সচলে আমার পড়া প্রথম উপন্যাস জুলিয়ান সিদ্দিকী-র "কম্পেন্ডার"

পুতুল এর ছবি
লিখেছেন পুতুল (তারিখ: সোম, ০৭/০৭/২০০৮ - ৬:৪২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

উপন্যাসটির লিংক-

এর আগেও সচলে বেশ ক'টি উপন্যাসের অনেকগুলো পর্ব পড়েছি। মধ্যবিত্তের দীর্ঘশ্বাসের কুয়াশায় আচ্ছন্ন সে সব লেখা পড়তে কেমন যেন দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। ক্লান্তিতে চোখে ঘুম আসে। মাঝ পথে থেমে যাই।
বলাই বাহুল্য; সে সব বইয়ের নিখুঁত ভাষা, ঘটনা, পাত্র-পাত্রী এবং বর্ণনা সব কিছু কেমন যেন গতানুগতিক। জুলিয়ান সিদ্দিকী-র আরো কয়েকটা গদ্য রচনা পড়েছি। সেখানে নিজের ফেলে আসা গ্রামের আভাটুকু দেখেছি। সে কারনেই তার পিডিএফ-এ ক্লিক করেছি। সময়ের অভাবে বইটি পড়তে আমাকে দু'বার বসতে হয়েছে।

"পাউডারের গুড়োর মতন লবণ ভাসে সোভানের গায়ে।"

আমি সোভানের গায়ের সে লবণটা দেখতে পাই। সোভান গত দশদিন বন্যার জলে ডোবা ঘরের চালে চিড়া আর গুড় খেয়ে পরে আছে। বাঁধের উপর আশ্রয় নেয়া জাহেদা-র অনুরোধ আর জলের তলে তলিয়ে যাওয়ার ভয়ে শেষ পর্যন্ত সোভান বাঁধের উপর আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।

খাদ্যের অভাবে ঔষধের প্রয়োজনীয়তার কথা বাঁধে আশ্রয় নেয়া অনাহারীদের মনে থাকে না। তারা ঔষধের লঞ্চ ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু ডাক্তারের কম্পাউন্ডার সোভান বুঝতে পারে যে কাজটার ঠিক হয়নি। সোভান বাঁধে আশ্রয় নেয়া কেরামত মেম্বারকে সাথে নিয়ে রিলিফ এবং একটা চাপ কলের ব্যবস্থা করে ফেলে। মমিনার ডায়েরিয়ায় গুড় আর লবণ দিয়ে সেলাইন বানাবার পদ্ধতি সবাইকে শিখিয়ে দেয়।

এভাবেই মেম্বারের বড় মেয়ে মদিনার হৃদয় জয় করে ফেলে সোভান। কিন্তু একদিকে মদিনার পাণি গ্রহন করলে ঘরজামাই হওয়ার ভয় আর অন্য দিকে জাহেদা-র প্রতি অশৈশব টান। এর টানাপোড়নে বাঁধের মানুষদের দুঃখ-দুর্দশা যেন একটু অবর্ণনীয় থেকে যায়।

আমার কাছে ভাল লেগেছে ঘটনার স্থান-কাল-পাত্র-পাত্রী চেনা-জানা বলেই হয়তো। সে কারণেই মনে হয় জুলিয়ান সিদ্দিকী খু-উ-ব কাছে গিয়ে প্রান্তিকের মানুষ জন চিনেছেন। তাদের দৈনন্দিন জীবন প্রণালী দেখেই বর্ণনা দেয়া যায় না। লেখককে সে জীবনে অভ্যস্ত হতে হয়। জুলিয়ান সিদ্দিকী-র বর্ণনা শুনে মনে হয় তিনি সোভানের মত নাও বাইতে পারেন। এমনি কথোপকথন, সংলাপ ঠিক যাদের কথা বলা হচ্ছে তাদের মত, তাদের মুখে, তাদের ভাষায় লিখেছেন। দু'একটা অতি আঞ্চলিক শব্দ কিছুটা পরিমার্জণ করা হয়েছে বলে মনে হল, যার কোন প্রয়োজন ছিলনা।

সোভান আর জয়নাল বেলতলী বাজারে নাও ভিড়ালে আমার চেনা বেলতলী বাজারের ল্যাংটার দরগায় মেলার কথা মনে পড়ে যায়।
আমি বেশী কথা বলি বলেই সোভানের হতাশ দৃষ্টিতে প্লাবিত জনপদের ছবি, বর্ণনার সংযমে পরিস্কার দেখতে পাই না। বাঁধের দুই দিকের জীবন ধারার পার্থ্যক্যও একই কারনে আবছা থেকে গেছে। কিন্তু বন্যার কারণে বাঁধে আশ্রয় নেয়া মানুষের দুর্ভোগ তাতে কমেনি।
সোভান-কে "ছোবান" লিখলে আরো চেনা লাগতো। সে ভাবেই কম্পেন্ডার এর জায়গা জলেভাসা বা অন্য কোন শব্দ দিয়ে বইটির নাম করলে জুৎসই হতো।

