বাংলা নাটক!

পুতুল এর ছবি
লিখেছেন পুতুল (তারিখ: শুক্র, ০৬/০১/২০১২ - ১১:০৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এক সময় খুব বালখিল্য কিছু করে ফেললে বা করতে চাইলে বলা হতো; বাংলা সিনেমার মতো । এখন বলা হতে পারে বাংলা নাটকের মতো। বাংলা নাটকের এই বেহাল অবস্থায় যাওয়ার আগে নাটক/ সিনেমা সম্পর্কে আমার অবস্থানটা পরিস্কার করার জন্য আমার দেখা একটা সিনেমার একমিনিটের আলোচনা করে নেই এখানে।

হাজার বছর ধরে। জহির রায়হানের উপন্যাস পড়া ছিল। মেয়ের বাংলা পরিকল্পনায় যোগ হয়েছে ইউটিউব। এতদিন সেটা ল্যাপটপেই চলতো। এখন সরাসরি টিভিতে ইন্টারনেট সংযোগ হয়েছে। ঠাকুরমার ঝুলি/সিসিমপুর দেখে মেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে আমরা পুরানো নাটক/সিনেমায় ঢুকি। সেভাবেই “”” “*হাজার বছর ধরে খুঁজে পেয়েছে বেগম।

একটা দৃশ্যে নায়ক মাছ মারার কোচ ঠিক করছে। যন্ত্রটা অনেক গুলো চোখা বাঁশের কঞ্চি শক্ত করে বাঁধা বাঁশের আঁটি। হাতলটা হাতের মুঠোতে ধরা যায় এমন চিকন। বাঁশের কঞ্চির মাথা যা মাছকে বিদ্ধ করবে লৌহার চুঙ্গি পরানো। মাছের গায়ে লেগে সে গুলো বাঁকা হয়ে যায়। অনেক সময় শক্ত পাথর বা অন্য কিছুতে লেগেই বাঁকা হতে পারে। সাধারণতঃ কিছুদিন পরপর সেগুলো সোজা করতে হয় বা নতুন করে চোখা করতে হয়। রাতের আবছা আলোয় তাই করছে নায়ক; ভেবেছিলাম আমি। কিন্তু তিনি কোচের হাতল চাছা-ছোলা করে বন্দুক দিয়ে গুলি ছোড়তে যে ভাবে এক চোখ বন্ধ করতে হয় সেভাবেই কোচ সোজা আছে কী না তাই দেখছেন। এখানে কী করতে হবে সেটা সম্ভবত মূল বইয়ে লেখা নেই। তাই একটা কিছু করছেন নায়ক। সেটা না হয় মেনেই নিলাম। কিন্তু তারপর মাছ মারতে যাচ্ছেন ঝাকি বা কণি জাল নিয়ে। আমার কাছে ঝাকি বা কণি জাল নিয়ে মাছ মারতে যাওয়ার আগে কোচ সারানোর কাজটা যৌক্তিক মনে হয়নি মোটেই। সমস্যা সেখানেই শেষ নয়। কোচ নিয়ে মাছ মারা, আর জাল নিয়ে মাছ মারার মৌসম আলাদা। একই সময়ে এই দুটি মাছ মারার যন্ত্র অন্তত আমার অভিজ্ঞতায় কখনো ব্যবহৃ হয় না প্রকৃতিক কারণে। অন্তত হাজার বছর ধরে গল্পের নয়কের ফুটফুটে নাদুস-নুদুস-ফর্সা চেহারা থাকার কথা নয়। অসংগত লেগেছে নায়ীকার সাজ-গোজ বয়স।
অথচ ছবিটিতে অনেক দৃশ্য, সাজ-সজ্জায় বাস্তবের কাছাকাছি রাখার চেষ্টা চলেছে। ক্ষেত-ক্ষামার-ঘর-বাড়ি নির্বাচনে
যথেষ্ট যত্ন ছিল। তার পরেও আমার কাছে আরো অনেক বিষয় অসংগত মনে হয়েছে। তবে বাংলা সিনেমার মতো এতো বেশি অসংগত নয়।

