গ্রাম-শহরের বৈষম্য প্রবলতর হচ্ছে শিক্ষাখাতে

গৌতম এর ছবি
লিখেছেন গৌতম (তারিখ: রবি, ০৫/১০/২০০৮ - ১০:৫৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রচলিত বিভিন্ন পণ্যে বিনিয়োগের সাথে শিক্ষায় বিনিয়োগের ধারণাটিকে এক কাতারে ফেলা যায় না। তবে বাজারকেন্দ্রিক ব্যবস্থায় যেখানে বা যেভাবেই বিনিয়োগ হোক না কেন, সেখান থেকে রিটার্ন বা ফেরত আশা করা হয়। পার্থক্য হচ্ছে, বস্তু বা পণ্যে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যেভাবে তড়িৎ রিটার্ন পাওয়া যায় বা আশা করা হয়; শিক্ষায় সেটি সম্ভব নয় বা আশাও করা হয় না। শিক্ষায় বরং স্বল্পমেয়াদী ফলাফলের চাইতে দীর্ঘমেয়াদী ফলাফলের ওপরই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। তবে অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে দৃশ্যমান রিটার্নটিই বেশি দৃশ্যমান হচ্ছে।

এবারের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে পর সর্বোচ্চ জিপিএ ৫ পাওয়া এবং শতভাগ পাশের হারের ভিত্তিতে সফল বিদ্যালয়গুলোর যে তালিকা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে এক ভয়াবহ চিত্র দেখা যাচ্ছে। এই তালিকায় মূলত শহরাঞ্চলের গুটিকতক বিদ্যালয় প্রতি বছরই স্থান করে নিচ্ছে। দু’একটি ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়, কিন্তু শিক্ষার এই সাফল্য এখন আবর্তিত হচ্ছে শহরকে কেন্দ্র করে।

সবচেয়ে উদ্বেগজনক চিত্র পাওয়া যাচ্ছে ঢাকা বোর্ডে। জিপিএ ৫-এর সংখ্যার ভিত্তিতে ঢাকা বোর্ডের সেরা যে দশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকা করা হয়েছে, সেখানে সবগুলো বিদ্যালয়ই অবস্থিত ঢাকা সিটি করপোরেশনে। একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার এর চাইতে উদ্বেগজনক চিত্র আর কী হতে পারে। ঢাকা যেভাবে দিন দিন প্রশাসনিক সব কর্মক্ষেত্রের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে, শিক্ষার সফলতাও তেমনি ক্রমশই ঢাকাভিত্তিক হয়ে যাচ্ছে। বিষয়টিকে ঢাকার বাইরে নিয়ে গেলে দেখা যাবে- শিক্ষা ক্রমে ক্রমেই শহরে পুঞ্জীভূত হচ্ছে। আগে যেভাবে গ্রামাঞ্চল থেকে শিক্ষার্থীরা উঠে আসতো, এখন সেই চিত্র পুরোপুরি বদলে গেছে। আজ থেকে মাত্র দু’যুগ আগেও সারাদেশের শিক্ষার্থীদের সফলতার আলো ছড়িয়ে পড়তো, এখন সেই আলো ঠিকরে পড়ছে কেবল ঢাকা থেকে কিংবা ঢাকার মতো বড় বড় শহরগুলো থেকে। গ্রামাঞ্চলের শিক্ষা ক্রমশই অবহেলিত হচ্ছে, অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে। এসএসসি বা এইচএসসির ফলাফল থেকে এটা বলা যায়- হয় সারাদেশের বিদ্যালয়গুলোর পড়ালেখার মানের ক্রমাবনতি হচ্ছে, না হয় শহরকেন্দ্রিক বিদ্যালয়গুলো তাদের মান এতোটাই উঁচুতে নিয়ে যাচ্ছে যে, গ্রামের বিদ্যালয়গুলো এর ধারেকাছেও পৌঁছাতে পারছে না।

