সেইসব বীরাঙ্গনা ও তাদের না-পাক শরীর

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি
লিখেছেন ফারুক ওয়াসিফ (তারিখ: শুক্র, ২১/০৩/২০০৮ - ৪:৫০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পাঠক, ৭১-এর নারীর প্রসঙ্গ বলার মতো পীড়ন আর নাই। ৭১ সালের যোদ্ধা নারী, নির্যাতিত নারী, আক্রান্ত নারীদের কথা যতই ভাবি, ততই বিষপানের বেদনা হয়। কে পারে চিত্ত অচঞ্চল রেখে নির্বিকার সাংবাদিক বা ঐতিহাসিকের মতো একাত্তরের সব থেকে বিষ্ফেরক প্রসঙ্গটি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে? আজ এতদিন পর পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে ঘৃণার অগ্নুতপাত ঘটানো বরং সহজ; কিন্তু কঠিন সেসব নারী ও শিশুদের কথা বলা; স্বাধীনতার দাম যারা সবচেয়ে বেশি দিয়েছিল এবং এখনও দিচ্ছে। গণহত্যায় বা লড়াইয়ের ময়দানে যে নারীরা মারা গিয়েছে তারা বরং মরে পরিত্রাণ পেয়েছে আজীবন দোজখবাস থেকে। কিন্তু যারা বেঁচে আছে তাদের যন্ত্রণার হুতাশন আজো নেভেনি, কোনোদিন নিভবে না। এমন এক স্বাধীন দেশের জন্য তারা সর্বস্ব দিয়েছে, যে দেশ তাদের স্বীকার করেনি। পাকিস্তানি সৈন্য এবং তাদের দেশীয় দোসররা লাখ লাখ নারীর জীবনকে তছনছ করে পুড়িয়ে খাক করে দিয়েছে, আর স্বধীন বাংলাদেশ তাদের সেই পোড়া ঘায়ে লবণ দেওয়ার উপযুক্ত কাজ করেছে। আমি জানি না, কোনটা বেশি গুরুত্বপর্ণ: সমব্যথা জানানো, না যে প্রক্রিয়ায় তাদেরকে ‘জ্যান্ত-মরা’ করা হয়েছে, তা?
সরকারি হিসাবে আড়াই লাখ এবং কোনো কোনো গবেষকের মতে প্রায় চার লাখ নারী একাত্তরে ধর্ষিত হয়েছিলেন। ৮ থেকে ৮৭ বছর বয়সের। একবার নয়, একদিনের জন্য নয়, বারবার অনেক দিন ধরে অমানবিক পরিবেশে আটক থেকে। আত্মহত্যা করারও উপায় ছিল না। মাথার চুল কেটে দেওয়া হয়েছিল, যাতে সিলিংয়ে ঝুলে পড়তে না পারে। ‘ধর্ষণ’ শব্দটি তাদের জন্য যথেষ্ঠ নয়। তাদের নির্যাতনকে চিহ্নিত করার মতো শব্দ আমার জানা নাই। পুরুষপ্রধান ভাষায় তা সম্ভব কি-না জানি না।
মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কারো মতে ১০ লাখ কারো মতে ৩০ লাখ বাঙালি গণহত্যার শিকার হয়েছিলেন। বেশি সংখ্যাটাই যদি ধরি এবং এর কমপক্ষে ২০ শতাংশ যদি নারী হন, তাহলেও ৬ লাখ নারী নিহত হয়েছিলেন। ৪ লাখ চরম নির্যাতিত (এদের অনেকেই মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছিলেন) আর ৬ লাখ নিহত নারীর পরিণতি আমাদের জাতীয় মানসে কোন দাগ রেখে গেল? এই দশ লাখ নারী কেন মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাবে না। জাতীয় মুক্তির যুদ্ধে কি কেবলই পুরুষেরই প্রবেশাধিকার? ১৯৭৩ সালে ৬৭৬ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নানা উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এর মধ্যে মাত্র দু’জন ছিলেন নারী। তাদেরই একজন কুড়িগ্রামের দরিদ্র নারী তারামন বিবি। তিনি তার ‘বীরপ্রতীক’ উপাধি পাওয়ার খবর জানতে পারেন ঘটনার ২৪ বছর পর।