আরো একটু যত্ন নিয়ে সোভান জাহেদা-র প্রেমাকুলতা একটু কমিয়ে বন্যাকবলিত মানুষের জীবনের কথা একটু বিস্তার করে, অনু-পরমানু গল্পের দিকে ঝোক কম হলে জলে ভাসা মানুষের মুখপাত্র হয়ে বইটি "তিতাস একটি নদীর নাম"-এর পাশে স্থান করে নিতে পারতো!

ব্যাতিক্রমী এ বইটি লেখার জন্য জুলিয়ান সিদ্দিকী-র তারিফ করতেই হয়। আশা করি বইটি পড়ে আরো অনেক সচল তাদের মূল্যবান মতামত ও পরামর্শ দিয়ে কম্পেন্ডারের লেখককে শক্তি ও সাহস যোগাবেন।
ধন্যবাদ জুলিয়ান সিদ্দিকী।


মন্তব্য

পুতুল এর ছবি

লিংকটি এভাবে সুন্দর করে দেয়ার জন্য মডারটেরদের ধন্যবাদ।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

উপন্যাসটা পড়া হয়নি সময়াভাবে... পড়বো আশা করি... আর না পড়ার মূর্খতায় কিছু বলতেও পারলাম না...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

পুতুল এর ছবি

পড়ে কিছু বলুন। নতুন লেখকরা উৎসাহ পাক।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

আমার কান্দন আসতেসে। সত্যিই!
কোনো পাঠক এমন ভাবে আলাদা পোস্টে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করবে তা আমার ভাবনার অতীত। তাই আমার পোস্টে লীলেন ভাইয়ের মন্তব্যের জবাবে সাহস করে বলতে পেরেছি যে, আলাদা পোস্টে সমালোচনা চাই। সচলায়তনে সমালোচনার ক্ষেত্র তৈরী হোক।

আপনি অদ্বৈত মল্ল বর্মণ-এর "তিতাস একটি নদীর নাম"-এর পাশে 'কম্পেন্ডার' রাখার মত হতে পারতো বলে আমাকে খুবই শরম দিলেন।

একজন সুন্দর মানুষ তার কিছু ত্রুটি নিয়েও সুন্দর। আর একজন অসুন্দর মানুষ তার অনেক সৌন্দর্য নিয়েও কুৎসিত। তা কেবল ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে। তাই পাঠক হিসেবে আপনার আবেগ চিন্তা বিশ্লেশণকে শ্রদ্ধা জানাই। কিন্তু আমাকে দিয়ে অত বড় মাপের সৃষ্টি তো দূরের কথা- পাঠক প্রিয় সাধারণ কোনো একটি লেখার জন্যই প্রাণপাত করছি দীর্ঘকাল ধরে।

তবে একটু সচেতন ভাবেই চেষ্টা করি আমার লেখার কোনো অংশ যেন 'অমুক' এর মত হয়ে না উঠতে পারে। কোনো চরিত্রে যেন 'অমুক' চরিত্রটির ছাপ না পড়ে। যে কারণে অনেক সময় রচনা গভীরতা হারায়। যা আমার ব্যর্থতা বলেই মনে করি। একজন মনোযোগী পাঠক ( যেমন আনোয়ার সাদাত শিমুল এর লেখা নীলুফার যখন মারা গেলো নিয়ে কয়েকজন বোদ্ধা পাঠক বেশ জোরালো মন্তব্য করেছেন।) বিদেশী বা দেশী চরিত্র কিংবা লেখকের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে চেষ্টা করেন। যা অনেক সময় লেখকের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। আমার ভয় সেখানেই। আর তেমনটি হলে মনে হয় আমার শ্রম সবই পন্ড!

তবে আপনার লেখা পড়ে আমার ভালো লাগছে এই ভেবে যে, একজন পাঠক কিছুটা হলেও "কম্পেন্ডার" নিয়ে ভাবছেন। তবে এখানেই কিন্তু কম্পেন্ডার শেষ হয়ে যায়নি। বাকিটা ভিন্ন নামে শেষ করেছি।
পুতুল পরিশেষে আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। পাঠোত্তর বিশ্লেষণ একজন লেখকের জন্য অনেক কিছু।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