কোনো নির্দিষ্ট একক কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলা যাবে না। প্রশাসনিক-আর্থিক-অবস্থানগত বিভিন্ন দিক দিয়ে শহরের বিদ্যালয়গুলো যে ধরনের সুবিধা ভোগ করছে, গ্রামের বিদ্যালয়গুলো ততোটাই পেছনে অবস্থান করছে। শহরে যে রকম দক্ষ শিক্ষক পাওয়া যায়, অবকাঠামোগত যে ধরনের সুবিধা শিক্ষার্থীরা ভোগ করতে পারে, গ্রামে সে ধরনের সুবিধার কথা চিন্তা করা বাতুলতা মাত্র। শহরাঞ্চলের অধিকাংশ বিদ্যালয়েই শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানাগার কিংবা লাইব্রেরি সুবিধা ভোগ করতে পারে, বিপরীতে গ্রামাঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোতে বিজ্ঞানাগার থাকাটাই আশ্চর্যের বিষয়। যদি কোনো বিদ্যালয়ে থেকে থাকে তাহলে সেটা তাদের সৌভাগ্যের বিষয়, যদিও এমনটা হওয়ার কথা ছিলো না।

এটা গেলো একটি দিক। রাষ্ট্র শিক্ষায় বিনিয়োগ করছে, কিন্তু প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সেই বিনিয়োগের একটি বড় অংশ ভোগ করছে শহরের বিদ্যালয়গুলো। ফলে শহরের বিদ্যালয়গুলো বিনিয়োগের বিপরীতে চমৎকার ফলাফল প্রকাশ করতে পারছে। অপরদিকে গ্রামাঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোতে বিনিয়োগের হার প্রয়োজনের তুলনায় কম। অনেক বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত শ্রেণীকক্ষ নেই, দক্ষ শিক্ষক নেই, বিজ্ঞানাগার নেই, লাইব্রেরি নেই- আছে কেবল ‘নেই’-এর লম্বা তালিকা। অর্থাৎ রাষ্ট্রের বিনিয়োগকৃত অর্থ সব প্রতিষ্ঠানে সমভাবে বণ্টিত হচ্ছে না কিংবা বলা যায় প্রয়োজন অনুসারে বণ্টিত হচ্ছে না।

রাষ্ট্রের বিনিয়োগের পাশাপাশি শিক্ষায় ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগও বাড়ছে দিন দিন। আগেই বলা হয়েছে, শিক্ষার রিটার্নগুলো এখন অনেক বেশি দৃশ্যমান, অনেক বেশি প্রায়োগিক। ব্রিটিশ কিংবা পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশ আমলের প্রথম দশকটি শিক্ষার প্রায়োগিক দিকের তুলনায় সামাজিক মূল্যমানের বিষয়টিই বেশি গুরুত্ব পেতো। বর্তমানে সামাজিক মূল্যমানের কথা যতোটুকু চিন্তা করা হয়, তার চাইতে বেশি ভাবা হয় এর প্রায়োগিক দিকগুলোকে কেন্দ্র করে। যার ফলে বিজ্ঞানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমছে, বাড়ছে বাণিজ্য শাখায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তো বটেই, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও বাংলা, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, গণিত, পদার্থবিজ্ঞান ইত্যাদির তুলনায় বিবিএ-এমবিএ ইত্যাদি বিষয়গুলো কদর বাড়ছে অনেক বেশি। এ অবস্থায় রাষ্ট্রের পাশাপাশি অভিভাবকরাও তাদের সন্তানদের শিক্ষায় প্রভূত পরিমাণ বিনিয়োগ করবেন- এটাই স্বাভাবিক এবং হচ্ছেও তাই।