ধর্ষণের পরও বেঁচে থাকা নারীদের মধ্যে ২৫ হাজার জন গর্ভধারন করেছিলেন বলে জানা যায় (ব্রাউনমিলার, ১৯৭৫ : ৮৪)। ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিংস কমিটির পুরোধা এমএ হাসান দাবি করেন, ‘এ ধরনের নারীর সংখ্যা ছিল কমপক্ষে ৮৮ হাজার ২ শ’। ’৭২ সালের মার্চ পর্যন্ত ১ লাখ ৬২ হাজার ধর্ষিত নারী এবং আরো ১ লাখ ৩১ হাজার হিন্দু নারী স্রেফ গায়েব হয়ে গিয়েছিল। তারা বিলীন হয়ে গিয়েছিল বিশাল জনসমুদ্রে।’ এদের মধ্যে ৫ হাজার জনের গর্ভপাত সরকারিভাবে ঘটানো হয়েছিল বলে জানান আন্তর্জাতিক প্লানড ফাদারহুড প্রতিষ্ঠানের ড. জিওফ্রে ডেভিস। যুদ্ধের পরপরই তিনি এসব মা ও তাদের শিশুদের সহায়তা করার জন্য বাংলাদেশে আসেন। ১৯৭২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি তার কাজের ওপর একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন তৎকালীন দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত হয়েছিল। তার মতে, সরকার উদ্যোগ নেওয়ার আগেই ১ লাখ ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার নারীর ভ্রুণ স্থানীয় দাই, ক্লিনিকসহ যার পরিবার যেভাবে পেরেছে সেভাবে 'নষ্ট' করেছে। এত কিছুর পরও যারা জন্মাতে পেরেছিল তাদের ভাগাড়ে নিক্ষেপ করা, ভিখারির কাছে বিক্রি করাসহ বিদেশে দত্তক দেওয়ার জন্য পাঠানো হয়। মাদার তেরেসা সে সময় এ কাজে সহযোগিতা করতে ঢাকা আসেন। তার প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে অনেক শিশুকে কানাডা, নরওয়ে প্রভৃতি দেশে পাঠানো হয়। এসব শিশুর নাম দেওয়া হয়েছে ‘যুদ্ধশিশু’। আজ তারা কী করছে, কী করছে তাদের হতভাগ্য মায়েরা? ‘কে আর ইতিহাস খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে?’ হয়তো এ কারণেই যৌন নির্যাতন সম্পর্কে তদন্তে যাওয়ার বদলে বিষয়টিকেই নীরবতা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। এসব নারীর মানমর্যাদার কথা চিন্তা করে নষ্ট করে দেওয়া হয় তাদের নামধাম, নথিপত্র। এভাবেই জাতীয় অহম রক্ষার জন্য নারী মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি ইতিহাস থেকেও মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়। সংস্লিষ্ট দপ্তরে তাদের সম্পর্কিত নথিপত্র গায়েব হয়ে যায় কিংবা পুড়িয়ে ফেলা হয়। নির্যাতিত বা শহীদ নারীদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ তো দূরের কথা একটা স্মারক পর্যন্ত নির্মিত হয়নি। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, জাতির ধারণা কি কেবলই পুরুষালি, নারীর অস্তিত্ব ও অবদানের স্বীকৃতি সেখানে কোথায়?
