জীবন নদীর পাঁকে পাঁকে

পুতুল এর ছবি
লিখেছেন পুতুল (তারিখ: সোম, ১৭/১১/২০১৪ - ২:১১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

শুভ, আমি তোমাকে আমার প্রিয় কবিতাটির মত মুখস্ত করতে চাই। প্রথম নিঃশ্বাসের শব্দ থেকে হৃদয়ের প্রথম স্পন্ধন পর্যন্ত। তোমার ভাবনা গুলো, ইচ্ছে গুলো, চাওয়া পাওয়া গুলো আপনার করতে চাই, তবে তোমাকে গ্রাস না করে। আমি তোমাকে আমার অঙ্গে ধারণ করি নাই, অন্তরে, মনে, চিন্তায় চেতনায় বপন করেছি। সে বপিত বীজে পত্র-পল্লব অঙ্কুরিত হয়েছে, ফুটেছে ফুল। তার সৈরভ, গৌরব, ছায়া,গন্ধ আমাকে মায়ায় আচ্ছন্ন করে রাখে সারাদিন, সারাক্ষণ। হয়ত যতটুকু দিতে পারব, তা চাওয়ার তুলনায় কম হবে। কমটুকু পূর্ণ করে নেবে এই ভেবে যে, আমার সবটুকু পেয়েছ। আমি মূলধণ রেখে উদবৃত্তটুকু দেইনি। সবটুকু দিয়েছি।

আমার উপর ভীষণ রাগ করলে চিঠির এই অংশ টুকু পড়ে শোনায় শুভ। মনে মনে বলি চাপা তো ভালই মারতে পারি! বাস্তবতা এমন যে, বেচারীকে নিত্যদিনের বাইরে ভাল করে দেখতেও পাই না। জীবনে ভাল কিছু শিখিনি। কঠোর পরিশ্রমেও প্রয়োজনটুকু মেটানো দায় হয়ে যায়। ক্লান্ত দেহ আর শ্রান্ত মন নিয়ে বাড়ি ফিরে দরজায় চাবি ঢুকালেই ছুটে আসে চারু। হাতদুটো উঁচু করে কোলে উঠতে চায়। আঁচল এখন আর বাবার কাছে চেয়ে চেয়ে না পেতে পেতে, কিছুই চায় না। কিন্ডার গার্টেন থেকে এসে টিভি দেখতে দেখতে খায় অথবা খেতে খেতে টিভি দেখে। জীবন এবং জীবন ধারণের সব এখন কর্পোরেট পদ্ধতিতে চলে। নাস্তার ডিম থেকে পড়নের কাপড় পর্যন্ত এই শৃংখলার ভেতর। শিশুরা পন্য। বাচ্চাকে কিন্ডার গার্টেনে রাখার জন্য টাকা দিতে হয়। এখানে বাচ্চাদের জন্য একটি সরকারী চ্যানেল আছে। তবে ভাল বা শিশুদের প্রিয় কার্টুন বেসকারী চ্যানেলে হয়। মাসে মাসে অত টাকা আমরা খরচ করতে পারি না। এ সব চেনেলের বিজ্ঞাপন দেখায় বিনে পয়সায়। সেটা দেখে আঁচল বলে; বাবা আমাকে এটা কিনে দেবে? আমি না করতে পারি না। তবে কিনে দিয়েছি মাত্র একবার "মিয়া এন্ড মি" এর একটা ডিভিডি ২০ ইউরো দিয়ে। ইউটিউবে ইউরোপ-আমেরিকার কিছুই পাওয়া যায় না। কপি রাইটের কারণে। সস্তার তিন অবস্থা হলেও। ঠাকুর মার ঝুলি ভালই ছিল বাংলা শেখার জন্য। কিন্তু এখন আঁচল বুঝতে পারে যে বাংলায় সিসিমপুর ছাড়া আর কোন ভাল কার্টুন নেই। মীনার সব কিছু ভাল। শুধু ভাষাটা শুদ্ধ না। শুদ্ধ হলে হয়তো উদেশ্য পূর্ণ হতো না। সবার জন্য সবাই বুঝতে পারে এমন ভাষাই ব্যবহার করা ভাল। তবে তাতে বাংলা ভাষাটা শুদ্ধ করে শেখার একটা সুযোগ নষ্ট হল।
এদিকে দিনে দিনে আঁচল বাংলা বলা কমিয়ে দিচ্ছে বা ভুলে যাচ্ছে। শুভ আঁচলের কথা শুনে এমন ভাব করে রাখে যেন বুঝতে পারেনি। বাধ্য হয়ে আঁচল বাংলায় চেষ্টা করে। কিন্তু আমার মাথায় অতো কিছু থাকে না। আমাকে জার্মানে কিছু বললে জবাবটা আমি জার্মানেই দেই।

