেই? তাদের দেশ ফেলে আমাদের দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে আমাদের দেশের ব্যাকবেঞ্চারদের বেকারত্বদূর করার বাসনা থেকে পুজিপতিরা আমাদের দেশে বিনিয়োগ করছে!!!!!???
আপনি বলতে পারেন মুনাফা বা যে উদ্দেশ্য থেকেই এখানে বিনিয়োগ হউক, একেবারে কর্মহীন থাকার চেয়ে শোষিত হয়ে হলেও কর্ম করার সুযোগ পাওয়াটাই বা কম কিসে? সমস্যাটা ঠিক এখানেই। কর্ম সংস্থান কি কারও দান ধ্যানের বিষয় যে আমরা “ভিক্ষার চাল কাড়া আর আকাড়া ” বলে গদগদ থাকব? নাকি কর্মসংস্থান প্রত্যেকটি মানুষের (তা সে শিক্ষিত, অশিক্ষিত বা ব্যাকবেঞ্চার যেই হউক না কেন) অধিকার যার নিশ্চায়তা বিধান করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। তাহলে রাষ্ট্র কেন সেটা করছে না বা করতে চাইছেনা সেই প্রশ্ন তোলাটা সবচেয়ে জরুরী।

নয়া উদারনৈতিক বিশ্বব্যবস্থায় রাষ্ট্র তার এই দায়িত্ব একদিকে অস্বীকার করছে অন্যদিকে এর ফলে যে বিপুল বেকারত্বের সৃষ্টি হবে তাদেরকে ঠেলে দিচ্ছে পুজিমালিকের শোষনের জাতাকলের নিচে। এখন এ বিষয়টিকে অধিকারের জায়গা থেকে না দেখে আমরা যেন মন্দের ভালো হিসেবে দেখি রাষ্ট্র এবং তার নিয়ন্ত্রণকারী পুজিমালিকেরাও তাই চায় এবং এটা তাদের সফলতা যে আমরা আমাদের শোষকের লাইনে চিন্তা করতে শুরু করেছি।

পুতুল এর ছবি

হায়রে কল সেন্টার!
শোষনের নতুন কৌশল।
বর্তমান ব্যংক সংকট নিয়ে একটা বিশ্লেষন দিন।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

দিনমজুর এর ছবি

বর্তমান ব্যংক সংকট নিয়ে একটা বিশ্লেষন দিন।

আন্তর্জাতিক শেয়ার বাজারের পতন ও ফাইনান্সিয়ালাইজেশানের সংকট

“ অর্থনৈতিক প্রবৃব্ধি এখন শূণ্যের কোঠায়। আমরা একেবারে থমকে গেছি”
----- অ্যালান গ্রীনস্প্যান

পারমানবিক বোমা নয়, ভয়ংকর জীবাণু বোমাও নয়- স্রেফ একটা বুদ্বুদের বিস্ফোরণেই বিশ্বপুঁজিবাদ ও সাম্রজ্যবাদের কেন্দ্রভূমি আমেরিকার অর্থনীতি এখন বিপর্যস্ত। বুদ্বুদটির জন্ম ২০০১ সালের কোন এক সময় আর মৃত্যু ২০০৭ সালের জুলাই মাসে। এর নাম গৃহায়ন বুদ্বুদ বা Housing Bubble। দৈনিক পত্র-পত্রিকার অর্থনীতির পাতায় চোখ বোলানের সুবাদে স্বপ্নভূমি আমেরিকার অর্থনীতি বিষয়ক খবরে প্রায়ই সাবপ্রাইম মর্টগেজ, হাউসিং বাবল ইত্যাদি শব্দাবলীর বহুল ব্যবহারে প্রথমে কৌতুহলী, পরবর্তীতে এর তাৎপর্য বুঝতে পেরে চিন্তিত ও মর্মাহত এবং অবশেষে আর দশটা বিষয়ের মতই এক্ষেত্রেও আমরা যখন ইতোমধ্যে বিরক্ত তখনই বুম!!!!!!! ওয়াল স্ট্রীট সহ সারাবিশ্বে বড় বড় সব শেয়ার বাজারের পতন, রাশিয়ার মত দেশের শেয়ার বাজার কয়েকদিনের জন্য একেবারে বন্ধ হয়ে যাওয়া, গতশতকের ত্রিশের দশকের মত মহামন্দার আশংকায় হাজার বিলিয়ন ডলারেও বেশী পাবলিক মানির শ্রাদ্ধ করে Freddie Mac, Fannie Mae কিংবা সর্বশেষ American Internatinal Group (AIG) এর মত কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রাইভেটাইজেশানের স্বর্গভূমি আমেরিকার সরকার কর্তৃক জাতীয়করন......ইত্যাদি আমাদের মাঝে নতুন করে আগ্রহ তৈরী করেছে। এ সুযোগেই আমরা চেষ্টা করব এই ঘটনাগুলোর প্রকৃত কার্য-কারণ অনুসন্ধানের।

