আবৃত্তির আবির্ভাব

পুতুল এর ছবি
লিখেছেন পুতুল (তারিখ: শুক্র, ১২/০৯/২০১৪ - ৩:৫৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


হাওয়ার মুখে বাঁশি ধরে বসে আছে কবি শাহীন হাসান কৃষ্ণের মতো। সখিগন সাথে জলকে চলেছে বুলা, যমুনায়। তার রূপে মুগ্ধ হয়ে বাঁশি রেখে
নিজের কণ্ঠে গান ধরেছে কৃষ্ণ...
কোন বা বৃক্ষের পুষ্প গো লাগে চিনি চিনি
চোখেতে মধুর চাওয়া, মুখে হিরামনি।

সব নারীর মনে লুকানো রাধারা জেগে উঠে কৃষ্ণের বাঁশি শুনে। বুলা তার ব্যাতিক্রম হয় কী করে। কৃষ্ণের গানে মুগ্ধ হয়ে রাধার মতো গেয়ে উঠল...
এ কী সুরে গান শোনালে ভীন দেশী পাখি...

সখিরা হায় হায় করে উঠল।

বাশিঁ শুনে আর কাজ নাই,
সে যে ডাকাতিয়া বাশিঁ।

বৃন্দাবনের এই দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য হল না আমার।
খবর পেলাম আনিস ভাইয়ের কাছে।
শাহীনটা মরেছে।

আমি ব্যস্ত উঠলাম।
কেন যুধিষ্টির তার কী হয়েছে?
তিনি বললেন: ইচ্ছে হলে গিয়ে দেখে আসতে পারো নিজের চোখে।

তথাস্তু, বলে তাকালাম আমার উত্তম অর্ধেকের দিকে।
তিনি বললেন; যাও, বিপদে বন্ধুর পরিচয় দিয়ে এসো। থাক কিছু দিন সংসারের ভার আমার কাঁধে।

গিয়ে দেখি বন্ধু কৃষ্ণ পাগল প্রায় রাধিকা বিহনে।
শুধালাম;
আছো কেমন বন্ধু?
চমকে উঠলো কৃষ্ণ আমার প্রশ্ন শুনে।
আখিঁ মেলে আমার দিকে ম্লান দৃষ্টি ফেলে বললেন...
বন্ধু, চলে যাচ্ছে কাহিনীর মতো,
বললাম; যার শরাঘাতে বধ হয়েছিল কংসপতি, তার আজ একী দুর্গতি!
প্রলাপের মতো তিনি শুধু বলে চলেছেন...
মুখ তার রহি রহি পড়েছে মনে

ওই জলকে চলেলো কার ঝিয়াড়ী
রূপ চাপে না তার নীল শাড়ি।

কী করি, কী করি! বন্ধুর এই বিপদে! অনেক ভেবে চিন্তে স্থির করলাম নিজেই একবার যাই বৃন্দাবনে।
সে ইচ্ছা ব্যাক্ত করতে বলে উঠলো কৃষ্ণ সন্দিহান কণ্ঠে...

ইয়ে মানে.. কোন দেবীকে পাঠালে ভাল হতো না।
তা মন্দ নয়। আপনি কার কথা ভাবছেন অবতার? জানতে চাইলাম আমি।
তিনি বললেন... মেনকাকে পাঠালে কেমন হয়?
বলেন কী মহারাজ! আপনি দেখি স্বর্গের কোন খবরই রাখেন না! আমার অবাক হবার কোন কারণ খুঁজে না পেয়ে, তিনি প্রশ্ন করলেন;
কেন, কী ঘটেছে স্বর্গে?
মহারাজ, দেবীত্ব আর অমরত্বের অধিকার নারায়ণের কাছে ফেরত দিয়ে কাঁকন নাম নিয়ে মেনকা নেমে গেছে নশ্বর পৃথিবীতে।
কেন তার কী হয়েছে? এবার আরও অবাক কণ্ঠ তার।
দিল রিয়াজ নামের এক মরণশীল যুবকের প্রেমে সে হাবুডুবু খাচ্ছে।
প্রেম মানুষকে অন্ধ করে দেয় গুরুদেব। সেই অন্ধ চোখ দিয়ে কাঁকন নামের মেনকা রাধিকার অবস্থা কিছুই বুঝতে পারবে না।
কিন্তু আপনি কোন দেবীকেই কেন রাধার কাছে পাঠাতে চাইছেন?

