কাব্যসংসারে কবির দায়, পাঠকের দায়িত্ব

ফকির ইলিয়াস এর ছবি
লিখেছেন ফকির ইলিয়াস (তারিখ: মঙ্গল, ০১/০১/২০০৮ - ৬:২৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কাব্যসংসারে কবির দায়, পাঠকের দায়িত্ব
ফকির ইলিয়াস
=======================================
একটি কাব্যসংসারের অংশীদার দু'জন। কবি ও পাঠক কিংবা পাঠিকা। কবি বাগান সাজান । পাঠক তা ভোগ করেন। এই যে
দান এবং গ্রহণের আনন্দ , তা -ই একটি কবিতাকে মহিমান্বিত করে তোলে বার বার। কালের পর কাল । প্রজন্মের পর প্রজন্ম।
ধরা যাক কবি জীবনানন্দ দাশের কথা।
জীবনানন্দ দাশ তাঁর জীবদ্দশায় ততোটা আলোচিত
হতে পারেন নি , যা পরে হয়েছেন।
তাঁর ''কবিতার কথা'' আমি যে কোনো নবিশ কবিতানুরাগীকে পড়তে বিনীত অনুরোধ করি।
আধুনিক কবিতা সমকালীনতার প্রান্জল বুনন। প্রকৃতি যেমন ছিল তেমনি আছে। একজন নতুন কবিকে নিজের চিত্রকল্প এঁকে যেতেই হয়।
দায় কিন্তু পাঠকেরও আছে । ছন্দ সমিল কবিতা খুঁজে অতীতে ফেরার চেষ্টা না করে পাঠককে ভাবতে হবে , একবিংশ শতাব্দীতে লেখা হচ্ছে '' দৃশ্য কবিতা''।
সিলিকন ভ্যালীর আলোয় বসে যে কবি, নির্মাণের নৃতত্ত্ব আঁকছেন , তার পংক্তিমালায় তিরিশের চিত্রকল্প , উপমা , অনুপ্রাস খুঁজে পাওয়া না ও যেতে পারে।
এ কথা খুবই সত্য, যদি সবাই কবি হতে পারতেন , তবে সব ভাষাসাহিত্যের সকল অধ্যাপকরাই হতেন বড় বড় কবি। তারা ই হতেন সব কবিতার নিয়ন্ত্রক। কিন্তু তা কোনো কালেই হয়নি।
আমার দেখে হাসি পায়, যারা শুদ্ধ করে বাংলা লিখতে পারেন না তারা ও কবিতা লিখেন । কাগজে পাঠান ।খাতির থাকলে ছাপাও হয়।
আমার কথা হচ্ছে যারা এই শুন্যদশকে ও প্রকৃত কবিতাগুলো লিখছেন, তারা তো বাংলা শব্দ ই ব্যবহার করছেন। তা হলে পাঠক-পাঠিকারা না বুঝার কৈফিয়ত তুলবেন কেন ? ব্যর্থতা টা কার ?
দুর্বোধ্য বলে কবিতায় কিছু আছে বলে আমি মনে করিনা।
যিনি পড়ছেন , তার পঠন-পাঠনের গভীরতা কতটুকু আছে ,তা ও বিবেচনায় রাখা জরুরী।
এক সময় জীবনানন্দ দুর্বোধ্য ছিলেন ! এখন বহুল নন্দিত ।
হয়তো অবহেলা ছিল ,তাঁর প্রতি । সমকালীন পাঠক তা খন্ডন করে এগিয়ে গেছেন আরেকধাপ।

দুই।
===
একটি কবিতাকে কে কিভাবে বিশ্লেষণ করেন , তা ও বিবেচ্য
বিষয়। কবি যে মনন নিয়ে লিখেছেন , পাঠক সে চোখ দিয়ে
না ও দেখতে পারেন। এই কবিতাটি পড়া যাক-----

'' নারীর ভিতরে ডুবে পুরুষটির মৃত্যু হয়েছিল।বালির উপর ছড়িয়ে আছে/ তার চশমা, বই ও ব্রিফকেস। সে নেই কিন্তু একটা পড়ে-থাকা শুন্য কাঁচের/ বোতলে তার আবছা প্রতিবিম্ব
আটকে আছে। সেই প্রতিবিম্ব এখনো হাসছে,/ হাত নাড়ছে,
কথা বলছে, মাঝে-মধ্যে রুমালে মুছে নিচ্ছে চুম্বনসিক্ত ঠোঁট।/

আর, অসংখ্য ডুবুরি সেই বোতলের ভিতরে ঢুকে খুঁজে চলেছে
তাঁর মৃতদেহ ''
( মদ/ রণজিৎ দাশ / শ্রেষ্ট কবিতা )

কবিতাটির চিত্রকল্প কি খুব কঠিন ? কারো কাছে তা লাগতেই পারে। তারপরও এটি একটি সার্থক কবিতা।
আসুন , আরেকটি কবিতা পড়ি -----

'' তোমরা চলে যাচ্ছ, ট্রাকে মালামাল উঠে গেছে সব, এক জীবনে মানুষের কতবার যে বাড়িবদল জরুরি হতে পারে মানুষও বুঝি তা জানে না

একদিন এভাবেই ট্রাকে মাল বোঝাই করে রেলিঙ ঘেরা এই বাড়ির একতলায় তোমরা নোঙর ফেলেছিলে-- অতিথি পাখি ও গৃহস্থ বিড়াল একদিন ভোরবেলা চার সদস্যের একটি নির্ঝঞ্ঝাট পরিবার দেখে আহ্লাদে উল্লাস করেছিল