এতো যখন বললামই তখন নাটক নিয়ে আমার কষ্টটাও বলে রাখি। গ্রামে নাটক-ফাটক কখন ছিলনা। যাত্রাই একমাত্র বিনোদন। অনেক যাত্রায় অভিনয় করেছি। কিন্তু এসএসসি পাশ করার পর নাক উঁচু হয়ে গেলো। যাত্র-ফাত্রা আর ভাল লাগে না। অন্য দিকে খেলা ঘরের ছোঁয়ায় কিছু নাটকের অভিজ্ঞতার সাথে জমা হলো রাজনৈতিক সচেতনতা। পাল্টা-পাল্টি আর ডিগবাজীর রাজনীতিতে মন টিকলনা বেশী দিন। ঢাকায় এসে যোগ দিলাম নাটকের দলে। সংলাপ করতো এক বন্ধু। সেখানে কয়েকদিন গোত্তা মেড়ে পরিচয় হলো দেশ নাটকের সাথে। তাদের কাছে নাটকের পাঠ। সে এক হিরন্ময় কষ্ট। ঈদের দিনেও পথ নাটক করেছি। তপন দাশ, শামসুল আলম বকুল, ইশরাত নিশাত, সালাহ উদ্দিন লাভলু, মাসুম রেজারা এক সময় আরন্যকে ছিল। পরে শুরু করে দেশ নাটক। বিশেষত্ব ছিল পথ নাটক। খুব কমিটেড ছিল মানুষ গুলো। তাদের সাথে থেকে নিজের ভেতরেও তার বীজ বপিত হয় নিজের অজান্তেই। প্রথম মঞ্চ নাটকে মাথাটা কামিয়ে ফেলি টিকি রেখে।

এই সময়ে জনপ্রিয় টিভি নাটক এই সব দিন রাত্রি, পূর্ব রাত্রি পূর্ব দিন, সংসপ্তক। আমার ধারণা সংসপ্তক আমার দেখা শ্রেষ্ঠ ধারাবাহিক নাটক। ছোট মালুর চেহারা, চরিত্রের সাথে না মেলাটা পুশিয়ে দিয়েছে অভিনয় দিয়ে। রইসুল ইসলাম আসাদের অতিঅভিনয় টুকুও মাফ করা যায়। আর সব ভীষণ রকমের ভাল। নাটকটা না কী এখন পাওয়া যাচ্ছে না। দুঃখের কথা। শঙ্খনীল কারাগাড়ের হুমায়ূন আহমেদ মারা গেলেন এই সব দিন রাত্রিতে। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে পথনাটকের কুশীলবরা পথেই রইলাম। তার পরেও সংসপ্তকের মতো কাজ দেখে প্রতিষ্ঠিত নাট্যকর্মীদের বিটিভিতে যাতায়ত মাফ করে দেই আমরা।

এই সব দিনরাত্রি নাটকে আবুল হায়াতের মাথায় পানি ঢালছে তাঁর মেয়ে। মাথা গরমের কারণ; দ্রব্যমূল্য নয়, এরশাদের ভোট ডাকাতি নয়, সেশন জট নয়। মাথাব্যথার কারণ; পার্কে এক লোক কলা খেয়ে চোলকা ফেলেছে পায়ে চলার পথে। দেশ নিয়ে চিন্তা করাটা এমন হাস্যকর ভাবেই আরো অনেক বিষয়ের সাথে উপস্থাপিত হয়েছে হুমায়ূন আহমেদের নাটকে। নন্দিত নরকের লেখককে এখানে খুঁজে পাওয়া কঠিন। হাসের মতো নিত্য নবনব ডিমে তিনি সায়লাব করে চললেন সাহিত্য এবং টিভির নাটক। আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজ পেয়ে গেলো নিরেট বিনোদন। কত গমে কত আটার মতো হাসির সংলাপে ভেসে গেল বিটিভি। তখনো বিটিভিতে সপ্তাহে একটা মঞ্চ নাটক দেখানো হতো। অন্তত কোয়ালিটি সচেতন দর্শকের খোরাক কিছু ছিল। নাটকে ঢুকতে হতো মঞ্চ নাটকের দলে ভিড়ে। অভিনয়ের কিছু অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শেখার একমাত্র সুযোগ তখন মঞ্চ নাটকের দলগুলোই দিতো। বিদেশী নাটকের সাংঘাতিক রকমের ভাল বাংলা রুপান্তরও করেছে তাঁরা। অনুবাদ কর্মে তাদের সমকক্ষ ছিল কেবল বাম ধারার অনুবাদকরা।

