উড়ছে শুধু স্মৃতির ধূলো

পুতুল এর ছবি
লিখেছেন পুতুল (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৫/০৮/২০১০ - ৩:৩৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

 
 
নজরুলের কেনা ফুটবল খেলতে সপ্তাহে চারআনা চাঁদা দিতাম। নাড়া ক্ষেতে বলে শট দেয়ার চেয়ে, বল নিয়ে কাড়াকাড়িটা-ই বেশী হতো। "কাড়াকাড়িতে" হেরে গিয়ে তাকে উন্নত করতাম "কিলাকিলিতে"। দুটোর শুরুই আমি করতাম কিন্তু হারতাম দুটোতেই।
 
কিলাইয়া আমারে তক্তা বানানোর পর হয়তো একটু মায়াও হতো। তাই কখন যেনো আমাদের চিরশত্রুতা কমতে কমতে একটু বন্ধুত্বের দিকে গেলো। সেটা হাসেমের কারণেই। ক্লাস ফাইভের সেন্টার পরীক্ষা শেষ। অনেক বড় হয়ে গেছি। এইসব আগডুম-বাগডুম করে মায়ের কাছ থেকে এক রাত্রি হাসেম, তসলিম, আর জাকিরের সাথে থাকার পারমিশন পেলাম। তসলিমদের বাংলো ঘরটার চাল ছিল পিচদুনার (বিটুমিন ?) ড্রাম কেটে বানানো টিনের। তো সেই টিন থেকে মাঝে মাঝে পিচ গায়ে পড়তো! তুলতে গেলে চামড়া সহ উঠে আসতো। কিন্তু তার চেয়ে ভয়ংঙ্কর ছিল গাড়ীর শব্দ।
 
গুলাইল দিয়ে কে কত পাখি তাড়ালাম, তার গল্প। কে কার মাঁচা থেকে শশা চুরি করেছি, কার গাছের ডাব চুরি করেছি, খেজুরের রসের কলসে পেঁপের ডগা ঢুকিয়ে খেতে গেলে ধরাপরার সম্ভবনা নাই, এমন নিরাপদ পুকুরের পাড়ের সন্ধান করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছি। অমনি একটা ট্রাক মাথার উপড় দিয়ে গেল। ধড়ফড় করে উঠে বসি। হাসেম আশ্বস্ত করে। "আরে ডরাইছ না, পুকুরের উফড়ে দিয়া গাড়ি তোরে চাপা দিতে আইতে পারব না"। তসলিম আর হাসেমদের বাড়ি একদম রাস্তার ধারে। ঢাকা-চট্রগ্রাম মহা সড়কের উত্তর পাশে। রাস্তার পরে একটা ডোবা। তার পর ওদের বাড়ি। এতো গাড়ি চলে! আমাদের বাড়ি গ্রামের একদম উত্তর দিকের শেষ সীমায়। কাজেই এতো গাড়ির শব্দ শুনে অভ্যস্ত না।
 
সেই থেকে শুরু। সেভেন-এইটে উঠার পর রকিব ভাই একটু পাত্তা দিতে লাগলো। পড়া-লেখায় সাহায্য করে, বিরাট উপদেশ দেয় কিন্তু যতো রকমের নাফরমানী কাম আছে তারও নেতৃত্ব দেয়। দিনে খালের উপড় বাঁশের হাক্কা দেয়ার জন্য অবস্থাপন্ন লোকের কাছে বাঁশ চেয়ে আনি। সাঁকো বানাই। লোকের প্রশংসা কুড়াই। আবার যারা বাঁশ দেয় নাই, রাইতে আমরা তাগোরে বাঁশ দেই। এই ভাবে বাঁশ দিতে গিয়ে কোন এক বাড়ির মুরগীর খোয়াড় সহ নিয়ে আসার জন্য উঁচু করতে গিয়ে টের পাই; খাঁচার নীচে ছাউনী নাই। মোরগ-মুরগী কড়কড় করতে করতে ছড়িয়ে যাচ্ছে, আর বাড়ির মালিক শুরু করছে হাউকাউ। এর মাঝে ঝিড়ঝিড়ে বৃষ্টি। রাস্তাঘাট পিচ্ছিল। আছাড় খাইতে খাইতে নিরাপদ দূরত্বে এসে দেখি আমি ছাড়া বাকী সবাই মুরগী নিয়াই ভাগছে।
 