বুদ্বুদের জন্ম:
পুঁজিবাদি অর্থনীতিতে ঋণ জিনিসটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এমন গুরুত্বপূর্ণ যে কোন কোন মহান পুঁজিবাদী ঋণকে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদির মত একটি মৌলিক অধিকার বলে প্রচার করার চেষ্টা করেন। তো এক মৌলিক অধিকার বাসস্থান বন্ধক রেখে আরেক 'মৌলিক' অধিকার ঋণ নেয়া- এই নিয়ে ফাইনান্সিয়াল জুয়া খেলার পরিণতিতেই বুদ্বুবটির জন্ম, যদিও পুঁজিবাদীরা এই জুয়া খেলাটিকে ফাইনান্স, বিনিয়োগ, ষ্টক ব্যবসা ইত্যাদি সুন্দর সুন্দর নামে অভিহিত করতে ভালোবাসে। বিষয়টিকে পরিস্কার করার জন্য বুদ্বুদের জন্ম প্রক্রিয়াটিকে আমরা ৫টি ধাপে ভাগ করতে পারি:

ধাপ ১: বিভিন্ন বাড়ির মালিকের ঘর-বাড়ি বন্ধক(Mortgage) রেখে ঋণ দেয়ার পর ব্যাংকগুলো সেই ঋণকে সিকিউরিটি(Securities) তে পরিণত করলো। এই সিকিউরিটির নাম হলো Mortgage Based Securities(MBS)। এই ধরনের সিকিউরিটি ক্রয়করার মানে হলো ঋণের বিপরীতে প্রাপ্য অর্থের অধিকার ক্রয় করা। ধরা যাক 'A' একটি কমার্শিয়াল ব্যাংক, 'B' একজন বাড়ির মালিক যার ঋণের প্রয়োজন এবং 'C' একজন বিনিয়োগকারী যার হাতে বিনিয়োগ করার মত উদ্বৃত্ত অর্থ রয়েছে। 'B',ধরা যাক, 'A' এর কাছে তার বাড়ি বন্ধক রেখে বার্ষিক ১০% সুদে ১০ লক্ষ ডলার ঋণ নেয়। 'B' যদি ভালো গ্রেডের ঋণ গ্রহীতা হয় অর্থাৎ তার ক্রেডিট হিষ্ট্রী যদি 'AAA' গ্রেডের হয় তবে ব্যাংক 'A' কে তিনি প্রতিবছর সুদ-আসল মিলিয়ে ১.১ লক্ষ ডলার করে কিস্তি পরিশোধ করবেন। ফলে ১০ বছর শেষে ব্যাংকটি মোট ১১ লক্ষ ডলার পাবে। ব্যাংকটির পরিচালক ঠিক করলো সে বাড়তি ১ লক্ষ ডলারের জন্য এত দীর্ঘ সময় অপেক্ষা না করে বিনিয়োগকারী 'C' এর কাছ থেকে এককালীন ১০.৫০ লক্ষ ডলার নিয়ে 'C' কে 'B' এর কাছ থেকে পুরো ঋণের কিস্তি গ্রহনের অধিকার দিয়ে দেবে। এভাবে ব্যাংকটি আসলে 'B' এর ঋণকে সিকিউরিটিতে পরিণত করলো যার নাম হলো Mortgage Based Securities বা MBS। কিন্তু ব্যাংকটি এভাবে সবসময় 'C' এর মতো ক্রেতা নাও পেতে পারে কেননা ঋণগ্রহীতা 'B' এর ক্রেডিট হিষ্ট্রী(Credit History) না জেনে বিনিয়োগকারী সেই MBS এর উপর আস্থা রাখতে পারবে না। এই ক্ষেত্রে আবির্ভাব হলো একদল ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকারের।