কিন্তু যেহেতু টিভির নাটকেই কিছু আয়ের সম্ভবনা। কাজেই অনেকের ঝোক ছিল সে দিকে। আমাদের দেশ নাটক মঞ্চ নাটকেই যেতে পারল না সবাইকে নিয়ে। মাসুম রেজার বিরসা কাব্য নাটকে যে কোন ধরণের সহযোগীতা করেও কোন চরিত্র করতে রাজী হলেন না তপন দাশ। গনতান্ত্রিক মানুষ বলে সবার সিদ্ধান্ত মানলেন ঠিকই, কিন্তু নিজের অবস্থান থেকে নড়লেন সামান্যই। তখন খুব কঠিন মনে হলেও এখন শ্রদ্ধাই হয় তপনদার সিদ্ধানের প্রতি।

আমাদের কঠোর অবস্থানকে পাশ কাটিয়ে রাথি-মহারথিরা এরশাদের অধীনেই নিয়মিত কতো গমে কতো আটার হিসাব মেলাতে লাগলেন। ধীরে ধীরে নীচের দিকে নামতে লাগল নাটকের মান। দেশ ছেড়ে আসার পর আর নাটকের কোন খোঁজ-খবর নেই। দিন গড়িয়েছে অনেক। এক বন্ধুর বাসায় গিয়ে পেলাম মাসুম রেজার টিভি নাটক দ্বিচক্র যান। টিভিতে রাজনৈতিক নাটক টাবু। তারপরেও দ্বিচক্র যান চলে। কিন্তু ঐ বন্ধুর গিন্নি নাটকটি দেখে খুব আপ্লুত নন। কারণ হলো তিনি নাটক দেখেন হালফ্যশনের জামা-জুতোর মডেল দেখতে। গ্রামের গল্প নিয়ে মাসুম রেজার নাটকটা তিনি আমাকে দিয়েই দিলেন।

আরো কিছুদিন পরে আসল ইন্টারনেট। তার সুবাদে গিন্নির সাথে বসে আমরা দেখলাম গুলশান এভিনিও। মানুষ নাটকটা কেন দেখেন সেটা তারাই জানেন। কিন্তু আমার কষ্টটা অন্য জায়গায়। তারেক আনামের মতো লোকেরা এই ধরণের নাটক করে কী ভাবে! কতো সস্তায় সন্তুষ্ট হচ্ছে আমাদের দর্শক। আমরা দেখি বলেই তো নাটকটা চলছে। আদার বেপারী আমি আর জাহাজের খবর লই না।

কিন্তু শুভ টিভির নাটক দেখে। সংসারে শান্তি বজায় রাখতে আমি বসে যাই একটা কমেডি দেখতে। ভাড়ায় কাইজা
করে এমন দুই মহিলার একজন ডলি জহুর। তাঁকে ভাড়া নেয় স্কুলের জমি পূর্ণদখল করতে মামুনুর রশিদ। সহশিল্পীদের তুলনায় অনেক খারাপ ছিল দুজনের অভিনয়। অনেক চ্যানেল হয়ে বরং নাটকের মান কমেছে। দুশ্চিন্তার বড় কারণ হচ্ছে এই দুজন প্রবীন শিল্পী এমন একটা অকল্পনীয় নীচু নাটকে অভিনয় করতে গেলেন কেন!

শঙ্খনীল কারাগাড়ের অভিনেত্রী ডলি জহুর। মামুনুর রশিদের লেখা নাটক জার্মান ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। সেটা কম কথা নয়। তাদের মতো শিল্পীরা এই সব ফাও নাটকে অভিনয় করেন, শুধু টাকার জন্য! কমপক্ষে তিন দশক ধরে তাঁরা টিভিতে অভিনয় করেও এখনো এতো অভাবী, যে এই সব নাটক করতে হয়! টিভির বাংলা নাটক এখন বাংলা সিনেমার সমার্থক হয়ে গেল। ব্যাপারটা হজম করতে কষ্ট হচ্ছে।