আগামী সেপ্টেম্বর থেকে স্কুলে যাবে আঁচল। সেটা আবার বাধ্যতামূলক। মেডিক্যাল সার্টিফিকেট ছাড়া স্কুল মিস করা দণ্ডনীয় অপরাধ। দেশে যেতে হবে ছুটির সময়। সেইটা আবার গ্রীষ্মকালে। গরমের সময় দেশে গেলে আমার মেয়েরা থাকতে পারবে না। সব কিছু বিবেচনা করে দেখলাম এই একমাত্র সুযোগ। ধার-দেনা করে আনিস ভাইয়ের সাথে ওদের তিনজনকে দেশে পাঠাব। শুভ জার্মান পাসপোর্টের আবেদন করে রেখেছে। না পাওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশী পাসপোর্টের মেয়াদ বাড়িয়ে আনাই ভাল। সেটাতে আবার নতুন করে ভিসা নিতে হবে। তার জন্য সময় লাগবে চার সপ্তাহ। জার্মান নাগরিকতার সনদ পেলেও জরুরী পাসপোর্টের জন্য সময় তিনদিন। তাতে আবার লাগবে বাংলাদেশের ভিসা। এক সপ্তাহ গেল পাসপোর্ট পেতে। বাসে বার্লিন গেলাম ভিসার জন্য। রাতের বাসে গিয়ে সকালে ভিসা নিয়ে দুপুরের বাসে ফেরৎ আসলাম।

এই দৌড়ের উপরে আবার কাজ করতে হয়। যাওয়ার সময় সুটকেস যখন গাড়িতে তুলি তখন কাদেরের মতো বলতে ইচ্ছে করে; „কুলির কাম করি না"। কিন্তু আমার কোন উপায় নেই। সব মিলিয়ে একশ কেজি গাড়িতে তুলে তৈরী হতে হতে এবং তৈরী করতে করতে কেউ আর কারো দিকে তাকাতে পারি না। মাল-টাল বিমানের গাড়ে চাপিয়ে দেখি ইমিগ্রেশনে ঢোকার সময় হয়ে গেছে। দর্শনার্থীদের শেষ ফটক পার হয়ে চারু দৌড়ে বাবার কাছে চলে আসে। শুভ-র কোলে চারুকে দিয়ে আমি দূরে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য রাখছি। মানুষের ভীড়ে শুধু আনিস ভাইয়ের মাথাটা ভরসা। একসময় সবাই দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল সবাই। শুভকে ফোনে জিগ্গেস করলাম সব ঠিক আছে কীনা। চারু এবং আঁচলকে সামলাতে "হ, ঠিক আছে", এর বেশী কথা বলা হল না।