ধাপ ২:
ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকারদেরকে এক্ষেত্রে বলা হয় Special Investment Vehicle বা SIV। SIVকোন এক বা একাধিক ব্যাংকের MBS গুলোকে কিনে নিয়ে সেগুলোকে একত্রিত করে আবার ঋণের ঝুঁকি অনুসারে ৩ টি ভাগে ভাগ করে:
1)ইকুইটি বন্ড(Equity Bond)
2)মেজানাইন বন্ড (Mezanine Bond)
3)ইনভেস্টমেন্ট গ্রেড বন্ড (Investment Grade Bond)

SIVগুলো হয়তো ব্যাংকের সকল MBS কে এমন ভাগে ভাগ করলো যে ৭০% MBS হলো ইকুইটি বন্ড, ২০% হলো মেজানাইন বন্ড আর বাকি ১০% হলো ইনভেস্টমেন্ট গ্রেড বন্ড। ভালো ক্রেডিট হিস্ট্রি সম্পন্ন ঋণগ্রহীতার মর্টগেজ ভিত্তিক বন্ড থেকে হয় ইনভেস্টমেন্ট গ্রেড বন্ড। ফলে এর ঝুঁকি সবচেয়ে কম, আর ঝুঁকি সবচেয়ে কম বলেই এর বিপরীতে আয়ও সবচেয়ে কম। অন্যদিকে খুব দুর্বল ক্রেডিট হিস্ট্রি সম্পন্ন ঋণগ্রহীতার মর্টগেজ ভিত্তিক ( যে মর্টগেজকে বলা হয় সাবপ্রাইম মর্টগেজ) বন্ডকে বলা হচ্ছে ইকুইটি বন্ড। যেহেতু Subprime Mortgage এর ডিফল্ট হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশী , সুতরাং এই মর্টগেজ ভিত্তিক সিকিউরিটিস এর ঝুঁকিও বেশী এবং এগুলোর বিপরীতে আয়ও বেশী। মেজানাইন বন্ডের অবস্থান মাঝামাঝি। এভাবে মর্টগেজগুলোকে বিভিন্ন স্তরে বিভিক্ত করে ঋণের ঝুঁকি কোন একটি ব্যাংকের কাছ থেকে একাধিক বিনিয়োগকারীর মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে যে বন্ডগুলো তৈরী করা হলো এগুলোকে সাধারণভাবে বলা হয় CDO বা কো-ল্যাটারাল ডেব্ট অবলিগেশান(Collateral Debt Obligation)। ইনভেস্টমেন্ট গ্রেড বন্ডের ঝুঁকি কম বলে SIV গুলোর পক্ষে এগুলো কিনতে ইচ্ছুক বিনিয়োগকারী বা ইনভেস্টার প্রতিষ্ঠান খুঁজে পেতে সমস্যা হয় না। ঝুঁকিবহূল ইকুইটি বা মেজানাইন বন্ডগুলো কিনবে কে?

ধাপ ৩: হেজ ফান্ড(Hedge Fund)গুলো প্রবেশ করে ঠিক এই পর্যায়ে। প্রথম ধাপের ঋণ প্রদানকারী ব্যাংকগুলোই বিভিন্ন ভাবে এই হেজ ফান্ডগুলো গঠন করে। উদ্দেশ্য উচ্চ ঝুঁকির CDO গুলো নিয়ে বাণিজ্য করা। ব্যাংক হয়তো প্রাথমিক ভাবে ১০ মিলিয়ন ডলার দিয়ে হেজ ফান্ডটি গঠন করলো। এই হেজফান্ড তখন উচ্চঝুঁকির CDO গুলো ক্রয় করে।

গৃহায়নশিল্পের সুসময়ে ঘর-বাড়ির বাড়তি দামের কারণে সেই সব ক্রমশ বাড়তে থাকা মূল্যের বাড়ি বন্ধক রেখে ঋণগ্রহীতার ডিফল্টার হওয়ার ঝুঁকিও কমতে থাকে। কেননা ব্যাংক/CDOএর মালিক যে কোন সময় উচ্চমূল্যে বাড়িটি বিক্রি করে ঋণের টাকা আদায় করে নিতে পারবে। ফলে ইকুইটি বন্ডের অবস্থা বেশ রমরমা হয়ে উঠে। যে বাড়িটির মর্টগেজের উপর ভিত্তি করে ইকুইটি বন্ডের যাত্রাশুরু সেই বাড়ির মূল্য আরও বাড়বে এই আশায় (ঋণগ্রহীতা বাড়ির মালিকের ক্রেডিট হিস্ট্রি যাই থাকুক না কেন) উচ্চঝুঁকির ইকুইটি বন্ডগুলোর দাম বাড়তে লাগলো চড়চড় করে। ফলে হেজফান্ডগুলোকে এখন আর সেই ব্যাংকের দেয়া প্রাথমিক ফান্ডের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে না, বিভিন্ন উৎস থেকেই সে ফান্ড পাচ্ছে।