পাকিস্তানে আটক অববস্থা থেকে মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফেরেন ১৯৭২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি। সেদিনই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল জনসভায় তিনি বলেন, ‘দুই লাখ মা-বোন! এদের আমি কোথায় কী করব?’ ১৯৭২ সালের ২৬ জানুয়ারি তিনি বলেন, ‘তোমরা বীরাঙ্গনা, তোমরা আমাদের মা’ (বাংলার বাণী, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২)।
‘যুদ্ধশিশু’ এবং তাদের মা’দের একটা সুব্যববস্থা করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নীলিমা ইব্রাহিম অনেক খেটেছিলেন। এদের ভাগ্যে কী হবে, তা জানতে তিনি শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি তাকে বলেন, ‘না আপা। আপনি দয়া করে পিতৃপরিচয়হীন শিশুদের বাইরে (বিদেশে) পাঠিয়ে দেন। তাদের সম্মনের সঙ্গে মানুষের মতো বড় হতে দিতে হবে। তাছাড়া আমি এসব নষ্ট রক্ত দেশে রাখতে চাই না।’ (ইব্রাহিম, ১৯৯৮ : ১৮)। এটি কেবল রাষ্ট্রের স্থপতি এক মহানায়কের সংকট নয়, এটা ছিল জাতীয় সংকট। গোটা জাতির হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল, গ্লানি জমছিল। তাই তারা যা ভালো মনে করেছেন, করেছেন। সরকারের তরফ থেকে এসব নির্যাতিত নারীকে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়। তারা ভেবেছেন সেটাই নারী জীবনের একমাত্র গন্তব্য। অল্প ক’জন মুক্তিযোদ্ধা এগিয়ে আসেন, তবে মোটা যৌতুক চান। যৌতুকের লিষ্টির মধ্যে লাল জাপানি গাড়ি থেকে অপ্রকাশিত কবিতার বই প্রকাশ করার দাবি পর্যন্ত ছিল। তাদের যুক্তি: এদের অভিভাবক হিসাবে যৌতুক মেটানোর দায় সরকারের। শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘আমি ওদের বাবা।’ ইতিহাসের দায় কি এতেই শোধ হয়? ড. ডেভিস মন্তব্য করেন, ‘না, কেউই এটা নিয়ে কথা বলতে চায়নি।... পুরুষেরা এ নিয়ে একদম কথা বলতে রাজি নয়। তাদের চোখে এসব নারী নষ্ট হয়ে গেছে। হয়তো তাদের মরে যাওয়াই ভালো ছিল এবং পুরুষরা সত্যিই তাদের মেরেও ফেলেছিল। আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। পশ্চিমা সমাজে এরকমটা এত অপরিচিত! এত অপিরিচিত!’ (সাক্ষাৎকার, বিনা ডি কস্টা, ২০০২)।