পুতুল এর ছবি

ভাই ধন্যবাদ দেবার কিছু নেই।
অনুকরনের ভয়ে অনেককেই দেখি খুব ভীত!
শেরালী প্রথমে গল্পের আকারে ছোট ছোট পোষ্টে সা.ইন ব্লগে দিয়েছিলাম। অবশ্যী ধারাবাহিকতা রক্ষা করে। সে খানকার পাঠকদের প্রতিক্রিয়া মনে রাখার মত।
অনেকের ধারনা "আমি প্রতিষ্ঠিত লেখক" মনের দুঃখে বা রাগে বেনামে ব্লগে লিখছি। অনেকে বলেছেন আক্তুরুজ্জামান ইলিয়াসের মত কেউ কেউ হুমায়ূন আযাদের েকটি বইয়ের নামও দিয়েছেণ। আমি কিন্তু আমার বিষয়ে মানে যা নিয়ে লিখছি, তাতে কোন ভাবেই কারো দ্বাড়া প্রভাবিত নই। তবু পাঠক মিলিয়ে দেখেন।
আমার কাছে এর সব গুলিই সম্মানের বিষয়।
আমি যত চেষ্টাই করিনা কেন; আমার লেখার ষ্টাইলটি বদলাতে পারব না। বদলাতে চাইও না। আর আমাদের চিন্তায় চেতনায় আমাদের অভিজ্ঞতার ছাপ থাকতে বাধ্য।
হোক সেটা আমাদের পঠিত লেখকদের বা ফেলে আসা গ্রামের। আমি সে প্রভাব থেকে মুক্ত হতে চাইনা।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

অমিত আহমেদ এর ছবি

উপন্যাসটি পড়ার আগ্রহ আরও বাড়লো আপনার পোস্টের দরুন।


ওয়েবসাইট | ফেসবুক | ইমেইল

পুতুল এর ছবি

আসা করি পড়বেন।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

তীরন্দাজ এর ছবি

আপনার পোষ্টের জন্যে ধন্যবাদ। সে কারণেই উপন্যাসটি পড়া হবে আমার!
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

পুতুল এর ছবি

পড়ুন।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

খেকশিয়াল এর ছবি

আহারে কত কিছু জইমা যাইতাসে, কবে পড়ুম !

-----------------------------------------
রাজামশাই বলে উঠলেন, 'পক্ষীরাজ যদি হবে, তা হলে ন্যাজ নেই কেন?'

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

পুতুল এর ছবি

সত্যিই, কত্ত লেখা কবে পড়ব!
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

কম্পেন্ডার লিংকটি এখানে
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

নিঝুম এর ছবি

প্রথমেই পুতুল কে অনেক ধন্যবাদ এই পোস্টটির জন্য । সাধারণত আমরা যা করি পুতুল তা করেন নি । আমরা অনেকেই ব্যাস্ততা, আলসেমি এবং আরো নানান অজুহাতে অনেক লেখার মন্তব্য করিনা বা করতে চাই না । আলাদা পোস্ট তো দূরের কথা । পুতুল এইখানে আমাদের ছাড়িয়ে গেলেন । তাঁকে আবারো অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাই ।

কম্পেন্ডার এখনো পড়া হয় নি । জানিনা কেমন । অতি অবশ্যই পড়ব । তবে , জুলিয়ান সাহেবকে যতদূর পর্যন্ত জেনেছি, সেখানে এই ভদ্রলোক সম্পর্কে শুধু শ্রদ্ধাই জন্মায় । সাহিত্যের জন্য , লিখবার জন্য তিনি জীবনে অনেক কিছু ত্যাগ করেছেন । অনেক কিছুর সাথে কম্প্রোমাইজ করেছেন । লেখাই তাঁর জীবন । মরুর উষ্ণ আর কঠিন জীবনেও তিনি ক্রমাগত আমাদের জন্য লিখে চলেছেন । এইরকম একজন ত্যাগী আর নিবেদিত লেখক সচলে আর কয়জন আছে আমার ঠিক জানা নেই । অসাধারণ এই লেখকের আরো আরো লেখা আমাদের প্রত্যাশায় থেকেই গেলো । আশা করি তিনি নিরাশ করবেন না ।

তার সুস্থ জীবন আর সাফল্য কামনা করছি । আবারো পুতুল কে অনেক অনেক ধন্যবাদ ।

---------------------------------------------------------
পৃথিবীর সব সীমান্ত আমায় বিরক্ত করে। আমার বিশ্রী লাগে যে, আমি কিছুই জানিনা...

---------------------------------------------------------------------------
কারও শেষ হয় নির্বাসনের জীবন । কারও হয় না । আমি কিন্তু পুষে রাখি দুঃসহ দেশহীনতা । মাঝে মাঝে শুধু কষ্টের কথা গুলো জড়ো করে কাউকে শোনাই, ভূমিকা ছাড়াই -- তসলিমা নাসরিন

পুতুল এর ছবি

নিঝুম আপনাকেও অনেক অনেক ধন্যবাদ।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।