তীর্থের কাক ৩৩

পুতুল এর ছবি
লিখেছেন পুতুল (তারিখ: সোম, ১১/১১/২০১৩ - ১:২৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সুখের স্বপ্নের মতো জাগরণে সোনিয়ার স্মৃতিরা প্রজাপতি হয়ে উড়ে বেড়ায় আমার চারপাশে। পাঁচ লিটারের রেড ওয়াইনের বোতল সময়ের সাথে খালি হতে থাকে। আমার চারপাশটা অন্ধকারে চেনা পথের মতো। কোন কিছু না দেখেও বেশ স্বচ্ছন্দেই হেঁটে যাই। আমার ভুবনে কেউ ঢুকতে পারে না। একটা নতুন পৃথিবী তৈরী করে নিয়েছি বেশ কিছু দিন হল। মাঝে মাঝে জসিম ক্ষেপে গিয়ে বকাঝকা করে। আমি তার কথা শুনতে না পেলেও ছায়ার মতো দেখি তার খিস্তিখেউড় আমার কানের পাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। জাহিদ ভাই, নূরুদ্দীন যানে, আমাকে কেউ বের করে আনতে পারবে না। আমার কানাগলি থেকে আমাকেই বের হয়ে আসতে হবে।

কোন কোন রাতে সোনিয়ার সাথে যেখানে প্রথম দেখা হয়েছিল সেখানে পায়চারী করে সকালে ফিরি গিরিখাদে। গতরাতে দেখি একটা কুকুর নিয়ে সোনিয়া বসে আছে আমাদের প্রথম দেখার পথের ধারের বেঞ্চে। অনেক রোগা আর ছোট হয়ে গিয়েছে সোনিয়া। হয়তো অনেক বুড়ো হয়ে গেছে। বুড়ো মানুষ ছোট হয়ে যায়। কয়েক দিন দেখে দেখে একদিন সাহস করে বলেই ফেললাম; কেমন আছো সোনিয়া?

মেয়েটি ত্রস্তে শুধরে দিল: আমার নাম সোনিয়া নয়, মেণ্ডি। ঠিক আছে। মেণ্ডিতে আমার আপত্তি নেই। মেয়েটি নড়ে বসে আমাকে বসার যায়গা করে দিল। তার নড়ার প্রয়োজন ছিল না। কারণ বেঞ্চটা যথেষ্ট চওড়া। তার পরেও তার সরে যাওয়া জায়গায়ই বসলাম। বেশ আরাম লাগল। যে যায়গাটা সে ছেড়ে দিল সেখানে তার গায়ের ওম ছিল।
তুমিও নতুন এই শহরে?
মেয়েটা বেশ কঠিন টানে জার্মান বলে। বুঝতে কষ্ট হয়।
মানুষ জন্মায় একা, মরেও একা। নির্লিপ্ত জবাব আমার।
কোন ব্যাপার না। তুমি এখন আর একা নও। আমিও নই। আমরা বন্ধু।
আমাকে সান্ত্বনা এবং অভয় দিল সে।

বন্ধু ব্যাপারটা এখনো আবিস্কার হয়নি। কী বিরাট ব্যার্থতা!

হাত বাড়ালেই বন্ধু, যেমন পা বাড়ালেই পথ।
মেয়েটার কথা একেবারে নিরর্থক নয়।
আমি হাত প্রসারিত করি।
কিন্তু মেয়েটা আমার হাত টেনে নেয় তার কাছে।
তারপর হাটতে থাকে কুকুরটা পেছনে রেখে।
গায়ের গন্ধ শুকে কুকুরটা আমাদের পেছনে হাঁটে।
কুকুরটা আসলে মেণ্ডির পেছনে হাটে।

একটা অপ্রশস্ত গলির কোন একটা বাড়ির গেটের দরজা খোলে আমার সদ্য হওয়া বান্ধবী।
ফ্ল্যাটে কয়েকটা ঘর। তার একটায় আমি বসে। মেণ্ডি খোলা বিয়ার বোতল নিয়ে টি টেবিলে রেখে আমার পাশে বসে।
আমরা বলি প্রোষ্ট।