ধাপ ৪: হেজ ফান্ডের আসল ভুমিকা এ ধাপেই। ব্যাংক যেমন তার ঝুঁকি SIV-গুলোর উপর দিয়ে দেয়, এসআইভি-গুলো যেমন তার ঝুঁকি হেজ ফান্ডের উপর দিয়ে দেয়, হেজ ফান্ডগুলোও তেমনি সেই ঝুঁকিপূর্ণ বন্ডগুলো নিজের হাতে রাখেনা । তারা এই CDO-গুলোকে কোন ব্যাংকের কাছে জমা রেখে ব্যাংক থেকে ধার করে এবং সেই অর্থ আবার বিনিয়োগ করে। ইকুইটি সিডিও-গুলোর মূল্য যত বেশী হবে হেজফান্ড তার বিনিময়ে ব্যাংক থেকে তত বেশী অর্থ পাবে। একারণে হেজ ফান্ডের ম্যানেজারদের উপর চাপ থাকে ইকুইটি সিডিও-গুলোর মূল্য বাড়িয়ে দেখানো। সিডিও-গুলোর আসল ভিত্তি যে বাড়িটি, এতগুলো ধাপ পেরিয়ে এসে সেই বাড়ির মূল্যের সাথে আর বাঁধা থাকেনা সিডিও-এর মূল্য।

ধাপ ৫: হেজ ফান্ড-গুলোকে ঋণদানকারী ব্যাংকগুলো ও হাউসিং মার্কেট চড়া থাকার কারণে এবং ভবিষ্যতে আরও চড়া হলে এগুলো বিক্রি করে প্রভূত মুনাফা লাভের প্রত্যাশায় নির্দ্বিধায় অতিমূল্যায়িত সাব-প্রাইম মর্টগেজ এর উপর ভিত্তি করে তৈরী করা সিডিও-গুলোর বিনিময়ে ঋণ দিতে থাকে। সেই টাকায় হেজ-ফান্ডগুলো এসআইভি-এর কাছ থেকে বেশী বেশী সিডিও নিতে থাকে, ১ম ধাপের ব্যাংকগুলোও মর্টগেজের কালি শুকানোর আগেই তার সমস্ত ঝুঁকি সহ মর্টগেজগুলোকে এসআইভি এর হাতে হস্তান্তরেরের সুযোগে আরো বেশী বেশী করে সাব-প্রাইম ঋণ দিতে থাকে।

বুদ্বুদের বিস্ফোরণ :

এভাবেই প্রত্যাশার সাগরে জন্ম নেয়া বুদ্বুদ একেবারে আকাশে উঠে যেতে থাকে। কিন্তু সাব-প্রাইম ঋণ উচ্চসুদের হওয়ার কারণে এবং অধিকাংশ নিম্ন আয়ের মানুষ এর গ্রহীতা হওয়ায়, একসময় দেখা যায় তারা আর ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারছে না। স্বাভাবিক ভাবেই সাব-প্রাইম মর্টগেজের উপর ভিত্তি করে তৈরী করা সিকিউরিটিগুলোর বর্তমান মালিক (ব্যাংক বা কোন ব্যাক্তি বিনিয়োগকারী) যখন বাড়িটি বিক্রি করতে চাইলো তখন সবাই মিলে বাড়ি বিক্রিকরার হিড়িকের কারণে সে উপযুক্ত মূল্য পেলনা এমনকি তার হাতে থাকা সিকিউরিটিগুলো বিক্রি করতে গিয়েও সে ক্রেতা পেলনা। কেননা কেউই তখন জানেনা এই সিকিউরিটিস এর ভিত্তি মূল্য আসলে কত। যখন সবকিছু ভালোয় ভালোয় চলছিল, তখন কেউ ভিত্তিমূল্যের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। কিন্তু সাবপ্রাইম ঋণগ্রহীতার ডিফল্টার হওয়া এবং হাউসিং বাজার পরে যাওয়ার কারণে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার মূল্যের সিকিউরিটি আক্ষরিক অর্থেই টয়লেট পেপারে পরিণত হলো। কেননা ফাইনান্সের দুনিয়ায় এর আর কোন মূল্য নেই, ভবিষ্যতে উচ্চমূল্য পাওয়ার আশা না থাকায় কেউ আর এগুলো কিনতে চাইছে না।

