শেরালী- সতের (বন্ধু বিহীন বঙ্গবন্ধু)

পুতুল এর ছবি
লিখেছেন পুতুল (তারিখ: সোম, ৩০/০৬/২০০৮ - ১০:৫৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আশা কইরা ঘর বান্দিলাম মায়া নদীর কূলে
এক মিনিটের নাই ভরসা দয়াল পার ভাঙ্গিয়া পড়ে রে
তুই আমার দয়ালের দয়াল রে।

মুক্তিযুদ্ধের বীর গাঁথা আর বেশী শ্রোতাকে মুগ্ধ করতে পারে না বলে ওহেদ আলী বয়াতী এখন মারফতি গায়। কিন্তু তাতেও খুব একটা কাজ হচ্ছে না।

মাঘের শেষে বর্ষণ হয়নি, ধন্য রাজার পূন্য দেশ হতে তাই এখনো অনেক বাকী। রবিশষ্যের ক্ষেতে ফুল থেকে ফল হয়েছে কেবল, এখনি সেচের প্রোয়োজন। গোমতীর জল এত নীচে যে হেওতি দিয়ে আর তোলা যাচ্ছে না।আর দোরন দিয়ে পানি তোলার কথা কেউ কল্পনাও করে না। কাওন, চিনা, গম পেট মোটা করে বসে আছে; ছড়া বের করছে না। পাতার উপরের অংশ বাদামী হতে শুরু করেছে। কলাই-এর লতাগুলো শুকিয়ে প্রায় খর হয়ে গেছে। এবার ফলনের আশা নেই দেখে, কৃষকরা সেগুলো গবাদিপশুর খাদ্য হিসাবে চালিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু কাওন, চিনা, গমের ক্ষেতগুলোও যদি সর্বনাশী খরার হাত থেকে রক্ষা না পায়, তাহলে সমূহ বিপদ। তাই অনেকে আশা ছেড়ে না দিয়ে ঘটি-বাটিতে করে জল এনে জমিতে ছিটিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এক ঘটি জল দিয়ে আবার জল আনতে আনতে, দেয়া জলটুকু শুকিয়ে যায়। এখনো ফাল্গুনই শেষ হয়নি, সামনে আছে চৈত্র! বৈশাখের বর্ষণ আসতে আসতে, কাওন চিনা গম তুলে ক্ষেতে আমন বুনতে হবে!

এদিকে চালের বাজারে আগুন। শেরালীদের মত যাদের প্রায় বারো মাসই চাল কিনে খেতে হয়, তারা এখন আর চাল বাজারের ধারে কাছে যায়না। পাঁচ টাকায় একসের আটা কিনতেই হিমশিম খেতে হয় শেরালীকে। কাজেই সে আটায় রুটি বানিয়ে খাওয়ার মত বিলাসিতা হুরুনি করতে পারে না। পাতিলভর্তি পানিতে একমুঠো আটা দিয়ে একটা তরল কিছু গরম করে। সেটাই সবাই মিলে ফুরুৎ ফুরুৎ করে খায়। শুধু শেরালী কাজে যাওয়ার সময় দুটো রুটি নিয়ে যায়। তাছাড়া লোকের সামনে আটার জাউ খেতে এক রকমের অস্বস্তিতো আছেই। তার উপর তরল জাউ গাট্টিতে করে নিয়ে যাওয়াও সম্ভব না। এদিকে কঠোর পরিশ্রম করতে একটু শক্ত খাবারতো লাগেই। তাও এতদিন অন্ততঃ কিছু রোজগার ছিল। কিন্তু এখন প্রয়োজনের অতিরিক্ত নতুন ইট, মালিক আর পোড়াবে না। ক্ষেত-খামারের কাজতো নেইই। শেরালীর মত অনেকেই খাল-বিলের মাছ যা দুএকটা ধরতে পারে, তাই নিয়ে বাজারে যায়, বেচতে।