যেহেতু শহর ও গ্রামাঞ্চলের মধ্যকার একটি প্রবল আয়বৈষম্য রয়েছে, তাই এই শিক্ষায় বিনিয়োগেও বৈষম্য প্রবল`sতর। তুলনামূলক বেশি আয়ের কারণে শহরাঞ্চলের একজন অভিভাবক তাঁর সন্তানকে যেভাবে প্রতিটি বিষয়ের জন্য প্রাইভেট টিউটর বা কোচিঙের ব্যবস্থা করতে পারেন, গ্রামাঞ্চলের অভিভাবকের পক্ষে সেটি বেশ কঠিন। পাশাপাশি ভালো প্রাইভেট টিউটর বা কোচিঙের সহজলভ্যতা, পর্যাপ্ত শিক্ষোপকরণের প্রাপ্যতা, প্রযুক্তিগত সহায়তা- সব দিক দিয়েই শহরাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা এগিয়ে রয়েছে। গ্রামের অভিভাবকের পর্যাপ্ত অর্থ থাকলেও সন্তানকে শহরে পাঠিয়ে লেখাপড়া করানো ছাড়া এই বিষয়গুলো নিশ্চিত করার আর কোনো পথ নেই। তাদের জন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষক আর পাঠ্যবই ছাড়া আর সহায়ক কোনোকিছু নেই। হয়তো বিদ্যালয়ে পাঠদান সঠিকভাবে নিশ্চিত করা গেলে অন্য কিছুর প্রয়োজনও হতো না। কিন্তু সেটির ব্যবস্থা তো করা হচ্ছেই না, বরং শিক্ষায় ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উৎসাহিত হচ্ছে। ফলে দিন দিন শিক্ষা হয়ে যাচ্ছে শহরের মানুষদের প্রবল প্রতাপের একটি বিচরণক্ষেত্র।

এডুকেশন ওয়াচ ২০০৬ সালের Financing Primary and Secondary Education in Bangladesh গবেষণায় Private Expenditure নামে একটি অধ্যায়ই রয়েছে। সেখান থেকে দেখা যাচ্ছে, প্রতিটি পর্যায়েই গ্রামাঞ্চলের একজন শিক্ষার্থীর জন্য অভিভাবক যা খরচ করেন, শহরাঞ্চলের অভিভাবকরা খরচ করেন তার চাইতে অনেক বেশি এবং এই খরচ হয় বিভিন্ন খাতে। এমনকি বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক হলেও সেখানেও শিক্ষার্থী প্রতি একটি বড় অংকের টাকা খরচ করতে হয় অভিভাবকদের। এই খরচ হয় প্রাইভেট টিউশনি, ভর্তি, অন্যান্য ফি, বই ও অন্যান্য শিক্ষোপকরণ ক্রয়, যাতায়াত, বিনোদন ইত্যাদি বিভিন্ন খাতে। অর্থাৎ প্রাথমিক শিক্ষাও সত্যিকার অর্থে পুরোপুরি ফিমুক্ত নয়। এখানেও অভিভাবকদের ব্যক্তিগত বিনিয়োগের ব্যবস্থা রয়েছে এবং যিনি যতো বেশি বিনিয়োগ করতে পারবেন, তিনি ততো বেশি শিক্ষালাভ করতে পারবেন। গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রামাঞ্চলে সবচেয়ে গরীর অভিভাবকদেরও শিক্ষার্থী প্রতি বছরে খরচ করতে হয় প্রাথমিক পর্যায়ের জন্য ১,৩১৩ টাকা এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে ৪,০৪৯ টাকা, শহরাঞ্চলে এর পরিমাণ যথাক্রমে ১,৪৫৭ টাকা ও ৫,২৯৫ টাকা। এই টাকার সংখ্যাটাই লাফ দিয়ে বেড়ে যায় ধনী অভিভাবকদের ক্ষেত্রে। প্রাথমিক পর্যায়ে গরীব অভিভাবক ওই ১,৩১৩ টাকা খরচ করলেও শহরের ধনী অভিভাবক খরচ করেন ৪,৫১৪ টাকা। মাধ্যমিক শিক্ষায় গ্রামের সবচাইতে একজন গরীব অভিভাবক বছরে শিক্ষার্থী প্রতি ৪,০৪৯ টাকা খরচ করলেও শহরের সবচাইতে ধনী ব্যক্তি খরচ করেন ১৭,১৩৫ টাকা। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, যার হাতে অর্থ আছে তিনিই শিক্ষার প্রতি এই খরচটুকু খরচ করতে পারছেন, যার উপযুক্ত প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে এসএসসি ও এইচএসসি পর্যায়ে।

