জাতীয় সরকারের উদ্যোগ বনাম জাতির স্বপ্নমঙ্গল

ফকির ইলিয়াস এর ছবি
লিখেছেন ফকির ইলিয়াস (তারিখ: বুধ, ১৩/০২/২০০৮ - ১০:১১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

জাতীয় সরকারের উদ্যোগ বনাম জাতির স্বপ্নমঙ্গল
ফকির ইলিয়াস
===================================
বাংলাদেশে অদূর ভবিষ্যতে যদি জাতীয় সরকার গঠিত হয় তবে এর কাঠামো কেমন হতে পারে? এ নিয়ে একটি ধারণা পাওয়ার চেষ্টা করছেন অনেকেই। মিডিয়া, লেখক, সাংবাদিক সবাই বিশ্লেষণ করছেন নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে। বিশ্বের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশের জাতীয় সরকারগুলোর রূপরেখা এবং কর্মযজ্ঞ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা এবং প্রাজ্ঞতাই এসব সরকারকে ক্ষমতায় কিছুদিনের জন্য টিকে থাকতে সাহায্য করেছে। পরস্পর সহনশীলতা মোটামুটিভাবে কিছুদিন ‘জাতীয় সরকারকে কাজ করার সুযোগ দিয়েছে; কিন্তু সেসব ঐক্য খুব দীর্ঘ হয়নি।’
প্রতিবেশী ভারতের প্রধানমন্ত্রী যখন চন্দ্রশেখর দায়িত্ব নিয়েছিলেন তখন সে দেশে একটি জাতীয় সরকারের ছায়া গড়ে উঠেছিল। কিন্তু নানা মতদ্বৈততার কারণে চন্দ্রশেখরের সরকার মাত্র কয়েক মাসই ক্ষমতায় থাকতে পেরেছিল।
বাংলাদেশে জাতীয় সরকার গঠন করার মতো আদৌ কোন সুযোগ আছে কি? এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত কিছু আলোচনা করা প্রয়োজন মনে করি। প্রথমত একটি দেশে তারাই জাতীয় সরকার চায়, যাদের দল গণতান্ত্রিকভাবে জনগণের কাছে দুর্বল অবস্খানে থাকে। কারণ তারা জানে, ভোটে জিতে কোন দিনই ক্ষমতায় যাওয়া যাবে না। তাই জাতীয় ঐকমত্যের মাধ্যমে যদি ক্ষমতার স্বাদ আস্বাদন করা যায়। বাংলাদেশে গণভিত্তিহীন রাজনৈতিক দলগুলোর এমন আগ্রহ অতীতে দেখা গেছে। বর্তমানে দেখাচ্ছে। ভবিষ্যতেও দেখা যাবে।
আর এই জাতীয় ঐক্য, সংহতির তথাকথিত বাণী আওড়িয়ে যে দলটি বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক সুবিধা নিয়েছে সে দলটির নাম জামায়াতে ইসলামী। জাতির জনক বঙ্গবু হত্যার পরপরই সামরিক জান্তাদের ছায়াতলে পুনর্বাসিত হয়ে জামায়াতি রাজাকাররা প্রথমেই বলেছে­ ‘আসুন ঐকমত্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশকে গড়ে তুলি।’ তারা তাদের জঘন্য কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা না চেয়েই, অনুতপ্ত না হয়েই বলতে চেয়েছে­ আসুন দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাই! যারা এই রাষ্ট্রকে স্বাধীন হতেই দেয়নি, তারাই কি না অতীত ভুলে যাওয়ার আহ্বান জানায়! তারাই কি না দেশকে এগিয়ে নেয়ার হুঙ্কার হাঁকে!