না, মানে গোধুলি লগনে রাধিকা আমাকে দেখেছিল এক পলকের জন্য। হয়তো আমার অবয়ব তার মনে নেই সম্পূর্ণরূপে। তাই আপনাকে দেখে যদি সে মনে করে এই কৃষ্ণ। তা হলে তো ভীষণ বিপদ। তাই বললছিলাম...
ও, এই কথা! আপনি কিছুই ভাববেন না। আমি মেঘের আড়ালে লুকিয়ে রাধার অবস্থা দেখে মেঘের পরে ভেসে চলে আসব, কেউ আমাকে দেখতে পাবে না।

কৃষ্ণ বললেন ব্যবস্থা মন্দ নয়। তবে তাই হোক। আপনি আর বিলম্ব করবেন না।
তথাস্তু মহারাজ।

এ দিকে মর্তের নিন্দুকেরা বলতে লাগল...
হে, প্রেম না ঢং। রাজারা বনে যায় মৃগয়ায়। কবিরা প্রকৃতির রূপ দর্শনে। সেই মুগ্ধতা কেঁটে যাবে দু ছত্র পদ্য লিখলেই। কী বা কাকে দেখেছে, আর তাকেই রাধিকা কল্পনা করে ঢং করছে কবি।

বৃন্দাবনে গিয়ে দেখি; বেচারী বুলার অবস্থা রাধার চেয়েও করুণ;

মেঘেরা ভেসে আসছে কৃষ্ণের গন্ধ মেখে। সখি বন্ধু কী দূত করে পাঠাল মেঘকে। প্রলাপের মতো বলে চলেছে বুলা ।আলুথালু কেশ থেকে পুষ্পেরা ঝড়ে গেছে। ধূলায় লুণ্ঠিত তার শাড়ির আচঁল কৃষ্ণ বিহনে।

কী যে চেয়েছিলে কেন কেঁড়ে নাহি নিলে।
সুরে ও বাণীর মালা দিয়ে তুমি আমারে ছুঁইয়া ছিলে।

যদি সত্যিই কৃষ্ণ মেঘকে দূত করে পাঠিয়ে থাকে, আর মেঘ যদি ফিরে গিয়ে তোমার এই বিরহের কথা কৃষ্ণকে বলে, তা হলে কৃষ্ণের বড়াই আরো বেড়ে যাবে। তুমি ধৈর্য ধর সখি।
বুলাকে বোঝাতে চেষ্টা করছে তাঁর সখীরা।

অবস্থা অনুকূল দেখে ফিরে এলাম কৃষ্ণের কাছে।
আমাকে দেখে কৃষ্ণ ব্যাকুল হয়ে শুধালেন...
বন্ধু বয়ে নিয়ে এলে কী বারতা?
বললাম...
আমি অনেক অনুনয় বিনয় করে রাধাকে রাজি করে এলাম। আর দেরী করা ঠিক হবে না বন্ধু। আপনি রাধার জন্য নিজেকে তৈরী করুন।

ঠিক আছে একটা শুভ লগ্ন আসুক। বললেন কবি শাহীন হাসান তৃপ্ত চিত্তে।
বুলাকে তো পেয়েই গেছি। এখন আর তাড়া কিসের! এমনই ভাব তাঁর কথায়।
পুরুষ শুধু জয় করেই আনন্দ পায়। মেয়েরা কাউকে একবার কৃষ্ণ ভেবে মনের সিংহাসনে বসালে সারাটা জীবন তাদের কেঁদেই কাঁটে রাধার মতো।

বুলা রাজি হয়েছে সেটা কেন বলতে গেলাম শাহীনকে! কৌশলে কথা বলতে হবে।

শুভ লগ্ন বলতে ঠিক কী বোঝাতে চাইছেন ?

তিনি আরাম করে সতেজ হয়ে বসলেন চেয়ারে, তারপর বললেন;
শুভ লগ্ন বলতে সবাই যা বোঝে আর কী! যেমন গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান। কখন কোথায় থাকলে কার সাথে কার মিলনে কোন বাধা নিষেধ নেই এই আর কী।

আমি সব জেনে এসেছি। যে গোধূলিতে বুলার রূপে মুগ্ধ হয়ে হাওয়ার মুখের থেকে বাঁশি নামিয়ে আপনি স্বকণ্ঠে গান ধরেছিলেন, সেটাই শুভ লগ্ন, আর তখন থেকেই আপনদের দৃষ্টি বিনিময় হয়ে আছে। এখন কেবল একটা আনুষ্ঠানিকতা বাকী।

আমার কথায় কবি কিছুটা ক্ষেপে গিয়েই বললেন;
তো সেই আনুষ্ঠানিকতার জন্যও তো সময় লাগে। বুলার জন্য উপহার যোগাড় করতে হবে। সমস্ত বিশ্ব তন্নতন্ন করে খুঁজে আনতে হবে একশ আটটা নীল পদ্ম!