মন্তব্য

শিশিরকণা এর ছবি

আমি কিছুদিন আগে ফারুকী গং দের নাটক পর্যন্ত দেখতে পেরেছি, কিছু উপভোগও করতে পেরেছি। কিন্তু এখন আর কোনটাই দেখার মত পাই না, নাটকের ২ মিনিট দেখে ধরে ফেলা যায় বাকি ২০ মিনিট কি তেনা পেচানো হবে, কারন সেই একই তেনা আরও বহু নাটকে বহুবার পেচানো হয়েছে।
আপনি অনেক উচু রসের মানুষ।, আপনার গুলশান এভিন্যু দেখে কেমন লেগেছে ভাবছি। এইটা হাল ফ্যাশানের জামা-জুতা দেখার নাটক, এর দর্শক যে আছে বুঝাই যাচ্ছে।

~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~

পুতুল এর ছবি

আমাদের সময় সরকার নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ার বিপরীতে অনেক নাট্যকর্মীর বেশ শক্ত অবকস্থান ছিল। শংকর সাওজাল এরশাদের পতন পর্যন্ত সে সংজম রাখতে পেরেছিলেন। আমার দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে এখন সেই শিল্পীদের মাঝে এমন কোন কমিটমেন্ট একেবারেই নেই কেন। এখনতো এরশাদের পেটোয়া বিহিনীও নেই।
এই ধরণের সং সাজতে এখন সেই সময়ের তারকাদের দেখলে বরং ভয়ইপাই। কর্পরোট কী সব কিনে নিল? না কী ভাল চিন্তার নাটক লেখক নেই কোথাও?

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

শিশিরকণা এর ছবি

বাঙ্গালির রুচিবোধ নিয়ে আমি খুব বেশি আশাবাদী হতে পারি না। বেশিরভাগ মানুষের রুচিবোধ তো হিন্দি সিরিয়াল লেভেলে, সুতরাং এর যা দেখতে চায় সেই রকম নাটকই চ্যানেল গুলা পরিবেশন করে। মাঝে মাঝে দুই একটা নাটক পাওয়া যায় ভাল মানের, নতুন চিন্তা ভাবনার, কিন্তু সেগুলা খুঁজে পেতে হলে আপনাকে এই অখাদ্য সহ্য করে টিভিতে চোখ সাঁটিয়ে বসে থাকতে হবে।

~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~

পুতুল এর ছবি

একমত। কোন না কোন ভাবে আমরা দর্শকরা বা দর্শকদের একাংশ এই অবস্থায় যেনে বা না জেনে সহযোগীতা করছি।

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

নিভৃত_সহচর এর ছবি

গুলশান অ্যাভিনিউর প্রযোজক বা পরিচালক নিমা রহমান, এই জন্যই বোধহয় তারিক আনাম অভিনয় করেন। ওইটাকে আবর্জনা বললে কম বলা হয়। বাসায় অন্যরা দেখে বলে এই অপসৃষ্টি মাঝেমধ্যে চোখে পরে। একেতো হিন্দি সিরিয়ালের স্টাইলে করা তার সাথে যোগ হয়েছে হাস্যকর স্ক্রিপ্ট। শহুরে আধুনিকারা একটা অনাগত শিশুকে অপয়া আখ্যা দিয়ে কচকচিয়ে যাচ্ছে দেখে মেজাজ যারপরনাই খারাপ হয়ে গেছিলো।
কিছুটা ছ্যাব্লামি থাকলেও লংমার্চ দেখে মজা পেয়েছি আর হাড়কেপ্পন দেখার ইচ্ছা আছে।

পুতুল এর ছবি

গুলশান এভিনিও বাংলা নাটকের তলানীতে মাইলষ্টোন হয়ে থাকবে মনে হয়।

লংমার্চ হাড়কেপ্পন দেখতে হবে।

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

মঞ্চ নাটককে পুরোপুরি পেশা হিসেবে নেবার মতো অবস্থা তৈরি করতে না পারলে মঞ্চ নাটকের আর উন্নয়ন সম্ভব না। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে কিছু বিবর্তন হয়তো হবে কিন্তু উন্নয়ন হবে না। স্বজনপ্রীতি, দলবাজি, দাদাগিরি, নেতৃত্বের ও প্রতিভার বিকাশ হতে না দেয়া, পড়াশোনার অভাব এমন আরো কিছু বিষয় এই ফিল্ডটাকে সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো চেপে বসেছে। বাংলাদেশের অনেক মানুষ আছে যাদের হাতে প্রচুর টাকা আছে। তারা খুব সহজেই পাঁচ-ছয়টা নাটক কোম্পানী খুলে ফেলতে পারে, মঞ্চ বানিয়ে ফেলতে পারে। এদেরকে এদিকে আগ্রহী করতে হবে। সরকারের আশায় বসে থাকলে চলবে না। আর দুনিয়ার যে কোন ক্ষেত্রে মেধাবী-পরিশ্রমী-আন্তরিক লোকের বিকল্প নেই। এই তিনটা গুণই একসাথে আছে এমন লোকের অভাব আছে মনে হয়।