রকিব ভাইদের বাড়ি একদম ফাঁকা। রান্নাটা সবাই মিলে সেখানেই করলাম। কাইজ্যা শুরু হইল খাওয়ার সময়। তছলিম কয়;
-এই হাইস্যা (হাসেম) তুই এতডি নিছস কেন?
ব্যাস শুরু হয়ে গেলো হাসেমের রাগ!
-যা, হোগাডা খাইতাম না। জাকির সুযোগ পেয়ে বলে;
_না খাইলে তোর থালাটা আমারে দে।
মুরগী ধরতে না পারায় আমি প্রায় অতিথি। কাটা-কুটি এবং রান্না-বাড়ায় একটু বেশী খেঁটেছি যাতে কোন খোঁটা না শুনতে হয়। তাই এই সব ঝগড়ায়ও একটু পিছে থাকি। তার পরেও হাসেমকে বললাম; আরে না খাইলে তো ঠকবি।
আমার কথায় হাসেম আরো চেতে; হোগাডা খামু! তোমরা বেক মাংস নিয়া গলার হাড্ডিগুলা রাখছ আমার লাইগ্যা।
বেচারা খেলো না। সকাল বেলা উঠে আমাকে বলে, দোস্তো; আমি একটা বাইঞ্চোদ। তারা আমারে চেতায়া দিসে ইচ্ছা কইরা। আর রাগ করুম না, রাগ করলে ঠকতে আয়।
 
এ ভাবেই ভালমন্দে আমাদের দলটা। এলাকার ভাল কাজে আমাদের ঘনঘন ডাক পড়ে। পড়ালেখার নামে আমি, জাকির, রকিব ভাই চলে গেলাম শহরে। তসলিম আর হাসেম থেকে গেলো গ্রামে। শহরে গেলেও প্রায় প্রতি সপ্তাহে বাড়ি যাই। জাকির গ্রামে আসে প্রায় প্রতিদিন। অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে লোকে বিশ্বাসই করতে চায় না যে , আমরা শহরে পড়ালেখা করি।
 
রকিব ভাই আর জাকির ছাড়া আমরা তিনজন একটু অভাবী সংসারের ছেলে। টিউশানী, লজিং করে চলে আমার। অভাবের তাড়নায় আমাদের পক্ষে ঠিকমতো পড়ালেখায় মন দেয়া সম্ভব হয় না।
 
 কিছুদিন বাদে আমি চলে আসি জার্মানে। হাসেম কিছু করতে না পারলেও একটা বিয়ে করে দেখালো আমাদের। প্রথম দেশে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে, শুনি মেয়ের বাপ হয়েছে হাসেম। অর্থায়নে আমাদের তেমন কোন ভূমিকা না থাকলেও প্রথম ঠেলাটা আমরাই দিলাম এম.এ জলিল হাইস্কুল প্রতিষ্ঠায়। ইন্টারমিডিয়েট পাস হাসেম একটি শিক্ষকতার চাকরি পেলো সে স্কুলে। কালে-ভদ্রে পরস্পরের খবর পাই। কিন্তু এই খবরের জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না।
 

দেশ থেকে অনেক মৃত্যুর সাথে নিজের বাপের মরার খবরটাও এসেছিল। বয়স হয়েছে, অনেক অসুখ-বিসুখে ভুগতেন বাবা। সেদিক থেকে বাবার মৃত্যু দুঃখের হলেও তেমন অপ্রত্যাশিত ছিল না। অপ্রত্যাশিত ছিল হাসেমের মৃত্যু। তার বড় মেয়ে কলেজে পড়ে। মোট চারটা মেয়ের সব থেকে ছোটটার তিন বছরও হয় নি। সেই হাসেম তুই মরার আর সময় পেলি না! তাও আবার ট্রাকের ধাক্কায়। এখন কে দেখবে তোর মেয়ে গুলো! জীবনের কুড়িটা বছরের সঙ্গী চলে গেলি! নিজের বাপের মৃত্যু সংবাদেও এতো খারাপ লাগে নি। জীবন এতো অসংগত কেনো?               


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

শেষে এসে এভাবে মনটা খারাপ করে দিলেন, কাজ কি ঠিক হলো?

পাগল মন

মেহবুবা জুবায়ের এর ছবি

জীবন এতো অসংগত কেনো? এর কী কোন উত্তর হয় পুতুল?

--------------------------------------------------------------------------------

ফারুক হাসান এর ছবি

একটানে পড়ছিলাম। শেষটা পড়ে খুব খারাপ লাগলো। আর কিছু লিখতে পারছি না।

তিথীডোর এর ছবি

"জীবন এতো অসংগত কেনো?"
সেইই..

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

বর্ণনাটা ভালো লাগল। আর মৃত্যু চিরকাল অপ্রত্যাশিত।
___________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।