তোমরা ত্যাগ করে যাচ্ছ একটি অভ্যস্ত পরিমণ্ডল, তার বিয়োগ ব্যথায় তুমি কাঁদলে তোমার মা কাঁদল, ট্রাকের সিটে গিয়ে বসলে সবাই, তুমি, তোমার মা, ছোট ভাই, কুমারী আত্মীয়া-- বাবাকে তো আগেই রেখে এসেছ অনিবার্য মাটির বিছানে

গাড়ি স্টার্ট নিতেই তাড়াতাড়ি হাত নাড়লে তোমরা সবাই, শেষবার তাকালে, বাড়িওয়ালা অনুভূতিহীন, তখনই টাঙিয়ে দিচ্ছেন ভাড়াটে ধরার 'টু লেট' বাহানা, ঘরে জল ঢেলে ধুয়েমুছে দেয়া হচ্ছে তোমাদের সুদীর্ঘ ছোঁয়া

সব মায়া কাটিয়ে বাধ্য হয়ে তোমরা শহরান্তরে যাচ্ছ, পেছনে কাজলা বিড়ালটি দৌড়াচ্ছে... দৌড়াচ্ছে... দৌ...ড়া...চ্ছে''
(বিড়ালটি/ মুজিব মেহদী)

কতো মর্মস্পর্শী এই কবিতাটির বুনন।

তিন।
====
বাংলা দেশে / কলকাতায় একটা কবিতার বই ছাপা হয় (সবার নয় অবশ্য) ৫০০/ ১০০০।
এমন কি পাশ্চাত্যে ও কাব্যগ্রন্থের কাটতি কম ।
কেন ?এ সময়ের আলোচিত মার্কিনী কবি ইউসেফ কমুনিয়াকা' র ''টকিং ডার্টি টু দ্যা গডস''
পড়ুন। দেখবেন কবিতার বিবর্তন কিভাবে ঘটিয়েছেন তিনি।
সময় কে ধারণ করতেই হবে।
আমি নিশ্চিত , ১০০ বছর পর আরো বদলাবে কবিতার বুনন।
তা কেউ আটকাতে পারবে না। পারা সম্ভব ও নয়।
না , কবিতা ব্রক্ষ্মবাদ নয়। সবাই স্পর্শ করুক , তা সব কবিই চান। কিন্তু স্পর্শ করার মনন ও তো থাকতে হবে।
কবি তো শিক্ষক নন , যে ক্লাশ করাবেন। তিনি লিখবেন তার ভাষায়। ভাষা শেখানোর দায়িত্ব তো কবি নিতে পারেন না।
অনেক ভালো , মেধাবী , সৃজনশীল কবি আছেন। এরা নতুন।
যারা খুবই ভালো লিখেন। কিন্তু সেগুলো ক'জন পড়েন ?
শুধু একটু বাহবা ই দায়িত্ব শেষ ? না , তা বোধ হয় নয় ।
শামসুর রাহমানের 'স্বাধীনতা তুমি' , ''তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা'' - এগুলো কেও প্রথম প্রথম অনেকে কবিতা বলে নি। বলেছে এগুলোতো গদ্য । এখন সে মানসিকতা অনেকের বদলেছে। আরো বদলাবে , সন্দেহ নেই।
পথে হাঁটতে হলে পথ চিনতে হবে। কবিতার আলোই টেনে নিয়ে যাবে পথচারীকে।

পাঠকের অবশ্যই অধিকার আছে ,তিনি কি পড়বেন - কি পড়বেন না।
মানুষের জীবন খুব ছোট। তাই পছন্দ করে পড়া অবশ্যই জরুরী।
যারা অবিন্যস্ত লেখেন , এরা অটোম্যটিকেলি বাদ পড়ে যাবেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তা নিয়ে ভাবার ও কোনো দরকার আছে বলে আমি মনে করি না।
কবিতা মানেই কয়েকটা শব্দের সংযুক্তিই নয়।
কবিতা চিত্রকল্প , উপমা,উৎপ্রক্ষা , অনুপ্রাস সহ বিনির্মাণের সমন্বয়।
না, কবি নিজে পড়ার জন্য লিখেন না। লিখেন সবার জন্য।তবে বুঝিয়ে দেবার দায়িত্ব তিনি নিতে পারেন না।
বেছে বেছে পড়লে পাঠকের মনন সময়ই সমৃদ্ধ করে।

আবারো বলি ,- যারা আধুনিক , উত্তরাধুনিক , মৌলাধুনিক কবিতার রসাস্বাদন করতে চান তারা কলকাতার শক্তি ,সুনীল, জয় থেকে আজকের বিকাশ সরকার , বিনায়ক বন্দোপাধ্যায় এবং বাংলাদেশের আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ
নির্মলেন্দু গুণ , হেলাল হাফিজ, মোহাম্মদ রফিক থেকে আজকের আবু হাসান শাহরিয়ার পর্যন্ত পড়ে দেখতে পারেন।
চলমান বাংলা সাহিত্যে অনেক ভালো কাজ হচ্ছে কবিতায়।
পড়তে হবে.. পড়তে হবে ...এবং পড়তে হবে।
পড়ার কোনো বিকল্প নাই । পঠন -পাঠনই বাড়িয়ে দিতে
পারে কাব্যসংসারের প্রঘাঢ় প্রেম ।
================নিউইয়র্ক , ০১ জানুয়ারী ২০০৮


মন্তব্য

নজমুল আলবাব এর ছবি

পড়ে মনে হয়, কবিতায় আমারো আছে অধীকার...

ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।