গ্রাম-শহরের মধ্যকার এই পার্থক্যের আরেকটি কারণ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। শহরাঞ্চলে প্রচুর কিন্ডারগার্টেন বা ইংরেজি মিডিয়ামের বিদ্যালয় রয়েছে, যা গ্রামাঞ্চলে অনুপস্থিত। এই সমস্ত বিদ্যালয়গুলোতে একজন শিক্ষার্থীর জন্য প্রয়োজনীয় সব সুবিধাই বিদ্যমান। বিত্তবান অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের এসব অভিজাত বিদ্যালয়ে পড়িয়ে একদম প্রথম থেকেই তাদের সন্তানদের গ্রামের বিদ্যালয়ের তুলনায় সবদিক দিয়েই এগিয়ে রাখছেন। যদিও এ ধরনের ক্ষেত্রগুলোতে ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগই প্রধান, কিন্তু একইসাথে এ ধরনের সুযোগসুবিধার প্রবল বৈষম্যসম্পন্ন বিদ্যালয়ব্যবস্থা রেখে রাষ্ট্রই মুলত বৈষম্যমূলক শিক্ষাকে উৎসাহিত করছে। ফলে গ্রামাঞ্চলের সাথে শহরাঞ্চলের শিশু ছোটবেলা থেকেই বেড়ে উঠছে বৈষম্যমূলক পরিবেশে।

শিক্ষার এই বৈষম্যমূলক পরিবেশ আমাদের দেশের জন্য ক্ষতিকর হতে বাধ্য। যেহারে শহরের শিক্ষা এগিয়ে যাচ্ছে, গ্রামের শিক্ষাকে যদি তার সাথে তাল মেলানো না যায় তাহলে গ্রাম-শহরের যে বৈষম্য বাড়বে, তাতে গ্রামের কোনো শিক্ষার্থীই আগামী দিনগুলোতে শহরের শিক্ষার্থীদের সাথে তাল মেলাতে পারবে না। প্রতি বছর এসএসসি বা এইচএসসির ফলাফল প্রকাশের পর পত্রিকার পাতায় ফলাও করে কিছু বিরুদ্ধ স্রোতের শিক্ষার্থীর কথা ছাপা হয় যারা প্রবল জীবনযুদ্ধের ভেতরেও ভালো ফলাফল করতে সক্ষম হয়েছে। বৈষম্যমূলক এই ব্যবস্থায় তাদের পক্ষেও বেশিদূর যাওয়া সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। তার চাইতেও বড় কথা, দেশের অধিকাংশ এলাকাকে উপেক্ষা করে, অন্ধকারে রেখে শুধু শহরকে নিয়ে একটি দেশের পক্ষে চলা সম্ভব নয়। কিছুকাল আগেও বিভিন্ন নামীদামী বিদ্যালয়-কলেজগুলোতে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা এসে ভিড় করতো ভর্তি হওয়ার জন্য, সেই দৃশ্য সা¤প্রতিক বছরগুলোতে একেবারেই পাল্টে যাচ্ছে। এখন শহরের শিক্ষার্থীদের চাপে গ্রামের শিক্ষার্থীরা এসব ‘ভালো’ বিদ্যালয়গুলোতে ভর্তিরই সুযোগ পাচ্ছে না। ফলে গ্রামের শিক্ষার্থীদের সারাটা শিক্ষাজীবন পার করতে হচ্ছে একধরনের সুবিধাহীন অবস্থায়। শিক্ষার খরচ যেভাবে দিন দিন বাড়ছে, তাতে গরীব মানুষের শিক্ষার পথও রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। আগে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিক্যাল কলেজগুলোতে গ্রাম থেকে আসা শিক্ষার্থীদের পদভারে মুখরিত হতো, এখন তাদের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। উচ্চশিক্ষা তো বটেই, মাধ্যমিক পর্যায়েও সাধারণ শিক্ষা দিন দিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