বোয়ালমারী বাজারের পাশে প্রবাহিত গোমতীর বাজার সংলগ্ন অংশটির দুদিকে বাঁধ দিয়ে, ভরাট করা হচ্ছে। নদী ভরাট করে বাজারটা বড় করা হবে। মাছ বাজারের ছাউনিগুলো ভেঙ্গে সেখানে একটা দালানের ভিত্তিপ্রস্থর গাঁথা হচ্ছে। দালানের মুখটা নদীর দিকে। দালানের উপড়ে দাড়িয়ে মৌসুমী বায়ুতে প্রাণ শীতল করার সুন্দর আয়োজন। কিন্তু দালান বরাবর নদীর অংশটুকুই দুদিক থেকে দুটো ড্রেজার দৈত্যের মত শব্দ করে পানি মিশ্রিত বালি দিয়ে ভরাট করছে। তলানী হিসাবে বালিটুকু জমে জমে নদী ভরাট হচ্ছে ধীরে ধীরে। দুদিকে সারি সারি পাম্পকল উপরের জলটুকু ফেলে দিচ্ছে নদীতে। লোকে বলে এই দালানের ছাদে দাড়িয়ে বঙ্গবন্ধু ভাষন দেবেন। টোপ ফেলে মাছ আনার মত, নদীর ভরাট করা অংশটিতে শ্রোতাদের জড়ো করা হবে।

নির্মানাধীন প্রাসাদের পাশেই ডুলাটা বিছিয়ে শেরালী দয়ালু খরিদ্দারের অপেক্ষা করতে লাগল। এত্ত বড় বাজারে এখন কোথায় মাছ বাজার খুঁজতে যাবে শেরালী! চেয়ারের হেলানীর সাথে ছাতা বেধে, তার তলায় বসে কাজ তদারকী করছে কন্টাক্টর। শেরালীর পসরা তার সাবধানী দৃষ্টি এড়িয়ে গেল না। মাগুর মাছগুলো এখনো নড়ছে! রাতের রান্নার জন্য তাজা মাছগুলো ঠিকাদারের পছন্দই হল। শেরালী দাম দস্তোরে তেমন পাঁকা নয়। গোটা আষ্টেক মাগুর আর দশবারোটা শিং। পাঁচ টাকা পেলেই শেরালী খুশী। বলাতো যায়না, যদি কিছু বেশী পাওয়া যায়, তাই শেরালী মনের কথা গোপন রেখে, দাম চাইল দশ টাকা। ঠিকাদার চালাক মানুষ। আড়াই টাকার বেশী দিতে রাজী হলেন না। শেরালী আর কোন উপায় না দেখে আড়াই টাকাতেই ঠিকাদারের রাঁধুণীর হাতে তুলে দিল মাছগুলো। যা হোক আধাসের আটাতো কেনা যাবে! কিন্তু কাল যে বিলে আবার মাছ পাওয়া যাবে, এমনতো কোন কথা নেই! তাই আড়াই টাকা কোমরে গুজতে গুজতে শেরালী সাহস করে কন্টাক্টরকে বলেই ফেলে, কোন কাজে এখানে শেরালীকে লাগানো যায় কিনা।
কন্টাক্টর ভেবে দেখলেন; দেয়ালগুলোতে সব সময় পানি না দিলে ফাঁটল ধরে যাবে। প্রখর রোদে গাঁথুনির সিমেন্ট খুব দ্রুত শুকিয়ে যায়; আর তাতেই ফাটল ধরে। কাজেই দেয়ালে পানি দেয়ার জন্য সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শেরালীর কাজ হয়ে যায় দৈনিক আড়াই টাকায়। শেরালী তাতেই অনেক আশ্বস্ত, দৈনিক আধাসের আটা; তাই বা কম কী!

পরেরদিন ভোরে, শেরালী ছোটে নতুন উদ্যমে, মানুষের গড়া অমর কীর্তির সুরক্ষনে। বালতী অনেক বড়। জলভর্তি বালতি নিয়ে আসতে আসতে শেরালীর নিজেরই পিপাসা লাগে। ছোট মগে করে পানি ছিটিয়ে দেয়, দেয়ালে। একবার এদিকে জল দেয়তো ওদিকটা শুকিয়ে যায়। আবার ছোটে বালতি নিয়ে। কন্টাক্টার কাজটা যেন অন্য কাউকে দিয়ে না দেয় শেরালীকে অযোগ্য ভেবে। এই চিন্তায় শেরালী বিরাম হীন ভাবে জল আনে আর দেয়ালের গায়ে ঢালে।