********************

হাজার রজনী'র চেয়ে বেশিবার প্রদর্শিত একটা নাটক দেখার জন্য ঢুকলাম। নাটক অর্ধেক শেষ হবার আগেই বের হয়ে আসতে বাধ্য হলাম। দুর্বল সংলাপ, খারাপ অভিনয়, মিসকাস্টিং, অপ্রয়োজনীয়-কুরুচিকর অঙ্গভঙ্গী কী নেই সেখানে! নাটকের দর্শকদের দায়টাও বোধহয় কম নয়। এমন নাটক যে স্রেফ আবর্জনা সেটা word of mouth-এ ছড়িয়ে দিলেই হতো। তাহলে আর বগল বাজিয়ে হাজার রজনী চালাতে হতো না।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

পুতুল এর ছবি

মঞ্চ নাটকে এই উন্নত বিশ্বেও কিন্তু সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা বিপুল। আমাদের জন্য এমন অকণ্পনীয় পৃষ্ঠপোষকতা কখনই সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। ব্রেখটের শততম জন্মবার্ষিকীতে সব কটি প্রদর্শনীর টিকেট কিনেছিলাম বিক্রির শুরুর দিকে।
সেই সুবাদে আসন পেয়েছি প্রথম সাড়িতে। এক মাত্র কালো আদমী দেখেই বোধ হয় আমার দিকে এগিয়ে এলেন থিয়েটারের পরিচালক। বাংলাদেশ বাড়ি শুনে জানতে চাইলেন ব্রেখটের নাটক দেখতে এসেছ কী জন্য? বললাম আমরা ব্রেখটের অনেক নাটক অনুবাদ করে অভীনয় করেছি। শুনে ভদ্রলোক আকাশ থেকে পড়লেন যেন!
বানে বন্যায় তোমাদের দেশতো পানীর নীচেই থাকে বেশীরভাগ সময়। সেখানে নাটক কর কী করে!
সরকারী সহায়তার সাথে এখানে আরো একটি বিষয় যুক্ত। তা হলো মঞ্চ নাটকের দর্শক মানেই সুশিক্ষিত, মার্জিত ভদ্রলোক।
আর মমতাশীল নাট্যকর্মীর তো বিকল্প নেই। এখানে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার সাথে থাকে অনেক ধরণের বৃত্তি। সব মিলিয়ে সুপার ষ্টার না হতে পারলেও নাটক করে চলা যায়। আমাদের দেশে নাট্যকর্মীদের বলতে গেলে কোন সুবিধাই নেই। পাঁচ বছর নাটক করে একটি পয়সাও কখনো পাইনি। উল্টো বিনিয়োগ করতে হয়েছে। বকুল ভাইয়ের লক্ষ্য ছিল এক সময় নাটকের শো শেষ হলে বাড়ি ফেরার রিক্সা ভাড়াটা যেন সব নাট্যকর্মীকে বিক্রিত টিকেট থেকে অর্জিত অর্থে দেয়া যায়। এমনও দিন গেছে মহিলা সমিতিতে নাটকের মঞ্চ সাজিয়ে বাড়ি ফেরার পয়সা না থাকায় পার্কের বেঞ্চে ঘুমিয়েছি।

দর্শকের দায়তো আছেই। আমাদের সময় সাত ঘাটের কানাকড়িকে বলা হতো বেদের মেয়ে জোস্না। কিন্তু নাটকটা সফল হয়েছিল! কারণ দর্শকরা যেতেন নাটক দেখতে নয়, তারকা দেখতে। সে সামর্থ্য নাগরিক, দুই থিয়েটার, আরন্যক ছাড়া আর কারো ছিল না। কাজেই আমাদের বিরসা কাব্য কেউ দেখতে যেতেন না। নাটককে পেশা হিসাবে নেয়ার মতো সুযোগ না থাকায় আমার মতো নাটক পাগল কতো ছেলে মেয়ে চীরতরে প্রস্থান করেছে নাটকের মঞ্চ থেকে!