আজকে হয়তো এই বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বুঝা যাচ্ছে না। কিন্তু শহরের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলকে গুরুত্ব না দিলে, এর শিক্ষার্থীদের তুলে না আনলে আগামী দিনগুলোতে দেশ একটি ভয়াবহ মানবসম্পদ শূন্যতার মুখোমুখি হবে। শহরের গুটিকতক শিক্ষার্থী নয়, গ্রামের বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থীই দেশের প্রাণ। শিক্ষার নীতিনির্ধারকদের এই বিষয়টির প্রতি এখন সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে মনে হয়। না হলে আস্তে আস্তে পুরো দেশ যখন ডুবে যাবে অন্ধকারে, শহরের প্রবল বাতি দিয়েও সারা দেশকে আলোকিত করা যাবে না। সেটি আসলেও বাস্তবে সম্ভবও নয়। তাই সময় থাকতেই গ্রামের নিভন্ত আলোকে পূর্ণোদ্যম জ্বালিয়ে রাখার ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

(লেখাটি গত ২৯ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোতে ছাপা হয়েছিলো। এখানে পুনরায় প্রকাশ করা হলো।)


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনি ব্লগে শিক্ষার যে বৈষম্য তুলে ধরেছেন তা সত্যিই উদ্বেগ জনক । আমার মতে রাষ্ট্র তার ভুল ব্যবস্থাপনার কারণে এই সমস্যার সৃষ্টি করেছে । তাই এর দায়ভার প্রধানত রাষ্ট্র কেই নিতে হবে । নব্বই এর দশক এর শুরুতে আমাদের কে বলা হল সবার জন্য শিক্ষা কিন্তু বলা হল না যে সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা । ফলে গ্রামাঞ্চলে যেখানে বাংলাদেশের অধিকাংশ দরিদ্র জনগোষ্ঠির বাস তারা পিছিয়ে পড়ল দিন কে দিন । কারণ অর্থনৈতিক সক্ষমতা আর সুযোগ এর ফলে শহুরে জনগোষ্ঠি তাদের সন্তানদের মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করল যা গ্রামাঞ্চলে সম্ভব নয় । আর এখানেই ধরা খেল গ্রামের শিক্ষা ব্যবস্থা ।
(০২)
শিক্ষা কে পণ্য হিসেবে গণ্য করাও ছিল আমাদের মস্ত ভুল । কারণ পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় যার অর্থ ক্ষমতা যত বেশি তার পণ্যের গুণগত মান তত ভাল হবে । আমার মতে এটাও বৈষম্যের অন্যতম কারণ ।
আমার ধারনা এইবার জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের উপর কোন স্টাডি চালানো গেলে দেখা যাবে অধিকাংশ শিক্ষার্থী উচ্চবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত ব্যাকগ্রউন্ড থেকে এসেছে ।
নিবিড়

গৌতম এর ছবি

মানসম্মত শিক্ষার বিষয়ে যে ভুলটি আমরা করেছি, সেটি কিন্তু বিশ্বনেতৃবৃন্দ করে নি। ১৯৯০ সালে থাইল্যান্ডের জমতিয়েন সম্মেলন থেকে নেওয়া হলো সবার জন্য শিক্ষা কর্মসূচি। কিন্তু ২০০০ সালে এসে দেখা গেলো অধিকাংশ দেশই সেটি অর্জন করতে পারে নি। ফলে ২০০০ সালের ডাকার সম্মেলনে সবার জন্য শিক্ষার পাশাপাশি ২০১৫ সালের মধ্যে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার ওপরও গুরুত্ব দেওয়া হলো। কিন্তু আমাদের দেশের নেতৃবৃন্দ ভাবলেন বোধহয় ২০১৫ সালের মধ্যে সবার জন্য শিক্ষা কর্মসূচি নিশ্চিত করার সুযোগ পুনরায় দেওয়া হয়েছে। ফলে তারা পুরনো পথেই হাটতে লাগলেন। মানসম্মত পড়েই থাকলো নিজের মানইজ্জত নিয়ে, ফাইলের ভেতর।

