লক্ষিন্দরের ভূত

ফারুক হাসান এর ছবি
লিখেছেন ফারুক হাসান (তারিখ: শনি, ০৪/০৮/২০০৭ - ১:১৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

দেশে ফিরেই এখন আর শফিকে খুঁজি না।

শফির সাথে প্রথম পরিচয় যখন কলেজে পড়ি, ঢাকা কলেজের সেই উন্মাতাল দিনগুলিতে। প্রথম জীবনের দীর্ঘ স্বাধীনতা ভোগের সময়গুলিতে- তখনই পরিচয়, কলেজের হোস্টেলে। একই ব্যাচ, আমি-সে একই হলে থাকি। জীবনে তখন স্রোতের মত বন্ধু আসে যায়- স্মার্ট, ড্যাশিং, মেধাবী, জোশ, তাওড়া- সেই মুক্তির দিনগুলিতে বন্ধুর অভাব নেই। তাদের কেউ সদ্য দীক্ষিত রাজনীতি সৈনিক, কেউ কেউ প্রেমিক, কেউ বা কবি। এরই মধ্যে আলাদা করে চোখে পড়ার মতন উজ্জ্বল, দারুণ এক সপ্রতিভ তরুণ। আমরা ডাকি পাগলা শফি।

সুন্দর চেহারা শফির, কলেজে ওকে এক প্রভোস্টের ছেলে ডাকতো নায়ক অক্ষয় ভাইয়া, সেরকমই দেখতে বলে। নিতান্তই পাগলামির ছলে দেখানো কারিশমা আর আন্তরিকতার ডুবোচরে যখন তখন আটকে ফেলতে পারে বলে বন্ধু মহলে শফির বিশাল নাম ডাক। ওর গলায় 'মেহবুবা মেহবুবা' তখন যৌবনের থিম সং।

দেশে এসেছি বহুদিন পর। বন্ধুদের সবাই কোথাও না কোথাও চাকুরিতে ঢুকে গাছ হয়ে গেছে। তাদের নিজস্ব বনভুমির বাইরে নিয়ে আসা যায় না আর। সুতরাং আমি মরুটিলার শীর্ষে হঠাত দুলে উঠা একলা ঘাসের মতন একাকীত্বে ভুগতে শুরু করার সময়টাকে দুরবর্তী কোনো স্টেশনে আটকে দেবার জন্য স্মৃতিবাস্তবতার আশ্রয় নেই, একদিন ভরদুপুরে গিয়ে হাজির হই ফেলে আসা ভার্সিটির ক্যাফের কিনারায়।

ভর্তি যুদ্ধে আমরা যখন আহত-নিহত হই, কলেজ দাবড়ানো শফির তখন সদ্য বৃষ্টিস্নাত দুব্বাঘাস মাড়ানো একটা পথ আলসে বুয়েটের শহীদ মিনারের মোড়ে মাথাটা মুড়তে গিয়েও গোঁ ধরে চলে যায় টিএসসি-শাহবাগ-ফার্মগেট-ভিআইপি রোড পেরিয়ে ক্যান্টনম্যান্টের দিকে।
আমরা ওর এত এত সাফল্যে ইর্ষায় জ্বলে পুড়ে যাই, ছারখার হই, আর শফি আমাদের একটার পর একটা কৌতুক শোনায়।
মুখোশহীন শফির মুখাভিনয় আমাদের ছাড়পোঁকা ঠাঁসা তোশকের তলায় শ্বাসরোধে মৃতপ্রায় নিষিদ্ধ সাহিত্যকেও বাঁচিয়ে তুলতে পারে তখন।
শফি আকাশে উড়ে। স্বপ্ন হলো সত্যি! ইটের পর ইট।
শফি নেভীর ধবধবে ফর্সা সাদা পায়রা অফিসার হবে। সামনে লাইফ।
শফি স্যুট বানায়, টাই কিনে। পাঁচ জোড়া জাংগিয়া, দশ জোড়া স্যান্ডো, দুই হালি সাদা সার্ট, হাতা কাটা, হাতাওয়ালা, সোয়েটার। বুট, সু, কেডস। চকচকে বেল্ট-বকলেস।
দুই বছরের ট্রেনিং। মামার জমানো টাকা নিয়ে নাকের বাঁকা হাড়টা পর্যন্ত ফেলে দেয়।
ওর স্যুট পড়ে আমরা ট্রায়াল দেই, জুতোর কালিটা ঠিক কিনেছে কিনা তা আমাদের জুতোয় ঘষে চেক করি। টাইয়ের নড ঠিক করে দেই। বন্ধুবাত্সল্যে উদলাই। তারপর পুরোদস্তুর সাহেব শফিকে বুকে ফুঁ দিয়ে চিটাগাং রোডের সবচেয়ে বড় হিনো কোচে তুলে দেই- যা ব্যাটা ট্রেনিং নিয়া বড় অফিসার হ। আমরা বুকে সেই অধিকারের বাষ্প নিয়া দাড়াইয়া ওরে টা টা দেই যেই অধিকারের বলে বুড়ো বয়সে পত্রিকায় শফির ছবি ছাপলে পর তা দেখিয়ে বংশধরদেরকে বলতে পারি, দেখ এই হলো আমাদের জিগরি দোস্ত শফি। কত প্যাদানিই না দিছি ওরে, আর এখন সেই শফি উর্দি পইড়া সৈন্য দাবড়ায়, দ্যাশ চালায়, গণতন্ত্র উদ্ধার করে।