জাতিরাষ্ট্রের মর্যাদা ও পারিবারিক পবিত্রততার পুরুষালী মূল্যবোধ একজোট হয়ে কীভাবে নারী মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা ও যন্ত্রণাকে ‘বীরাঙ্গনা’ নামের আড়ালে ঢেকে দেয় এ ঘটনা তার প্রমাণ। পরিবারের পিতা বা বড় ভাই আর ‘জাতির পিতা’ এখানে এক সুরে কথা বলেন। পুরুষালি ইতিহাস নারী মুক্তিযোদ্ধাই হোক আর যাই হোক কেবল সতীত্বের তকমা আঁটা চেহারাতেই দেখতে চেয়েছে। নারী যুদ্ধও করবে, পুরুষের রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের বলিও হতে পারবে কিন্তু কোনোভাবেই 'অসতী' নারী পুরুষের পরিবারের সদস্য হওয়ার উপযুক্তা হতে পারবে না।
দুই. বড় মাছ যেমন ছোট মাছকে খায়, তেমনি বড় ইতিহাস ছোট ইতিহাসকে লোপাট করে। বড় ইতিহাস মানে জাতীয় ইতিহাস, সেখানে নায়ক-মহানায়ক আছে, বীর আছে। তারা জাতি গঠনের ইঞ্জিনিয়ার ও স্থপতি। তাদের অনুসারীদের ভাবোচ্ছ্বাসে ইতিহাসের ছোট ছোট কারিগরের ভূমিকা ঢাকা পড়ে যায়। ইতিহাসেও মাৎস্যন্যায় আছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ইতিহাসে এ সত্য বিরল নয়।
যে কোনো মহাকাব্যিক জাতীয় যু™েব্দর মতো মুক্তিযুদ্ধও একটি মাত্র উপাখ্যান নয়। মুক্তির যুদ্ধ মানে একইসঙ্গে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের যৌথ ও ব্যক্তিগত যুদ্ধ। যৌথ যুদ্ধের ইতিহাসও তেমন সহি কিছু নয়, তবু তা আছে। কিন্তু এই সাড়ে সাত কোটি মানুষের জীবনে যে সাড়ে সাত কোটির অনেক গুণ বেশি ঘটনা ঘটেছিল তার হদিস কোথায়? কোথায় তাদের অর্ধাঙ্গিনীদের ইতিহাস? সেসবও কি জাতীয় ইতিহাসের অংশ নয়? কেবল অংশই নয়, নারীর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কেবল বিকৃতই নয়, অসত্য। যদিও এ বিকৃতি নিয়ে আহাজারি করার লোক কম, প্রতিবাদের প্রশ্ন তো রইলই।
পুরুষের মুক্তির যুদ্ধ তাই মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র কাহিনী নয়। যুদ্ধটা নারীরও, বরং তারই বেশি। নারীর যুদ্ধে কোনো ফাঁক ছিল না। একজন নারীকে পাওয়া যাবে না যে জাতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। সেদিন বাঙালি সত্তা যেমন আক্রান্ত হয়েছিল তেমনি নারীসত্তাকে দলিত ও ধ্বংস করাটাও শত্রুর লক্ষ্য ছিল। নারী তাই দু’ভাবে আক্রান্ত হয়েছিল। প্রথমত, নারী হিসাবে; দ্বিতীয়ত, বাঙালি মাতা হিসাবে, বাঙালিদের নারী হিসাবে। ’৭১-এ কোনো নারী বোধ করেনি যে, সে আলাদাভাবে আক্রান্ত। ব্যক্তিগত বোধ সে রকম পরিস্থিতিতে লোপ পায়। তাদের অনেকে যুদ্ধে যোগ দিয়ে প্রমাণ রেখেছিল দেশপ্রেমের। সবচয়ে বড় যা; তারাই তখন সমাজ-সংসারকে টিকিয়ে রেখেছিল। শাহীন আফরোজের এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, মেয়েরা তাদের চোখের সামনে স্বজনদের খুন হতে দেখে প্রতিশোধ স্পৃহায় যুদ্ধে নেমেছিল। অথচ আজো মুক্তিযোদ্ধা, দেশপ্রেমিকের প্রতিচ্ছবি কেবলই পুরুষেরই দখলে। জাতীয়তাবাদ কি তবে পুরুষের মতাদর্শ?
ওরা হারিয়ে গেছে। আর মুক্তিযুদ্ধ তো ওউষধি কলাগাছ, একবার ফল দিয়ে পচে যাওয়াই কি তার নিয়তি?