এ সময়ে শিক্ষা যে কীভাবে আস্তে আস্তে পণ্য হয়ে যাচ্ছে, সেটি নিয়ে আরেকটি বিশদ লেখা প্রকাশের আশা রাখি।

আর শিক্ষার বিষয়ে রাষ্ট্র কেন দায়ভার নিবে? আমরা যদি আদর্শ একটি সমাজ বা রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা চিন্তা করি, তাহলে অবশ্যই শিক্ষার দায়ভার রাষ্ট্রের নেওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্র কি সেরকম? আমাদের এই রাষ্ট্র তো সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার কথা বলে নি; সংবিধানেও সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার কথা বলা হয় নি। শুধু শিক্ষা দেওয়ার অঙ্গীকার করা হয়েছে। রাষ্ট্র যখন শিক্ষা নিশ্চিত না করে কেবল অঙ্গীকার করে, তখন শিক্ষার দায়ভার রাষ্ট্রের ওপর চাপানো ঠিক না। এটা চাপাতে গেলে শিক্ষা নিয়ে রাষ্ট্রের দর্শন ঠিক করতে হবে প্রথমেই।

আপনার মন্তব্যগুলো ভালো লাগলো। অনুপ্রাণিত হলাম। ধন্যবাদ।

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

ব্লগস্পট ব্লগ ::: ফেসবুক

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

মুজিব মেহদী এর ছবি

লেখাটি প্রথম আলোয় পড়া হয়েছিল। অল্প আয়তনে গ্রাম-শহরে বিরাজিত শিক্ষাক্ষেত্রের বৈষম্যের একটা ভালো চিত্র উঠে এসেছে এতে।
এই বৈষম্য এমন ভয়াবহ পর্যায়ে গেছে যে বাজেটে যদি এখন থেকে গ্রাম ও শহরের শিক্ষাখাতে সমান বরাদ্দও রাখা হয়, তাও ৫০ বৎসর বা তারও বেশি সময় লাগবে। অথবা কখনোই আর এই বৈষম্য দূর করা যাবে না। কেবল কমানো যাবে। যতদিনই লাগুক তবু উদ্যোগ তো নিতে হবে। সব সরকারই এই বৈষম্য সম্পর্কে অবগত হয়, কিন্তু কেউই বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেয় না ।
................................................................
তোমার হাতে রয়েছি যেটুকু আমি, আমার পকেটে আমি আছি যতটা, একদিন মনে হবে এটুকুই আমি, বাকি কিছু আমি নই আমার করুণ ছায়া

... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
কচুরিপানার নিচে জেগে থাকে ক্রন্দনশীলা সব নদী

গৌতম এর ছবি

ধন্যবাদ মুজিব ভাই। এখানেও একটা বৈষম্য দরকার। গ্রাম-শহরের পার্থক্যটা এতোটাই বিশাল যে সরকার যদি বৈষম্যমূলক আচরণ না করে গ্রাম-শহরের জন্য সমান বরাদ্দ দেয়, তাহলে এই দেশের কপালে খারাবি আছে। সুতরাং সরকারকে তাই গ্রামের বরাদ্দটা বেশি দিতে হবে।

আর উদ্যোগের কথা বলছেন? সরকার ছাড়া আর কে-ই বা এই উদ্যোগ নিতে পারে!
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

ব্লগস্পট ব্লগ ::: ফেসবুক

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

শামীম এর ছবি

জনগুরুত্বপূর্ণ লেখা।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

গৌতম এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ, শামীম ভাই।
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

ব্লগস্পট ব্লগ ::: ফেসবুক

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।