বিশ্বের সমস্ত বৃক্ষের ফল-ফুলকে আমি আপনার জন্য মুক্তা করে দেব, পৃথিবীর পর্বতমালাকে করে দেব হিরে। বিনিময়ে আপনি বুলা নামের মেয়েটিকে ভুলে যাবেন।

না বন্ধু, না। আমি কোন কিছুর বিনিময়ে তাকে ভুলতে পারব না।

ভাবলাম; এই তো লক্ষী ছেলে, এবার লাইনে এসেছো।

বললাম; আপনার কী মনে হয়, বুলা নামের মেয়েটি আপনার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে, সে আপনার উপহারের জন্য? নাকী আপনাকে পাবার জন্য?

আমার মনে হয় আমার জন্য।
শুভষ্য শীঘ্রম:। তা হলে আর বিলম্বের কারণ দেখছি না। পুষ্পকরথ সজ্জিত আছে, আমনি যাত্র করুন।

তাদের মালা বদল তো হয়ে গেল, কিন্তু নিন্দুকেরা বলে বেড়াতে লাগল;
হে! মালা বদল তো হয়ে গেল, ঘর বাঁধুক দেখি।

আমার এ ঘরে আপনার করে গৃহদ্বীপ খানি জ্বাল বলে, কবি শাহীন হাসান বুলাকে নিয়ে গৃহ প্রবেশ করলেন।
নিন্দুকেরা বলল;
হে, ঘরে উঠেছে, তো কী হয়েছে? ছেলে-পিলে করে দেখাক দেখি!

একদিন ঘর আলো করে মায়ের কোলে এলো আবৃত্তি

নিন্দুকেরা নিন্দা করে আনন্দ পাক। আমরা এমন একটা সুন্দর ছেলে উপহার দেয়ার জন্য অভিবাদন জানাই ছেলের বাবা মা-কে। এই দিনটির জন্যই কবিগুরু গেয়ে গেছেন;

এদিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার
আজি প্রাতে সূর্য্য উঠা, সফল হল কার?।
কাহার অভিষেকের তরে সোনার ঘটে আলোক ভরে,
উষা কাহার আশিষ বহি হল আঁধার পার?।

বনে বনে ফুল ফোটেছে, দোলে নবীন পাতা-
কার হৃদয়ের মাঝে হল তাদের মালা গাঁথা?।।
বহু যুগের উপহারে বরণ করি নিল কারে,
কার জীবনে প্রভাত আজি ঘুচায় অন্ধকার।।

ছবি: 
18/10/2007 - 10:08অপরাহ্ন

মন্তব্য

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

পুত্রের নাম আবৃত্তি? বাহ, দারুণ তো! অভিনন্দন! হাততালি

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

দীনহিন এর ছবি

অনবদ্য!

পুরুষ শুধু জয় করেই আনন্দ পায়। মেয়েরা কাউকে একবার কৃষ্ণ ভেবে মনের সিংহাসনে বসালে সারাটা জীবন তাদের কেঁদেই কাঁটে রাধার মতো।

চলুক

বহু যুগের উপহারে বরণ করি নিল কারে,
কার জীবনে প্রভাত আজি ঘুচায় অন্ধকার।।

আমার প্রিয় গান। যতবার শুনি, নতুন করে বাঁচার প্রেরণা পাই।

আর 'আবৃত্তি' কি সুন্দর একটি নাম!

.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

অভিনন্দন, কবি শাহীন হাসান (যদি ভুল বুঝে না থাকি)!

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

এক লহমা এর ছবি

বাঃ! সপরিবার কবি শাহীন হাসানকে অভিনন্দন! আর কবিবন্ধুকে চলুক এই চমৎকার পোস্টটির জন্য!

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

চলুক

____________________________

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

অনেকদিন পর আপনার লেখা পড়লাম। লেখায় নতুনত্বের স্বাদ পেলাম। দারুণ হয়েছে লেখাটা!
ভাল থাকুন। আনন্দে থাকুন। হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।