কী এক অদ্ভুত কারণে মেণ্ডি আমার মুখের ভেতর থেকে চুষে বিয়ার বের করার চেষ্টা করে। তার হাতের বোতল পূর্ণ প্রায় টেবিলে রাখা।
এক সময় আমার মনে হয়। আমি কী বোদাই! দাও আমার বিয়ার আমাকে ফেরত দাও। এই নিয়ে আমাদের কাড়াকাড়িটা কুইস্তা-কুস্তিতে অবনত হ‌য়। মেণ্ডি টেনে নিয়ে যায় আমাকে একটা বিছানার পাশে।

খাটের কিনারে বসে আমাকে সে টানে। তার টানে টাল সামলাতে না পেরে আমি তার উপর পরে যাই।
চীৎ হয়ে সে কাপড় খোলে। ঝগড়ায় হেঁড়ে গিয়ে আমি ধারালো কিছুর সন্ধান করতে পকেটে হাত দিয়ে যা পেলাম তাই বের করতে গিয়ে দেখি সেটা কাপড়ে মোড়ানো।

কাপড়ের ভাজ থেকে সে অস্ত্র বের করতে করতে দেখি আমার বান্ধবী পা ফাঁক করে দিয়েছে। আমি কোন এক নারীর ঊরুসন্ধিতে মুক্তির আশায় বিদ্ধ করি বারা বার। পাশবিক আনন্দে। শত্রুকে ঘায়েল করার আনন্দ। কিন্তু এক সময় প্রজাপতির মতো উড়ে আসে সোনিয়ার স্মৃতি অথবা সে নিজেই। আমি অপ্রস্তুত হই। আমার লজ্জা লাগে। আমার পড়নে কোন কাপড় নেই। লজ্জা সে জন্যও হতে পারে। মানুষকে কষ্ট দিয়ে আমি আনন্দ পাই না। মেণ্ডিকে কষ্ট দিয়ে আমার কী লাভ। আমি আমার কাপড়ের ভাজে ছুড়ি লোকোই। মেণ্ডি অবাক হয়ে আমার পথ খোঁজা দেখে। এক সময় বলে দেয়; এইটা বের হওয়ার দরজা।
আমি পথে নেমে পথ খুঁজি, ঘরে ফেরার। বলিনি কখনো কিন্তু ইচ্ছে ছিল ঘরে গেলে সোনিয়া আমায় দরজা খুলে দেবে। হয়তো সোনিয়া আজো আমার জন্য দ্বার খুলে জাগে। আমিই তাকে আমার ঠিকানা লিখে দিয়েছিলাম। আমাদের ইজমাইলী ঘরের ঠিকানা আমি তার কাছে চাইনি। সেও দেয় নি। আমি পথেই পথ খুঁজি, ঘরে ফেরার পথ।

যেখানে আমি চাইনি সেখানেই নিয়ে আসতে হয়েছিল সোনিয়কে। আমাদের সেই চেনা ঘরে ফিরে দেখি রাজ্যের মানুষ। তিন ঘর বাঙ্গালী প্রতিবেশীর মধ্যে প্রতির চেয়ে বিপরীতের প্রাবল্য প্রধান। আমি জাত-ধর্ম-বংশ কোন কিছু মানি না বলে কে আমাকে কী বলে তাতে আমার কিছু আসে যায় না। কিন্তু অন্যদের আসে যায়। ঢেঁকির স্বর্গের মতো আমরা আমাদের জাতি-ধর্ম-বংশ কাঁধে নিয়ে বেড়াই। আমার ধর্ম নেই, সেটা অনেকের কাছে অধর্ম। সে ভাবেই রফিক, সুরুজ মিয়া আমাকে আমি মুসলমানের ছেলে নাস্তিক বলে তাদের প্রতি অধর্ম করেছি বলে অভিযোগ করেছে। বলেছে; দেশে অইলে হিডায়া মানুষ কইরা হালাইতাম।

