আমরা কেনো বারাক ওবামা-হিলারি ক্লিনটনের দূতিয়ালি করছি?

গৌতম এর ছবি
লিখেছেন গৌতম (তারিখ: মঙ্গল, ১৮/১২/২০০৭ - ৯:৩৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অন্য কোনো দেশের চাইতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন নিয়ে গণমাধ্যম এবং জনগণের আগ্রহ একটু বেশি থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। ফলে খুব একটা খবরমূল্য থাকুক বা না থাকুক, আমাদের শীর্ষ সংবাদপত্রগুলো প্রায় প্রতিদিনই এ সম্পর্কিত আপডেট ছাড়ছে আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠাগুলোতে।

আজ থেকে কয়েকমাস আগে থেকেই পত্রিকাগুলো মেতে উঠেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে কোন দলের কে প্রার্থী হচ্ছেন, তা নিয়ে। ফলে সম্ভাব্য প্রার্থীদের পোশাকের কেনাকাটার খবর থেকে শুরু করে তারা কোথায় কী খেতে বাধ্য হচ্ছেন, সে খবরও আমরা পাচ্ছি প্রতিনিয়ত। এই প্রার্থীদের মধ্যে আবার রিপাবলিকানদের তুলনায় ডেমোক্র্যাটরা প্রচারণায় এগিয়ে। বিদেশের কাগজগুলো দেখার সুযোগ তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় সত্যিকার চিত্রটা আমরা পাচ্ছি কি-না, সে সম্পর্কে সন্দেহ থাকলেও অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে-- প্রার্থী নির্বাচনে রিপাবলিকানদের তুলনায় ডেমোক্র্যাটরা বেশ সচেতন, তারা আগে থেকেই এ ব্যাপারে কাজ শুরু করেছে। তবে তথ্যমাধ্যমকে সচেতনভাবে নিজ স্বার্থের অনুকূলে ব্যবহার করার প্রবণতা থাকায় সন্দেহ থাকে, বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে এবার ডেমোক্র্যাটদের প্রচারণা বেশি চালানো হচ্ছে কি-না! এবং বাংলাদেশের প্রচারমাধ্যমগুলো জান্তে বা অজান্তে সেই প্রচারণার অংশ হয়ে গিয়েছে কি-না। তা না হলে রিপাবলিকানরাও যেখানে প্রার্থী নির্বাচনে তৎপরতা চালাচ্ছে, সেখানে তাদের খবরাখবর পত্রিকার পাতায় নেই বললেই চলে।

ডেমোক্র্যাটরা এবার গুরুত্ব পাচ্ছে অন্য একটি দিক থেকে। এই দলের যে কয়জন প্রার্থী হিসেবে দাঁড়াতে ইচ্ছুক, তাদের মধ্যে প্রধান দুই প্রার্থীই দুই দিক দিয়ে ব্যতিক্রমী। একজন বারাক ওবামা, যিনি বয়সে তরুণ এবং বলা হচ্ছে তিনিই হতে পারেন ‘জেনারেশন নেক্সট’-এর যোগ্য নেতা। অন্যজন হিলারি ক্লিনটন, নামের শেষাংশই যার মূল পরিচিতি ছিলো একসময়। যদিও আস্তে আস্তে তিনি নিজেই নিজ পরিচয়ে পরিচিত হচ্ছেন।

গত ছয় মাসে বাংলাদেশর শীর্ষ সংবাদপত্রগুলোর খবর ঘেঁটে এটুকু উপলব্ধি হয়েছে যে, আরো অনেক প্রার্থী থাকলেও আমাদের সংবাদপত্রগুলো এই দু’জনকে নিয়ে বেশি ব্যস্ত। সন্দেহ নেই, অন্য প্রার্থীদের তুলনায় এই দুই প্রার্থীর খবরমূল্য অনেক বেশি। এছাড়া পশ্চিমা মিডিয়াগুলোতে যেসব গালগল্প ছড়ানো হয়, সেগুলো বাছবিছার ছাড়াই আমাদের সংবাদপত্রগুলো ছেপে যায়। পশ্চিমা মিডিয়া কোনো কারণে এই দু’জনের প্রতি বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে, যার একটি অবশ্যম্ভাবী ছাপ পড়ছে আমাদের আন্তর্জাতিক খবরের পাতাগুলোতে।

সেটিও হয়তো আসতে পারে। যেহেতু আন্তর্জাতিক খবরের জন্য আমাদের দেশের সংবাদপত্রগুলোকে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের ওপর নির্ভর করতে হয়, তাই তারা যে খবর সরবরাহ করে সেগুলো ছাপানো ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, খবর বা নিউজ ছাড়াও আমাদের সংবাদপত্রগুলো কেনো বাছবিছারহীনভাবে বিশ্লেষণের নামে অহরহ এসব খবরের উদ্দ্যেশ্যপ্রণোদিত ভিউজ ছাপছে? এটা কি কেবল পত্রিকার পাতা ভরানোর দায়?