বুদবুদের প্রথম বড় ধরনের ঝাঁকিটি অনুভুত হয় ২০০৭ সালের জুলাই মাসে যখন দু'টি বিয়ার স্টার্ন হেজ ফান্ডের একটি তার ৯০% মূল্য হারায় আর আরেকটি একেবারে মূল্যহীন হয়ে যায়। এই ধরণের হেজ ফান্ডগুলোর সাথে ব্যাবসা করতো এমন ইউরোপ, আমেরিকা এবং এশিয়ার বড় বড় ব্যাংকগুলোও স্বীকার করতে শুরু করলো যে তারাও বিষাক্ত সাব-প্রাইম ঋণের স্বীকার। ফাইনান্সিয়াল ইন্সটিটিউশানগুলোর মাঝে লেনদেন প্রায় বন্ধ হয়ে এলো- কেননা কেউ জানেনা কার হাতে কতটুকু বিষাক্ত মর্টগেজ আছে। সারা বিশ্বের ফাইনান্স জগতে দ্রত আতংক ছড়িয়ে পড়লে। কেননা তারা প্রত্যেকেই মর্টগেজ নিয়ে এই জুয়া খেলার সাথে কোন না কোন ভাবে যুক্ত। সর্বব্যাপি একটা ভয় ছড়িয়ে পড়লো যে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ২.৫% এর নীচে নেমে যাবে অর্থাৎ মন্দার কবলে পড়বে।

অবশেষে মন্দা:

"Bernanke Warns of 'Deep and Extensive Recession' If Feds Don't Take Action"
-----Fox news
Friday, September 19, 2008
"Hello recession, my old friend Economic downturns? He's seen more than a few."
------------------------Matthew DeBord
September 21, 2008, Los Angeles Times

"Depression or recession? I know which one I'd choose"
------------------- Brendan Keenan
Sunday September 21 2008
The Irish Independent

এ মাসের মাঝামাঝি এসে অবশেষে ঘটনাটি ঘটতে শুরু করে। উপরোক্ত হেডলাইনগুলোর মতো অসংখ্য হেডলাইনে সংবাদ সংস্থাগুলো ভেসে যেতে থাকে। সবারই একই কথা- ১৯২৯ এর পর আবার আসছে মহামন্দা। বিয়ার স্টার্ন তার দুটি হেজ ফান্ডকে রক্ষা করে ৩.২ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে। Goldman Sachs তার আলফা নামের হেজ ফান্ডকে রক্ষা করে ৩ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে। এরপর ২০০৭ সালের শেষ দিকে আমেরিকার ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট জাতীয়করন করে Freddie Mac আর Fannie Mae কে আর ব্রিটেন জাতীয় করণকরে Northern Rock কে। Bear Stern তার দুটি হেজ ফান্ডকে রক্ষা করলেও নিজেকে কিন্তু রক্ষা করতে পারেনি। ২০০৮ এর মার্চ মাসে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক ৩০ বিলিয়ন পরিমাণ সরকারী ডলার খরচ করে বিয়ার স্টার্ন কে বেইল আউট( অর্থা? বিপুল পরিমাণ তারল্য বা অর্থ সরবরাহ করা) করে। এর পর সেপ্টেম্বরের শুরুতে Lehmen Brothers এর পতন ঘটলে সরকার নিরব থাকার সিদ্ধান্ত নিলেও তার পরপরই যখন AIG, ১০০০ বিলিয়নের বেশী মর্টগেজ ভিত্তিক সিকিউরিটি ধারনকারী বিশ্বের বৃহত্তম ইনসিউরেন্স কোম্পানীর যখন পতন ঘটে তখন ফেডারেল রিজার্ভ আর বসে থাকতে পারেনি, তারা জনগনের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে সেই কোম্পানী এবং তার সম্সত্দ মর্টগেজ ব্যাক্ড সিকিউরিটির জাতীয়করণ করে!এর ফলাফল কি? পুজিঁবাদে যা কিছই ঘটুক না কেন তার ফলে শেষ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্থ হয় খেটে খাওয়া মানুষ। এবারের মন্দাক্রান্ত অর্থনীতেও তাই ঘটছে। ইতিমধ্যেই আমেরিকায় চাকরি হারিয়েছে ৬ লক্ষেরও বেশী শ্রমিক, গৃহহীন হয়েছে হাজার হাজার নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং সবশেষে এই যে প্রাইভেট লসের জাতীয়করণ তার খেসারতও বহন করতে হবে সাধারণ জনগণকে অতিরিক্ত ট্যাক্স প্রদানের মাধ্যমে! বিষয়টি লক্ষ করে Financial Times এর কলামিস্ট Willem Buit বলছেন:

"বর্তমান বাস্তবতা কি এমন যে, লগ্নীপুঁজি নিয়ন্ত্রীত অর্থনীতিতে যখন সবকিছু ভাল চলে, তখন বেসরকারী প্রতিষ্ঠান গুলো বেসরকারী মুনাফা কামায় আর যখনই কোন সমস্যা হাজির হয় তখন সাময়িক ভাবে সেই সমস্যাগ্রস্থ বেসরকারী প্রতিষ্ঠানটিকে সাময়িক সরকারীকরণ করা হয়, যার ফলে সমস্ত লসের দায়ভার বহন করে জনগণ? তাই যদি হয়, তবে এগুলোকে চিরস্থায়ীভাবেই জাতীয়করণ করা হচ্ছে না কেন? "

ফাইনান্সিয়ালাইজেশানের সংকট:
গৃহায়ণ বুদবুদের জন্ম, বিভিন্ন ফাইনান্সিয়াল ইন্সট্রুমেন্টের মাধ্যমে এর আকাশে উঠা, এবং অবশেষে সাব-প্রাইম মর্টগেজের ঋণ পরিশোধের অক্ষমতা ও হাউসিং সেক্টরের পতন ইত্যাদির কারণে বুদবুদটির বিস্ফোরণ - চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, উৎপাদনমুখী অর্থনীতি থেকে যতই আলাদা স্বাধীন সত্ত্বা হিসাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হউক না কেন ফাইনান্সিয়ালাইসেশান কখনই উৎপাদনের অর্থনীতির বিকল্প হতে পারেনা এবং পুজিঁবাদী অর্থনীতির যে মৌলিক সংকট অন্তর্নিহিত, তার সত্যিকারের সমাধান করতে পারেনা। পুঁজিবাদী রিয়েল ইকোনমি'র সংকট, মন্দা বা স্থবিরতার সময় ফাইনান্সিয়ালাইজেশান সেক্টরের বিকাশের মাধ্যমে সাময়িক ভাবে কিছু অনুৎপাদনশীল সেক্টরে কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং তার মাধ্যমে কৃত্রিম ভাবে পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করা সম্ভব হলেও পরিণামে তা আরো গভীর সংকটের সৃষ্টি করে।
বর্তমান সাম্রজ্যবাদী অর্থনীতি উৎপাদন ও বিনিময়ের এক বিশ্বব্যবস্থা যার মাধ্যমে সারাবিশ্বের শ্রমিক শ্রেণীকে শোষণের মাধ্যমে উদ্বৃত্ত মূল্যের বৈশ্বিক উৎপাদন হয়। আর এই উদ্বৃত্ত মূল্য উৎপাদনের নিরিখে ফাইনন্সিয়ালাইসেশান একদিকে বিশ্বপুঁজিবাদের টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় এবং অন্যদিকে পরজীবি একটি প্রক্রিয়া। পরজীবি- কেননা এটি কোন উদ্বৃত্ত তৈরী করেনা বরং উৎপাদন প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন উদ্বৃত্তে ভাগ বসায়। প্রয়োজনীয়- কেননা উদ্বৃত্ত মুনাফার পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে কেন্দ্রীভবন এবং তার মাধ্যমে মুনাফা তৈরীর নতুন রাস্তা তৈরী করা ও দ্রুত পুঁজি লগ্নি করে মুনাফা তুলে নেয়া আর ঝুঁকি দেখলে আরও দ্রুত সেই লগ্নি পুঁজি প্রত্যাহার করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যেকারণে ফাইনান্সিয়ালাইসেশানের যুগে, উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, লগ্নি পুঁজি আজকে থাইল্যান্ডের রিয়েল এস্টেট মার্কেটে গেল তো কাল সেখান থেকে মুনাফা তুলে নিয়ে ব্রাজিলের ইথানল উৎপাদনে লগ্নিকৃত হলো আবার সুযোগ বুঝে আমেরিকার মর্টগেজ মার্কেটে লগ্নী হলো। এর সাথে আরেকটি বিষয় যুক্ত- লগ্নী পুঁজির স্বল্পমেয়াদী আগমন ও বহির্গমণের মাধ্যমে কোন একটি দেশের স্থানীয় পুঁজিকে বশবর্তী রাখা হয় ও পুঁজির পূণর্বিন্যাস করা হয়- একটা বৃহৎ শিল্প কারখানাকে ঋণ না দেয়া কিংবা পুঁজি প্রত্যাহার করে সর্বসান্ত করে ফেলার হুমকীর মাধ্যমে সহজেই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। আর এই ধরণের ফাইনান্সিয়াল শৃঙ্খলা তৃতীয় বিশ্বের সবগুলো দেশের উপরেই আরোপ করা হয়- আমেরিকা নিয়ন্ত্রিত আইএমএফ যাতে মূল ভূমিকা পালন করে। যেকারণে ফাইনান্সিয়াল দুনিয়ার অস্থিরতা বর্তমান পুঁজিবাদের বিশ্বায়িত ও লগ্নী পুঁজি নিয়ন্ত্রিত বাস্তবতা এক ধ্রুব সত্য।