সেই ঐক্যের দোহাই দিয়েই রাজাকার শাহ আজিজ, মশিউর রহমান যাদু মিয়ারা মন্ত্রিত্ব পেয়েছিল। দীর্ঘদিন পর সেই একই কায়দায় জাতীয় সংহতির ঐক্যের ডাকে গড়ে উঠেছিল বিএনপি-জামায়াত চারদলীয় ঐক্য। একাত্তরের আলবদর কমান্ডার মতিউর রহমান নিজামী এবং আলী আহসান মুজাহিদরা মন্ত্রিত্ব পেয়েছিল­ সে দোহাই দিয়েই।
এই জাতীয় ঐক্যের ভাগাভাগিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনাও। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জাসদের নেতা আ স ম রব এবং পতিত জাপার ভগ্নাংশের নেতা আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে মন্ত্রিত্ব দিয়ে তথাকথিত ‘জাতীয় ঐক্য গড়তে চেয়েছিলেন। এর ফলও শুভ হয়নি। তার প্রমাণ শেখ হাসিনা পেয়েছিলেন ২০০১-এর নির্বাচনে। যদি জনগণ জাতীয় ঐক্যকেই মেনে নিত তবে তো শেখ হাসিনার আবারো বিপুল ভোটে জেতার কথা ছিল। তিনি জিতবে পারলেন না কেন? কেন ভরাডুবি ঘটল তার দলের?
দুই.
ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করা আর জনগণের মুক্তির জন্য রাজনীতি করা দুটি পৃথক বিষয়। কিন্তু ক্ষমতায় না গিয়ে জনগণের আশা-আকাáক্ষা পূরণ করা যায় না। প্রতিটি জাতির একটা নেপথ্য কাণ্ডারি শক্তি থাকে, যে শক্তি মেধা-মনন, সত্যবার্দিতা, নিষ্ঠা দিয়ে জাতির স্বপ্ন মঙ্গলের জন্য কাজ কৃের যান। এরা ক্ষমতার তোয়াক্কা না করেই মানুষের আশা-আকাáক্ষার পক্ষে দাঁড়ান। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এ রকম স্বপ্নদ্রষ্টা রাজনীতিক বেশকিছু আছেন। কমরেড মণি সিংহ, কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ কিংবা শ্রী প্রসূন কান্তি রায় (বরুন রায়)­ এদের মতো মানবদরদি নেতারা বাঙালি জাতির গৌরব প্রদীপ বললে ভুল হবে না।
অতি সম্প্রতি আমরা ঠিক সে কাতারেরই একজন নেতাকে চিরতরে হারালাম। তিনি সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিক। সারাজীবন গণমানুষের কাতারে দাঁড়িয়েছেন নি:স্বার্থভাবে। বামপন্থি রাজনীতির এই পুরোধা ব্যক্তিত্ব জীবনের শেষ দিকে এসে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গণফোরামে যোগ দেন। গণফোরাম বাংলাদেশে আপামর জনতার প্রিয় রাজনীতিক দলে রূপ লাভ করতে পারেনি। এর অনেক কারণ আছে। কিন্তু একজন নির্ভীক, আদর্শবাদী নেতা হিসেবে জনাব মানিক সবসময়ই জনগণের পাশে থেকেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এই মহান ব্যক্তি কালো পথে রাষ্ট্র ক্ষমতার ভোগবিলাস চাননি। অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি। হয়তো তিনি ক্ষমতার ভাগিদার হতে পারেননি; কিন্তু তার কর্ম উদ্যম দিয়ে, আদর্শ দিয়ে বাঙালি জাতিকে যেভাবে প্রকৃত আলোয় প্রজ্বলিত করেছেন­ তা কি জাতি কোনদিন ভুলতে পারবে? না, তাঁর কর্মচেতনার ঋণ কোনদিন শোধ করা যাবে না।
বাংলাদেশে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলেন­ তারা যদি অসাধু-অশুভ শক্তির সঙ্গে হাত না মিলিয়ে নীতিবান রাজনীতিকিদেরকে মূল্যায়ন করতেন তবে হয়তো আজকের প্রেক্ষাপট ভিন্নতর হতো। কিন্তু তারা তা করেননি। ক্ষমতায় যাওয়ার পরপরই তারা দলীয় মোসাহেবদের কবলে ব্যস্ত থেকেছেন ওদের লুটপাটকে সাহায্য করতে। আমার বারবার প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে শেখ হাসিনার মতো নেত্রী কেন চাটুকারদের কবলে পড়ে ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিয়েছিলেন? কেন বঙ্গবুর হাতে গড়া আওয়ামী লীগে এত বেশি তস্করবৃত্তির মানুষ ঠাঁই পেয়েছিল?
