কবিতার চিত্রকল্প, কালিক চেতনার ধারা

ফকির ইলিয়াস এর ছবি
লিখেছেন ফকির ইলিয়াস (তারিখ: শুক্র, ২৮/১২/২০০৭ - ৯:২৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কবিতার চিত্রকল্প, কালিক চেতনার ধারা
ফকির ইলিয়াস
------------------------------------------------------------

বর্তমান কবিতাগুলো কি আসলেই খুব কঠিন হয়ে যাচ্ছে? নাকি ঝাপসা চিত্রকল্প এবং উপমার সমুদ্রে খেই হারিয়ে ফেলছেন পাঠক? ঝাপসা কিংবা কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরের সুর্যোদয় যারা অবলোকন করেন তারা কি শুধুই স্বপ্নবিলাসী? এমন অনেকগুলো প্রশ্ন আজকাল প্রায়ই শোনা যায়| আবার কেউ কেউ আধুনিক অনেক গদ্য কবিতায় তাদের ছন্দের ব্যারোমিটার বসিয়ে দুরবীন দিয়ে দেখার চেষ্টাও করেন| কখনো তারা সফল হন| কখনো তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়| আবার কেউ কেউ নিজেকে ছান্দসিক কবি ভেবে আত্মতৃপ্তি লাভে আটখানা হন| স্বপ্নবিলাস— তা যাই হোক না কেন, কবিতা যে এগিয়ে যাচ্ছে তাই হচ্ছে বর্তমানের প্রকৃত বাস্তবতা| কোন্ কবিতা কালোর প্রতীক হয়ে দাঁড়াবে তা অতীতে যেমন বলা যায়নি, বর্তমানেও বলা যাবে না| উদাহারণ স্বরূপ জীবনানন্দকে আবারো প্রণাম করি| শতাব্দীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত তার বিচরণ আমাদেরকে আশান্বিত করেছে বৈকি! তার আধুনিক চেতনা এবং নান্দনিক প্রত্যয় কালের বাহক হয়েই থেকে যাচ্ছে— যাবে বহুবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত| তা এ মুহুর্তে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে| কবিতা লেখাকে অনেক কবি মৌলতাত্বিক এবং সমসাময়িক আর্টিস্টিক বলে মনে করেন| তাদের এমন ধারণার পেছনে যুক্তিও আছে প্রচুর| কারণ অনুভবের অনুসৃতি এবং প্রার্থনার চেতনা তো হৃদয় থেকেই উৎসারিত হয়| একজন মানুষ চোখ খোলা রেখে অনেক কিছু দেখতে পায়| আবার চোখ বন্ধ করেও অনেক কিছু দেখতে পায়| একথা আমরা সবাই জানি এবং বুঝি| কিন্তু হৃদয়ের চোখের আয়নায় দাঁড়াতে পারি কজন? কবিতার কল্পচিত্র সব সময়ই বিশ্বজনীন এবং সার্বজনীন|