কতদিন পর আবার ফিরলাম ক্যাম্পাসে?
ক্যাফের চেয়ার টেবিলের বোধহয় রং বদলেছে, নাকি আগের মতই? অনেকক্ষণ বসে থাকি কোণায়।
যে কৃষনচূড়ার ফুলে ঢাকা ইট বিছানো রাস্তার বুকে প্রতিটা ইটের ফাঁকে ফাঁকে লেপে দিয়েছি দম্ভ,দিনে দুবেলা করে জীবনের পাঁচটা বছর, আজ থেকে সাত বছর আগে- নতুন পীচের চাঁদর গায়ে জড়ানো সেই রাস্তার শেষ মাথায় তাকাই। কিছু নেই সেখানে।
নিজেকে ঝলমলে অসংখ্য কালো চুলের ভীড়ে বিমর্ষ এক পাঁকা চুল বলে মনে হয়। আমার মুখটা ঝুলে পড়ে। বাড়ি ফিরতে অথবা ক্যাম্পাস ছাড়তে আমি হঠাত উঠে দাঁড়াই।

আর তখনই কোথ্থেকে যেন ডানা মেলে বিশাল কালো বাদুরের মত উড়ে এসে শফির ভূত আমাকে গিলে ফেলে আপাদমস্তক।

সেই ভূত, যাকে দেখে আমাদের বকুলের মা চমকে উঠেছিলো আজ থেকে পাঁচ যোগ সাত মোট বারো বছর আগে, যেদিন স্যুট-বুটে সাজিয়ে শফিকে বিসর্জন দিয়েছিলাম, তুলে দিয়েছিলাম অনিশ্চিত জীবনের স্রোত থেকে একটানে চিটাগাং রোডের সবচেয়ে বড় হিনো কোচে, মেসবাড়িটার সেই অন্ধকার আড়াইতলার ঘুঁপচিতে তার পরদিন দুপুরে কিংবা সন্ধ্যায়।

শফি ফিরে এসেছিলো, গেট থেকে- যার উপারেই লেফট-রাইট-লেফট, বউ-বাচ্চা-বাড়ি, ডাণ্ডা-হুকুমদারি। আরেকটা পা এগুলেই যখন সত্যিকারের অন্য কিছু, সেই মুহুর্তে শফি থেমেছে, আর এগোয়নি। কি ভেবে কে জানে!

হয়তো সবুজ তখন পোকায় খাওয়া খোকসা পাতায় বন্দী, সাদা কেবল ধুসর আর চাপড়া ধরে খসে যাওয়া পলেস্তারায় নীল তখন বাস্তুহীন পেইন্ট। আমরা দেখিনি।
আমরা যখন শফির পাগলামিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানে ব্যস্ত হয়ে পড়ি, শফি তখন লোহার ঘর বানায়।
আর বাইরে এক অদৃশ্য সুতানলি সাপ ঘুর ঘুর করে। দূর থেকে আড় চোখে তাকায় ঠান্ডা চোখে।

ততদিনে আমাদের গতি হয়েছে।
আমরা কচুরিপানার দল একটা বিলে ঢুকে পড়ি, তারপর একটা মাঝারিমানের পুকুর পেয়ে থিতু হই। জলপাই রং গায়ে দারুণ মানিয়ে যায়।

শফিও ফিরে আসে। এই ক্যাম্পাসে।
সেখানে তখন অন্য গল্প দারুণ দানা বেধে আছে। শফির বুকের উপর সুতানলি সাপ এই প্রথম ফঁণা তুলে।

একদিন শুনি, শফির বুকে গর্ত। আর সেখানে প্রাণের বদলে সীসা।
শফির প্রিয় লেফট-রাইট-লেফট জীবনেরই কোনো এক ডামির উপহার।
কার্যশেষে সুতানলি সাপ মা মনসার কাছে ফিরে যায়।

কী অদ্ভুত, তারপরও আমাদের বুকে আস্তহরিণগেলা অজগর কুন্ডলী পাকিয়ে ঘুমায়। আর মাঝে মাঝে গরম শ্বাস ফেলে।
ধুলোর চর্বি জমে গায়ে। তবু অজগর জাগে না।

এদিকে শফির ভূত ডিম দেয়। শহীদ মিনারের সিড়িতে ফেলে রাখা বাদামের ঠোংগায়, ভার্সিটির হলের বারান্দার অন্ধকার কোণে, লনের ঘাসে। ক্যাফের ডিমচপে কামড় দিলে ভেতর থেকে আস্ত শফির ভুত ডিম ফুটে বেরিয়ে আসে, তারপর ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে চলে যায় পরিত্যক্ত ক্যামিস্ট্রি ল্যাবের স্যাতস্যাতে ঝোপে। সেখানে লুকিয়ে থাকে।

আজকের অপেক্ষায়।


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

আহা লেখাটা পড়ে বুকটা হুহু করে উঠল। জিয়ার জন্য দুঃখিত। বড় ভাল লিখেছেন।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

ফারুক হাসান এর ছবি

খুব খেয়াল কইরা। এটা কিন্তু কেবলই একটা গল্প!

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

সত্যি হোক বা শুধুই গল্প - ভালো লিখেছেন। ইঙ্গিতবাহী বাক্যগুলো আপনার লেখার শক্তির পরিচয় দিচ্ছে।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

ফারুক হাসান এর ছবি

যারা পড়ছেন এবং মন্তব্যের জন্য এসএম৩, অ.হাসান এবং মু. জুবায়ের কে ধন্যবাদ।

সাথে একটু সমালোচনাও আশা করছিলাম। হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।