পরিশিষ্ঠ : তিন ধরনের তিন নারীর তিনরকম প্রতিরোধ ও বিপর্যয়ের কাহিনী দিয়ে এই কহন শেষ করব।
১. মধুমিতার কাহিনী (ছদ্মনাম) ‘‘তাদের কাজ হয়ে যাবার পর তারা বাড়িতে আগুন লাগিয়ে চলে গেল। কিন্তু আমি তো আমার ভাইটিকে মরতে দিতে পারি না। তাই অসহ্য ব্যথা সত্ত্বেও নিজেকে কোনো মতে তুলে ভাইকে দরজা ভাঙায় সাহায্য করলাম। তা করতে গিয়ে মারাত্মকভাবে পুড়ে গেলাম। সেই রাতে লুকিয়ে থাকলাম বাড়ির পেছনের পুকুরটাতে। পরদিন ভোরে যখন পুকুর থেকে উঠলাম, আমার গায়ের মাংস খাবলা খাবলা করে খসে পড়তে লাগল। দু’একটা টুকরা ছাড়া গায়ে কোনো কাপড় ছিল না। এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলাম, গাঁয়ের কিছু লোক ভোরের নামাজ পড়ে ফিরছে। আমাকে দেখে তারা মজা পেয়ে হৈহৈ করে উঠল। আমি তাদের বলার চেষ্টা করলাম, ‘আমি বেশ্যা নই, ওমুক আমার বাবা, আমাকে সাহায্য করুন।’ কিন্তু তারা চলে গেল। সেদিন থেকে আমি জীবšø মরা। আমার শরীরে যšúণা। আজ আমার কোনো শিক্ষা কোনো স্ট’ান কোনো মর্যাদা নেই। ভাইয়ের জন্য আমার জীবন, সম্মান সবকিছুই বিসর্জন দিয়েছি। অথচ আমি এখন তার চাকরের থেকে বেশি কিছু না। এই-ই বাংলাদেশে মেয়েদের কপাল।’’ (সাইকিয়া, ২৮৬, হিষ্টরি ওয়ার্কসপ জার্নাল)
২: এ গল্পটি বলেছে বিমান (ছদ্মনাম)। ‘‘এপ্রিলের তিন তারিখে পাকস্তানি বাহিনী শহরে ঢোকে। রেলওয়ে কলোনির বিহারিরা তাদের দেখে বুক ফুলিয়ে চলাফেরা শুরু করে। দেখে আমাদের মনে রাগ জাগল। আমি এবং আমার পাঁচ বন্ধু মিলে ঠিক করলাম, তাদের একটা শাস্তি পাওনা হয়েছে। আমরা এক প্রতিবেশী বিহারির বাড়িতে গেলাম। তাকে আমি ‘চাচা’ ডাকতাম। তার মেয়েটি আমার বোনের বাল্পব্দবী। সে আমাকে ‘ভাই’ বলত। কিন্তু সেদিন সব মানবিক বন্ধন ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল।
আমরা জোর করে ওই বাড়িতে ঢুকে পড়ি... মেয়েটিকে ধরি এবং তার কাপড়-চোপড় খুলে ফেলি। কিন্তু সে আমাদের হাত থেকে ছুটে পালায়। আমরাও পিছু নিই। তার পেছনে ছোটা লোকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। আমার মনে কেবল তখন একটাই চিন্তা, আমি এই মেয়েটিকে ধর্ষন এবং বিনাশ করব, ওরা আমাদের শত্রু।... সেই মুহুর্তেই বুঝলাম আমার ভেতরে শয়তান জন্ম নিচ্ছে। আমার কাছে মানুষ মারার অস্ত্র আছে, আমার প্রশিক্ষণ আছে। ট্রেনিং দিয়ে আমাকে সাপের মতো ঠাণ্ডা বানানো হয়েছে। যুদ্ধের সময় আমি ভেবেছি, ‘এ আমার কী হলো’? এখন এতদিন পর এ নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি, অনেক অপরাধ আমার। জাতীয়তাবাদ খারাপ জিনিস।’’ (সাইকিয়া, ২৮৬)
এটি নিশ্চয়ই একজন মুক্তিযোদ্ধার আদর্শ চরিত্র নয়। আবার এমন ঘটনার অস্তিত্ব একেবারেই কম নয়। কথা হচ্ছে, যারা এভাবে বিচ্যুত হয়েছিলেন তাদের মুখ বন্ধ করে রেখে তাদেরও কি নিরন্তর আত্মদংশনের যন্ত্রণা সইতে বাধ্য করা হচ্ছে না? তাদের প্রায়শ্চিত্তের সুযোগও আমরা রাখতে চাই না, চাই না তারা এসব চাপা গুমর প্রকাশ করে বিবেকের বোঝা লাঘব করুন। (সাইকিয়া, ২৮৬)