এ প্রসঙ্গে আমি কয়েকজন মার্কিন কবির সমসাময়িক কবিতার বাংলা তর্জমার কিছু খন্ডচিত্র তুলে ধরতে চাই| এরা যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃত কবি| যারা কবিতার ব্যঞ্জনা এবং ঘূর্ণায়নের মাধ্যমে শৈল্পিক আবহকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন| ‘সোনালি মানুষ’ কবিতায় কবি ডানা লোভন সোনালি মানুষটিকে এভাবেই নির্মাণ করেন— ‘এবং এসিড এসে ধৌত করে দেয় তাকে,/ হ্যাঁ, আমি ছোট্ট মানুষটিকে নির্মাণ করছিলাম|’ একটি কবিতা তখনই প্রকৃত সার্থকতা পায়, যখন একটি একান্ত ব্যক্তিগত অনুভুতি সার্বজনীনতা লাভ করে| একটি হৃদয়ের আকাঙ্খা হয়ে ওঠে বহূ হৃদয়ের প্রভাষণ| কবি ক্যাথরিন লিডিরার তার ‘বেঁচে থাকার একটি নতুন পথ’ কবিতাটির মুখবন্ধ শুরু করেছেন এভাবে— ‘আমি ক্লান্ত এভাবে ক্ষমা করতে করতে/ একটি রাত, একটি গাম্ভীর্যপূর্ণ ফোরাম যেমন/ একটি মধ্যতর্জনী’।
একটি কবিতায় বহুমাত্রিক অনুযোগ কিংবা অনুপ্রাস কবিতাটিকে সমৃদ্ধ করে নি:সন্দেহে| যেকথা অনেকে বলতে কিংবা লিখতে পারেন না,- তা কবি পারেন| সেক্ষেত্রে কবি তার উত্তর প্রজন্মের জন্য নির্মাণ করেন একটি বিশুদ্ধ নিবাস| কবি জন ইয়াউ-এর তেমনি কিছু কথা আমাদের কানে বাজে, বুকে লাগে| তার ‘রাশিয়ান চিঠি-৩’ কবিতার কয়েকটি পঙক্তি— ‘প্রিয় মেঘের চিত্রকর/ কি প্রমাণ থাকবে সেখানে/ যখন দোকানী/ আমাদের ধুলিচিহ্ন ঝেড়ে ফেলে দেবে ছোট্ট নালীতে’| একইভাবে কবি ডানা লোভন-এর আহ্বান জাগিয়ে তোলে তার সহযাত্রী অনুজদেরকে| ‘কাজ’ কবিতায় তার বাণীগূলো এরকম— ‘এই সেই আমেরিকা—/ তুমি পাত্রের মধ্যে পানি রাখো| এই সেই তোমার শতাব্দী—/ যে চুলোয় তুমি আগুন জ্বালো/ তুমি অনুভব করো, এই শহর, তোমার চারদিকের ধুসর, যেভাবে তুমি কালো চা রাখো কাপের মাঝে|’
যুক্তরাষ্ট্রের সমসাময়িক অন্যতম প্রধান কবি মি. জিরাল্ড স্টার্ন-এর স্বগতোক্তি থেকে কালিক কবিতা নির্মাণে চিত্রকল্পের ব্যবহার সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যেতে পারে| স্টার্ন বলেন, আমার কবিতায় আমি আমার সময়কেই ধরে রাখতে চেয়েছি| বর্তমানই ছিল আমার কাছে মূল বিবেচ্য বিষয়| জীবনের রঙ অনেকটাই তো ফ্যাকাশে| মহাসাগর পাড়ি দিয়ে যে জন এগিয়ে আসতে পারে সেই হয় ভাগ্যবান জীবনের অধিকারী| কবিতায় সমসাময়িক বিষয় এবং চেতনার ব্যাপৃতি— বর্ণনা থাকা স্বাভাবিক| শত বছর আগে
একজন কবি কম্পিউটার, ই-মেইল, ইন্টারনেট সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না| বর্তমানের কবিরা এই গ্লো­বাল ভিলেজে বসবাস করে এসব বিষয়গুলোকে রপ্ত করছেন মনে প্রাণে| তাদের চিন্তা চেতনায় এখন সিলিকন ভ্যালি| আলোর ঝলক| একবিংশ শতাব্দীর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে তাই তো,মাইকেল ও’ নীল বলে যান— ‘আমি ক্রমশ: শব্দগূলোকে বন্দী করছি একটি দুর্দান্ত বাক্সের ভেতর/ ফুলগুলো যেন ফুটছে আমার হাত দিয়ে সবুজ গোপনগুলো স্থির হয়ে দাঁড়াচ্ছে একটি কালো জমিনের বিপরীতে/ এভাবেই মধ্যরাতের আন্ত:জালে (ইন্টারনেটে) আমি খেলছি তোমার সাথে|’
আধুনিক চিত্রকল্পগুলো, আধুনিক মননের বুনন| এ বুনন তখনই আরো সমৃদ্ধ হয় যখন একটি কবিতার শিল্পায়ন ঘটে আন্তর্জাতিকতার নিরিখে| যারা পশ্চিমা সাহিত্যের বিবর্তনকে ধনবাদী আধুনিকায়ন বলে নাক সিটকান তাদের অবগতির জন্য বলতে হয়, যে প্রক্রিয়া পাশ্চাত্যে শুরু হয়েছে অর্ধশতাব্দী আগে, প্রাচ্যে এখন তার অনুকরণ চলছে| অতএব যদি চলমান সময়কে কবিতায় ধারণ করা না যায়, তবে হয়তো দু’ যুগ পরে আজকের কবি এবং কবিতা স্বকীয়তা নিয়ে আলোচনায় আসতে পারবেন না| বাংলা সাহিত্যের অনেক স্বনামধন্য কবি আছেন যারা বলেন, বর্তমানে কবিতার কিছুই হচ্ছে না| প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে— তারা কেন কিছু করছেন না| বা করার চেষ্টা করছেন না| একবিংশ শতাব্দীর শূরুতে দাঁড়িয়ে ক্ষণিক পিছন ফিরে তাকালে বেশ কিছু উত্থান চোখে পড়বে| বেশ কিছু আধুনিক কবি তাদের চিত্রকল্প নির্মাণের মাধ্যমে যে চিহ্নতত্ত্ব সংরক্ষণ করে যাচ্ছেন তা নিয়ে হয়তো বিশদভাবে আলোচনা হবে সময়ে— ভবিষ্যতে| কবিতার চিত্রকল্প সব সময়ই গতিশীল| আর কবিরা সেই গতির শক্তি নিয়েই কালের দিকে ধাবমান|