তথ্যসূত্র:
# Matthias Chang এর The Shadow Money Lenders
# The Economist, Sep 18th 2008.
# http://www.greenleft.org.au/2008/768/39617

অয়ন এর ছবি

কিন্তু সাব-প্রাইম ঋণ উচ্চসুদের হওয়ার কারণে এবং অধিকাংশ নিম্ন আয়ের মানুষ এর গ্রহীতা হওয়ায়, একসময় দেখা যায় তারা আর ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারছে না।

সাবপ্রাইম ঋণের সুদের হার কমই ছিলো। পরে রিফাইন্যান্স করার সময় টের পায় যে সুদের হার বেড়ে গেছে। তখন ধরা।

দিনমজুর এর ছবি

সাবপ্রাইম ঋণের সুদের হার কমই ছিলো।

আপনাকে ধন্যবাদ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য। আপনার মন্তব্য পড়ে মনে হচ্ছে বিষয়টি আরেকটু বিশদ ভাবে লিখা দরকার ছিল। যাই হোক এখন দেখি আমার বক্তব্যটাকে পরিস্কার করা যায় কিনা------
সাব-প্রাইম ঋণ মানেই হলো প্রাইম ঋণের চেয়ে বেশী সুদের হার। ঋণগ্রহীতার ঝুকিপূর্ণ ক্রেডিট হিষ্টরি থাকার কারনে প্রাইম লোন এর কাঠামোর বাইরে যাদের অবস্থান, তাদেরকে ঋণদেয়ার মাধ্যমে ব্যাংকিং বাণিজ্যের আওতায় নিয়ে আসার উদ্দেশ্য থেকেই এই সাবপ্রাইম লোনের শুরু।
A type of loan that is offered at a rate above prime to individuals who do not qualify for prime rate loans. Quite often, subprime borrowers are often turned away from traditional lenders because of their low credit ratings or other factors that suggest that they have a reasonable chance of defaulting on the debt repayment.
Subprime loans tend to have a higher interest rate than the prime rate offered on traditional loans. The additional percentage points of interest often translate to tens of thousands of dollars worth of additional interest payments over the life of a longer term loan.
সুত্রঃ http://www.investopedia.com/terms/s/subprimeloan.asp

কাজেই আপনি যে বলছেন সাবপ্রাইম ঋণের সুদের হার কম ছিল সেটা মোটেই ঠিক নয়।

auto

http://www.frbsf.org/publications/economics/letter/2001/el2001-38.html

তবে

"পরে রিফাইন্যান্স করার সময় টের পায় যে সুদের হার বেড়ে গেছে। তখন ধরা।"
---- আপনার এই বাক্যের সাথে আমি পুরোপুরি একমত। অর্থাত এমনিতেই উচ্চ যে সুদের হার তা পরবর্তীতে অ্যাডজাস্ট করতে গিয়ে দেখা যায় আরো উচ্চ সুদের হয়ে উঠেছে। আমেরিকায় যে ধরনের সাবপ্রাইম মর্টগেজ সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল তা হলো ২-২৮ পদ্ধতির অর্থাত প্রথম ২ বছর সুদের হার তুলনামূলক ভাবে কম (যদিও তখনও তা প্রাইম লোনের চেয়ে বেশী) থাকে কিন্তু পরবর্তী ২৮ বছর তাকে নতুন অ্যাডজাস্টেবল হারে আরো বেশী সুদে সে ঋণ পরিশোধ করতে হয়।