গত ছয় মাসে বারাক ওবামা ও হিলারি ক্লিনটন সম্পর্কিত যতো খবর ছাপা হয়েছে, তার সবকয়টিতেই খবরের অন্তরালে লুকিয়ে ছিলো কিছু হিডেন ভিউজও। প্রায় প্রতিটি লেখায়ই বারাক ওবামার অন্যতম যোগ্যতা বলতে গিয়ে বুঝানো হচ্ছে, তিনি নির্বাচিত হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে তিনিই হবেন প্রথম কৃষ্ণাঙ্গদের নেতা। অন্যদিকে একই ধরনের কভারেজ পাচ্ছেন হিলারি ক্লিনটনও। তিনি যদি প্রার্থী হয়ে জয়লাভ করেন, তাহলে তিনিই হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট এবং ফলে যুক্তরাষ্ট্র নারীর ক্ষমতায়ন, নারীবাদ ও নারীনেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় একধাপ এগিয়ে যাবে।

কিন্তু সত্যিকার অর্থেই কি বারাক ওবামা কৃষ্ণাঙ্গদের নেতা? বারাক ওবামার গায়ের রং কালো, সে হিসেবে তাকে কৃষ্ণাঙ্গ বলা যেতে পারে। কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গ এবং কৃষ্ণাঙ্গদের নেতা- শব্দগুলোর মধ্যো পার্থক্য যোজনদূর। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরগুলো পড়ে কোথাও পাওয়া যায় না যে, বারাক ওবামা নিজেকে কৃষ্ণাঙ্গদের নেতা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তিনি অবশ্য প্রচারণার অংশ হিসেবে কৃষ্ণাঙ্গদের সাথে কথা বলেছেন, সমর্থন চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, আমার এবং আপনাদের গায়ের রং এক। এর আগে কখনোই কালো চামড়ার মানুষরা নেতৃত্বে আসতে পারে নি। ফলে কৃষ্ণাঙ্গদের দিকে যথোচিত নজর কেউ দেয় নি, তাদের ইস্যুগুলো নিয়ে কেউ কথা বলে নি। আমি সেগুলো নিয়ে কাজ করতে চাই।

এই ধরনের গুটিকতক বক্তব্য ছাড়া বারাক ওবামা আর যতো বক্তব্য রেখেছেন, তাতে করে প্রমাণ করা মুশকিল যে তিনি সত্যিকার অর্থেই কৃষ্ণাঙ্গদের নেতা, কৃষ্ণাঙ্গদের বঞ্চনাগুলো তিনি বহন করেন, উপলব্ধি করেন। যদিও তিনি বলেছেন তিনি নির্বাচিত হলে কৃষ্ণাঙ্গদের সমস্যাগুলোর দিকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নজর দেবেন, কিন্তু তিনি কোথাও খোলাসা করে বলতে পারেন নি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের মূল সমস্যা কী। এছাড়া কৃষ্ণাঙ্গদের সমস্যা সমাধান করলে শ্বেতাঙ্গরা সেগুলো মেনে নিবে কি-না কিংবা এ সম্পর্কিত কৌশলগুলো কী হওয়া উচিত- সাংবাদিকদের প্রশ্নগুলো তিনি এড়িয়ে গেছেন সচেতনভাবেই। একজন সত্যিকারের কৃষ্ণাঙ্গ নেতার এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানাতে দেরি হওয়ার কথা নয়। অন্যদিকে কৃষ্ণাঙ্গদের কথা বেশি বললে শ্বেতাঙ্গদের ভোট হারাতে পারেন, সেই হিসেবও বারাক ওবামার জানা আছে ভালো করেই। ফলে তিনি এটিকে বড় কোনো ইস্যু হিসেবে বিবেচনা করছেন না, যা প্রমাণিত হয় তার দেওয়া বক্তব্যগুলো বিশ্লেষণ করলে। শুধু গায়ের রং কালো হলেই কৃষ্ণাঙ্গদের নেতা হওয়া যায় না, যদি না তিনি কৃষ্ণাঙ্গদের বঞ্চনা ও মানসিকতাগুলো ধারণ না করেন।