দুই.
মনে পড়ছে একদিন টিএসসি তে আড্ডা দিচ্ছিলাম আমি , কবি মোহন
রায়হান ও রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ । এ সময় আমার আরেক বন্ধু এগিয়ে আসেন । রুদ্র হাত বাড়িয়ে দেন। বলেন , ''আই এ্যাম রুদ্র মুহম্মদ
শহীদুল্লাহ , দ্যা পোয়েট ।'''
মোহন ভাই হেসে ফেলেন। রুদ্র তার হাসি মুখে বলেন, ইয়েস, আই
এ্যাম দ্যা পোয়েট । তা বলবো না ?
হাঁ, একজন প্রকৃত কবির আত্মপ্রত্যয় এভাবেই সুদৃঢ় । কারণ তিনি জানেন ,তিনি কি করছেন।
এ প্রসংগে ময়মনসিংহের এক প্রখ্যাত বাউল মরমী কবি উকিল মুন্সীর
কথা আমার সব সময় মনে পড়ে। তাঁর একটা নন্দিত গান আছে,
'' আমি আগে না জানিয়া সখীরে কইরে পিরীতি /
আমার দু:খে দু:খে জনম গেলো , সুখ হইলো না এক রতি।''
এই গানটি এখনো মুখে মুখে ফিরে । কেন ফিরে? কারন মানুষ এখনো
বাউল উকিল মুন্সীর আত্মায়, প্রতিকৃতিতে নিজেকে খুঁজে পায়।
একজন কবির সার্থকতা সেখানেই।
কবিতার ভাষার প্রকাশভংগী বদলায় কালে কালে। বদলায় কবির বলার
ধরন। কিন্তু চন্দ্র , সূর্য, গ্রহ , নক্ষত্র , সমুদ্র , পর্বত সহ প্রকৃতির সিংহ ভাগ
যেমন ছিল , তেমনি থেকে যায়। কবিতা বার বার আসে কালের আবর্তনে।
কবির নতুন ধ্যানে .. চিত্রনে ।
===========================================


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

খুব ভাল লাগল আপনার লেখাটি। অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে

মুজিব মেহদী এর ছবি

আই এ্যাম রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, দ্যা পোয়েট
এরকমটা রুদ্রই পারতেন।
...................................................................
অসংখ্য 'নেই'-এর ভিড় ঠেলে
জ্বলজ্যান্ত 'আছে' খুঁজে পাওয়া হলো আসল ফকিরি

... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
কচুরিপানার নিচে জেগে থাকে ক্রন্দনশীলা সব নদী

অতিথি লেখক এর ছবি

থ্যাংকস , মুজিব ভাই

অতিথি লেখক এর ছবি

থ্যাংকস , মুজিব ভাই ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।