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

কালো কাক এর ছবি

গুলশান এভিনিউ টাইপ নাটকে যেসব জামাজুতা দেখায় সেগুলো রাস্তাঘাটে কাউকে পরতে দেখা যায় না। এগুলোর সাথে একমাত্র মিল পাওয়া যাবে বস্তাপঁচা হিন্দি সিরিয়ালগুলোর। কাহিনির বালাই নাই শুধু অসম্ভব কুটনা কতগুলো মহিলা ভয়ংকর ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের সাথে ভয়ংকর কুটিল অঙ্গভঙ্গী করতে থাকে !
এগুলো ছাড়া আছে ফারুকী ভাইবেরাদরদের নাটক। এগুলোর ফর্মুলা আরো ভয়ংকর। এক বা একাধিক মেয়ের পিছনে এক বা একাধিক ছেলে নানান ফন্দিফিকির করতে থাকে, সেই মেয়েরাও আবার একই সাথে কয়েকটা ছেলেকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাতে থাকে। শহর বা গ্রাম দুই পটভূমিতেই এই নাটকগুলো বিস্তৃত। কিছু শহুরে নাটক জুড়ে থাকে আবার কয়েকটা জুটির প্রেম যা প্রকাশিত মোবাইল আলাপন ও পার্কে/রেস্টুরেন্টে ডেটিংএ।
এই দুই টাইপ ছাড়া টিভি নাটক দুর্লভ।

তবে ভালো নাটক মানেই সিরিয়াস বিষয় নিয়ে নাটক মানতে পারছি না। এইসব দিনরাত্রি ভালো লেগেছিলো।

"হুমায়ুন আহম্মেদ" বানানটা চোখে লাগছে।

কালো কাক এর ছবি

দুঃখিত। ভুল ধরতে যেয়ে ভুল করেছি। "হুমায়ূন আহাম্মদ বা হুমায়ূন আহম্মদ বানানটা চোখে লাগছে"

পুতুল এর ছবি

এই সব দিনরাত্রি ভাল লাগতেই পারে। সম্ভবত আল মনসুর বলেছিলেন "আমার নাটক দেখার পর দর্শকরা একটা বিনোদনমূলক সন্ধ্য উপভোগ করেছেন, এইটুকুই মনে রাখবেন বড়জোর"। এক সময় সিরিয়াস বিষয় নিয়ে নাটক কেন করতে হবে? এমন একটা ধারণার বিপরীতে এই ধরনের কথাবার্তা ছিল ফ্যাশন। একজন দর্শক কেন একটি অনুষ্ঠান দেখবেন সেটা তার ইচ্ছা। এ ব্যাপারে কিছু বলার নেই।

কিন্তু সত্যিই এই সব নাটকের আবেদন কী খুব বেশী? কতো নাটক হয় আবার কেবল আর্থিক কারণে কতো নাটক চিত্রিত হয় না। এখানে দর্শকের নির্বাচনের কিন্তু একটা ক্ষমতা আছে। ধরুন আনিসুল হকের "বালক বালিকা"। ঢাবি এবং মাস্তানী নিয়ে ছাত্র/ছাত্রীদের জীবন দেখাতে চেষ্টা করেছেন নাট্যকার। মেয়েটার পথ রোধ করে একটা মাস্তান টাইপের ছেলে। মেয়ের প্রেমিক হাতে পায়ে ধরে ঐ মাস্তানের হাত থেকে মেয়েটার ব্যাগ ফেরত এনে দেয়। ছেলেটার এই নপংশুকতায় মেয়েটা সুব বিরক্ত হয়। বিরত্ব দেখাতে ছেলেটা নিজেই মাস্তান হতে চেষ্টা করে। পুলিশের হাতে ধরাপরে কিছুদিন হাজতবাসের পর মাস্তানী ছেড়ে বিদেশে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। মেয়েটা খুসী হয়।
এই হল নাটক। এখানে ছেলেটার মাস্তান হওয়াই একমাত্র উপায়? ছাত্র/ছাত্রীদের আবদান কিন্তু আমাদের দেশে কম নয়। দেশের বিভিন্ন আন্দোলন তার সাক্ষী। নাটকটি বলে দিচ্ছে কোন কিছু বদলে দেয়ার দায়-দায়ীত্ব কেবল আলু পেপারের। ছাত্র/ছাত্রীরা শিক্ষাঙ্গনে মাস্তানদের তাড়া খেয়ে বিদেশ যাওয়াই একমাত্র পথ। এই যে আরমপ্রিয় বিনোদন, সেটা আমার ভাল লাগে না।
দেখুন দেশ চিন্তা করছেন আবুল হায়াত এইসব দিনরাত্রি নাটকে। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে দেশ গরম। আর আবুল হায়াত মাথা গরম করছেন, একটা লোক কেন কলার খোশা রাস্তায় ফেলছে তা নিয়ে। এই যে বাস্বতাকে পাশ কাটিয়ে জনগনের পয়সায় এমন একটা পরিবেশ দেখানো হচ্ছে যেখানে কলার খোশা পথে ফেলা ছাড়া আর কোন সমস্যা নেই মাথা ঘামানোর মতো। আমার আপত্তিটা সেখানে। কিন্তু সবাই আমার মতো ভাবতে হবে এমন কোন কথা নেই।