Common subprime hybrids include the "2-28 loan", which offers a low initial interest rate that stays fixed for two years after which the loan resets to a higher adjustable rate for the remaining life of the loan, in this case 28 years. The new interest rate is typically set at some margin over an index, for example, 5% over a 12-month LIBOR. Variations on the "2-28" include the "3-27" and the "5-25".
সুত্রঃ
http://en.wikipedia.org/wiki/Subprime_lending#Subprime_mortgages

ছোটন [অতিথি] এর ছবি

দিনমজুর ভাই, আপনার এই বিশ্লেষনটা আমার খুবই ভাল লাগছে। তাই এটা কপি পেস্ট করে গুগল ডক্সে তুলে দিয়ে আমার ফ্রেন্ডদের লিংকটা পাঠিয়েছি। সামহোয়ারেও দিয়েছি। কিন্তু একটা ভুল হয়ে গ্যাছে....আমি ভাবছি এটা এলান গ্রিনস্প্যানের অনুবাদ। পরে সামহোয়ারে একজন ভূল ধরিয়ে দিল। এখন কি করি?

১. গুগল ডক্সে কি ডকুমেন্টটা থাকবে? আপনার অনুমতি চাচ্ছি।
২. সামহোয়ারে পোস্টে ডকুমেন্টের লিংকটা রাখবো?
৩. আমি লেখাটা প্রিন্ট করে আমার কিছু বন্ধুকে ফটোকপি করে দিতে চাই, কারন তারা এব্যাপারে সচেতন না। অনুমতি দিচ্ছেন?
৪. আমরা একটা ম্যাগাজিন বের করতে যাচ্ছে। বিজনেস ম্যাগ। তাতে লেখাটা কভার স্টোরি করতে চাচ্চি। অনুমতি দিচ্ছেন? যদি দেন তবে তো ধরা খেয়ে গ্যালেন। কারন লেখাটা কষ্ট করে একটু ইংলিশ ট্রান্সলেট করে দেন না....প্লিজ।

আমাকে পাবেন এখানে no_zam04এটyahoo.com

সুমন চৌধুরী এর ছবি

আপনি এই কাজটা করার আগে অনুমতি নিলেই কি ভালো হতো না?



অজ্ঞাতবাস

ছোটন [অতিথি] এর ছবি

স্যরি, আমার এই ভুলটা অনেক বড় হয়ে যাচ্ছিল, তাই সামহয়ারের পোস্ট+গুগল ডক্সটা মুছে দিলাম। পারলে নিজ গুনে ক্ষমা করে দিয়েন। আর আগে যা বলছি, ভুলে যাইয়েন।

কান ধরতাছি.....

শামীম এর ছবি

বিদেশ থেকে এসে কেউ কষ্টের গল্প করে না ... ঠিক সেইরকম কলসেন্টার নিয়েও কেউ সমস্যার কথাগুলো বলে না। আপনার লেখা পড়ে অনেক কিছু জানা গেল।

কলসেন্টারের লাইসেন্সধারীরা সমস্যায় পড়বে কি? --- যারা কলসেন্টারের লাইসেন্স নেয় তারা তো মুনাফার ভাগীদার। ভুক্তভোগী হয় মূলত কর্মীগণ।

কাজের দক্ষতা ও মান বৃদ্ধির জন্য মাঝে মাঝে বিরতি নেয়া জরুরী। এ প্রসঙ্গে একটা গল্প পড়েছিলাম .... একজন ম্যানেজার জাহাজের মাল খালাসের তার কর্মীদের প্রতি ঘন্টা কাজ শেষে ১০ মিনিট করে বিরতি দেয়াতে মালিকের উপহাসের পাত্র হয়েছিলেন। কিন্তু দিন শেষে দেখা গেল তার গ্রুপের কর্মীরারই জনপ্রতি বেশি মাল খালাস করেছে।

বেশি কাজ পাওয়ার জন্য এই কৌশলগুলো এখন আধুনিক কর্মপরিবেশেও প্রয়োগ করা হয়। আর এজন্যই বড় বড় কর্পোরেট এবং সরকারী কাজে বিনোদন ছুটির ব্যবস্থা আছে। নিয়োগকারী বুদ্ধিমান হলে বেশি কাজের জন্য এরাও কর্মীদের প্রয়োজনীয় বিশ্রামের ব্যবস্থা করবে। অবশ্য উদ্দেশ্য যদি হয়, কয়েক মাসে সমস্ত কাজের শক্তি নিংড়ে বের করে তারপর ছুড়ে ফেলে দেয়া তাহলে অবশ্য অন্য কথা।

এইরকম অমানবিক চাপের বিরূদ্ধে কেউ কোন আন্দোলন করে না?
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।