আঠার ইউরো পার্ক মাষুল দিয়ে বন্দর থেকে বের হতেই আবার ফোন বাজল। আফসোস হচ্ছিল- কারো কাছ থেকেই বিদায় নেয়া হয়নি। এই কাজটা আমি ভাল পারিও না। "বিমানে উঠেছি, কিন্তু আনিস ভাইকে দেখতে পাচ্ছি না।" মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। "তুমি কোন চিন্তা কর না। আমরা পারব।" কিছু কারা নেই। শুভকে বললাম "শুভ আমি তোমাকে ভালবাসি" কিন্তু ততক্ষণে গাড়িতে বাজতে শুরু করেছে "উদাও হাওয়ার পাগলামীতে, পাখা ওদের উঠে মাতি"। গাড়ির গান এবং ফোন একই চ্যানেলে। শুভ ফোন রেখে দিয়েছে। সে জন্য গান শুরু হয়ে গেছে। ভালবাসি কথাটা মানুষ খুব বেশী ব্যবহার করে। আমি একেবারেেই করি না। যা ও কালে ভাদ্রে কখনো করি, তখন ভালবাসার মানুষটি তা শুনতে পায় না।

বাসায় এসে পড়লাম ফাপরে। একদম পিনপতন নীরবতা। কত কাজ, কত লেখা জমিয়ে রেখেছি। সময় পেলে করব। কিন্তু কিছুই করতে ইচ্ছে করে না। দুই বোন বাবাকে চীৎ করে মেঝে শুইয়ে পেটের উপড় ঘোড়া চালায়। দু'পা দুদিকে রেখে বসে আর উঠে। আমি বলি "মাইও মাইও" আমাদের গ্রামের ভাষায়। দুই বোন খিল খিল হাসে। আবার উঠে, আবার বসে, আর বলে; "বাবা মাইও মাইও বলো"। শারীরিক কষ্ট তো হয়ই। তার ভেতরেও এক ধরণের আনন্দ আছে। অনেক দিনের জন্য সে আনন্দ আর পাব না।

হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। দেখি ভোর হয়ে গেছে। রকি বলল ফোনে; তোমার মেয়েরা এখন আমার কোলে। বাইরে তাকিয়ে দেখি ভোর হয়ে গেছে। জীবন নদীর পাঁকে পাঁকে মন আর প্রাণ দোলতেই থাকে। হয়তো এই দোলার নামই জীবন। পাঁকে পাঁকে প্রিয় মানুষগুলোকে যেন সময় মতো বলতে পারি তারা আমার কত প্রিয়। কত ভাল আমি তাদের বাসি।

ছবি: 
18/10/2007 - 10:08অপরাহ্ন

মন্তব্য

তাসনীম এর ছবি

ভালো লাগলো।

টাকা পয়সার জন্য দৌড়াতে দৌড়াতে আমার ক্লান্ত লাগে খুব, এরপরেও সন্তানের সান্নিধ্য সারাদিনের কষ্ট ভুলিয়ে দেয়।

আপনাদের জন্য শুভকামনা রইল অনেক অনেক।

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

পুতুল এর ছবি

ধন্যবাদ বস। আপনারাও ভাল থাকবেন।

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

অতিথি লেখক এর ছবি

কষ্ট আর আক্ষেপ লেখায় ঝরে ঝরে পড়ছে।

এই তো জীবন !
"লাইফ ইজ বিউটিফুল", সবার জন্য নয়। সবসময়ের জন্য নয়।

রাজর্ষি

পুতুল এর ছবি

কথা সেটাই। এত সুন্দর করে বলেছে বাংলার বাউল! এখন গানটাই শুনি বসে বসে। জীবন নদী এমন বাঁকে চলছে যে; আক্ষেপ ছাড়া বেশীর ভাগ সময়ই আর কিছু করার থাকে না। এই তো বহতা নদীর মতো জীবন। ধন্যবাদ রার্জষি। ভাল থাকবেন সব সময়।

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

অতিথি লেখক এর ছবি

শুভকামনা অনিঃশেষ জানবেন।

আমি মূলধণ রেখে উদবৃত্তটুকু দেইনি। সবটুকু দিয়েছি।

ভালো থাকবেন। অনেক। সবসময়।

দীপংকর চন্দ

পুতুল এর ছবি

ধন্যবাদ দীপংকর চন্দ। আপনিও ভাল থাকবেন সব সময়।

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

প্রিয়জনের সঙ্গ সারাদিনের ক্লান্তি আর আক্ষেপ ভুলিয়ে দেয়। সুন্দর লেখা।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।