মায়ের দেয়া দুটো রুটি সকাল দশটায় খেয়ে ফেলেছে। যোহরের আযানের সময় আবার ক্ষিধে পায় শেরালীর। কন্টাক্টরের রাঁধুণী শেরালীকে বলে; কীরে ভুক লাগে নাই! শেরালী শুকনো মুখে চুপ করে থাকে। বুড়ি এবার ব্যাখ্যা করে বলে; মছিদের বারান্দায় নামাজের পরে লংগর খানায় রুটি বিলায়। যে যায় হেরেই দেয়। আমিও যাই পরতিক দিন। মগ লইয়া গেলে দুধও দেয়। কিন্তুক হেই দুধ খাইলে পেট লামায় (পাতলা পায়খানা)। আমি দুধ খাইনা। দুডার বেশী রুটি দেয় না! শেরালীর দিকে চেয়ে কন্টাক্টার নীরব অনুমতি দেয়। বুড়ি, শেরালীর হাত ধরতেই শেরালী উঠে পড়ে। জীবনের প্রথম প্রেমের মত অবস্থা শেরালীর। সব কিছুতেই কেমন বেমানান লাগে নিজেকে। ভিখেরী হয়ে তো আর কেউ জন্মায় না, তাই পেশার প্রাথমিক সংকটতো থাকবেই!

ক্রমশ...


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালো লাগলো পুতুল আপু।

- একরামুল হক শামীম

পুতুল এর ছবি

সচলায়তনে স্বাগতম। আপনাকে এখানে দেখে খুব ভাল লাগছে।
আর আমি কিন্তু পুতুল দা কিংবা পুতুল ভাই। এখানে এসে খুঁজে খুঁজে আমার লেখা পড়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

রণদীপম বসু এর ছবি

চলুক।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

পুতুল এর ছবি

একটু জোরেশোরে মন্তব্যের ঠেলা না পেলে কেইম্তে চলবে?
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

তানবীরা এর ছবি

মন খারাপ হয়ে যায়, সাথে নিজেকে স্বার্থপর মনে হতে থাকে।

তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

পুতুল এর ছবি

মন খারাপ করার ইচ্ছে ছিলনারে ভাই! আমিই কী কম স্বার্থপর!
মনে হল স্বাধীনতা উত্তর ঘটনা প্রবাহের নাটকীয়তায় এসব ছোটখাট মানুষদের হাভাতে গল্প তেমন একটা কেউ লিখেনি। এবং তার পরবর্তী পরিস্থিতিও কম নাটকীয় নয়। এখানে তার একটা ধারনা দেয়ার চেষ্টা করছি মাত্র।
অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

কীর্তিনাশা এর ছবি

ভালো লাগলো।
----------------------------
সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে !

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

পুতুল এর ছবি

ভাল লাগার জন্য ধন্যবাদ কর্তীনাশা।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

তীরন্দাজ এর ছবি

পুরোটা এক নি:শ্বাসে পড়লাম। ভাল হচ্ছে প্রতিবারের মতোই।

"বন্ধু বিহীন বঙ্গবন্ধু" মনে ধরেছে। পুরোপরি ঠিক বলেছেন।

**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

পুতুল এর ছবি

নাম নিয়ে ভয় কাটল আপনার মন্তব্যে। ধন্যবাদ তীরুদা।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

উদ্ধৃতি
আশা কইরা ঘর বান্দিলাম মায়া নদীর কূলে
এক মিনিটের নাই ভরসা দয়াল পার ভাঙ্গিয়া পড়ে রে...

আমাদের কারোরই মনে হয় স্বপ্নে দেখা বা প্রত্যাশিত বাংলাদেশ কখনো পাবো না। ওই যে মানেক শ বলেছিলেন "হাতিয়ার ডাল দো!" তারপরই আমরা সবাই নিধিরাম সর্দার। দৃশ্যগুলো সম্ভব হলে আরেকটু ফুটে উঠুক। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশ দেখি নতুন চোখে।
ধন্যবাদ পুতুল। আমি একই রকম মুগ্ধ পাঠক।

____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

পুতুল এর ছবি

জুলিয়ান সিদ্দিকী, আপনার মন্তব্যটা পড়ে মনটা ভরে গেল!
লেখার পরিশ্রমটুকু বৃথা যায়নি।
স্বাদীনতা উত্তর বাংলাদেশ এই দৃষ্টিকোন থেকে দেখানোই আমার মূল উদ্দেশ্য। বঙ্গবন্ধু বিহিন বাংলাদেশও তুলে ধরতে চেষ্টা করব একটু।
আরো কয়েকটা পর্বে ৭৪-এর দুর্ভিক্ষ, বন্যা-খড়া ইত্যাদি তুলে ধরতে চেষ্টা করব, শেরালীদের দৃষ্টিতে।
সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।