তিন.
সরকার নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এ কথা বলছেন প্রধান উপদেষ্টা এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনারও। এদিকে বিশেষ ক্ষমতা আইন শিথিল করে পৌরসভা এবং সিটি কর্পোরেশনে নির্বাচনের কথাও বলা হচ্ছে। যদি নির্বাচন করতে হয়, তবে তা কি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা যাবে? বিশেষ করে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে দলীয় প্রভাব পড়বে চরমভাবে, তা নিশ্চিত করে বলা যায়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে পৌরসভা তো বটেই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও দলীয় তৃণমূল নেতাকর্মীরা ঝাঁপিয়ে পড়বেন এসব নির্বাচনে। তার কারণ ১৯৭১-এর পর, বড় দুটি দল বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব বাঁচাবার মতো নির্বাচনই অনুষ্ঠিত হবে ২০০৮ সালে। ১৯৭১-এর কথা এজন্য বলছি, কারণ তখন স্বপ্ন একটাই ছিল­ স্বাধীন বাংলাদেশ। আর এখন বিএনপি, আওয়ামী লীগ সমর্থকদের লক্ষ্য একটাই, তাদের নেত্রীদের মুক্তি।
বর্তমান সরকার যদি তাদের মত না পাল্টান তবে নিশ্চিত করে বলা যায়, একটা পরিকল্পিত নির্বাচন অনুষ্ঠান করে একটি কোয়ালিশন সরকার ক্ষমতায় আসবে এবং সম্মিলিত বাহিনী সে সরকারকে ব্যাকআপ করে যাবে। এভাবে চলতে পারে হয়তোবা দু’টার্ম অর্থাৎ দশ বছর। এর মধ্যে চলতে থাকবে রাজনীতিক শুদ্ধি অভিযান। সে অভিযানের মাধ্যমে বড় দলগুলোকে শুধরিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে। আর যদি বর্তমান শীর্ষ পর্যায়ে মত পরিবর্তন হয়­ তবে কোন বড় দলের নেতৃত্বে জাতীয় সরকারের আদলেই গঠিত হতে পারে আগামী সরকার। ক্ষমতায় যেই আসুক বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির স্বপ্ন মঙ্গল কতটা সাধিত হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন বাড়ছে বৈ কমছে না। সেনাপ্রধান জে. মইন উ আহমেদ বলেছেন, তারা বেশিদিন থাকবেন না। কিন্তু কাউকে না কাউকে তো আসতে হবে। কারা আসবেন, তাদের পূর্ব প্রস্তুতি কতটা সম্পন্ন হয়েছে।
দেশে জরুরি অবস্খা তুলে নিলেই অবস্খা দ্রুত পাল্টে যেতে পারে। রাজনীতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি কোন মধ্যস্বত্বভোগী চক্র সহিংসতা ছড়াতে তৎপর হতে পারে। হিংস্র জঙ্গিবাদীদের হামলে বৃদ্ধির সম্ভাবানাও উড়িয়ে দেয়ার মতো নয়।
সব মিলিয়ে একটি অনিশ্চিত শঙ্কার দিকেই অগ্রসর হচ্ছে বাংলাদেশ। কারণ নির্বাচন করতে হলে, জরুরি অবস্খা ক্ষমতা আইন তুলতে হবে। আর তা তুলে নিলে আবার দেশ সহিংসতার দিকে যেতে পারে। যারা ক্ষমতায় আছেন, তারা সার্বিক অবস্খা বিবেচনা করেই অগ্রসর হবেন বলে সাধারণ মানুষ মনে করছেন।
কারণ কে জিতবে, কে ক্ষমতায় আসবে তা বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে, জাতির নিরাপত্তা এবং স্বপ্নপূরণ। তিন যুগ পরও এ প্রত্যাশাটি কি খুব বেশি?

-------------------------------------------------------
দৈনিক সংবাদ। ঢাকা। ১৩ফেব্রুয়ারি২০০৮,বুধবার প্রকাশিত


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।