৩. যশোরের হালিমা পারভীন : ১৯৭১ সালে হালিমা অস্টম শ্রেণীতে পড়তেন। স্বপ্ন ছিল শিক্ষিত হয়ে বড় মানুষ হবেন। পাকিস্তানি বাহিনী তাদের বাড়ি জ্বালিয়ে দেয় এবং তার পিতাকে নির্মম প্রহার করে। এ দেখে হালিমার মনে প্রতিশোধ স্পৃহা জন্মায়। তিনি তার পরিবারের অন্যদের সঙ্গে অস্ত্র তুলে নেন। তারা ৩৫ জন তরুণ-তরুণীর একটি বাহিনী গড়ে তোলেন এবং ট্রেনিং নেন। হালিমা একাধিক অপারেশনে অংশ নেন এবং আর্মি ও রাজাকার হত্যা করেন। একটা পর্যায়ে স্থানীয় দালালরা খবর দিয়ে তাদের ধরিয়ে দেয়। তারা ঘেরাও হয়ে যান। কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই ধরা দেন এজন্য যে, নইলে অনেক গ্রামবাসীও মারা পড়ত। তাদের যশোর ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। তার সামনেই সব পুরুষ যোদ্ধাকে হত্যা করা হয়। হালিমার সঙ্গে ধরা পড়েছিলেন ফাতেমা ও রোকেয়া নামের আরো দু’জন নারী যোদ্ধা। হালিমার ভাষায় : যশোর ক্যান্টনমেন্টে আমরা আরো হাজার হাজার নারীকে বন্দি থাকতে দেখি... তাদের ওপর যে অত্যাচার হয়েছিল তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। নিজ হাতে তাদের কবর খুঁড়তে হতো।... বাড়ি ফেরার পর আমি বুঝলাম আমার যুদ্ধ শেষ হয়নি। যদিও যশোর স্বাধীন হয়েছে কিন্তু আমি স্বাধীন হইনি। আমার যুদ্ধ যেন নতুন করে শুরু হলো। কিন্তু এবারের যুদ্ধ আমার নিজ মানুষদের সঙ্গে, আমার নিজের দেশের সঙ্গে যার জন্য আমি যুদ্ধ করেছি, যাদের জন্য আমি সব হারিয়েছি। আমার যুদ্ধ এখনো চলছে (ওমেন ইন ফ্রন্টাল ওয়ার : শাহীন আফরোজ, ২০০৫)। হালিমা মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে যুদ্ধের মধ্যে বন্দি হন। কিন্তু তার নাম মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় ওঠে নাই, উঠেছে বীরাঙ্গনার খাতায়। এই ছিল তার পুরস্কার। হালিমা ছোটবেলায় চেয়েছিলেন ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করতে। তার সাধ অর্ধেক পূরণ হয়েছে। তিনি ডাক্তার হতে পারেননি, অনেক কষ্টে সিভিল সার্জন অফিসের আয়া হতে পেরেছেন।
কণ্ঠ আরো অনেক বাংলাদেশি মেয়ের মতো। সেই কণ্ঠ নির্যাতিতের কণ্ঠ। যোদ্ধা হওয়া বা দেশের জন্য ত্যাগ স্বীকারের গর্বের সঙ্গেই জড়িত হয়ে আছে তার সর্বনাশের ইতিহাস। পরিবারের ধর্ম এবং রাজনীতিই তাদের ‘শত্রুশরীরে’পরিণত করেছে। পাকিস্তানি সৈন্য,বাঙালি রাজাকার এবং বিহারিরা দেশ ও জাতির নামে তাকে ধ্বংস করে দিয়েছে এবং ফেলে গেছে পুড়ে মরার জন্য। যখন সে পুকুর থেকে উঠে এলো, তখন তার গায়ের পোড়া মাংসের ঘ্রাণ কি আমাদের নাকে লেগেছিল? কিংবা তার যন্ত্রণা কি আমরা টের পেয়েছিলাম? আমরা তাকে ফেলে এসেছি দূর অতীতে,কখনোই না ফুরানো একাকীত্বের মধ্যে,যেখানে সে কিংবা আরো অসংখ্য বিধবা, পঙ্গু, পরাস্ত যোদ্ধার স্মৃতি, ভয়, উদ্বেগ অথবা আশার কোনো অংশীদার নেই।
''মনে পড়ে কবেকার পাড়াগাঁ'র অরুণিমা সান্যালের মুখ,
উড়ৃক উড়ুক তারা, পৌষের জ্যোছনায় নীরবে উড়ুক।'' (জীবনানন্দ দাশ)