একই কথা প্রযোজ্য হিলারি ক্লিনটন সম্পর্কেও। তিনি নিজে একজন নারী, কিন্তু তাঁর বক্তৃতা-বক্তব্য শুনলে মনে হওয়া খুবই কষ্টকর যে, তিনি নারীবাদের কিংবা নারী আন্দোলনের একজন নেতা। নারী ক্ষমতায়নের কথা তিনি বলেন বটে, কিন্তু সেটি পুরুষ ক্ষমতায়তেনর সূত্র ধরে একটি পার্ট হিসেবে। মূলত নারী ইস্যু নিয়ে তিনি যে কয়টি কথা বলেছেন, তাতে এটা স্পষ্ট যে তিনি নারী হলেও পুরোপুরি পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাচেতনা ধারণ করছেন। ফলে নারী ইস্যুগুলো নিয়ে একজন পুরুষ (নারীবাদী পুরুষ নয়) যে ধরনের চিন্তা করেন, হিলারি ক্লিনটনের চিন্তাধারা তার ওপরে উঠতে পারে নি। পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব নিজ অবস্থান বজায় রেখে নারীদের যতোটুকু অর্থনৈতিক-সামাজিক ও লৈঙ্গিক স্বাধীনতা দিতে চায়, হিলারি ক্লিনটন তার একচুল বেশি দিতে রাজি নন। তাহলে তিনি কীভাবে নারীবাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বা নারীদের প্রতিনিধিত্ব করছেন? তাঁর শারীরিক কাঠামো বা অবয়ব অবশ্যই নারীর, কিন্তু মস্তিষ্ক সুগঠিত পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবে। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশেও খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনা যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন অনেকেই নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে বলে উচ্চকিত ছিলেন। কিন্তু তাঁরা কি শেষ পর্যন্ত পুরুষতন্ত্রের চূড়ান্ত জয়গান গেয়ে যান নি?

এই লেখার উদ্দ্যেশ্য প্রার্থীদের কাউকে সমর্থন বা কারো বিরুদ্ধে দাঁড়ানো নয়। মূলত বারাক ওবামা-হিলারি ক্লিনটন বা আর যে কেউই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হোন না কেন, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব মোটেও বদলাবে না। আর এটি প্রমাণিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা নীতি নিয়ে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের প্রায় একই মনোভাব প্রকাশে। তবে কৌশল হয়তো কিছুটা বদলাতে পারে। এ অবস্থায় বারাক ওবামাকে কৃষ্ণাঙ্গদের নেতা আখ্যা দিয়ে যেমন উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই, তেমনি হিলারি ক্লিনটনকেও নারী নেতা বলে আত্মতৃপ্তি পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের সংবাদপত্রের পাতাগুলোতে এ সম্পর্কিত খবরগুলো আসতে পারে শুধু খবর হিসেবেই, সেখানে না জেনেশুনে বিভিন্ন বিশেষণে বিশেষায়িত করে উল্লাসসহকারে ভিউজ দেওয়ার কোনো দরকার আছে কি? যেখানে আমাদের কোনো স্বার্থ নেই; সেখানে আমাদের নিজেদেরকে তাদের প্রচারযন্ত্রে পরিণত করার দরকার কতোটুকু? কেনো আমরা তাদের জন্য উচ্চকিত? নিজের অজান্তেই কি আমরা তাদের প্রোপাগান্ডার পার্ট হয়ে যাচ্ছি না?

অবশ্য দরকার-অদরকারের প্রশ্ন আসে অনেক পরে। আজ থেকে দু’দশক আগে মফিদুল হক লিখেছিলেন ‘মনোজগতে উপনিবেশ’ বইটি। সেই বইয়ের উপযোগিতা এবং মনোজগতে উপনিবেশের কার্যকারিতা কতটুকু, তা আমাদের দেশের সংবাদপত্রগুলোর লেখার প্রকাশভঙ্গীর মাধ্যমেই প্রমাণিত হচ্ছে।

গৌতম


মন্তব্য

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

মিডিয়ার ভূমিকা ও নির্বুদ্ধিতার প্রশ্নে মোটামুটি একমত। তবে আমি এই নির্বাচনের প্রাইমারি নিয়ে উৎসাহের কিছু কারণ দেখি। 'হিলারি ও ওবামা' নিয়ে আমি চিন্তিত নই। হিলারি যেকোন পুরুষের চেয়েও বেশি পুরুষালি। সুতরাং নারী-নেতৃত্ব নিয়ে আমেরিকার অবস্থান এই নির্বাচনে বোঝার জো নেই। তবে ওবামার ইলেক্টিবিলিটি এই দেশকে নিয়ে অনেক কিছু বলে দেবে। অনেক দিন ধরেই লিখি লিখি করছি এটা নিয়ে। সময় নেই দেখে মন্তব্যেই ছাড়তে হচ্ছে। ভাল লাগলো পড়ে।

অতিথি লেখক এর ছবি

আমাকে যদি ব্যক্তিগতভাবে সাপোর্ট করতে বলা হয় (তর্কের খাতিরে) তাহলে আমিও হিলারির চাইতে ওবামাকে সাপোর্ট করবো। কারণ তাঁর কথা হিলারির তুলনায় পরিপক্ক ও গোছানো এবং মনে হয়, তার একটি আলাদা ভিউ আছে। কিন্তু যে পয়েন্টের সূত্র ধরে আমি কথাগুলো লিখেছি, সেগুলোর ব্যাপারে আপনার কোনো বিশ্লেষণ থাকলে জানতে আগ্রহী। আমাদের মিডিয়ায় দৈন্যতা চোখে পড়ে, এটি তার একটি উদাহরণ বলে আমি মনে করি। ধন্যবাদ ইশতিয়াক রউফ।

ধন্যবাদ, অরূপ।

গৌতম

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।