পরাজিতজন

গৌতম এর ছবি
লিখেছেন গৌতম (তারিখ: বুধ, ৩০/০১/২০০৮ - ১২:১৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মনে করি, এই ব্লগ সাইটের কোন একটি পাতায় কোন একটি নির্দিষ্ট বিন্দু আছে। বিন্দুটির একটি নাম দেওয়া দরকার। বেশ সুন্দর নাম। যেনো মনে হয়, বিন্দুটি কোনো প্রাণ থেকে উৎসারিত কিংবা কেউ একজন বিন্দু থেকে। বিন্দুতে যেনো কারো না কারো অস্তিত্ব বজায় থাকে। বিন্দুর কোন আনন্দে কেউ যেনো আনন্দিত হয়, বিন্দুর কোন দুঃখেও তেমনি। কী নাম দেওয়া যায়? শেকড়ের সন্ধানে গেলে কেমন হয়? এই যেমন সঙ্গম, কিংবা দশ মাসের অপো, কিংবা প্রসব বেদনা, কিংবা একেবারে জন্ম! নাম হিসেবে জন্মটাই তো বোধহয় ভালো, তাই না? নর-নারী সঙ্গম করে যতোটা না ভবিষ্যৎ প্রাণের জন্মের আশায়, তার চাইতে বেশি তাৎণিক সুখের। আর দশ মাসের অপেক্ষা? সেটাও আসলে এক প্রকার সুখ। কোনো কিছু উদ্ভাবনের সুখ। প্রসব বেদনা শরীরের একটা অসাধারণ মুহূর্ত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তাহলে সেই জন্মই দাঁড়াচ্ছে। জন্মমুহূর্তে আত্মীয়-পরিজন একটা অনুষ্ঠানের উপলক্ষ খুঁজে পায়, বাবা খুঁজে পায় বংশ, আর মা পায় পৃথিবীর খাতায় আবিষ্কারকের নাম হিসেবে নিজেকে দেখতে পাওয়ার সুখ।

বিন্দুটি তা-হলে জন্ম। ইউক্লিডীয় জ্যামিতি অনুসারে যে কোনো বিন্দুকে তার অবস্থান থেকে সামনে বাড়াতে থাকলে তৈরি হয় সরলরেখা। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, সরলরেখার কোনো সীমা নেই, পরিসীমা কি আছে? জ্যামিতি অনুসারে আমরা কি এগুতে থাকবো?
পরাজিতজন গল্পের ছবি
তাহলে জন্মমুহূর্তটিকে যদি আমরা উপরের ছবির মতো A ধরি, তাহলে কিছুদূর এগিয়ে B অবস্থানে গেলে শৈশবকে দেখতে পাবো। তাকে হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে এলাম বিন্দু C-তে। কিন্তু C-তো কৈশোরকাল- D বিন্দু যাকে হাত তুলে ডাকছে খেলতে। হাঁসিমুখে সাড়া দিতেই কৈশোর হয়ে যায় গোঁফ ওঠা এক তরুণ। সব কিছু ভেঙেচুরে নতুন করে ঠিক করবে বলে তরুণ যখন নিজেকে প্রস্তত করছে তখনই নিজেকে সে আবিষ্কার করে E বিন্দুতে। বেশ গাট্টাগোট্টা এক যুবক। সংসার পালন করা আদৌ ধর্ম কি-না, ভাবনা আসে সংসারধর্ম পালন করতে গিয়ে। এখানে প্রবেশ করে যুবকটি সমাজ, রাষ্ট্র, পৃথিবীর কথা ভুলে গিয়ে নিজের দিকে তাকায়। দেখতে পায় এক প্রৌঢ় F বিন্দুতে বসে আছে। পেনশন নিতেই সবাই মিলে জোর করে তাকে ঠেলে দেয় G বিন্দুতে। নিজেকে দেখে ভারি অবাক হয় সে। এ কি সে? সাদা- সব সাদা। জীবনের পরিণত রূপ কি সাদা?

না, জীবনের পরিপূর্ণ রূপ সাদা নয়, কালো- এবং ওই H বিন্দুতে। এটা আরো প্রমাণিত হয়ে গেলো যখন কালো পোশাক পরা কিছু মানুষ তাকে নিয়ে গেলো কবরে-মহাশ্মশানে। কিন্তু এটা তো কথা ছিল না! কথা ছিল জ্যামিতি বাড়তে বাড়তে A, B, C, D, E, F, G, H ... চলতেই থাকবে। কিন্তু এখানে হঠাৎ থেমে গেলো কেন?


ইউকিডীয় জ্যামিতিতে সময়কে বিবেচনায় আনা হয়নি। সম্ভবত তাই এ অবস্থা। প্রশ্ন হলো, যে জ্যামিতি জীবনকে অসীমের সন্ধান দিতে পারে না, তার মূল্য কতোটুকু?


ঢাকা শহরের একটি ঘর। উপরে পলিথিন, চারদেয়াল পাটকাঠির। দরোজা বন্ধ। গোঙানির শব্দ আসছে ভেতর থেকে। বাইরে মানুষের ভিড়, অজানা আশঙ্কায় কাঁপা চাহনি। শিশুটি ভূমিষ্ঠ হলো। প্রাকৃতিক নিয়মে কিছুণ কেঁদে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলো- পাটকাঠি, পলিথিন- বাঃ বেশ! পৃথিবীর তাহলে বেশ উন্নতি হয়েছে! আচ্ছা, ঘরটা কি জ্যামিতিক ছকে বানিয়েছে?

কিন্তু শিশুটি যেনো হঠাৎই শুনতে পায় আরেক ডাক। মহাজীবন, অনন্তের ডাক। কিন্তু কাজ? তার যে সব কাজই পড়ে থাকলো!

সব কাজ ফেলে, বাইরের উন্নতির এই দুনিয়ার চোখ ধাঁধানো আলো না দেখে সে আস্তে করে ঘুমিয়ে পড়লো। আবিষ্কারকের খাতায় মায়ের নাম থাকলেও সেখানে সফল ব্যক্তিদের প্যারা থেকে মুছে গেলো মায়ের পরিচিতিটা।


আমরা কিন্তু কেউই জানি না, শিশুটি ছিলো ইউক্লিড।


ঈশ্বর দুঃখ প্রকাশ করলেন। ‘আরেকজনের পরিবর্তে ভুল করে তোমাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। তুমি বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই জীবনকে জ্যামিতিতে মিলিয়ে নিতে! মানুষ হয়ে যেতো অমর। সেটি আমি হতে দিই কী করে? আমি নিশ্চয়ই আমার প্রতিদ্বন্দ্বি তৈরি করবো না। কী বলো?’


ঈশ্বর কি ভুল করেন? নাকি মানুষ তার প্রতিদ্বন্দ্বি হয়ে যাবে এ শংকায় অবশেষে পরাজিত হলেন তাঁরই সৃষ্টির কাছে?


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাবনার খোরাক পেলাম। চমত্কার।

-নির্বাসিত

গৌতম এর ছবি

কী ভাবনার খোরাক পেলেন জানাবেন? ধন্যবাদ।

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।