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

সাত্যকি. এর ছবি

রাজনৈতিক স্লোগানবাজি বিহীন নাটক দেখতে আপনার আপত্তি থাকতেই পারে! সেক্ষেত্রে এইসব দিনরাত্রি আপনার জন্য নয়।
ঠিক যেরকম গুলশান এভিনিউ আমার জন্য নয়।
রিমোট তো আমাদের হাতেই।
মঞ্চনাটকের ঘরানা টিভিনাটকে টেনে আনলে তো যাত্রায় পরিণত হবে। মঞ্চনাটকের স্টাইল আলাদা, বোধকরি দর্শকও তাই।
'হুমায়ূন আহাম্মদ' আর 'শংখনীল কারাগাড়' -- বানানের এই দশা কি নতুন প্রকারের বিদ্রুপ নাকি?

পুতুল এর ছবি

সিরিয়াস বিষয় নিয়ে নাটক হলে তাকে রাজনৈতিক নাটক বলতেই হবে এমন কোন কথা নেই। যেমন রাজনৈতিক নাটক হলেও দোষের কিছু নেই।
মঞ্চ নাটকই এক সময় দেখানো হতো বিটিভিতে, মঞ্চ নাটকের ঘরানা নয়। আর মঞ্চ নাটক মানেই যাত্রা এমন ধারণাটা ঠিক নয়। মঞ্চ নাটকে সরকারী বিধি/নিশেধ না মেনেও নাটক করা যায়। এখানে নাট্যকারের স্বাধীনতা অনেক বেশী। যে কোন আইন কানুন দিয়ে কোন শিল্পকে কেবল বাঁধা যায়। শিল্প সৃষ্টি হয় না। এরশাদ পতনের আগে একবার বৃটিশদের তৈরী আইন দিয়ে মঞ্চ নাটককে বাঁধতে চেয়েছিলেন। টিএসসি থেকে বেদম প্রহার করে বের করে দিয়েছিলেন এরশাদের পেটোয়া বাহিনী সব নাট্যকর্মীদের। কাজেই মঞ্চ নাটকের ক্ষমতা খুব কম নয়।
যেমন যাত্রাকেও অবহেলার কোন কারণ নেই। পশ্চিমের অপেরার মত আমাদের যাত্রা। আপনার আমার মতো ভদ্রলোকেরা যাত্রায় যাইনা বলেই যাত্রা আজকের অবস্থায় নেমে এসেছে। যত সহজে বলা যায় যাত্রার মতো। যাত্রা করা কিন্তু ততই কঠিন।
চারদিকে দর্শক ভরা মঞ্চে দাড়িয়ে যুদ্ধ বিগ্রহের পাশাপাশি অভিনয় এবং গানও জানতে হয় যাত্রা শিল্পী কে।

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

তপন দাশ এর ছবি

মিথুন,

মাসুমের কাছে শুনে তোমার লেখাটি পড়লাম। ওই সময়কে বেশ মনে রেখেছো। পথ নাটক নিয়ে এখন অনেকে ডক্টরেট করেছে। ভুল ইতিহাসেই ডিগ্রি নিচ্ছে। সে কথা থাক। তুমি একটা ভুল তথ্য দিয়েছ। আমি এবং মাসুম আরণ্যক থেকে এসে দেশ নাটক করিনি, আমরা সরাসরি দেশ নাটক গড়ি।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।