মেঘদূত

পুতুল এর ছবি
লিখেছেন পুতুল (তারিখ: বুধ, ১৫/০৮/২০১২ - ৪:০৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

দেশ নাটক-এ ঢুকেছিলাম তাদের খেলা নাটক দেখে। সব রকমের টেকনিক্যাল সাহায্য ছাড়া মঞ্চের এমনকি পাড়ার সব মানুষ শুনতে পায় এমন জোড়ে যাত্রার সংলাপ বলার অভিজ্ঞতা কাজে লাগল। কিন্তু সমস্যা হল উচ্চারণ নিয়ে। যে কোন কথা বললেই মনি-নিশাত-শেলী আপারা হাসি হাসি মুখ করে তাকায়। প্রথমে খুশীই হয়েছি। একটু জড়তা ভাঙ্গার পর সবাই যে কোন কথা বললেই একটা ভুল উচ্চারণ খুঁজে পায়। অবস্থা এমন হল যে; কথা বলতেই ভয় করে।

তখন টিএসসিতেই নাটক-ফাটক সহ সব রকমের বাদাইম্যা কাম-কাইজ হইত। খবর পেলাম কণ্ঠ শীলনে ভর্তি হলে শুদ্ধ বাংলা শেখা যায়। ভর্তি হয়ে লাভে হল যে; বুঝতে পারলাম, আমার পক্ষে শুদ্ধ বাংলা বলা কখনো সম্ভব হবে। কিন্তু লেগে থাকলাম। পরম শ্রদ্ধেয় ওহিদুল হক পড়াতেন লিপিকা। সিদ্ধি গল্প এতো ভাল লাগল যে, মুখস্থ করে ফেললাম। কোন এক শুক্রবার সকালে ক্লাসে সেটা পড়তে হবে। এর মধ্যে সবাই যেনে গেছে যে আমি একটা ক্ষ্যাত। কোন কিছুই পড়িনি। কোন কিছুই জানি না। আমার আগে পড়েছিল একটা মেয়ে। মেয়েটার উচ্চারণ অতুলনীয় ভাল। সে জন্য তিনি এখন একজন খ্যাতিময়ী অভিনেত্রী বাংলাদেশে। এবার আমার পালা। পড়ার শেষে স্যার জানতে চাইলেন; কারটা ভাল হয়েছে? বেশীর ভাগ ছাত্র-ছাত্রী মেয়েরটা পছন্দ করল। কেউ কেউ ভোটদানে বিরত রইল। স্যার কী বলেন? সবাই অপেক্ষা করছে স্যারের মতামতের। তিনি বললেন মেয়েরটা ভাল হয়েছে, তবে আমার কাছে বেশী ভাল লেগেছে ছেলেরটা।

এই ছেলেটা এই জীবনে এর চেয়ে বড় স্বীকৃতি আর পায় নি। অনেকেই পাত্তা দিতে লাগল। খুব মার্জিত রুচির এক দম্পতি সব সময় ক্লাসে পেছনে এসে বসতেন। টিএসসির দোতালায় একটা ঘরে মেঝে বসে ক্লাস হতো কণ্ঠ শীলনের। একদিন সেই দম্পতির মাসুদ (আসলে ভদ্রলোকের নাম মসযূদ, কিন্তু শুনে এবং বলে অভ্যাস, তাই মাসুদ ভাই ডাকতাম আমরা) ভাই বললেন তিনি মেঘদূত নামে একটা আবৃত্তি সংগঠন করবেন। আমি যোগ দিলে তিনি খুশী হবেন। আসলে যোগ দিয়ে আমিই বেশী খুশী হয়েছিলাম।

পরে জেনেছি মাসুদ ভাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কাজ করেন। ভাবী ঢাবিতে ইংরেজী পড়ান। আবৃত্তির চেয়ে আড্ডাটা বেশী ভাল লাগত। সমবয়সী বেশ কিছু মেয়ে ছিল। সময়টা বেশ ভাল কেটেছে। তারপর এক সময় গাট্টি গোল করতে হল। চলে এলাম জার্মানীতে। কেটে গেল কুড়ি বছর।

গত বছর বা তার আগের বছর দীপন ভাইয়ের সাথে তবলায় টুংটাং করার জন্য গেলাম বিসবাডেন। বাংলাদেশকে সাহায্য করা হবে, তাই সেখানে একটু বাংলা সংস্কৃতি দেখাতে হবে। দীপন ভাইয়ের কাছে শুনেছিলাম; আমাদের রাষ্ট্রদূত সেখানে থাকবেন। খাওয়ার সময় এক ভদ্রলোক কেমন করে যেন সামনে পড়ে গেলেন। খাবার-দাবার-পানীয় কিছু চাইলেন না। শুধু জানতে চাইলেন আমি কতদিন হল জার্মানে এসেছি। পরে শুনলাম তিনি আমাদের রাষ্ট্রদূত।

পরের বার মিউনিখে। তবলা বাজাচ্ছি মঞ্চে বসে। সামনের সাড়িতে কণ্ঠ শীলনের সেই দম্পতি। মাসুদ ভাইয়ের চুল-টুল একটু কমে গেছে। কিছু সাদাও হয়েছে। কিন্তু ভাবী সেই কুড়ি বছর আগের অবস্থাতেই আছেন। দুজনকে পাশা-পাশী দেখে চিনতে অসুবিধা হল না।