মন্তব্য

সুমন সুপান্থ এর ছবি

অসাধারন লেখা , অভিবাদন ফারুখ ওয়াসিফ ।

---------------------------------------------------------
নীল সার্ট নেই বলে কেউ আমাকে নাবিক বলেনি !
অথচ সমুদ্রে-ই ছিলাম আমি

---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !

অতিথি লেখক এর ছবি

আমি সমর্থন করছি তাদের প্রায়শ্চিত্তের সুযোগও রাখা উচিত না।অনেক ভাল লাগলো।
-নিরিবিলি

ফারুক হাসান এর ছবি

সত্যি অসাধারণ লেখা। এভাবে নির্মম সত্যের প্রকাশ খুব একটা দেখা যায় না। পুরুষশাসিত সমাজে মুক্তিযুদ্ধের মত ব্যাপক আর নির্বিশেষ ব্যাপারও হাইজ্যাক হয়ে যাচ্ছে কিংবা পুরোটা হয়ে গেছে কি না - এই প্রশ্ন আরো আগেই উঠা উচিত ছিল। নারীদের অবদান আমরা সবসময়ই ছোটো করে দেখতে চাই, এই চাওয়ার মধ্যে নিজেদের স্বার্থ জড়িত থাকে বলাই বাহুল্য। বীরঙ্গনা বলে গলা ফাটাই, কিন্তু তাদের প্রাপ্য মর্যাদা, সম্মান আর প্রতিষ্ঠা দিতে কুন্ঠাবোধ করি। এ আমাদের লজ্জা এবং জাতি হিসেবে ব্যর্থতা।
আরেকটা ব্যাপার এই লেখায় দারুণভাবে উঠে এসেছে, সেটা হলো নারীদেরকে বীরাঙ্গনা নামের আড়ালে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় থেকে খুব সাবধানে দূরে রাখা। নারীর মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়কে মুছে ফেলাও দেখা যাচ্ছে আমরা বেশ দক্ষতার সাথেই করেছি বা করছি।
দারুণ একটি লেখা শেয়ার করার জন্য আপনাকে অভিনন্দন এবং (বিপ্লব)
----------------------------------------------
আমাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে একটা নদী-
সাথে নিয়ে একটা পাহাড় আর একটা নিঃসঙ্গ মেঘ।

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

এবং আরো একটা ব্যাপার হলো, এই কাণ্ডগুলো ১৯৭১ এর পরে পাতাল থেকে জাগা দৈত্যরা করে নাই। করেছে তাদেরই সহযোদ্ধা-স্বদেশী মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশ_মানে আমরাও, যারা পরে তাদের বলা ইতিহাসকেই ছহি মনে বিশ্বাস করেছি। এর বীজ ১৯৭১ সালেও নেতাদের মনে ছিল। নইলে দেশ এমন হতো না।
::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::
মনে হয় তবু স্বপ্ন থেকে জেগে
মানুষের মুখচ্ছবি দেখি বাতি জ্বেলে

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

শেখ জলিল এর ছবি

দারুণ বিশ্লেষণী লেখা।

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

নুরুজ্জামান মানিক এর ছবি

লেখাটি সমকালে পড়েছিলাম বছর ১/২ আগে।

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

হ্যাঁ, সামান্য পরিমার্জন করেছি। আবার দিয়েছি পরের লেখাটিতে পৌঁছনোর জন্য। এটুকু বলে না নিলে সেটা প্রকাশ করা বাতুলতা হতো।
::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::
মনে হয় তবু স্বপ্ন থেকে জেগে
মানুষের মুখচ্ছবি দেখি বাতি জ্বেলে

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

নুরুজ্জামান মানিক এর ছবি

@ফারুক ওয়াসিফ

সমকালের কথা বলে আমি কিন্তু আপত্তি তুলি নি ; এই লেখাটি আমার খুব ভাল লেগেছিল । তাই মনে রেখেছি আর জানান দিয়েছি ।

যা হোক , যে পর্বে যাবার জন্য এই লেখাকে হাজির করলেন সেটা কই। মাস ত' পেরিয়ে গেল।

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

বিনম্র শ্রদ্ধা - সেইসব বীর'মাতাকে।

অমিত আহমেদ এর ছবি

চোখ জ্বালা করে উঠলো লেখাটা পড়ে। এমন অবস্থায় আমার মাথা খারাপ হয়ে যায়, প্রচন্ড ক্রোধে ইচ্ছে করে সব ভেঙে-চুরে ফেলি। আমরা বাঙালিদের মধ্যে এত স্বদ্বন্দ কেন!


ওয়েবসাইট | ফেসবুক | ইমেইল

ধুসর গোধূলি এর ছবি
হিমু এর ছবি

ক্যাটেগরিতে ১, ২ ... যোগ করবেন না। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সমস্যাবলি ১ আর সমস্যাবলি ২ দুটো ভিন্ন ক্যাটেগরি হয়ে যাচ্ছে। "মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সমস্যাবলি" রাখলে পরবর্তীতে ক্যাটেগরিতে ক্লিক করলে সেই ক্যাটেগরির অন্তর্ভুক্ত পোস্টগুলো এক পাতায় দেখা যাবে।


হাঁটুপানির জলদস্যু

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।