মিটিং বসেছে আমাদের ঘরে। ঘটনার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিল নূরুদ্দীন। রফিক সুরুজ মিয়াকে অথবা উল্টোটা তাদের ভাষায় মানুষ করতে চেষ্টা করেছে। বেশীর ভাগ বাঙ্গালী মনে করে; সুরুজ নয়, রফিকই সুরুজকে লাঠি হাতে মানুষ করতে চেয়েছিল। কপাল ভাল যে, বিশেষ আহত কেউই হয়নি। সবাই মিলে চেষ্টা করতে হবে যাতে ঝগড়া না বারে। এবং একে অপরকে আর শত্রু না ভাবে।

সব ঘরের চেয়ার জড় করেও সবার বসার ব্যবস্থা হল না। আমি খাটের কিনারে পাছা ঠেকাইতে দেখি আমার দিকে মুখ করে মুচকি হাসছে একটা পাকিস্তানী। তাকে বললাম ভাই; সব অল্প বয়সী ছেলে-পেলে ঝগড়া-ঝাটি করেছে। আমরা মিল-ঝিল করে দেব। এখানে তামাসা দেখার কিছু নেই। তা ছাড়া আমরা বাংলায় কথা বলছি এবং বলব তুমি কিছু বুঝবেও না। দয়া করে নিজের ঘরে যাও। কাল সকালে চা খেতে এসো।

রফিক বলল: উনি এখানে থাকবেন। আমার পক্ষের লোক হয়ে।
আমার অবস্থা আসলে কথা বলার মতো ছিল না। মনে হল; কিছু কিছু বাঙ্গালীর পক্ষে পাকিস্তানীরা সব সময়ই ছিল। বাঙ্গালী মেয়েদের ধর্ষণের আনন্দ যুদ্ধবন্দী পাকিস্তানী সৈন্যরা জার্মানে এসে এই লাগারেই অনেক বাঙ্গালীকে শুনিয়েছে। তাহের ভাইয়ের মুখে কথাটা শুনে বিশ্বাস করিনি আগে। কিন্তু এখন অবিশ্বাসের কোন কারণ দেখি না। পাকিস্তানীকে ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার কথাটা বলা ভাল হয়নি। বেচারা আমাদের মেহমান। রফিক তাকে অভিভাবক বানিয়েছে। পাছা আমার বিছানাতেই ঠেকানোই ছিল। এবার লম্বা হয়ে গেলাম।


মন্তব্য

গুরুত্বহীন এর ছবি

যখন দেশে ছিলাম বিদেশকে একটা স্বপ্ন মনে হতো। এখন হিসাব মেলাতে কষ্ট হয়। আপনার লেখাগুলা পড়লে একটা অন্যরকম অনুভূতি আসে। মনে হয় আমি একা না।

পুতুল এর ছবি

সেই স্বপ্ন এখন একটা দুঃস্বপ্নের মতো হয়। পড়ার জন্য ধন্যবাদ গুরুত্বহীন।

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালই এগোচ্ছে। শুভকামনা থাকলো।

শব্দ পথিক
নভেম্বর ১১, ২০১৩

পুতুল এর ছবি

ধন্যবাদ।

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

সুমন চৌধুরী এর ছবি

একটাই কথা। পরেরটা নামান তাড়াতাড়ি।

পুতুল এর ছবি

নামাইলাম।

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

মেঘলা মানুষ এর ছবি

আপনার এই সিরিজটা অনেকদিন ধরেই পড়ে আসছি, মন্তব্য মনে হয় করিনি কোন দিন।
পরে কী হল? জানতে চাই তাড়াতাড়ি।

শুভেচ্ছা হাসি

পুতুল এর ছবি

আর দুটো পর্ব । আপনাকেও শুভেচ্ছা।

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।