ভয় হয় এমব্যাসির কথা শুনলে। এক ভদ্রলোকের মায়ের ওপেন হার্ট সার্জারি হবে। বউ ছেলে নিয়ে দেশে যাবেন। কিন্তু ভদ্রলোকের জার্মান পাস। ভিসা লাগবে। আমি তখন বেকার। তিনি উপযুক্ত লোক ভেবে তার ভিসা নেয়া, টিকেটা, কেনা-কাটার দায়ীত্ব আমাকেই দিলেন। সব ঠিকঠাক। রবিবার ফ্লাইট। শুক্রবারেও এমব্যাসি থেকে আমাকে ফোনে নিশ্চিত করা হল; ভিসা লাগিয়ে আপনার বন্ধুর পাসপোর্ট পাঠিয়ে দিয়েছি। মায়ের অসুখ বলে কথা। সেখানে কোন গাফিলতি চলে না।

শনিবারের ডাকে আর পাসপোর্ট আসে নাই। তিনটা টিকেটের প্রায় ১৮০০ ইউরো জলে গেল। টাকা না হয় গেল। কিন্তু পাসপোর্ট না হলে তো দেশেই যেতে পার না! কী করি! আমার বন্ধুর পাসপোর্ট বহন করার লিখিত অনুমতি পত্র নিয়ে সোমবার সকালে পৌঁছলাম দূতাবাসে। তাঁরা বলল; নাহ্, এই নাম-ধামে আমাদের কাছে কোন পাসপোর্ট আসেনি তো। আরে ভাই, কতো লোকে ফোন করে কার কথা বলছেন! আমাকে তিনি চিনতেই পারলেন না।

কিন্তু আমার বাড়ি মাথাভাঙ্গা না হলেও, মাথাভাঙ্গার কাছে। বার্লিনে মাথাভাঙ্গা গ্রামের লোক আছে শ খানেক। প্রায় সবাইকেই চিনি। কিন্তু ফোন নাম্বার আছে শুধু জসীমের। তাকেই ফোন করলাম। ঘটনা শুনে সে আরো সাত-আটজন নিয়ে এমব্যাসিতে হাজির। সেই ভদ্রলোক যিনি একটু আগে আমার পাঠানো পাসপোর্টটা খুঁজে পাচ্ছিলেন না; তিনি ব্যস্ত হয়ে উঠলেন- আরে জসীম ভাই যে, কী মনে কইরা? এদিকে তো একেবারেই আসেন না! বসেন চা দিচ্ছি। জসীম বলল; চাহা-মাহা লাগদ না, তার পাসপোর্টটা দেন। হ্যাঁ হ্যাঁ দিচ্ছি। এর জন্য কষ্ট করে আসতে হয়! একটা ফোন করলেই তো পারতেন। ম্যাজিকের মতো কাজ হল। পাঁচ মিনিটের মধ্যে সিল মেরে পাসপোর্টটা হাতে দিয়ে দিলেন।

অথচ তৎকালীন রাষ্ট্রদূতও অনেক অনুষ্ঠানে বিনয়ের সাথে সব সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কত বার! তাই এবার আমার বেগমের পাসপোর্টের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য আগে-ভাগেই পাঠালাম। মাসুদ ভাইকে রাষ্ট্রদূত দেখে খুশী হয়েছিলাম। হয়তো বাংলাদেশের সব রাষ্ট্রদূত মাসুদ ভাইয়ের মতো কণ্ঠশীলন বা মেঘদূত করে না। কিন্তু তারমানে এই নয় যে, তাদের দায়ীত্বজ্ঞান কম। এইটা সিস্টেমের (পদ্ধতির) ত্রুটি। কাজেই মাসুদ ভাই রাষ্ট্রদূত হলেই পদ্ধতি ভাল যাবে এমন আশা করা বোকামি। মাস খানেক পার হলে জসীমকে ফোন করব।

শুক্রবারে পোষ্ট করেছি পাসপোর্ট । সোমবারে এমব্যাসি ফোন করেছে বাসায়। আবেদনে লিখেছি পাঁচ বছরের মেয়াদ বাড়াতে, আর টাকা পাঠিয়েছি এক বছরের জন্য। বছর খানেকের মধ্যে শুভ জার্মান পাসপোর্ট পেয়ে যাবে। সে জন্য বাড়তি খরচ করতে চাই নি। কিন্তু আবেদন করার সময় ভেবেছিলাম পাঁচ বছরের জন্যই করি। ফোনটা শুভই ধরেছে, এবং বলেছে ভুলে পাঁচ বছর লিখে ফেলেছি, এক বছরই হবে। ওপার থেকে বলল; ঠিক করে দিচ্ছি।

শুক্রবারে ডাকবাক্স খুলে তো নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। শুভর পাসপোর্ট পাঠিয়ে দিয়েছে। এক সপ্তাহে! কোন রকমের তদবির ছাড়াই! আমার অভিজ্ঞতায় বিশাল অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার! অথচ শুনেছি মাসুদ ভাই এমব্যাসিতে সহকর্মীদের সাথে হাতা-হাতি বা লাঠা-লাঠি করেছেন। কষ্ট পেয়েছিলাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে মাসুদ ভাইয়ের বাঁশ না খেলে এমব্যাসির কর্মচারীরা রাতারাতি এতো ভাল মানুষ হয়ে যেতেন না। সাবাস মাসুদ ভাই।


মন্তব্য

খেয়া'দি এর ছবি

আপনি যখন দেশ নাটকে ঢুকেছিলেন সম্ভবত তার আগেই আমি বেরিয়ে গেছি।

পুতুল এর ছবি

আপনি কবে থেকে ছিলেন দেশ নাটকে? এখন কোথায় থাকেন?

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।